মানুষকে যদি প্রশ্ন করা হয়, পৃথিবীতে কোনটির প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি? কেউ উত্তর দিবে অর্থের মূল্য সবচেয়ে বেশি। আবার, কেউ বলবে ভালবাসার মূল্য বেশি। কিন্তু আসলে সবচেয়ে মূল্যবান কোন জিনিসটি?
এক্ষেত্রে, প্রশ্ন আসবে প্রয়োজনীয়তার কথা। মানুষের যেটা বেশি প্রয়োজন এবং এই প্রয়োজন মেটাতে যেটার দরকার, সেটাই সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। কিছু ক্ষেত্রে, মানুষের সব ধরণের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে পারে অর্থ সম্পদ।
অর্থ সম্পদ দিয়ে যেসব প্রয়োজন মেটানো হয়, এইসব প্রয়োজনের বাইরেও কিছু প্রয়োজন আছে যা আমাদের মন, শরীর, ঐন্দ্রজালিক চিন্তা-ভাবনা, আচার-আচরণ সর্বোপরি আমাদের সত্তাকে সমৃদ্ধ করে। এইসবের অভাব কেউ টাকা দিয়ে পূরণ করতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন পড়া। বই পড়া। বই মানুষকে সবদিক থেকেই প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে।
আমরা সবাই ছোট বেলা থেকেই একটি উক্তি শোনে এসেছি- বই মানুষের পরম বন্ধু।
টাকাই যদি সবচেয়ে প্রয়োজন হয়, তাহলে আমাদের উচিৎ সেই টাকা দিয়ে বই কেনা। কিংবা ভালবাসাই যদি বেশি প্রয়োজন হয়, তাহলে ভালবাসাটা হোক বইয়ের সাথে। একটা বই-ই হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস।
একজন মনীষীর উক্তি আছে এরকম- ঘরের কোনো জিনিসই বইয়ের মতো সুন্দর নয়।
তার এই উক্তি থেকেই বুঝা যায় বইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। বইয়ের সাথে অন্য কিছুর তুলনা চলে না। নিয়মিত বই পড়ার চমৎকার কিছু দিক আছে। আজকে আমরা সেসব চমৎকার ও গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করব।
১. বই পড়া জ্ঞান বৃদ্ধি করে
অন্যান্য পশু পাখি থেকে মানুষ আলাদা শুধু জ্ঞানের কারনেই। জ্ঞান আর মনুষ্যত্ব একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ৷ মানুষের যদি জ্ঞান না থাকতো তাহলে শিয়াল আর মানুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকতো না। জ্ঞান হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে শক্তিশালী জায়গা৷ জ্ঞান হচ্ছে মানুষের গর্ব।
মানুষ সমাজেও যাদের জ্ঞান নেই, তাদেরকে আমরা ভারসাম্যহীন মানুষ বলি। তাদেরকে আমরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেই। তারা সম্পূর্ণ একা। আমাদের সমাজেও পরোক্ষভাবে যার জ্ঞান সবচেয়ে বেশি, তাকে সবাই সম্মান করে ও মেনে চলে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জ্ঞানী মানুষ হওয়ার প্রথম শর্ত। এর বাইরেও যারা অনেকে বই পড়ে। যাদের অভ্যাস বেশি বেশি বই পড়া, তারা আরো বেশি জ্ঞানী হয়ে থাকেন।
বই পড়ার ফলে নতুন নতুন জিনিস জানা যায়। নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে অভিজ্ঞতা হয়। যে ব্যক্তি যত বেশি জানে, তার জ্ঞানের পরিধি তত ব্যাপক। বই পড়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের জ্ঞানের বৃদ্ধি ঘটাতে পারি। নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে জানতে পারি। মহাশূন্যে প্রতি নিয়ত কী ঘটে চলছে তা জানার জন্য বই পড়তে হবে। মাটি ও পানির নিচে কী আছে তা জানতে পারব বই পড়ার মাধ্যমে। তাই বলা যায়, বই মানুষের জ্ঞানকে প্রসারিত করে।
২. বই পড়া একাকিত্ব দূর করে
আমাদের ছোট্ট জীবনে আমরা অনেকবার নিজেদের অবস্থান বদলে ফেলি। এর ফলে পুরনো জায়গা, বন্ধু-বান্ধব, পরিবেশ ও রাস্তাঘাট বদলে ফেলতে হয়। নতুন একটা জায়গায় গিয়ে আমাদের খাপ খাওয়াতে কিছুটা সময় লাগে। কিংবা জীবনে অনেক সময় এরকম আসে যে সময়টায় নিজেকে অনেক একা লাগে। এই সময়টা একেবারেই একাকিত্বে ভুগতে হয়।
এই সময়গুলোতে বই হতে পারে যুগোপযোগী বন্ধু। বইয়ের চেয়ে ভাল বন্ধ আর কিছু হতে পারে না৷ একটা বই আপনাকে সব ধরণের অনুভূতি দিতে সক্ষম। একটা ভাল উপন্যাস আপনাকে দীর্ঘ সময়ের জন্য প্রাণবন্ত করে তুলতে পারে। যতক্ষণ আপনার সাথে কয়েকটি কিংবা একটি হলেও বই থাকবে, ততক্ষণ আপনি একাকিত্বে ভুগবেন না।
জীবনে অনেক ইমোশনাল সময় আসে, যে সময়টাকে কাউকে পাশে পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তারা হয়ত আপনার খারাপ সময়টাকে ভাল করে তুলতে পারে না। আপনি তখন বই নিয়ে বসে পড়ুন। দেখবেন আপনার মনোজগৎ একেবারে বদলে গেছে।
৩. বই পড়া আত্মবিশ্বাস যোগায়
আপনি যখন কোনো পরিস্থিতির কারনে বিপর্যস্ত, জীবনের কোনো এক পর্যায়ে এসে হাল ছেড়ে দিবেন ভাবছেন, কিংবা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ রকম চিন্তিত হয়ে পড়েছেন, তখন আপনার উচিৎ বই নিয়ে বসা। বড় বড় মনীষীদের বই পড়তে বসবেন, যারা জীবনে বড় হয়েছেন অসহনীয় কষ্টের মধ্যে দিয়ে। পৃথিবীতে যারা বিখ্যাত হয়েছেন, তারা সবাই অনেক পরিশ্রমের মধ্যে দিয়েই বিখ্যাত হয়েছেন।
একটা উল্লেখযোগ্য জীবনীগ্রন্থ আপনাকে বদলে দিতে সক্ষম। এমনও হতে পারে একটা বই আপনাকে এমনভাবে প্রেরণা দেবে, যার ফলে আপনি আপনার কাজটি পুরোদমে করে ফেলার মতো জীবনীশক্তি পেয়ে যাবেন। আপনি এতটাই অনুপ্রেরণা পেতে পারেন, যার ফলে আপনার মনে হতে পারে জীবনে পরাজয় বলে কিছু নেই। অফুরন্ত আত্মবিশ্বাস জন্মাবে মনের মধ্যে।
৪. বই পড়া মানসিক অবসাদ কমাতে সাহায্য করে
মানুষ মাত্রই কমবেশি সবাই মানসিক উত্তেজনা বা অবসাদে ভুগে থাকেন। এতে আমাদের স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবন যাপনে ব্যাঘাত ঘটে। অনেকের কাছে ব্যাপারটি এতটাই গুরুতর হয়ে ওঠে যে সে শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়।
এরকম ভয়াবহ মানসিক অবসাদ থেকে নিজেকে দূরে রাখার জন্য বই পড়া উত্তম একটি সমাধান। বই মানুষকে ঠিক এতটাই প্রশান্তি দিতে পারে যেভাবে পর্যাপ্ত ঘুম মানুষকে প্রশান্তি দেয়। প্রচন্ড মানসিক চাপে পড়লে করণীয় কাজগুলোর মধ্যে বই পড়াকে এক নাম্বারে রাখা উচিৎ বলে আমি মনে করি।
শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যেমন এক্সারসাইজ দরকার হয়, তেমনি মানব মস্তিকেরও একইভাবে এক্সারসাইজ বা ব্যায়ামের প্রয়োজন হয়। ব্রেণকে সতেজ ও আরো কর্মক্ষম হিসেবে তৈরি করতে অনেক ধরণের উপায়ের কথা বলে থাকেন স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা। তারা এমন সব এক্সারসাইজের কথা বলেন, যেসব এক্সারসাইজ সরাসরি ব্রেণের সাথে সংযুক্ত।
যেমন, দাবা খেলা। দাবা খেলার ৫টি মানসিক উপকারিতা রয়েছে যেগুলো ব্রেণের সঙ্গে সম্পর্কিত। ঠিক একই রকমের অন্যতম এক্সারসাইজ হচ্ছে বই পড়া যেটা ব্রেনের উপর ভাল প্রভাব ফেলে। বই পড়ার অভ্যাস আপনার ব্রেণকে সতেজ করে তোলার মাধ্যমে মানসিক অবসাদ দূর করে।
৫. বই পড়া নতুন নতুন দক্ষতা তৈরি করে
পড়ার অভ্যাস আপনাকে নতুন নতুন শব্দ জানতে সাহায্য করবে। এতে আপনার নতুন দক্ষতা তৈরি হবে কর্মক্ষেত্রে। নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস আপনার শব্দ উচ্চারণে ভিন্নতা এনে দিবে। কথা বলার ক্ষেত্রে আপনি সুস্পষ্ট করে কথা বলতে শিখবেন।
একজন মানুষ কোনো কথা বলতে যে সাধারণ শব্দ ব্যবহার করবে, আপনি তার থেকেও অপরিচিত একটি শব্দ ব্যবহার করে আপনার কথার গুরুত্ব বাড়িয়ে দিতে পারবেন। এর মাধ্যমে আপনার মতামতের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে। বই পড়ার কারণে কর্মক্ষেত্রে আপনার গ্রহনযোগ্যতা বাড়বে যেটা একজন বই না পড়ুয়ার ক্ষেত্রে হবে না।
বই পড়ার অভ্যাস আপনাকে নতুন নতুন ভাষা শিখার জন্য সহযোগীতা করবে। বই পড়ার অভ্যাস যাদের আছে, তারা মূলত অন্য ভাষা শেখার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। নতুন ভাষা শেখার ফলে নতুন একটি সাংস্কৃতি সম্পর্কেও জানার সুযোগ হয়। এর ফলে আপনি একটি নতুন দেশ, জাতি ও তাদের সাংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা পাবেন। এই সুযোগ একজন মানুষের জন্য অনেক বড় পাওয়া।
৬. বই পড়া চিন্তাশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে
যারা নিয়মিত বই পড়ে, তাদের চিন্তাশক্তি আর যারা বই পড়ে না তাদের চিন্তাশক্তিতে অনেক পার্থক্য থাকে। একজন পড়ুয়া কোনো বিষয় যেভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে চিন্তা করতে পারবে, একজন বই না পড়ুয়া সেভাবে পারবে না। বই না পড়লেও চিন্তা করা যাবে, তবে অনেকটাই গোলমেলে হয়ে যাবে।
বই পড়ার অভ্যাস মানুষকে সৃজনশীল করে তোলে। নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা বেড়ে যায়। আলাদাভাবে চিন্তা করে পুরনো কিছুকে নতুনভাবে উপস্থাপন করা যায়।
বই পড়ার অভ্যাস চিন্তাশক্তিকে আরো তীক্ষ্ম করে তোলে। কারণ, যখন কেউ বই পড়ে, তখন সে শুধু পড়েই না বরং সাথে সাথে কল্পণাও করতে থাকে। যখন সে পড়ে ‘ নদীর তীরে বাধা একটি নৌকা ‘ তখন সে সাথে সাথে মনে মনে কল্পনাতে দেখেও ফেলে। সে ওই স্থানকে অনুভব করতে পারে।
এভাবে সে ধীরে ধীরে তার নিজের চিন্তাশক্তিকে আরো ধারালো করে তোলে। এর ফলে সে যেটা ভাবে, সেটা সে সুন্দর করে নিজের মনে গুছিয়ে ফেলতে পারে। এতে কোনো একটা বিষয় কাউকে বলতে হলে সে সেটা সুন্দরভাবে ও বিশদ বর্ণনা করে বুঝাতে পারবে। এদের মধ্যে কাউকে বুঝানোর ক্ষমতাও থাকে অবিশ্বাস্য যা একজন বই না পড়ুয়ার মধ্যে থাকে না।
৭. অবাধ বিনোদনের মাধ্যম হচ্ছে বই
ইদানীং এই যুগে একটু মানসম্মত বিনোদনের জন্য টিকিট কেটে সিনেমা হলে যেতে হয়। কিংবা ক্যাবল সংযোগ দিয়ে টেলিভিশন দেখতে হয়। এর জন্য অনেক টাকা বের হয়ে যায়। আমাদের সমাজের একটা বড় অংশ টাকা খরচ করে বিনোদন নিবে এই ক্ষমতার বাইরে বাস করে। তাদের পক্ষে সংসার চালানোর পরে আর টাকা খরচ করে বিনোদন নেয়ার সুযোগ হয়ে ওঠে না।
কিন্তু বই আমাদেরকে বিনে পয়সায় কিংবা অনেক সময় স্বল্প পরিমাণ খরচ করলেই অনেক মানসম্মত সামাজিক বিনোদন দিতে পারে। আপনি যে টাকায় সিনেপ্লেক্সে গিয়ে মুভি দেখবেন, সেই টাকায় ভিন্ন ভিন্ন ধাচের কয়েকটা বই কিনে নিতে পারেন।
বই পড়লে আপনার যেসব উপকার হবে, একটা দামী টিকিট কাটা মুভি দেখে সেই রকম উপকার নাও হতে পারে। আবার হয়তো মুভিটি আপনার ভাল নাও লাগতে পারে। এর জন্য কিন্তু আপনি অন্য একটা চাইলেও সেখানে বসে আর দেখতে পারবেন না। কিন্তু আপনি চাইলে যে কোনো সময় যে কোনো বই পড়তে পারবেন। একই টাকায় আপনি একই রকম বিনোদন না নিয়ে হরেক রকমের বিনোদন নিতে পারবেন শুধুমাত্র বই পড়েই।
সিনেমা হলে গিয়ে যা পাবেন, তার থেকে বহু বেশি কিছু পাবেন পাড়ার লাইব্রেরিতে গিয়ে। অনেক পাড়ায় হয়ত লাইব্রেরি নেই, তার জন্যেও সমাধান আছে। শুধুমাত্র ইন্টারনেট কানেকশন থাকা ফোন থাকলেই আপনি ঘরে বসেই যেকোনো ধরণের বই পেতে পারেন। ইন্টারনেটে এখন অনেক সাইট আছে যারা বিনামূল্যে পিডিএফ আকারে বই সরবরাহ করে থাকে। এমনকি, এমন একটা সাইট আছে যেখান থেকে আপনি বিনামূল্যে যে কোনও বই ডাউনলোড করতে পারবেন।
Md Yousuf Mridha says
হৈচৈ বাংলা ওয়েবসাইটকে অনেক ধন্যবাদ বই পড়ার উপর সুন্দর একটি আর্টিকেল দেওয়ার জন্য। বন্ধুরা, আপনারা যদি অনলাইনে ইনকাম এবং টেকনোলজি সম্পর্কে জানতে চান, তাহলে এই ওয়েবসাইটে ভিজিট করতে পারেন।