দাবা খেলার উপকারিতা অপরিসীম। আপনি হয়তো এই ইনডোর গেমটি নিয়মিতই খেলে থাকেন কিংবা কখনোই খেলেন না। কিন্তু গেমটির গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপকারিতা জেনে রাখতে তো সমস্যা নেই।
দাবা খেলা হয়তো আপনাকে আপনার পেশি শক্তি বাড়াতে সাহায্য করবে না। কিংবা সিক্স প্যাক বানাতেও সাহায্য করবে না। কিন্তু ব্রেণকে অবশ্যই তরতাজা করে তুলবে। এটি দিনকে দিন আপনার ব্রেণকে করে তুলবে আরো দ্রুত এবং তীক্ষ্ণ। এছাড়াও, মেন্টাল হেলথ বা মানসিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য দাবা খেলার বিকল্প আর নেই।
দাবা খেলার সময় আপনার ব্রেন প্রতিটা সেকেন্ড ব্যস্ত থাকে। প্রতিটা মুভ করার সময় ব্রেণ তার সর্বোচ্চ আউটপুট দেয়ার জন্য কাজ করতে থাকে। অন্য আর কোনো খেলা মানুষের ব্রেণের সাথে এতটা সংস্পর্শে থাকে না। তাই, বুদ্ধি বাড়ানোর জন্যে ব্রেন গেম হিসেবে দাবার তুলনা নেই।
নিশ্চয়ই খুবই অদ্ভুত লাগছে শুনতে!
আরো জানতে চান এই স্ট্র্যাটেজি গেমটির উপকারিতা সম্পর্কে? আসুন, আগে দাবা সম্পর্কে কিছু বেসিক বিষয় জেনে নেয়া যাক।
দাবা কি?
দাবা একটি স্ট্র্যাটেজি বোর্ড গেম। এটি খেলতে বিশেষ কিছু স্ট্র্যাটেজি বা কৌশল অবলম্বণ করতে হয়। আর এটি খেলা হয় মূলত একটি বোর্ডের উপর যেখানে ৬৪টি ঘর থাকে। এই ঘরগুলো সাধারণত সাদা-কালো হয়ে থাকে। আর, একজন খেলোয়াড়ের পক্ষে এই ঘরগুলোতে রাজা, মন্ত্রীসহ মোট ১৬টি ঘুটি থাকে। অপর খেলোয়াড়েরও তাই।
দুই খেলোয়াড়ের মধ্যে একজনই জিতে থাকে। আর জেতার জন্যে অপর খেলোয়াড়ের রাজাকে রাজ্য ছাড়া করতে হয়। তবে, এই রাজ্য ছাড়া কিন্তু রাজ্য থেকে বের করে দেয়া নয়। বরং, এমন একটা চাল চালা যেখানে রাজা একদম কোনঠাসা হয়ে যায়। এমনকি, তার সরে দাঁড়ানোর মতো কিংবা পলায়ন করার মতো আর কোনও জায়গা না থাকে। এটাকে বলা হয় কিস্তিমাত।
দাবা খেলা কে আবিস্কার করেন?
দাবা খেলা ঠিক কে আবিস্কার করেছেন সেটা নিশ্চিতরূপে জানা যায়নি। তবে, এটির সূচনা যে ভারতবর্ষে এটা সবাই জানেন। ভারতের গুপ্ত সাম্রাজ্যে সর্ব প্রথম দাবা খেলতে দেখা যায়। সময়টা ছিল চতুর্থ শতাব্দী আর তখন এর নাম ছিল চতুরঙ্গ। তবে, পুরোপুরি দাবা না হলেও দাবার মতোই আরেকটি খেলার সন্ধ্যান পাওয়া গিয়েছে প্রাচীণ মিশরে যার নাম ছিল শতরঞ্জ। সেটা তৃতীয় শতাব্দীতে হলেও ভারতকেই দাবার জন্মস্থান হিসেবে ধরা হয়।
এক সময় ভারত থেকে চীন হয়ে ইউরোপসহ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে রাজা-বাদশাদের এই কৌশলী গেমটি। চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কের কারণে সবার প্রথম চীনেই পাড়ি দেয় দাবা। চীনারা এর নাম দেয় শিয়াংচি, আবার কেউ কেউ জিয়ানকিও বলে থাকেন। তবে, আজকে আমরা যে আধুনিক দাবা খেলি বা খেলতে দেখি, তা কিন্তু ইউরোপের পরিবর্তণ, পরিমার্জণ এবং আধুনিকায়ন।
যাইহোক, দাবা সম্পর্কে বিশেষ কিছু বিষয় জানা হলো। এবার আসুন, আমাদের মূল আলোচনা দাবা খেলার আশ্চর্যজনক কিছু উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
দাবার খেলার উপকারিতা
দাবা খেলার যে উপকারিতাগুলো সম্পর্কে আমি আলোচনা করতে যাচ্ছি, এগুলো সম্পর্কে হয়তো আপনারা আগে থেকেই জানেন। তবে, সবাই হয়তো জানেন না যে স্মার্টফোনে দাবা খেলার অনেক অ্যাপ বা গেম বেরিয়েছে। আর বর্তমানে অনেকেই ঘরে বসে এই অ্যান্ড্রয়েড দাবা গেমগুলো দিয়ে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সঙ্গে দাবা খেলছে, বন্ধুত্ব গড়ে তুলছে, অবসর সময়কে সুন্দরভাবে উপভোগ করছে।
ফ্যাকচুয়াল হোক আর ভার্চুয়াল হোক, আপনিও দাবার খেলার ৫টি দারুণ লাভ জেনে নিতে পারেন এবং আজ থেকেই খেলতে শুরু করতে পারেন।
দাবা সিজোফ্রেনিয়া রোগ থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করে
সিজোফ্রেনিয়া রোগ এক ধরণের মানসিক রোগ যা কোনো ব্যক্তির মনে ও দেহে দীর্ঘস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে ব্যাক্তির অনুভূতি, আচার-আচরণ ও চিন্তাভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায়। আমাদের আশেপাশে অনেক মানুষ আছে যারা এই রোগে আক্রান্ত।
ফ্রান্সের ব্রোনে অবস্থিত একটি নিউরোসাইন্স সেন্টারের গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু মানুষ যারা সিজোফ্রেনিয়া রোগে ভুগছিল তারা নিয়মিত দাবা খেলার কারনে সিজোফ্রেনিয়া রোগ থেকে ধীরে ধীরে সেরে উঠছিলেন। ২৬ জন সিজোফ্রেনিয়া রোগীর উপর এই অনুসন্ধান চালানো হয়েছিল।
২৬ জনের দলটির একাংশ দক্ষ দাবাড়ু খেলোয়াড়দের অধীনে একাধারে পাঁচ সপ্তাহ এবং সপ্তাহে দুই দিন করে খেলতো। আরেক দল যারা দাবা খেলতো না, যে দলটি নিয়মিত দাবা খেলতো তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তণ লক্ষ্য করা যায় মাত্র ৫ সাপ্তাহ পরেই।
সুতরাং, এটা বলা যায় যে সিজোফ্রেনিয়ার মতো ভয়ংকর ব্যাধি থেকে নিরাপদে থাকার জন্য দাবা খেলা বিশেষ একটি উপায় বলে ধরে নেয়াই যায়।
দাবা খেলা মানসিক হতাশা ও উদ্বেগ দূরে রাখে
আমাদের মধ্যে অনেকেই কোন কাজ শুরু করার আগে বা পরে কিংবা অনেক সময় কোনো কারন ছাড়াই মানসিক হতাশা ও উদ্বেগের মুখোমুখি হই। এটা বর্তমানে আমাদের জেনারেশনের উল্লেখযোগ্য একটি সমস্যা। কিন্তু, দাবা খেলার অভ্যাশ আমাদেরকে এই সমস্যাটি থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করে। নিয়মিত দাবা খেলা আমাদের যে কোনো পরিস্থিতিতে শান্ত এবং দৃঢ় থাকার মানসিকতা তৈরি করে দেয়।
যখন আপনি দাবা খেলতে থাকবেন, তখন আপনার চিন্তা থাকবে শুধু খেলার প্রতিই। কিভাবে আপনি জিততে পারেন কিংবা কিভাবে অনিবার্য হার এড়িয়ে নিজে জয়ী হতে পারেন, শুধুমাত্র এই চিন্তাতেই বুঁদ হয়ে থাকবেন।
মানব মস্তিষ্ক একই সাথে দুইটা কাজ করতে পারে না। এতে আপনার মস্তিষ্ক অন্য কোনো অহেতুক চিন্তা করার কোনো সুযোগই পাবে না। এতে আপনার মানসিক হতাশা কিংবা উদ্বেগ আপনার ধারে কাছেও ঘেষতে পারবে না। আর আপনি এভাবেই দাবা খেলার মাধ্যমে হতাশা ও উদ্বেগ থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। এক্ষেত্রে, দাবা খেলা হচ্ছে হতাশা ও উদ্বেগ নিরাময় ঔষধের মতো।
দাবা খেলা কাজের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে
দৈনন্দিন যে কোনো কাজই করা হয় না কেন, সেই কাজের প্রতি পুরোপুরি মনোযোগ না থাকলে কাজ সম্পূর্ণ করা যায় না। সম্পূর্ণ করা গেলেও কাজের যে সৌন্দর্য কিংবা পরিপূর্ণতা রয়েছে সেটা ফুটে ওঠে না।
কিন্তু আপনি যখন দাবা খেলতে বসবেন, তখন আপনাকে পুরো মনোযোগ দিয়ে খেলতে হবে। আপনাকে প্রতিটা মুহুর্ত প্লান নিয়ে এগুতে হবে, প্রতিপক্ষের চালগুলো খেয়াল রাখতে হবে, আবার সেই চাল অনুযায়ী আপনাকে নতুন চিন্তা করতে হবে। দাবার ৬৪টি ঘরেই আপনাকে চোখ রেখে খেলতে হবে। পুরো মনোযোগ রাখতে হবে খেলার প্রতি। পর্যবেক্ষণ করতে হবে প্রতিটা গুটি। দাবা খেলার উপকারিতা হিসেবে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এসব কাজগুলো হবে ব্রেনের মাধ্যমে। খেলার পুরোটা সময় আপনার ব্রেণ শুধু খেলা নিয়েই চিন্তা করবে। আপনার ব্রেণের ফোকাস থাকবে দাবার বোর্ডের দিকে। এভাবে প্রতিনিয়ত খেলার ফলে যে কোনো জিনিসের প্রতি ফোকাস রাখার বিষয়টা আপনার আয়ত্বে চলে আসবে।
আমাদের নিত্যদিনের অনেক কাজও এরকম মনোযোগ দিয়ে করতে হয়। আপনি যখন নিয়মিত দাবা খেলবেন, তখন কিন্তু এমনিতেই মনোযোগ ধরে রাখার অনুশীলন হয়ে যাবে। এতে একটা সময় মনোযোগ দিয়ে একনাগাড়ে কাজ করার অভ্যাস তৈরি হয়ে যাবে। যার ফলে আপনি যে কোনো কাজই অনেক সুক্ষ্মভাবে, দ্রুততার সাথে ও সুন্দরভাবে শেষ করতে সক্ষম হবেন। সুতরাং, মনোযোগ ধরে রাখা কিংবা বাড়ানোর জন্য দাবা খেলার বিকল্প নেই।
দাবা খেলা সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটায়
ভারতের একটি স্কুল এক গবেষণা চালিয়েছিল কিছু বাচ্চাদের উপর। বাচ্চাদের দলটিকে দুটো ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। এক ভাগ যারা দাবা খেলবে আরেক ভাগ যারা দাবা খেলবে না।
তাদেরকে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে বলা হয়েছিল, এসব জিনিস দিয়ে আমরা যা করি তার থেকে আলাদা কিছু করতে।
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, যারা দাবা খেলতো, তাদের রেজাল্ট অনেক উপরে। তাদের প্রত্যেকেই নতুন ধরণের কিছু করে দেখিয়েছিল। আর যারা দাবা খেলতো না, তাদের রেজাল্ট অনেক নিচে ছিল, তারা গতানুগতিক কাজই করেছিল। এতে বুঝা যায়, দাবা খেলা ব্যক্তির মনে প্রভাব ফেলে। এতে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়। নিয়মিত দাবা খেললে সৃজনশীল চিন্তা বেরহয়ে আসবে।
খেলাটি পুরোপুরি বুদ্ধি নির্ভর হওয়ায় মূলত মস্তিকে দারুণ একটি প্রভাব ফেলে। মস্তিক সব সময় সচল থাকার কারনে মস্তিকের কর্মক্ষমতা ও তীক্ষ্মতা বৃদ্ধি পায়। যার ফলে নতুন নতুন চিন্তা ভাবনা করতে সহজ হয়৷
দাবা খেলা আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে
সারা পৃথিবীতেই সমাদৃত একটি খেলা দাবা। দিনকে দিনকে খেলাটি সব বয়সের মানুষের কাছেই দারুণভাবে জনপ্রিয়। কেন জনপ্রিয় হবে না? যখন খেলাটি আপনাকে আত্মবিশ্বাস যোগাবে বা শক্তিশালী মানসিকতা তৈরি করতে সাহায্য করবে। আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়াবে যা আপনার দূর্বলতা দূর করবে।
যখন আপনি দাবা খেলে থাকেন, তখন আপনি শুধু আপনার খেলাটি নিয়েই ডুবে থাকবেন। কিভাবে আপনি জিতবেন শুধু এই চিন্তা করবেন বা হেরে গেলেও কেন হারলেন ঠিক কোন কারনে হারলেন, ভুলটি কোথায় হয়েছিল এসব ভাববেন।
এই যে বারবার জেতার বা হারার কারনগুলো যখন ভাবতে থাকবেন, এতে ধীরে ধীরে আপনার প্রতি আপনার নিজের আস্থা তৈরি হতে থাকবে। যে আস্থা আপনাকে যে কোনো পরিস্থিতিতে আত্মবিশ্বাসের যোগান দিবে। আত্মবিশ্বাসের কারণে মানুষ কোনো এক বিষয়ে দক্ষ না হয়েও কাজটি করে ফেলতে পারে।
যে কোনো কাজ করতে গেলে আত্মবিশ্বাস এবং শক্ত মানসিকতার দরকার হয় সবার আগে। শক্ত মানসিকতা এবং আত্মবিশ্বাস কঠিন মুহূর্তে এনার্জি দিয়ে থাকে। যার ফলে কঠিন পরিস্থিতিতেও আপনি সফলতার সাথে এগিয়ে যেতে পারবেন।
দাবা খেলার কারনে আপনার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে। আপনি কোনো প্রতিযোগিতায় অন্য দশজন প্রার্থীর থেকে আত্মবিশ্বাসের কারনে অনেকটাই এগিয়ে থাকবেন।
শেষ কথা
পৃথিবীতে দাবা খেলা জনপ্রিয় খেলাগুলোর একটি। বুদ্ধির খেলা হিসেবে সারা পৃথিবীতেই এই খেলা সমাদৃত। বিশ্বের বিখ্যাত ১০ মেধাবী ব্যক্তি সম্পর্কে যদি খোঁজ-খবর নেন, তবে দেখবেন যে তাদের প্রত্যেকেই দাবা খেলায় এক্সপার্ট ছিলেন।
পৃথিবীর সবচেয়ে পুরানো এবং জনপ্রিয় খেলাগুলোর একটিও কিন্তু এই দাবা খেলা। যারা দাবা প্রফেশনালি খেলে থাকে তাদেরকে ‘দাবাড়ু’ বলা হয়। তরুণ থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষের কাছেই সমানভাবে আকর্ষণীয় একটি খেলা হচ্ছে দাবা। ব্রেণের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য দাবা খেলা হচ্ছে সবচেয়ে ভাল মাধ্যম। দাবা খেলার উপকারিতা জানলেন, আশা করি অন্যদের জানাতে ভুলবেন না।
Leave a Reply