আগামী ৩০মে ইংল্যান্ড বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের মাধ্যমে পর্দা উঠতে যাচ্ছে ক্রিকেটের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসর ওডিআই বিশ্বকাপের। ইতোমধ্যে বিশ্বকাপে অংশ নিতে যাওয়া ১০টি দলই তাদের স্কোয়াড ঘোষণা করে ফেলেছে। ওডিআই বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১৯ এ বাংলাদেশ দল কেমন করতে পারে তার একটি পর্যালোচনা নিয়েই হৈচৈ বাংলার আজকের আয়োজন।
১৫ই এপ্রিল বিসিবি ঘোষণা করে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দল। এর সাথে ৫ই মে আয়ারল্যান্ডে শুরু হওয়া ত্রিদেশীয় সিরিজের স্কোয়াডও ঘোষণা করে বিসিবি। ১৫ সদস্যের এই স্কোয়াডে দলের প্রধানতম খেলোয়াড়েরা কেউই বাদ পড়েননি, ইঞ্জুরি ছাড়া অন্য কোনো কারণে এদের কারো বাদ পড়ার কথাও নয়। কিন্তু শুধু পঞ্চপাণ্ডব মানে মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মাহমুদুল্লাহ ও মুশফিকদের নিয়েই তো দল গঠন করা যায় না!
এই ৫ জন অটোচয়েস বাদে তরুণদের মধ্যে পছন্দের তালিকায় শীর্ষে আছেন মুস্তাফিজ। বিশ্বকাপ দলে তিনিও থাকবেন, কোনো সন্দেহ নেই। আর পেস বোলিং কন্ডিশনে রুবেল হোসেনের জুড়ি মেলা ভার। বিশ্বকাপ যেহেতু ইংল্যান্ডে হবে, যেখানকার কন্ডিশন পেস বোলিং এর সহায়ক, তাই সেখানে পূর্ণ ফিট রুবেল হোসেন যে থাকবেন না তা হয় না। তাই এখানে কথা বলব বাকি ৮ জনকে নিয়ে। তার আগে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ অভিযানের অভিযাত্রীদের দেখে নেয়া যাকঃ
ওডিআই বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১৯: বাংলাদেশ দল
ব্যাটসম্যানঃ
তামিম ইকবাল, সৌম্য সরকার, সাব্বির রহমান, মোহাম্মদ মিঠুন।
অল-রাউন্ডারঃ
সাকিব আল হাসান, মাহমুদুল্লাহ, মাশরাফি বিন মর্তুজা, মোহাম্মদ সাইফুদ্দীন, মোসাদ্দেক হোসাইন, মেহেদী হাসান মিরাজ।
বোলারঃ
মুস্তাফিজুর রহমান, রুবেল হোসেন, আবু জায়েদ রাহি।
উইকেট কিপারঃ
মুশফিকুর রহিম, লিটন দাস।
আয়ারল্যান্ড এর মাটিতে শুরু হতে যাওয়া ত্রিদেশীয় সিরিজের স্কোয়াডে এই ১৫ জনের পাশাপাশি আছেন দুই উদীয়মান তারকা ইয়াসির আলী ও নাঈম হাসান। আয়ারল্যান্ড সিরিজে দারুণ কিছু করতে পারলে এদের কোনো একজন জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে যেতে পারেন। উল্লেখ্য, ত্রিদেশীয় সিরিজটিতে তৃতীয় দল হচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
এবার এই দলটির একটু পর্যালোচনা করা যাক। আগেই বলেছি এবং সবাই জানি, ইংল্যান্ডের কন্ডিশন পেস বোলিং এর সহায়ক। তাই স্কোয়াডেও দেখা যাচ্ছে ৫ জন পেসার। মাশরাফি বিন মর্তুজাকে মূলত অল-রাউন্ডার হিসেবেই ধরা হয়, যদিও তিনি পেসার।
আর সাইফুদ্দীন তো প্রতিষ্ঠিত পেস বোলিং অল-রাউন্ডার। তবে বিশ্বকাপের স্কোয়াড বিতর্কমুক্ত রাখা বোধহয় ছোট এক ফুঁয়ে “শিখা অনির্বাণ” নেভানোর মতই কঠিন কাজ। অর্থাৎ এবারের বিশ্বকাপের দলটিও বিতর্কমুক্ত নয়। এই পর্যন্ত যত দল বিশ্বকাপের স্কোয়াড ঘোষণা করেছে, সবগুলো স্কোয়াড নিয়েই ছোটবড় বিতর্ক আছে।
আসলে বিতর্ক থাকাটাই স্বাভাবিক। প্রিয় দলকে নিয়ে ভক্তদের উদ্বিগ্নতা না থাকলে থাকবে কাদের! একে নিলে ভালো হত, ওকে নেয়াটা ঠিক হয়নি, এমন ছোটবড় অভিযোগ থাকবেই। বাংলাদেশের দলটাও এর ব্যতিক্রম নয়। বিশ্বকাপ দলের বাকি যেই ৮ জনের কথা আগে বলেছিলাম, তাদের সম্পর্কে, তাদের সাম্প্রতিক পার্ফরমেন্স সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
সৌম্য সরকার
বাংলাদেশ দলের ভবিষ্যৎ তারকা ভাবা হয় যে কজনকে, তাদের মধ্যে অন্যতম সৌম্য সরকার। ওপেনিংয়ে তামিমের আদর্শ সঙ্গী হিসেবে বাঁহাতি সৌম্যকেই বেছে নিয়েছে বিসিবি। বাংলাদেশ দলের বদলে যাওয়ার সিরিজ অর্থাৎ ২০১৪ সালের সেই জিম্বাবুয়ে সিরিজ থেকে ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। তার প্রতিভা সম্পর্কে সবাই কমবেশ জানেন। ওডিআই তে তার স্ট্রাইকরেট ৯৮.৬১। বুঝাই যাচ্ছে, তিনি একজন মারকুটে ব্যাটসম্যান।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে অসাধারণ ব্যাটিং করতেন সৌম্য। তার এভারেজও তখন ছিল ৫০ এর কাছাকাছি। একরকম তারকাই বনে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এরপর মুদ্রার উল্টো পিঠও দেখতে হয়েছে তাকে। টানা বাজে ফর্মে কাটিয়েছিলেন অনেকদিন। বাদও পড়েছিলেন দল থেকে।
এরপর ঘরোয়া লীগে ও বিভিন্ন প্রস্তুতি ম্যাচে ভালো খেলে দলে জায়গা ফিরে পেয়েছেন আবার। জায়গা পেয়েই গত বছরের অক্টোবরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে করেছিলেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। এরপর বাংলাদেশের ওয়েস্ট ইন্ডীজের বিপক্ষে ঘরের মাঠের সিরিজে তার স্কোর যথাক্রমে ১৯,৬ ও ৮০। আর নিউজিল্যান্ডের মাটিতে কঠিন পরীক্ষায় তার ফলাফল ৩০, ২২ আর ০।
তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পার্ফরমেন্স করেছিলেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে। ১ম টেস্টে খেলেছিলেন ১৪৯ রানের দুর্দান্ত ইনিংস, জুটি গড়েছিলেন মাহমুদুল্লাহর সাথে। মাহমুদুল্লাহও করেছিলেন ১৪৭ রান। এইসব পার্ফরমেন্সের উপর ভিত্তি করেই যে তাকে দলে নেয়া হয়েছে, সেটা আন্দাজ করতে সমস্যা হয় না।
এবারের ডিপিএল এ প্রথম দিকে তাঁর ব্যাট কথা না বললেও শেষ দিকে দারুণ ঝড় তুলেছেন। ফাইনালে করেছেন ডাবল সেঞ্চুরি। চলমান ত্রিদেশীয় সিরিজেও দারুণ করছেন সৌম্য। তাছাড়াও আক্রমণাত্মক ব্যাটিং, পেস বল খেলার দক্ষতা এবং কার্যকর মিডিয়াম পেস বোলিং করতে পারা, এসবও কাজ করেছে তার ওডিআই বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১৯ খেলার জন্যে দলে সুযোগ পাওয়ার পিছনে।
সাব্বির রহমান
সৌম্যের মতোই সাব্বিরেরও ক্যারিয়ার শুরু ২০১৪ সালের ঐ জিম্বাবুয়ে সিরিজ থেকে। সৌম্যের সাথে ব্যাটিং পজিশনে বা ব্যাটিংয়ের হাতে মিল না থাকলেও মিল আছে দুজনেই আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান। ওডিআইতে তার স্ট্রাইকরেট ৯১.৬৭। একজন আশাজাগানিয়া ক্রিকেটার ছিলেন সাব্বির। মিডল-অর্ডারে ঝড় তুলে দলের রান করার গতি বাড়াতে পারার জন্যই সর্বপ্রথম সবার নজরে আসেন তিনি।
স্টাইলিশ ব্যাটিং এর পাশাপাশি ফিল্ডিংয়েও দুর্দান্ত সাব্বির। কিন্তু বাংলাদেশ দলের অন্যান্য সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের মতো তারও একটা সমস্যা, সেটা হচ্ছে ধারাবাহিকতার অভাব। শুধু তাই নয়, শৃঙ্খলাজনিত কারণে দল থেকে নিষিদ্ধ হয়েছেন, হয়েছেন বিতর্কিত।
দলের ব্যাটিংয়ের যেই পজিশন নিয়ে বিসিবির ঘুম নেই, সেই ওয়ান ডাউন পজিশনে সাব্বিরকে থিতু করার জন্য দীর্ঘদিন প্রচেষ্টা চালিয়েছেন টিম ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু সেই চেষ্টা পুরোপুরি ব্যার্থ হয়েছে। বরং মিডল অর্ডারেই নিজের স্বভাবজাত মার মার কাট কাট ব্যাটিং এর মাধ্যমেই সফলতা পাচ্ছেন সাব্বির।
বিশ্বকাপ দলে তার জায়গা পাকা হয়েছে নিউজিল্যান্ড সিরিজে ওডিআইতে দারুণ ফর্মের কারণে। ক্যারিয়ারের ১ম সেঞ্চুরি হাকিয়েছিলেন তিনি সেই সিরিজেই। অন্য ২টি ম্যাচেও মোটামুটি ভালোই করেছিলেন। আসলে বাংলাদেশের কাছে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে তাদের বিপক্ষে সিরিজ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এখন পর্যন্ত সেখানে একটা ম্যাচও জিতেনি টাইগাররা। আর নিউজিল্যান্ডের সাথে যেহেতু ইংল্যান্ডের কন্ডিশনে মিল আছে, তাই ঐ সিরিজে যারা ভালো করেছেন, তাদেরকেই বিশ্বকাপ দলে রেখেছেন নির্বাচকেরা।
তাছাড়াও সাব্বিরের লেগ স্পিনও তাকে দলে জায়গা করে নিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করেছে।
মোহাম্মদ মিঠুন
বাংলাদেশ দলের ব্যাটিংয়ে নতুন এক ভরসারর নাম মোহাম্মদ মিঠুন। জাতীয় দলে আসা যাওয়ার মধ্যে ছিলেন অনেকদিন ধরেই। তবে ঘরোয়া লীগে ভালো করে নজর নির্বাচকদের কেড়ে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছেন তরুণ এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান। আর সেই সুযোগেরও সদ্ব্যবহার করেছেন তিনি দারুণভাবে।
এশিয়া কাপে তার বীরত্বগাঁথা আমরা সবাই জানি। তবে দলের সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা যেটা অর্থাৎ নিউজিল্যান্ড সিরিজ সেখানে তিনিই ছিলেন দলের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে সফল। অন্য ব্যাটসম্যানরা যেখানে ছিলেন আসা-যাওয়ার মিছিলে, সেখানে এই মিঠুন একলাই দলের হাল ধরেছেন। মূলত তার কারণেই ওইসব ম্যাচগুলোতে দল কিছুটা সম্মানজনক স্কোর পেয়েছিল। আর সেই নির্বাচনী পরীক্ষায় ভালোভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার কারণেই তিনি পেয়েছেন বিশ্বকাপের টিকিট।
মোহাম্মদ সাইফুদ্দীন
বাংলাদেশ দলে দুইটা জিনিসের জন্য দীর্ঘদিন ধরে হাহাকার। জিনিস দুটো হচ্ছে ভালো একজন লেগস্পিনার ও পেস বোলিং অলরাউন্ডার। ভালো একজন লেগস্পিনার এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে অপর জিনিসটি অর্থাৎ পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন মোহাম্মদ সাইফুদ্দীন। আর ইংল্যান্ডের কন্ডিশনে একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার পাওয়া মানে সোনায় সোহাগা।
এই কারণেই সাইফুদ্দীনের দলে অন্তর্ভুক্তি। ডানহাতে তিনি যেমন লাইন লেন্থ ঠিক রেখে ভালো গতিতে বল করে যেতে পারেন, তেমনি বাঁহাতি ব্যাটিংটাও আশাজাগানিয়া। নির্বাচনী পরীক্ষা অর্থাৎ নিউজিল্যান্ড সিরিজে তার ব্যাটিং মুগ্ধ করেছে নির্বাচকদের। টেল পজিশনে অর্থাৎ ৭-৮ নম্বরের দিকে আদর্শ একজন ব্যাটসম্যান সাইফুদ্দীন। বিশ্বকাপে তার জায়গা পাওয়াটা তাই স্বাভাবিকই।
ডিপিএল (ঢাকা প্রিমিয়ার লীগ) এও তার ফর্ম ছিল খুব ভালো। চলমান ত্রিদেশীয় সিরিজেও দারুণ করছেন সাইফুদ্দীন। তাই ওডিআই বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১৯ এ স্থান পেয়েছেন তিনি।
মোসাদ্দেক হোসাইন
বাংলাদেশ দলের আরেক সম্ভাবনাময় তরুণ খেলোয়াড় এই মোসাদ্দেক হোসাইন। মিড-অর্ডারে একজন নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান মোসাদ্দেক। কার্যকর অফস্পিনও করতে পারেন তিনি। ঘরোয়া লীগে তার ফর্ম অসাধারণ। জাতীয় দলেও সুযোগ পেয়ে ভালোই করেছিলেন অন্যান্য তরুণ খেলোয়াড়দের মতোই।
কিন্তু মাঝে ইঞ্জুরিজনিত কারণে বেশ কয়েকবার বাদ পড়েছেন। ফিনিশার হিসেবে দলে একজনের দরকার। মোসাদ্দেক সেই ভূমিকা পালন করতে পারেন দক্ষতার সাথে। এবারের ডিপিএল এ ব্যাট হাতে দাউণ করছেন মোসাদ্দেক। ১৩ ইনিংসে ৫৩.৫৫ গড়ে এখন পর্যন্ত ৪৮২ রান করেছেন তিনি, বল হাতে পেয়েছেন পেয়েছেন ৭ উইকেট, ইকোনোমি রেট ৩.৯৭। তবে তার ফর্ম যে ভক্তদের খুব একটা স্বপ্ন দেখাচ্ছে, তা কিন্তু নয়।
ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের মাঠে ১০ ম্যাচ খেলে ৮ ইনিংসে ২৭.৮ গড়ে ১৩৯ রান তুলেছেন মোসাদ্দেক। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া মোসাদ্দেক সম্পর্কে বাংলাদেশ দলের প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু বলেন যে তাঁরা একজন অফ স্পিনিং অলরাউন্ডার চাচ্ছিলেন। তাছাড়া মাহমুদুল্লাহর কাঁধের চোট পুরোপুরি না সেরে উঠার কারণে মোসাদ্দেকের অফ স্পিন কাজে লাগানোর কথা জানান তিনি। উল্লেখ্য, ওডিআই তে মোসাদ্দেকের গড় ৩১।
মেহেদী হাসান মিরাজ
টেস্টে মিরাজের সৌরভ অনেক আগেই পেয়েছে সবাই। অভিষেক সিরিজেই ২ টেস্টে ৪ ইনিংসে ১৯ উইকেট নিয়ে ম্যান অব দা সিরিজ হয়েছিলেন তিনি। সাথে বাংলাদেশ পেয়েছিল টেস্টে প্রথমবারের মতো ইংরেজ বধের স্বাদ। টেস্টে তার প্রতিভা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। স্পিনিং উইকেটে তিনি প্রতিপক্ষকে একেবারে ধরাশায়ী করতে পারেন।
১৯ টেস্টে ৩৪ ইনিংস খেলা মিরাজ ক্যারিয়ারে এরই মধ্যে পেয়ে গেছেন ৮৬ উইকেট। টেস্টে বাংলাদেশের সেরা ইনিংস ফিগার (১২/১১৭) এই মিরাজের দখলে। টেস্টে দারুণ ফর্মের কারণে ওডিআই দলেও ডাক পেয়ে যান। তবে ওডিআই তে প্রথম প্রথম নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি মিরাজ। কিন্তু ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছেন এই তরুণ তুর্কি।
দলের ভারসাম্য বজায় রাখতে তাই মিরাজকে গুরুত্ব দিয়েছেন নির্বাচকেরা। এক সময়ে বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক ছিলেন মিরাজ, যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে সেরা সাফল্য (তৃতীয়) পেয়েছিল। তিনি মূলত একজন অলরাউন্ডার, তবে আমরা এখন পর্যন্ত তার বোলিং প্রতিভাটাই বেশি দেখেছি।
অবশ্য সম্প্রতি টেল পজিশনে ভালোই ব্যাট চালাচ্ছেন মিরাজ। বিশ্বকাপ দলে তার জায়গা পাকাপোক্ত হবার কারণ মূলত নিউজিল্যান্ড সিরিজের নির্বাচনী পরীক্ষায় সফলতার সাথে পাশ করা। ৩ টি ওডিআই তে ৮ নম্বরে (শেষের ওডিআই তে ৯ নম্বরে) নেমে তার স্কোর যথাক্রমে ২৬, ১৬ ও ৩৭। টেলেন্ডারদের কাছ থেকে এরকমই তো আশা করে টিম ম্যানেজমেন্ট। ৩ ওডিআই তে সাকিববিহীন বাংলাদেশের স্পিন আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছেন এই মিরাজ, নিয়েছেন ২ উইকেট।
আসলে ঐ সিরিজে বাংলাদেশের সব বোলারই ব্যর্থ হয়েছেন। তাই মিরাজের ২ উইকেটকে ছোট করে দেখার কিছু নেই। ইংল্যান্ডের সাথে মিল থাকা আয়ারল্যান্ডের কন্ডিশনে চলমান ত্রিদেশীয় সিরিজে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখছেন মিরাজ।
আবু জায়েদ রাহি
বাংলাদেশের টেস্ট দলে এখন প্রায় নিয়মিতই দেখা যাচ্ছে সিলেটে জন্ম নেয়া মিডিয়াম পেসার আবু জায়েদ রাহিকে। বিপিএল এ তার ঝলক অবশ্য আগেই দেখা গেছে। এবারের বিপিএল এ ১৩ ম্যাচ এ ১৮ উইকেট শিকার করে তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীদের তালিকায় ৭ নম্বরে। আর চলমান ডিপিএল এ ৯ ম্যাচে তার শিকার ১২ উইকেট, ইকোনোমি ৫.৫৯।
বিপিএলে রাহির ইকোনোমি রেট ছিল ৮.৪৬। অবশ্যই এটা আহামরি কিছু নয়। কিন্তু রাহির আছে বল সুইং করানোর ক্ষমতা। আর সাথে আছে মাস খানেক আগেই নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা। এখনো ওডিআই অভিষেক ঘটেনি তার। তবে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলেছেন তিনি। সেখানেও ফর্ম এত চমকপ্রদ নয়।
তবে তাকে দলে নেয়ার পিছনে কাজ করেছে মূলত পূর্বোল্লিখিত বল সুইং করার ক্ষমতা ও নিউজিল্যান্ডে টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা। তাসকিন মাত্র ইঞ্জুরি থেকে ফিরেছেন, তার ফর্ম ফিরে পেতে সময় লাগবে, সেজন্যই তাকে দলে নেয়া হয়নি। আর শফিউল এবারের ডিপিএল এ তেমন কিছুই করতে পারেন নি। তাসকিন, শফিউল, রাহি এই ৩ জন থেকে বিসিবি একজনকে টার্গেট করেছিল।
আর সবকিছু মোটামুটি পূরণ করতে পারায় রাহিই দলে টিকে গেলেন। এখন বিশ্বকাপ আর তার আগের ত্রিদেশীয় সিরিজে তিনি কি করতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়। ত্রিদেশীয় সিরিজে এক ম্যাচে সুযোগ পেয়ে তেমন ভাল করতে পারেন নি। তবে, ওডিআই বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১৯ এ তিনি ভাল করবেন বলে অনেকেই আশাবাদী।
লিটন দাস
তরুণ স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান লিটোন দাস ঘরোয়া লীগে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ঘরোয়া লীগের অন্যতম সেরা তরুণ খেলোয়াড় লিটন জাতীয় দলে নিজেকে প্রমাণ করতে সময় নিয়েছেন অনেক। সৌম্য, সাব্বিরদের মতো দলে ঢুকেই সবাইকে তাক লাগাতে পারেননি তিনি। দলে তাই আসা যাওয়ার মধ্যেই ছিলেন। কিন্তু ঘরোয়া লীগে অসাধারণ ফর্ম তার উপর নির্বাচকরদের নজর রাখতে বাধ্য করে।
দলে সুযোগ পেয়ে মোটামুটি খেলতেন তিনি। মূলত মুশফিকের বদলে বদলি উইকেট কিপার হিসেবেই দলে তার বেশি জায়গা হয়। তবে লিটনের সাম্প্রতিক কিছু ইনিংসই তাকে বিশ্বকাপের টিকিট পেতে বেশি সহায়তা করেছে। বিশেষ করে এশিয়া কাপ ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে তার অনবদ্য ১২১ রানের সেই ইনিংসটি অনেকদিন মনে রাখবেন ক্রিকেটপ্রেমীরা।
তাছাড়াও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে তার দারুণ কয়েকটি ইনিংসও দলে তার জায়গা পেতে ভূমিকা রেখেছে। নিউজিল্যান্ড সিরিজে যদিও ব্যর্থ হয়েছেন, কিন্তু ওইসব ইনিংস আর বদলি উইকেট কিপারের সংকটের কারণেই দলে জায়গা করে নিতে পেরেছেন লিটন। নিজের খেলা দিয়ে লিটন নির্বাচকদের এটা বুঝাতে পেরেছেন যে, নিজের দিনে তিনি যেকোনো কিছুই করতে পারেন।
বিশ্বকাপ দলে ইমরুল কায়েস আর তাসকিন আহমেদকে না নেয়ার জন্য অনেক কথা উঠছে। তাসকিন গত বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী ছিলেন। পেস আক্রমণে দারুণ এক ভরসাই ছিলেন তিনি। কিন্তু তার বোলিং অ্যাকশন নিষিদ্ধ হবার পর নতুন অ্যাকশনে অতটা ভালো করতে পারেনি। এর মাঝে কয়েকবার ইঞ্জুরিতে পড়েছেন।
বিপিএল এ দারুণ পার্ফরমেন্সের পর জাতীয় দলে জায়গা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল তাসকিনের। কিন্তু আবারো পড়লেন ইঞ্জুরিতে। আর এটাই কাল হলো তার জন্য। ডিপিএলে তেমন কিছু করতে পারেন নি। ইঞ্জুরি থেকে ফেরার পর ফর্ম ফিরে পেতে তার একটু সময় লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই তাকে দলে নিয়ে ঝুঁকি নিতে চাননি নির্বাচকেরা।
তবে ত্রিদেশীয় সিরিজে দলে আছেন তিনি। আর ইমরুল কায়েস ভালো খেলোয়াড় বটে, কিন্তু পেস বোলিং এর সামনে তিনি ভালো কিছু করতে পারেন না। অনেকবারই তাকে সুযোগ দিয়ে এমন দেখা গেছে। বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। ডিপিএলে তেমন কিছু করতে পারেন নি। ১১ ইনিংসে মাত্র ২৩.৮১ গড়ে ২৬২ রান তুলতে পেরেছেন।
বাংলাদেশের সর্বশেষ হোম সিরিজ অর্থাৎ ওয়েস্ট ইন্দিজ সিরিজে ২ ম্যাচে সুযোগ পেয়ে তিনি করেছেন যথাক্রমে ৪ ও ০ রান। আসলে এইসব ব্যর্থতাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে কায়েসের জন্য। তাই তার দলে সুযোগ না পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
নির্বাচকেরা যতটা সম্ভব ভালো একটা দল দেয়ার চেষ্টা করেছেন। যারা সুযোগ পেয়েছেন, পার্ফরমেন্সের জোরেই সুযোগ পেয়েছেন। এশিয়া কাপে যেই দলটা ফাইনালে গিয়েছিল, এই দল অনেকটা সেটার মতোই হয়েছে। পেস বোলিং কন্ডিশনের জন্য রাখা হয়েছে অতিরিক্ত পেসার, রাখা হয়েছে পেস বোলিং অলরাউন্ডার। নিজেদের দিনে যেকোনো কিছু করারই সামর্থ্য রাখেন এইসব ক্রিকেটাররা।
কিন্তু বাংলাদেশ দলের তরুণদের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে ধারাবাহিকতার অভাব। এই সমস্যাটা না থাকলে বাংলাদেশ দলের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করাই যায়। তবে সমর্থকদের ভয় পাইয়ে দিচ্ছে সর্বশেষ নিউজিল্যান্ড সিরিজ। ওই সিরিজে প্রতিটি ম্যাচে একেবারে উড়ে গেছে বাংলাদেশ দল। আর নিউজিল্যান্ডের সাথে ইংল্যান্ডের কন্ডিশনে ভালোই মিল।
তবে নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশ এর আগে কখনোই ভালো করতে পারেনি, আর ইংল্যান্ডের মাটিতেই ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিল সেমিফাইনালে পৌঁছেছিল বাংলাদেশ। গত বিশ্বকাপেও অস্ট্রেলিয়ার মাটিতেই টাইগাররা কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছেছিল। অবশ্য এবারের বিশ্বকাপের নিয়মটা একটু অন্যরকম। ১০ দলের এই বিশ্বকাপে প্রতিটি দল একে অপরের মুখোমুখি হবে। শেষ পর্যন্ত শীর্ষ ৪টি দল সেমিফাইনালে পৌঁছবে। তাই এবারের বিশ্বকাপ কিছুটা চ্যালেঞ্জিংই হবে মাশরাফি বাহিনীর জন্য।
শেষ কথাঃ
বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দল নিয়ে অনেক কথা বলে ফেললাম এতক্ষণ। একটা জিনিস কিন্তু সবাই জানেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ৫ খেলোয়াড় একত্রে এই বিশ্বকাপের পর আর কোনো বিশ্বকাপ খেলবেন না। অন্তত ৩৫ বছর বয়স্ক চোটে জর্জরিত মাশরাফি যে চলে যাবেন অবসরে, সেটা বলাই বাহুল্য। তাই এবারের বিশ্বকাপে ভালো কিছুই চাইছেন ভক্তরা।
আগেই বলেছি, বিশ্বকাপের এবারের আসরটা কিছুটা হলেও চ্যালেঞ্জিং হবে বাংলাদেশ দলের জন্য। টাইগাররা কি পারবে সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে? সবকিছু সময়ই বলে দিবে। আপাতত আশার বাণীই শোনাচ্ছেন দলের সিনিয়ররা। ভালো কিছু করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টাই করবেন তারা। সাথে যদি তরুণরা ধারাবাহিকভাবে ভালো করতে পারেন, তবে আমরা ভালো কিছু আশা করতেই পারি এই দলটা থেকে। নির্বাচকেরা যতটা সম্ভব ভারসাম্যপূর্ণ দলই ঘোষণা করেছেন। মাঠের খেলাতেই বাকিটা দেখা যাবে। পরিশেষে শুভ কামনা রইল ওডিআই বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১৯ টাইগারদের প্রতি।
Leave a Reply