উদ্যোক্তা হবার কথা ভাবছেন, কিন্তু কিভাবে শুরু করবেন তা ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছেন না? একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য আমাদের সকলেরই কিছু বিষয় সম্পর্কে ধারণা থাকা উচিত। যেমন, আপনি আসলে কি ধরনের পণ্য নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী?
সবার আগে ভেবে বের করুন আপনার কোন কোন বিষয়ে দক্ষতা আছে। কারণ, আপনি যেই কাজ সম্পর্কে আগে থেকেই জানেন, সেই জিনিস নিয়ে আপনি যদি শুরু করেন, তাহলে আপনি একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার লক্ষ্যে এক ধাপ এগিয়ে রইলেন।
আমরা অনেক সময় কোন একটা কাজ শুরু করতে যেয়েই থেমে যাই। অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় চলে আসে। যেমন-
- কোন পণ্য নিয়ে কাজ করবো?
- কি পরিমান মূলধন দিয়ে শুরু করবো?
- যেই কাজটি শুরু করতে যাচ্ছি তাতে সফল হবো তো?
- আমার পণ্য বিক্রি করার জন্য ক্রেতা পাবো তো?
এ-রকম হাজারো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত অনেকেরই উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। অথচ ছোট ব্যবসা করে ধনী হওয়ার উপায় আছে। এমনকি, আপনার হাতের কাছে যা কিছু আছে তার মাঝে আপনার নিজস্ব সৃজনশীলতা যুক্ত করেই কিন্তু হয়ে যেতে পারেন একজন উদ্যোক্তা।
পণ্য তালিকায় প্রথম পছন্দ হিসেবে রাখতে পারেন দেশীয় পণ্য। বিদেশি পণ্যের ভিড়ে আমাদের দেশীয় অনেক পণ্যই একটা সময় হারাতে বসেছিল। কিন্তু এখন দিন দিন দেশীয় পণ্যের চাহিদা বেড়েই চলেছে।
আজকে এমন ৫টি দেশীয় পণ্য নিয়ে আলোচনা করব।
আপনার উদ্যোগ শুরু হোক দেশীয় গহনা দিয়ে
আদিলগ্ন থেকেই নারীদের সাজ-গোজের একটি বিশাল অংশ দখল করে রেখেছে গহনা। উপমহাদেশের শুরুর দিক থেকে নারীদের সাজ-সজ্জায় গহনা বা অলংকার খুব গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে আসছে। গহনা পছন্দ করে না এমন কোনও নারী খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাই, আপনার উদ্যোগটি শুরু করতে পারেন দেশীয় গহনা দিয়ে।
আপনার যদি বিভিন্ন ধরনের নকশা আঁকার অভিজ্ঞতা থেকে থাকে, তবে আপনি নিজের হাতে তৈরি গহনা দিয়েও আপনার ব্যবসাটি দাঁড় করাতে পারেন। আমাদের দেশীয় অনেক উপাদান ব্যবহার করে গহনা তৈরি হয়ে থাকে, যেমন-
- মাটি
- কাঠ
- পুঁতি
- সুতা
- কাপড়
- নানা ধরনের মেটাল, ইত্যাদি।
এখন আর নিজে হাতে গহনা তৈরি করা শিখার জন্য আপনাকে কোন প্রশিক্ষন কেন্দ্রে যেতে হবে না। ইউটিউব ঘেঁটে চমৎকার সব ডিজাইনের গহনা বানানোর টিউটোরিয়াল পেয়ে যাবেন। মেয়েদের জন্যে নানা রকম ব্যবসা আইডিয়া হিসেবে এটি আপনার জন্যে দারুণ হবে। মনে রাখবেন, আপনি আপনার পণ্যটিকে যত ইউনিক এবং আকর্ষণীয়ভাবে ক্রেতার কাছে তুলে ধরতে পারবেন, আপনার পণ্যের চাহিদা ততোটাই বেড়ে যাবে।
চেষ্টা করবেন আপনার পণ্যের মাঝে আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য রাখতে। এতে আপনার তৈরি জিনিস সহজেই ক্রেতাদের নজর কাড়বে। এর ফলে, আপনি একসময় সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের একটি পরিচিতি গঠন করতে পারবেন।
শাড়ি হতে পারে আপনার উদ্যোগের প্রথম পণ্য
শাড়ি পছন্দ করে না এমন বাঙালী নারী হয়তো খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। আমাদের দেশের আদি ঐতিহ্যর ভেতর শাড়ি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে আসছে। দেশের তাঁত শিল্পগুলো যুগ যুগ ধরে বাহারি রঙ এবং কারুকার্যের শাড়ি বুনন করে আসছে।
দেশের আনাচে কানাচে বেশির ভাগ অঞ্চলে তাঁতশিল্প রয়েছে। তাঁতিরা তাদের নিজস্ব ডিজাইনের শাড়ি তৈরি করে নারীদের পোশাকের যোগান দিয়ে থাকে। এই তাঁতিদের কাছ থেকে আপনি চাইলে নিজের পছন্দের ডিজাইন দিয়ে অথবা তাঁতিদের করা ডিজাইনের শাড়ি অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়ে নিয়ে আপনার নিজের একটি বুটিক শপ খুলে নিতে পারেন।
আজকাল অনেকেরই দোকানের পাশাপাশি অনলাইনেও বুটিকশপ আছে। অনেকে আবার শুধুমাত্র অনলাইনের উপর নির্ভরশীল।
ভাবছেন এত এত বুটিকশপ থাকতে আপনারটা কেনো চলবে?
বেশিরভাগ ক্রেতাই কিন্তু নিজের জন্য একদম ইউনিক ডিজাইনের পোশাকটিই কিনতে চায়। সেক্ষেত্রে, আপনাকে খুব যাচাই বাছাই করে পণ্য সংগ্রহ করতে হবে। আমাদের দেশীয় অনেক শাড়ি এখনো তাদের জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। যেমন-
- ঢাকাই জামদানি
- মসলিন
- বেনারসি
- কাতান
- রাজশাহি সিল্ক
- টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি
- সিলেটের মনিপুরী শাড়ি
- পাটের শাড়ি
এছাড়া, আরো অনেক ধরনের দেশি শাড়ির সাথে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। এছাড়া আপনি যদি সেলাই, ব্লক, বাটিক, টাই ডাই, হ্যান্ডপেইন্ট এসবের কাজ জেনে থাকেন তবে দোকান থেকে এক রঙের শাড়ি কিনে নিজেই ডিজাইন এবং কারুকাজ করে নিতে পারেন। প্রথম দিকে অল্প মূলধন দিয়েই শুরু করে দিতে পারেন। আপনার পণ্যের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে বিনিয়োগের পরিমান বাড়িয়ে দিবেন।
পাটের তৈরি দ্রব্য বিক্রির উদ্যোগ নিতে পারেন
পাটের সোনালি আঁশ যা বাংলাদেশের শত বর্ষের ঐতিহ্য। একটা সময় এই পাটই ছিল আমাদের দেশের এক নম্বর রপ্তানিকৃত দ্রব্য। কিন্তু, সময়ের পরিক্রমায় প্লাস্টিক এই পাটের জায়গা দখল করে নিয়েছে যা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর এবং প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর।
বর্তমানে পাটশিল্পে আবার নতুন করে সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে। দিনদিন পাটের তৈরি জিনিসের চাহিদা বেড়েই চলছে। পাটের তৈরি আসবাব এবং দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র এখন সবার ঘরে ঘরে শোভা পাচ্ছে। পাটের তৈরি জিনিস নিয়ে আপনিও শুরু করে দিতে পারেন আপনার উদ্যোগটি।
ঘর সাজানোর জিনিস থেকে শুরু করে গায়ের পোশাকও পাট দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে। পাট থেকে তৈরি চটের উপর নানা রঙের উলের সুতা ব্যবহার করে বাহারি নকশার শতরঞ্জি তৈরি করা হয় যার বর্তমানে প্রচুর চাহিদা ক্রেতাদের কাছে।
এছাড়া, পাট থেকে তৈরি গহনা, ব্যাগ, পুতুল, জুতা, শাড়ি, বাচ্চাদের খেলনা আর অনেক কিছু তৈরি করা যেতে পারে। পাটের তৈরি পণ্য নিয়ে কাজ করে যেমন আপনি হতে পারেন একজন উদ্যোক্তা, তেমনি আপনার সাথে সাথে অনেক পাট চাষিদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তাহলে আর দেরি না করে পাটের মতো পরিবেশবান্ধব জিনিস দিয়ে শুরু করুন আপনার সফল উদ্যোক্তা হওয়ার পথচলা।
উদ্যোক্তা হতে পারেন ঘরে তৈরি খাবারের
যারা ভাল রান্না করতে পারেন, তাদের জন্য দেশি খাদ্য নিয়ে কাজ করাটা সবচেয়ে উপযুক্ত হবে। আজকালকার এত ভেজালের ভীড়ে সবাই ঘরে তৈরি খাবার খোঁজে। সবাই চায় অস্বাস্থ্যকর খাবার বর্জণ করে ভেজালমুক্ত খাবার খেতে।
অফিস আদালতে আজকাল অনেকেই ঘরে তৈরি খাবার সাপ্লাই দিয়ে আসছে। শুধুমাত্র অফিস আদালতই না, অনেকে ঘরোয়া অনুষ্ঠানের জন্যও বাড়ির তৈরি খাবার অর্ডার করে থাকেন। বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষের কাছেই ঘরে তৈরি খাবারের চাহিদা প্রচুর।
রান্না করা খাবারের পাশাপাশি ফ্রোজেন খাবারও আপনার বিক্রির তালিকায় রাখতে পারেন। এছাড়া ঘরে তৈরি বিভিন্ন ধরনের গুড়া মশলা, পিঠা, মিস্টি, চকলেট, ড্রাইফ্রুট, এবং আরো অনেক ধরনের শুকনো খাবার। অনেকেই আজকাল বেবিফুডও ঘরে তৈরি কেনাটাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
একবার যদি আপনার গ্রাহকদের কাছে নিজের হাতের বানানো খাবারের চাহিদা তৈরি করে ফেলতে পারেন, তবে একজন সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে আপনাকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।
নকশিকাঁথা হতে পারে নজর-কাড়া উদ্যোগ
আমাদের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য হিসেবে যুগ যুগ ধরে নকশিকাঁথার প্রচলন চলে আসছে। গ্রামের বাড়িতে মেয়েরা সারাদিনের কাজকর্ম শেষ করে অবসর সময়টাতে সুই সুতা নিয়ে বসতো। কাঁথার উপর ফুল, লতা, পাখি, গ্রামের মেঠো পথ আরো বাহারি নকশা একে সুতার সেলাই করে সেটাকে নকশিকাঁথার রুপ দিতো।
সময়ের পরিক্রমায় অনেক ধরনের নিত্যনতুন জিনিসের আবির্ভাব হলেও নকশিকাঁথার চাহিদা কিন্তু আগের মতোই আছে। প্রায় প্রতিটা ঘরেই নকশিকাঁথা পরম যত্নে সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া নকশিকাঁথা কাজ করা বেড শিট, থ্রিপিস, ব্যাগ অনেক বেশি জনপ্রিয়।
আপনি চাইলে আপনার নিজের করা নকশা দিয়েও কারিগরদের দিয়ে এই সব ধরনের পণ্য বানিয়ে নিতে পারেন। অথবা আপনি যদি সেলাই ফোঁড়াইয়ে পারদর্শী হয়ে থাকেন, তবে নিজেও বানিয়ে নিয়ে শুরু করে দিতে পারেন আপনার ব্যবসা।
শেষ কথা
সর্বোপরি, আপনি যেই পণ্য নিয়েই কাজ করতে চান না কেনো, আপনাকে অবশ্যই সেই পণ্য সম্পর্কে সঠিক ধারনা রাখতে হবে। গতানুগতিক ধারার বাহিরে গিয়ে যতোটা সম্ভব নিজের কাজকে ভিন্নধর্মী রুপ দেওয়ার প্রচেস্টা করতে হবে।
আপনার কাজ দিয়ে গ্রাহককে আকৃষ্ট করতে পারাটা খুব জরুরি। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখবেন, যদি দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ নেওয়ার কথা চিন্তা করে থাকেন, তবে আপনার পণ্য অবশ্যই গুনগত মানসম্মত হতে হবে। আপনার পণ্য নিয়ে গ্রাহকের সন্তুষ্টিই আপনাকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলবে।
Leave a Reply