আপনি কি গ্যাস্ট্রিক, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্যর মতো সমস্যায় ভুগছেন? সাধারণত, এ-সব সমস্যা হজম শক্তি কম থাকার কারণে হয়ে থাকে। তাহলে আসুন, হজম শক্তি বাড়ানোর উপায় সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
বদহজমের লক্ষণগুলো মাঝে মাঝে দেখা দিলে আমাদের তেমন কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু যখন বদহজমের মাত্রা বেড়ে যায়, তখন এগুলি আমাদের জীবনে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। বর্তমানে প্রায় সবারই একটি নিয়মিত বা অনিয়মিত সমস্যা হচ্ছে বদহজম।
এই সমস্যার মূলে রয়েছে আমাদের অনিয়মিত বা অগোছালো জীবনধারণ এবং খাদ্যাভ্যাস। আমরা অনেকেই এমন সব খাবারের দিকে মনোযোগ দেই না, যেসব খাবার হজম শক্তি বাড়ায়। তাই বলে কি এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না? অবশ্যই যাবে। আমরা হজম শক্তি বাড়ানোর সহজ এবং কার্যকরী উপায়গুলো মেনে চললেই বদহজমের সমস্যাগুলো থেকে মুক্তি পেতে পারি।
হজম শক্তি বাড়ানোর উপায়
আমরা দেহে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য খাদ্য গ্রহণ করি কিন্তু সে খাদ্য হজম না হলে আমাদের দেহে সৃষ্টি হবে নানা রোগব্যাধি। তাছাড়া, খাদ্য হজমের জন্য আমাদের পাকস্থলীতে থাকতে হবে প্রয়োজনীয় হজম শক্তি। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য হজম শক্তি বাড়াতে নিচে দেওয়া উপায়গুলো অনুসরণ করুন।
১. সুষম খাবার গ্রহণ করুন
আমাদের পাঁচটি মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্যই প্রথম এবং প্রধান মৌলিক চাহিদা। আমরা বেঁচে থাকার জন্য খাবার খাই। কিন্তু তাই বলে আমরা যা ইচ্ছা তাই খেতে পারবো না। হজম শক্তি বৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্যের জন্যে আমাদেরকে সবসময় উপকারি খাবার খেতে হবে। সুস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ৮টি সুপারফুড সম্পর্কে জেনে নিন এবং নিয়মিত খাবার চেষ্টা করুন।
সুস্বাস্থ্য এবং হজম শক্তি বৃদ্ধির জন্যে আমাদের গ্রহণীয় খাবার হতে হবে ভেজালমুক্ত এবং সুষম খাবার। সুষম খাবার বলতে সে সকল খাবারকে বোঝায়, যাতে খাদ্যের ছয়টি মৌলিক উপাদান বিদ্যমান থাকে। সুষম খাবার পাকস্থলিতে হজম শক্তি বৃদ্ধি করে, দেহের অভ্যন্তরীণ জৈবিক প্রক্রিয়াকে সচল রাখতে সহায়তা করে।
২. প্রচুর পরিমাণে আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করুন
হজম শক্তি বাড়ানোর সহজ উপায় হচ্ছে আঁশযুক্ত খাবার প্রচুর পরিমাণে খাওয়া। কারণ, আঁশযুক্ত খাবার হজম শক্তি বৃদ্ধিতে ব্যাপক সহায়তা করে।
আঁশযুক্ত খাবারের মধ্যে রয়েছে শিম, বাদাম, শাকসবজি, গোটা শস্য এবং গমের ভুষি ইত্যাদি। বিশেষ করে, শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে আঁশ থাকে। আঁশযুক্ত খাবার দেহের পানি শোষণে সহায়তা করে যা আপনাকে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে রক্ষা করে।
তাই, হজম সংক্রান্ত সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি, ফলমূল খাওয়ার অভ্যাস করুন।
৩. খাদ্য তালিকায় স্বাস্থ্যকর ফ্যাট যুক্ত করুন
হজম শক্তি বাড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ফ্যাট খাওয়া প্রয়োজন। স্বাস্থ্যকর ফ্যাট পাকস্থলির খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে সহায়তা করে। এতে খাদ্য সহজে হজম হয়।
খাদ্য বিশেষজ্ঞদের মতে আলসারেটিভ, কোলাইটিসের মতো ফ্যাটি অ্যাসিড পেটের বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে এবং হজম শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
সাধারণত চিয়া বীজ, বাদামের পাশাপাশি সালমন, ম্যাকেরল এবং সার্ডাইন জাতীয় মাছ হচ্ছে ফ্যাটি অ্যাসিডের প্রধান উৎস।
তাই, হজম শক্তি বাড়ানোর জন্য আপনার খাদ্য তালিকায় ফ্যাটি এসিড যুক্ত খাবার রাখুন। এটি হজম শক্তি বাড়ানোর উপায় হিসেবে অত্যন্ত কার্য্যকরী।
তবে, অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, ফ্যাট আমাদের জন্য উপকারী হলেও অতিরিক্ত ফ্যাট গ্রহণ আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অতিরিক্ত ফ্যাট গহণে আমাদের দেহে মেদের সৃষ্টি করে। এ-জন্য ফ্যাট যুক্ত খাবার পরিমাণমতো খান।
৪. প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন
আমাদের দেহের প্রায় দুই তৃতীয়াংশই পানি দ্বারা গঠিত। দেহের অভ্যন্তরীণ জৈবিক প্রক্রিয়া সচল রাখতে পানির কোনো বিকল্প নেই। আমাদের সুস্থ্য থাকার জন্য প্রতিদিন ১.৫ থেকে ২ লিটার পানি পান করা উচিৎ।
তাছাড়া, দেহে পানি স্বল্পতার কারনে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়ে থাকে। খাবার হজমে সমস্যা হয়। পানির অভাবে আমাদের দেহের বিভিন্ন শরীরবৃত্তীয় কাজের বিঘ্ন ঘটে।
আপনার হজম শক্তি বাড়াতে প্রতিদিন পরিমিত পানি পান করার পাশাপাশি তরল খাবার গ্রহণ করুন। ফলমূল এবং শাকসবজি যেমন- শসা, টমেটো, বাঙ্গি, স্ট্রবেরি, আঙ্গুর এবং পীচ ছাড়াও বিভিন্ন ফলের জুস আপনার খাদ্য তালিকায় যুক্ত করুন। এগুলোও আপনার দেহের পানির ঘাটতি পূরণ করতে সাহায্য করবে।
৫. মাইন্ডফুল খাওয়া খান
মাইন্ডফুল খাওয়া বলতে বোঝায় খাবার খাওয়ার সময় পরিপূর্ণ মনোযোগ দিয়ে খাওয়া। গবেষণায় দেখা গেছে, খাওয়ার সময় অমনোযোগিতার ফলে পেট ফোলাভাব, গ্যাস এবং বদহজম হয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মনোযোগ সহকারে খাওয়ার ফলে বদহজমজনিত লক্ষণগুলো কমে যায় এবং হজম শক্তি বৃদ্ধি পায়।
মনোযোগের মাথে খেতে হলে ধীরে ধীরে খাবার খান। খাওয়ার সময় টিভি, ফোন বন্ধ করে আপনার খাবারের দিকে নজর দিন। আপনার খাবারটি দেখতে কেমন, খাবারের গন্ধ, খাবারের গঠন, তাপমাত্রা এবং স্বাদের প্রতি মনোযোগ দিন ।
খাবার ভালোভাবে চিবিয়ে খান। এতে খাবার হজমে কম শক্তি ব্যয় হয়। খাবার সহজে হজম হয়।
৬. নিয়মিত ব্যায়ম করুন
নিয়মিত অনুশীলন বা ব্যয়াম হজম শক্তি বাড়ানোর অন্যতম সেরা উপায়। খাওয়ার পরে কিছুক্ষণ হাঁটাচলা করলে আপনার শরীরের জৈবিক প্রক্রিয়া সচল হবে। ফলে খাবার সহজে হজম হবে।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, সাইকেল চালানো এবং জগিংয়ের মতো পরিমিত ব্যায়ামের ফলে অন্ত্রের ট্রানজিট সময় প্রায় ৩০% বেড়ে যায়। তাছাড়া, দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্যযুক্ত লোকদের জন্য ৩০ মিনিট করে ৩১ দিন হাঁটার একটি ব্যায়ামের নিয়ম প্রচলন করা আছে।
নিয়মিত ব্যায়াম করার ফলে পেটের বিভিন্ন রোগের লক্ষণ হ্রাস পায়।। ব্যায়াম আপনার হজম শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি করবে। তাই, সুস্থ জীবনযাপনের জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
৭. আপনার দেহের চাহিদা অনুযায়ী খাবার খান
আপনি যখন ক্ষুধা অনুভব করেন, তখন খাবার গ্রহণ করুন। আবার, আপনার পেট ভরে গেলে খাওয়া বন্ধ করুন। কেননা, অতিরিক্ত ক্ষুধা থাকলে এবং পেটে খাবারের পূর্ণতা বেশি থাকলে গ্যাস জমা, পেট ফুলে যাওয়া ও বদহজমের মতো সমস্যাগুলো বেশি দেখা দেয়।
সাারণত কম খাওয়া এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে হজম শক্তি কমে যায়। তাই, খাবার সহজে হজমের জন্য প্রয়োজন মতো খাবার খান।
৮. একটি নির্দিষ্ট সময়সূচী মেনে খাবার খান
আপনার হজম শক্তি বাড়ানোর জন্য প্রতিদিনের খাবার গ্রহণের একটি সময়সূচী তৈরি করুন। প্রতিদিন একই সময়ে ( সকালে, দুপুরে, রাতে তিন বেলা) খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। এক দিন এক সময়ে আবার আরেক দিন আরেক সময়ে খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করুন।
নিয়মিত সময়সূচী মেনে খাবার গ্রহণের ফলে আপনার স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা ঠিক থাকবে এবং আপনার হজম শক্তিও বৃদ্ধি পাবে।
৯. খারাপ খাদ্যাভ্যাস ত্যাগ করুন
প্রকৃতপক্ষে আমাদের হজম শক্তি কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে ধূমপান, অত্যধিক অ্যালকোহল পানের মতো খারাপ অভ্যাসগুলো।
ধূমপানের ফলে পেটের আলসার, আলসারেটিভ কোলাইটিস এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। আপনার যদি হজমে সমস্যা হয় এবং সিগারেট পান করেন, তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ অভ্যাস ত্যাগ করুন। ধূমপান ত্যাগ করার ১৩টি উপায় জেনে নিন এবং নিজের জন্যে সবচেয়ে কার্য্যকরী উপায়গুলো ব্যবহার করুন।
একই সাথে অ্যালকোহল বা মদ পানের অভ্যাশ থাকলে সেটিও ত্যাগ করুন। অ্যালকোহল আপনার পেটে অ্যাসিড উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে বদহজম ছাড়াও পেটে আলসার হতে পারে। তাই, সুস্থ্য থাকতে হলে অ্যালকোহল পানের অভ্যাস ত্যাগ করা উচিৎ।
১০. রাতের খাবার তাড়াতাড়ি গ্রহণ করুন
গভীর রাতে খাওয়ার ফলে বদহজম হতে পারে। খাবার হজমের জন্য নির্দিষ্ট সময় প্রয়োজন। কিন্তু, রাতে দেরিতে খেয়ে আমরা যখন ঘুমাতে যাই, তখন খাবার হজম হওয়ার জন্য সময় পায় না। কারণ, ঘুমানোর সময় সাধারণত আমাদের দেহের জৈবিক ক্রিয়াগুলো কম চলে।
তাই, রাতের খাবার ঘুমানোর দুই ঘন্টা আগে খেতে চেষ্টা করুন এবং খাওয়ার পরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করুন।
১১. পুদিনা চা পান করুন
পুদিনা চা বমি বমি ভাব এবং বদহজমের একটি ঘরোয়া প্রতিকার। পুদিনা চা পেট ব্যথা, বুকজ্বলা এবং বদহজমের সমস্যাগুলো থেকে মুক্তি দিতে পারে। আপনার হজম শক্তি বাড়াতে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমানে পুদিনা চা পান করুন।
১২. মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকুন
মানসিক চাপ আমাদের হজম শক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে। লক্ষ্য করলে দেখবেন যে, বড় কোনো ঘটনা বা পরীক্ষার আগে আমাদের পেটে অস্থিরতা কাজ করে। আমাদের শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যের উন্নতি আমাদের মনের উপর অনেকটাই নির্ভর করে।
কারণ, মানসিক চাপ থাকলে ঠিকমতো ঘুম হয় না। আবার, খাওয়াও কম হয় যা আমাদের স্বাস্থ্যের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলে। তাই, সুস্থ্যতা নিশ্চিত করতে নিজেকে যতটা সম্ভব মানসিক চাপ মুক্ত রাখার চেষ্টা করুন। প্রচন্ড মানসিক চাপে পড়লে করণীয় কাজগুলো করুন, এতে মন প্রশান্ত হবে এবং শরীর সুস্থ্য থাকবে।
সবশেষে বলা যায়, বদহজম থেকে মুক্তি পেতে উপরে দেওয়া হজম শক্তি বাড়ানোর উপায় অনুসরণ করুন। আপনার অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার মান পরিবর্রতন করুন। ফাইবার, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার পরিমাণমতো গ্রহণ করুন।
দৈনিক খাবারের রুটিন মেনে চলুন। এই নিয়মগুলো অনুসরণের মাধ্যমে আপনার হজম শক্তি বৃদ্ধি পাবে। আপনি পাবেন একটি সুন্দর ও সুস্থ্য জীবন।
selim says
এখানে সবকিছুর চেয়ে আমার জীবনযাপন ভিন্ন? কী করি বলেন তো।
Munsur Seikh says
হজম সমস্যায় ভোগা মানুষদের জন্যে খুব ভালো একটি লেখা। আমার ওয়েবসাইটেও এ বিষয়ে একটি লেখা আছে, দেখার অনুরোধ রইল।