সুস্বাস্থ্যের জন্য সুপারফুড এর প্রয়োজনীতা এখন আমরা অনেকেই জানি। কারণ, সুপারফুড স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী বলে একটি কথা আজকাল বহুল প্রচলিত। কিন্তু সুপারফুড বলতে আসলে ঠিক কি বোঝায় তা আমরা অনেকেই জানি না।
বিদেশি আর্টিকেলগুলোতে যে সুপারফুডের নাম পাওয়া যায় তার অনেকগুলোই বাংলাদেশী রসনায় খাপ খায় না, বা বাংলাদেশে সহজলভ্য নয়। কিংবা পাওয়া গেলেও দেখা যায় দাম অনেক বেশি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভাল সুপারফুড কোনগুলো, এবং কোন পরিস্থিতিতে কি কি সুপারফুড এড়িয়ে যাওয়া উচিৎ তা সংক্ষেপে আপনাদের সামনে তুলে ধরার লক্ষ্যেই এই লেখাটি। এছাড়া স্বাস্থ্যকর খাবার সম্পর্কে আরও জানতে চাইলে পড়তে পারেন কোন কোন খাবারে সবচেয়ে বেশি ভিটামিন এ আছে।
সুপারফুড কি?
এক কথায় সুপারফুড বলতে বোঝায় প্রচুর পরিমাণে পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ফুড যা শরীরের প্রধান প্রধান পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারে। উইকিপিডিয়ার মতে, সুপারফুড একটি মার্কেটিং টার্ম যা প্রচুর পরিমাণ পুষ্টির ফলে স্বাস্থ্যের জন্যে অনেক উপকারি। তবে, ফুড এক্সপার্ট, ডায়েটিশিয়ান এবং পুষ্টি বিজ্ঞানীরা সাধারণত এই শব্দটি ব্যবহার করেন না।
সুপারফুড হিসেবে তেলাপোকার দুধ কিংবা এ রকম আজগুবি না হলেও, বিভিন্ন কোম্পানী যা কিছু বাজারে ছাড়ছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট নন এইসব পুষ্টি বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, ন্যাচারাল খাবারেই রয়েছে সুপারফুড। তাই তাদের মতে, প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি রয়েছে এই রকম ৮টি সুপারফুড নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।
সুস্বাস্থ্যের জন্য সুপারফুড
১। সবুজ শাক সবজি
- কেন খাবেন
প্রচুর পরিমাণে আঁশ, ফলিক এসিড, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন সি সহ প্রয়োজনীয় প্রায় সব পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায় সবুজ শাক সবজিতে।
সুতরাং আপনার শরীর ও মনের সুস্থতার জন্যই সপ্তাহে অন্তত দুই থেকে তিন দিন প্রচুর পরিমাণে পালং শাক, পুঁই শাক, লাউ শাক সহ সব ধরনের সবুজ শাক সবজি খাওয়া উচিত। এতে আপনি হৃদরোগ থেকে শুরু করে এনিমিয়া পর্যন্ত সব রোগ এড়াতে পারবেন।
- কখন খাবেন নাঃ
সবুজ শাক সবজি খুবই নিরাপদ খাবার। কাজেই ডাক্তারের সরাসরি নিষেধ ছাড়া না খাবার কোন কারণ নেই। ডাক্তাররা কিডনি রোগীদের অবশ্য পালং শাক খেতে নিষেধ করেন।
২। গ্রিন টি
গ্রিন টি আগে এই দেশে সহজলভ্য ছিল না। কিন্তু এখন খুব সহজেই যে কোন দোকানে বা সুপার শপে গ্রিন টি পাওয়া যায়। দামও হাতের নাগালে মধ্যে।
- কেন খাবেন
প্রচুর পরিমাণে এন্টি অক্সিডেন্ট থাকায় গ্রিন টি ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় ও বার্ধক্য এড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও এটি কোলেস্টেরল কমায় এবং ডায়াবেটিস ও হার্ট এটাকের ঝুঁকি কমায়।
- কখন খাবেন না
গ্রিন টিতে থাকা ট্যানিন পেটে এসিডের নিঃসরণ বাড়ায়। তাই তীব্র এসিডিটির রোগীরা এটা খাবেন না। অন্যদেরও খালি পেটে না খাওয়াই উচিৎ। দিনে চার থেকে পাঁচ কাপের বেশি গ্রিন টি খাবেন না।
গ্রিন টি কেনার সময় চেষ্টা করবেন টি ব্যাগ না কিনে চা পাতা কিনতে। চিনি ছাড়া খাওয়ার অভ্যাস করুন। গ্রিন টি যত তাজা হবে এর কার্যকারিতা ততই বেশি।
৩। দই
- কেন খাবেন
প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন বি৬ ও বি১২, রিবোফ্লাভিন, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও প্রোটিন ছাড়াও এতে প্রচুর পরিমাণে ভাল ব্যাকটেরিয়া বা প্রোবায়োটিকস থাকে।
প্রোবায়োটিক্স রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। নিয়মিত দই খেলে হাড়ের ক্ষয় রোধ করা যায়, এবং হজমে সহায়তা করে। মাঠা খেলেও একই রকম উপকার পাবেন।
- কখন খাবেন না
মিষ্টির দোকানের লালচে বা রঙিন দই খাবেন না। দইয়ের রঙ হওয়া উচিত সাদা।
লো ফ্যাট ও চিনি ছাড়া দই বা মাঠা খাওয়ার চেষ্টা করুন। লাবাং বা বোরহানিতে সাধারণত বাড়তি চিনি দেয়া হয়, এগুলো তাই কম খান।
৪। আদা
- কেন খাবেন
আদায় প্রচুর পরিমাণে এন্টি অক্সিডেন্ট আছে। সুস্বাস্থ্যের জন্য সুপারফুড হিসেবে এটি অনন্য। বমি ভাব, পেট ব্যাথা বা বদহজমের লোকজ চিকিৎসায় আদার ব্যাবহার বহু পুরানো। মাথা ধরার সমস্যায় আমরা সবসময় আদা চা খেয়ে থাকি। কিন্তু যেটা অনেকেই জানি না তা হল বাতের ব্যাথা বা আরথ্রাইটিসেও আদার চা অনেক উপকারী।
- কখন খাবেন না
গর্ভবতী মহিলাদের অতিরিক্ত আদা খাওয়া উচিত নয়।
৫। রসুন
- কেন খাবেন
রসুন খেলে রক্তে কোলস্টেরলের পরিমাণ কমানো যায়। এ কারণেই চিরকাল চর্বিদার খাবারে প্রচুর রসুন যোগ করা হয়। এছাড়াও ব্লাড প্রেশার কমাতে এবং রোগ প্রতরোধ ক্ষমতা বাড়াতে রসুনের জুড়ি নেই।
রসুনে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও অন্যান্য পুষ্টিকর উপাদান যেমন ম্যাঙ্গানিজ ও সেলেনিয়াম আছে। ক্যান্সার প্রতিরোধেও রসুন কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
- কখন খাবেন না
অতিরিক্ত পরিমাণে রসুন খেলে মাথাঘোরা ও বমি দেখা দিতে পারে। রান্না করলে রসুনের কার্যকারিতা কিছুটা কমে যায়। কাঁচা রসুন দিনে এক কোয়ার বেশি খাবেন না।
৬। বাদাম ও বিভিন্ন ধরনের বীজ
বাদামের মধ্যে চিনাবাদাম, কাঠবাদাম, পেস্তাবাদাম, কাজুবাদাম, আখরোট ইত্যাদি বাংলাদেশে সহজেই পাওয়া যায়। ভায়াগ্রার বিকল্প ১০টি খাবারের তালিকায় বাদামও আছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। হ্যাজেলনাট, ম্যাকাডেমিয়া, পিকান ইত্যাদি বাংলাদেশে পাওয়া কঠিন। খাওয়া যায় এমন বীজের মধ্যে রয়েছে তিল, তিসি, পোস্ত ও মিষ্টিকুমড়ার বীজ। সূর্যমুখী ও চিয়া নামের এক প্রজাতির বীজ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও তা এই দেশে সহজে পাওয়া যায় না।
- কেন খাবেন
বাদামের উপকারিতার কথা বলে শেষ করা যায় না। এতে আছে শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী ওমেগা ৩ ও ওমেগা ৬ ফ্যাটি এসিড, মনোআন্স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ফাইবার, প্রোটিন ও পুষ্টিকর খনিজ পদার্থ যেমন পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, জিঙ্ক, থায়ামিন ইত্যাদি।
বাদাম ও বীজে যে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে তা ভিটামিন এ, ই ও ডি হজম করতে সাহায্য করে আমাদের হৃৎপিণ্ডকে শক্তিশালী করে। এছাড়াও বাদাম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, শরীরের পেশি ও হাড় গঠনে সাহায্য করে এবং বার্ধক্যের গতি কমিয়ে আনে।
- কখন খাবেন না
প্রচুর পরিমাণে ফ্যাট থাকার কারণে একসাথে অতিরিক্ত পরিমাণে বাদাম বা বীজ খাওয়া উচিত নয়। যদিও বাদামের ফ্যাট আনস্যাচুরেটেড হওয়ার কারণে স্বাস্থ্যের জন্য ভাল, তবুও সব কিছু নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।
তাছাড়া বাদাম হজমে কারও কারও সমস্যা হয়। তারা বাদাম ভিজিয়ে রেখে খেতে পারেন।
৭। হলুদ
- কেন খাবেন
আমাদের দেশে প্রায় সব তরকারিতেই হলুদ ব্যবহার করা হয় বলে আমরা হলুদের গুণাগুণ আর উপকারিতার কথা আর আলাদা করে ভাবি না। কিন্তু পাশ্চাত্যে ইদানীং হলুদ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
হলুদের প্রধান উপাদান হল কারকিউমিন (curcumin)। এটি একটি শক্তিশালী এন্টি অক্সিডেন্ট ও এন্টি ইনফ্ল্যামেটরি এজেন্ট। ক্যান্সার, হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতেও কারকিউমিন কার্যকরী ভূমিকা রাখে। এছাড়া জখম সারানো ও ব্যথা কমানোতেও এর জুড়ি নেই।
কারকিউমিনের একটি সমস্যা হল এটি মানুষের শরীর সহজে গ্রহণ করতে চায় না। তেল মশলা দিয়ে রান্না করলে এটি হজম করতে সুবিধা হয়। এ কারণেই বাঙালি ধাঁচের রান্নায় হলুদের ব্যবহার খুবই কার্যকর।
- কখন খাবেন না
হলুদ রান্নায় যে পরিমাণে ব্যবহার হয় তা কোন ক্ষতি করে না। অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে (১৫০০ মিলিগ্রামে র বেশি) বমি ভাব দেখা দিতে পারে।
৮। ডাল ও শস্য
মুগ, মুসুরি, অড়হর, খেসারি, মটর, ছোলা ইত্যাদি ডাল আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে খাওয়া হয়। এছাড়া গম, ভুট্টা, বারলি, জোয়ার, ওটস ইত্যাদিও শস্যবীজের অন্তর্গত। ইংরেজিতে এগুলোকে লেগুম বলে।
- কেন খাবেন
ভেজিটেবল প্রোটিনের সবচেয়ে বড় উৎস হল ডাল। এছাড়াও এতে প্রচুর ভিটামিন, খনিজ ও ফাইবার থাকে। শরীরে পুষ্টি যোগাতে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এর বিকল্প নেই।
- কখন খাবেন না
অনেক সময় ডাল হজম হতে চায় না বা এসিডিটি হয়। এক্ষেত্রে ডাল ভাল করে ভিজিয়ে রেখে খেলে সহজে হজম হয়। এছাড়া সামান্য পরিমাণ মাংস বা প্রাণীজ চর্বির সাথে ডাল রান্না করলে শরীর সহজেই ডালের প্রোটিন হজম করতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, ভাল করে খেতে হলে শুধু দামী খাবার বা, জনপ্রিয় “ট্রেন্ডি” খবার খেলেই হবে না। নিজের পুষ্টির চাহিদা বুঝে সেই অনুযায়ী খাওয়া দাওয়া করতে হবে। সেই সাথে খেয়াল রাখতে হবে যাতে সব ধরণের ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবারই থাকে আমাদের খাদ্য তালিকায়। সাপ্লিমেন্ট না খেয়ে প্রাকৃতিক খাবার থেকেই আমাদের ভিটামিন সংগ্রহ করা উচিৎ। তাই, জেনে রাখতে পারেন যে ১০টি খাবারে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স পাবেন। আর মেনে চলতে পারেন প্রাকৃতিক খাদ্য গ্রহণের প্রক্রিয়া, সুস্বাস্থ্যের জন্য সুপারফুড যা রয়েছে খাবারেই।
Leave a Reply