রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। কখনো হাই, কখনো লো, আবার কখনোবা নরমাল। আমাদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ হাই কিংবা লো, কোন লেবেলই ভাল নয়। সবচেয়ে ভাল হয় যদি এটি সব সময় নরমাল লেবেলে থাকে।
হিমোগ্লোবিন মূলত একটি আয়রন-রিচ প্রোটিন যা রক্তের সেলের মধ্যে থাকে। ফুসফুসে যখন অক্সিজেন প্রবেশ করে, যার সাথে হিমোগ্লোবিনের ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে, অক্সিজেনকে শরীরের বিভিন্ন টিস্যুতে পৌঁছে দিতে কাজ করে এই হিমোগ্লোবিন। হিমোগ্লোবিন কি এবং আমাদের শরীরে হিমোগ্লোবিনের কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিতে পারেন।
কোন ব্যক্তির শরীরে যখন হিমোগ্লোবিন বা রক্তের শ্বেত কণিকার অভাব দেখা দেয়, তখন শরীর তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া সম্পাদনের জন্যে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের ঘাটতিতে পড়ে যায়। কাজেই, রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা নরমাল থাকা জরুরী। বেশি বা কম, কোনটিই শরীরের জন্যে ভাল নয়।
চলুন, আমাদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের বিভিন্ন পরিমাণ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা নিয়ে রাখা যাক। অবশ্য তার আগে আমাদের জানা দরকার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা পরিমাপ করা হয় কিভাবে। তাহলে পরবর্তী আলোচনা মানে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বোঝাটা আরো সহজ হয়ে যাবে।
রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ
হিমোগ্লোবিনের মাত্রা পরিমাপ করা হয় যেভাবে
আমাদের রক্তে কতটুকু হিমোগ্লোবিন রয়েছে, সেটা কোন লেবেলে আছে তা জানার জন্যে একটি ব্লাড টেস্ট করতে হয়। হিমোগ্লোবিন বা সংক্ষেপে এইচবিকে গ্রামে, প্রতি ডেসিলিটার হিসেবে পরিমাপ করা হয়। রক্তে হিমোগ্লোবিনের লো লেবেল সরাসরি অক্সিজেনের লো লেবেল হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।
যদি ব্লাড টেস্টে দেখা যায় যে কোন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১৩.৫ ডেসি লিটারের কম, তবে ধরে নেয়া হয় যে তার অ্যানেমিয়া বা রক্তশূণ্যতা দেখা দিয়েছে। আর প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলাদের ক্ষেত্রে রক্তশূণ্যতা বা অ্যানেমিয়া ধরা হয় তখন যখন রক্তে হিমোগ্লোবিন ১২ ডেসি লিটারের কম ধরা পড়ে। শিশুদের ক্ষেত্রে বয়স ভেদে ভিন্নতা রয়েছে।
হিমোগ্লোবিনের নরমাল লেবেল
সাধারণত বয়সের উপর হিমোগ্লোবিনের নরমাল লেবেল নির্ভর করে। বয়:সন্ধিকাল এবং লিঙ্গের উপর ভিত্তি করেও মেডিকেল সায়েন্স মানুষের শরীরের জন্যে স্বাভাবিক হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ নির্ধারণ করে থাকে। যাই হোক, নিচে হিমোগ্লোবিনের নরমাল বা স্বাভাবিক মাত্রা দেয়া হল-
- সদ্য ভূমিষ্ট মানব শিশু – ১৭ থেকে ২২ ডেসিলিটার
- এক সপ্তাহ বয়সের শিশু – ১৫ থেকে ২০ ডেসিলিটার
- এক মাস বয়সের শিশু – ১১ থেকে ১৫ ডেসিলিটার
- সাধারণ শিশু বয়স – ১১ থেকে ১৩ ডেসিলিটার
- প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ – ১৪ থেকে ১৮ ডেসিলিটার
- প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলা – ১২ থেকে ১৬ ডেসিলিটার
- মাঝ বয়সী পুরুষ – ১২.৪ থেকে ১৪.৯ ডেসিলিটার
- মাঝ বয়সী মহিলা – ১১.৭ থেকে ১৩.৮ ডেসিলিটার
ল্যাবরেটরি টেস্টের উপর ভিত্তি করে উপরোল্লেখিত হিমোগ্লোবিনের মাত্রা সামান্য একটু কম বেশি হতে পারে, সেটা কোন ব্যাপার না। কিন্তু যদি মানুষের শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা এই নরমাল রেঞ্জ থেকে অতি মাত্রায় কম বা বেশি হয়, তবে সেটা অনেক বড় ব্যাপার। বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে কোনভাবেই রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম বা বেশি থাকা যাবে না।
যে নারী গর্ভ ধারণ করেছে এবং সন্তান প্রসব করবে তার ক্ষেত্রে হিমোগ্লোবিনের কম বা বেশি মাত্রার কারণে নিজের চেয়েও অনাগত সন্তানের বেশি ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবণা থাকে। প্রথমত সন্তান প্রসবে নানা রকম ঝুঁকি তৈরি হয়ে যায়। সময়ের পূর্বেই সন্তান প্রসব হয়ে যেতে পারে এবং সেক্ষেত্রে সন্তানের শরীরে নানা রকম সমস্যা লেগেই থাকবে। এছাড়াও, কম ওজনের সন্তানের জন্ম হতে পারে। কাজেই, গর্ভবতী মহিলাসহ আমাদের সকলেরই হিমোগ্লোবিনের পরিমাণের বেলায় সতর্ক থাকতে হবে।
হিমোগ্লোবিনের হাই লেবেল
রক্তে হিমোগ্লোবিনের উচ্চ মাত্রা Polycythemia নামের একটি বিরল রোগের দিকে ইঙ্গিত করে। হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে এ রোগটি হয়। এটা এ কারণে হয় যে লোহিত রক্ত কণিকার সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হয়ে যায়। আর এক্ষেত্রে একজন মানুষের শরীরের রক্ত অনেক ঘন থাকে।
উচ্চ মাত্রায় হিমোগ্লোবিন আরো একটি বিরল রোগের জন্ম দেয় যার নাম Clots। এছাড়াও বেশি হিমোগ্লোবিন স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবণা বাড়িয়ে দেয় অনেক গুণে। যদি সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমানো না হয়, তবে এটি কারো কারো ক্ষেত্রে জীবন নাশেরও কারণ হয়ে যেতে পারে।
রক্তে হিমোগ্লোবিনের লেবেল স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায় প্রধাণত ডিহাইড্রেশনের কারণে। এর পরের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত ধূমপান। এছাড়াও, ফুসফুস এবং হার্টের রোগ থেকেও রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে এবং হার্ট অ্যাটাকসহ আরো নানা রকম রোগের সৃষ্টি করতে পারে।
হিমোগ্লোবিনের লো লেবেল
রক্তে হিমোগ্লোবিনের নিম্ন মাত্রা স্বাভাবিকভাবেই Anemia বা রক্তাপ্লতার দিকেই ইন্ডিকেট করে। বিভিন্ন ধরণের Anemia রয়েছে, যেমন-
– আয়রণের অভাব জণিত Anemia হচ্ছে সবচেয়ে কমন। এ জাতীয় Anemia হয় তখনই যখন একজন ব্যক্তির শরীরে যথেষ্ট্য পরিমাণ আয়রন না থাকে। সচরাচর রক্তক্ষয় থেকেই Anemia হয়ে থাকে। তবে, এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যথেষ্ট্য পরিমাণে আয়রণ সমৃদ্ধ খাবার না খাওয়ার কারণেই হয়। কোন কোন রোগীর বেলায় গ্যাস্ট্রিকের বাইপাস সার্জারি করালেও Anemia দেখা দিয়ে থাকে।
– আয়রণের অভাব থেকে সৃষ্ট আরো এক ধরণের Anemia হয় যা মূলত মহিলাদের গর্ভ ধারণের সঙ্গে সম্পর্কিত। আর এটির সঙ্গেও আয়রণের যোগসূত্র রয়েছে। অর্থাৎ গর্ভ ধারণ কিংবা সন্তান প্রসব নারীদের শরীরের জন্যে প্রচুর আয়রণ ডিমান্ড করে। যদি যথেষ্ট্য পরিমাণ আয়রণ তখন সাপ্লাই দেয়া না যায়, তবে Anemia হবেই।
– যথেষ্ট্য পরিমাণ পুষ্টির অভাবে মানুষের শরীরে ভিটামিন বি১২ বা ফলিক অ্যাসিডের অভাব দেখা দেয়। আর এর অভাবে দেখা দেয় ভিটামিন জণিত Anemia। এ ধরণের Anemia লোহিত রক্ত কণিকার শেপ বা আকৃতি বদলে দেয় যা রক্তের কার্য্যকারিতা কমিয়ে ফেলে।
– হিমোগ্লোবিনের অভাবে বা মাত্রা কম হওয়ার কারণে মানুষের শরীরে সৃষ্ট আরো নানা ধরণের অ্যানেমিয়ার মধ্যে রয়েছে Aplastic Anemia, Hemolytic Anemia, Sickle Cells Anemia ইত্যাদি।
Leave a Reply