ওজন বৃদ্ধি নিয়ে টেনশনে আছেন অনেকে মহিলাই। ঘরে বসে থাকা কিংবা অলস সময় কাটানো অথবা অতিরিক্ত ভোজন, যে কারণই হোক না কেন, পুরুষের তুলনায় মহিলাদের ওজন বৃদ্ধি পায় তাড়াতাড়ি। মহিলাদের মধ্যে ওজন বৃদ্ধির জন্যে উপরোক্ত ওপেন কারণগুলো সবাই জানলেও একটি হিডেন এবং সবচেয়ে বড় কারণ আছে যা অনেকেই জানেন না। আর সেটি হচ্ছে হরমোনের ইমব্যালেন্স।
হরমোনের ভারসাম্যহীনতা শুধু ওজনই বাড়ায় না, মহিলাদের মাঝে আরো অনেক সমস্যা সৃষ্টি করে। আর এগুলো বয়ো:সন্ধি, গর্ভাবস্থা এবং কিছু মেডিকেশনের সঙ্গে রিলেটেড। মেয়েদের মানসিক এবং শারীরিক অবস্থার উপর ইমফ্যাক্ট ফেলা ছাড়াও, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ব্যাপকভাবে ওজন বাড়িয়ে দেয়।
আপনি কি জানেন এই হরমোনগুলো কি কি? কিভাবে এগুলো ওজন বাড়ায়?
আসুন, ওজন বাড়ানোর পেছনে কাজ করা এই হরমোনগুলো সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক, যাতে আমরা এগুলোকে অ্যাভয়েড করে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। আজকাল কিছু ওয়েটলস অ্যাপস্ পাওয়া যায় যেগুলো ওজন নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আমাদেরকে টেকনোলোজিক্যাল্লি সাহায্য করে থাকে। কিন্তু তার আগে ওজন বাড়ার জন্যে দায়ী হরমোন সম্পর্কে জানাটা জরুরী।
ওজন বাড়ার জন্যে দায়ী হরমোন
১. থাইরয়েড হরমোন
থাইরয়েড হরমোনজনিত সমস্যাটা সব মহিলাদের মধ্যেই বিদ্যমান। হাইপোথাইরয়ডিজম হচ্ছে থাইরয়েড হরমোনের স্বল্পতা যার কারণে মহিলাদের ওজন বাড়তে পারে। এই রোগের লক্ষন হচ্ছে- ক্লান্তি, ওজন বৃদ্ধি, শুষ্ক ত্বক ও কোষ্ঠকাঠিন্য।
থাইরয়েড গ্ল্যান্ড ৩টা হরমোন প্রডিউস করে। এগুলো হলো T3, T4 এবং Calcitonin। এই হরমোনগুলো একত্রে আমাদের মেটাবোলিজম বা খাদ্য বিপাক, ঘুম, হার্ট রেট এবং ব্রেন ডেভেলপমেন্টসহ আরো কিছু বডি ফাংশন নিয়ন্ত্রণ করে।
কিন্তু মাঝে মাঝে থাইরয়েড প্রয়োজনীয় এই হরমোনগুলো সঠিক পরিমাণে উৎপাদন করে না যা হাইপোথাইরয়েডিজমের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এটি অনেকের ক্ষেত্রেই ওজন বাড়ার পেছনে ভূমিকা পালন করে।
২. এস্ট্রোজেন
এস্ট্রোজেন মহিলাদের একটি যৌন হরমোন। ঋতুজরার সময় মহিলাদের ওজন বাড়ার কারণই হচ্ছে এই হরমোন। ঋতুজরার সময় হরমোন স্বল্পতার কারণে ওজন বাড়ে। ফ্যাট সেল অর্থাৎ চর্বি কোষ হচ্ছে এস্ট্রোজেনের উৎস। চর্বি কোষ ক্যালরিকে ফ্যাটে রূপান্তরিত করে, যার কারণে মেদবৃদ্ধি দেখা দেয়।
মেয়েদের শরীরে এস্ট্রোজেনের পরিমাণ কমে গেলেও ওজন বাড়ে, আবার বেড়ে গেলেও ওজন বাড়ে।
এস্ট্রোজেন বেড়ে গেলে শরীরে যে-সব কোষ ইনসুলিন তৈরি করে, সেগুলো বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে, শরীর হয়ে ওঠে ইনসুলিন প্রতিরোধী। আর এতে করে রক্তে সুগারের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং ওজন বৃদ্ধি পায়।
এস্ট্রোজেন কমে গেলে ওভারিয়ান সেল আর ঠিক মতো কাজ করে না। ফলে, শরীর অন্যত্র এস্ট্রোজেন খুঁজতে থাকে যার একটি অন্যতম সোর্স হচ্ছে ফ্যাট সেলস্। কাজেই, এটি শরীরের অতিরিক্ত শক্তির সোর্সকে ফ্যাটে রূপান্তরিত করে এবং ওজন বেড়ে যেতে থাকে, বিশেষ করে শরীরের নিচের অংশগুলোতে।
৩. প্রোজেস্টেরোন
ঋতুজরার সময় প্রোজেস্টেরোনের লেভেল কমে যায়। যার কারণে মহিলাদের শরীরে জল প্রবাহ হয় ও শরীর ফুলে যায়। এই অবস্থায় শরীর ভারী ভারী লাগে।
শরীর সঠিকভাবে কাজ করতে গেলে প্রোজেস্টেরন এবং এস্ট্রোজেন দুটোই ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, মেনোপজ, স্ট্রেস, অ্যান্টিবায়োটিক এবং হরমোনযুক্ত খাবার গ্রহণ বা জন্ম নিয়ন্ত্রণের পিলের ব্যবহারের কারণে প্রোজেস্টেরন ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে যা ওজন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
৪. টেস্টোস্টেরন
টেস্টোস্টেরন একটি সেক্স হরমোন যা মূলত পুরুষরাই বেশি বহন করে। কিন্তু মহিলাদের শরীরেও টেস্টোস্টেরনের উৎপাদন হয়, যদিও সেটা পুরুষের চেয়ে কম। এটি ফ্যাট বার্ন, পেশী শক্তি বৃদ্ধি, হাঁড় শক্ত করা এবং যৌন চাহিদা বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
কিন্তু অনেক মহিলাদের মধ্যে PCOS (পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম) দেখা দেয়। যার কারণে টেস্টেস্টেরন হরমোনের লেভেল বেড়ে যায়। এই কারণে ওজন বৃদ্ধি, মাসিক ব্যাধি, মুখে লোম, ব্রণ ও বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে।
৫. ইন্সুলিন
ইন্সুলিন হরমোনটির সাথে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত। এই হরমোনটি আমাদের শরীরে ফ্যাট এবং কার্বোহাইড্রেট নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ইন্সুলিন শরীরকে গ্লুকোজ ব্যবহার করার অনুমতি দান করে। এটি PCOS ব্যাধির কার্যকারক যার জন্য বন্ধ্যাত্ব দেখা দেয়। শরীরে প্রচুর পরিমানের ইন্সুলিন থাকলে মহিলাদের ওজন বেড়ে যায়।
অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজত খাবার, ফলমূল, অ্যালকোহল, কৃত্রিম চিনি এবং স্ন্যাকস্ এর মতো অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের ফলে শরীরে ইনসুলিন প্রতিরোধের সৃষ্টি হয়। ফলে, শরীরের বিভিন্ন সেল ইনসুলিন ব্লক করে দেয় আর এটি বেড়ে গিয়ে বাড়িয়ে তোলে শরীরের ওজন।
৬. করটিসল
করটিসল “স্ট্রেস হরমোন” নামেও পরিচিত। শরীরে উচ্চ পরিমানের করটিসল থাকলে আমাদের ক্ষুদা বেড়ে যায় ও তাতে ওজন বৃদ্ধি ঘটে। স্ট্রেস এবং ঘুমের অভাব হচ্ছে করটিসল হরমোন বেড়ে যাওয়ার দুটি কারণ।
৭. লেপটিন
আমাদের শরীর যখন শতভাগ স্বাস্থ্যবান, তখন লেপটিন সিগন্যাল দিয়ে জানিয়ে দেয় যে আর খাওয়ার প্রয়োজন নেই, এবার বন্ধ করা উচিৎ। এরপরও যখন আমরা খাবার খেতে থাকি, বিশেষ করে সেসব খাবার যেগুলোতে প্রচুর পরিমাণে সুগার রয়েছে, তখন শরীরে ফ্রুকটোসের অতিরিক্ত সাপ্লাই হতে থাকে যা ফ্যাটে কনভার্ট হয়ে ওজন বৃদ্ধি করে।
৮. ঘেরলিন
এটি ক্ষুধার হরমোন! ঘেরলিন ক্ষুধা জাগ্রত করতে এবং চর্বি বাড়াতে সহায়তা করে। এটি প্রধানত পেট, সেই সাথে ছোট অন্ত্র, অগ্ন্যাশয় এবং মস্তিস্কের দ্বারা নিঃসৃত হয়। রক্তে ঘেরলিনের অতি মাত্রা ওজন বাড়ায়। স্থুলকায় মহিলারা যে বেশি বেশি খেতে চায়, তার কারণ এই ঘেরলিন।
৯. মেলাটোনিন
মেলাটোনিন আমাদের মস্তিষ্কের গভীরে পাইনাল গ্রন্থিতে উত্পন্ন হয়। এটি আমাদের শরীরের সারকাডিয়ান ছন্দটি বজায় রাখতে সহায়তা করে। যারফলে, আমরা নিয়মিত ঘুমাই এবং ঘুম থেকে উঠি। মেলটোনিনের মাত্রা রাতের বেলা স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এতে গ্রোথ হরমোন নিঃসৃত হয় যা শরীরকে সুস্থ করতে, পাতলা পেশী তৈরি করতে এবং হাড়ের ঘনত্ব উন্নত করতে সহায়তা করে। কিন্তু যদি এই মেলাটোনিন নি:সরণ কোন কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে এবং ওজন বৃদ্ধি পায়।
১০. গ্লুকোকোর্টিকয়েডস
শরীরের নিরাময় প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ইনফ্লেমেশন বা প্রদাহ। তবে, দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ ওজন বৃদ্ধিসহ আরো অনেক সমস্যা তৈরি করে। আর গ্লুকোকোর্টিকয়েডস এই প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে। এমনকি, এটি আমাদের দেহে চিনি, চর্বি এবং প্রোটিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু কিছু মহিলার ক্ষেত্রে দেখা যায় এই হরমোনটি ঠিক মতো কাজ করে না। যারফলে, ওইসব মহিলাদের মেদভুঁড়ি দেখা দেয়।
আপনার শরীরের ওজন কেন বাড়ছে তা তো জেনে নিলেন| ওজন কমানোর কিছু উপায়ও জেনে নিন-
ওজন কমানো কোনো সহজ সাধ্য ব্যাপার নয়, তবে এই কয়েকটা উপায় আপনাকে কিছুটা হলেও ওজন কমাতে সাহায্য করবে।
- চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
- শুধুমাত্র ক্ষুদা লাগলেই খাবেন।
- স্বাস্থ্যকর খাবার খাবেন এবং জাঙ্ক ফুড কম খাবেন।
- ৮ ঘন্টা বা তার চেয়ে বেশি ঘুমানোর চেষ্টা করবেন।
- নিয়মিত ব্যায়াম করবেন।
- দুধ জাতীয় খাবার কম খাবেন।
- অনেক বেশি পানি পান করবেন।
- হরমোন বাড়ছে না কমছে তা চেকআপ করাবেন।
Leave a Reply