আপনি যদি মনে করেন মটরশুঁটি একটি সাধারণ সবজিমাত্র, তবে আপনার ভাবনাটা বেশি গভীর নয়। কারণ, মটরশুঁটি খাওয়ার উপকারিতা জানার কারণে উন্নত বিশ্বের মানুষ, বিশেষত খাদ্য বিশারদরা এটাকে গোল্ডেন পি বা সোনালী মোটর বলে থাকে। এটি শুধুমাত্র একটি সবজি নয়, বরং একটি উচ্চমাত্রার পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার।
মটরশুঁটির পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতার দিক বিবেচনা করে প্রায় সকল health nutritionist এটাকে প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় রাখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
শীতকালের এই সবজিটি সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জেনে নিন।
মটরশুঁটি সম্পর্কে বিস্তারিত
মটরশুঁটি কি?
মটরশুঁটি মূলত একটি সবজি যা শুঁটির ভেতরে থাকে। এটি Legume জাতীয় শাক-সবজি ও Pisum sativum জাতীয় উদ্ভিদের আন্ডারে পড়ে। মসুর, ছোলা, মটরশুটি ও চিনাবাদাম বলতে গেলে একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। একটা মটরশুঁটির গড় ওজন হতে পারে ০.১ হতে ০.৩৬ গ্রাম।
একটি শুঁটির ভেতর এক বা একাধিক মটর থাকে। শুঁটি খুলে মটরগুলোকে বের করে আনতে হয়। এরপর, এগুলো ভেজে খাওয়া যায়, আবার সবজি হিসেবে রান্নায়ও ব্যবহার করা যায়। আমাদের দেশে পোলাওর সঙ্গে মটরশুঁটির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। মটর শুকোলে সেটিকে ভেঙ্গে দু’ভাগ করে মটর ডাল হিসেবেও খাওয়া হয়।
মটরশুঁটির প্রকারভেদ
আল্লাহসুবহানাহুঅতাআ’লা আমাদের জন্যে বহু ধরণের মটরশুঁটি সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ, প্রকৃতিতে নানা প্রকারের মটরশুঁটি পাওয়া যায়। সেগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য ৫টি মটরশুঁটি হলো হলো-
- Green Peas
- Snow Peas
- Snap Peas
- Pigeon Peas
- Chick Peas
Green Peas এর আরেক নাম Garden Peas। এটিই আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং জনপ্রিয়। অন্য দুই ধরণের মটরশুঁটি অন্যান্য দেশে বেশি জনপ্রিয় হলেও আমাদের দেশেও পাওয়া যায়। কিন্তু, আমাদের দেশের মানুষ খায় কম। সবচেয়ে বেশি যেটি খায় সেটি হচ্ছে Green Peas।
মটরশুঁটির পুষ্টিগুণ
মটরশুঁটিতে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি রয়েছে। তবে, উপরোক্ত ৩ প্রকারের মটরশুঁটির পুষ্টিগুণ কাছাকাছি হলেও এক সমান নয়। ধরণ অনুযায়ী ভিন্নতা রয়েছে। নিম্নে আলাদা আলাদাভাবে সেগুলোর পুষ্টিগুণ দেয়া হলো-
Green Peas এর পুষ্টিগুণ (১ কাপ)
- ক্যালোরি: ১৩৪ (kcal)
- প্রোটিন: ৮.৬ গ্রাম
- কার্বো-হাইড্রেট: ২৫ গ্রাম
- ডায়েটারি ফাইবার: ৮.৮ গ্রাম
- সুগার: ৯.৫ গ্রাম
- ফ্যাট: ০.৪ গ্রাম।
Snow Peas এর পুষ্টিগুণ (১ কাপ)
- ক্যালোরি: ৬৭ (kcal)
- প্রোটিন: ৫.২ গ্রাম
- কার্বো-হাইড্রেট: ১১.৩ গ্রাম
- ডায়েটারি ফাইবার: ৪.৫ গ্রাম
- সুগার: ৬.৪ গ্রাম
- ফ্যাট: ০.৪ গ্রাম।
Snap Peas এর পুষ্টিগুণ (১ কাপ)
- ক্যালোরি: ২৭৮ (kcal)
- প্রোটিন: ১৫.২ গ্রাম
- কার্বো-হাইড্রেট: ৪২.৬ গ্রাম
- ডায়েটারি ফাইবার: ১১.৫ গ্রাম
- সুগার: ৮.০ গ্রাম
- ফ্যাট: ৫.৮৮ গ্রাম।
Pigeon Peas এর পুষ্টিগুণ (১ কাপ)
- ক্যালোরি: ২০৩ (kcal)
- প্রোটিন: ১১.৪ গ্রাম
- কার্বো-হাইড্রেট: ৩৯.০ গ্রাম
- ডায়েটারি ফাইবার: ১১.৩ গ্রাম
- সুগার: ৫.৮ গ্রাম
- ফ্যাট: ০.৬ গ্রাম।
Chick Peas এর পুষ্টিগুণ (১ কাপ)
- ক্যালোরি: ২৬৯ (kcal)
- প্রোটিন: ১৪.৫ গ্রাম
- কার্বো-হাইড্রেট: ৪৫.০ গ্রাম
- ডায়েটারি ফাইবার: ১২.৫ গ্রাম
- সুগার: ৭.৯ গ্রাম
- ফ্যাট: ৪.৩ গ্রাম।
মটরশুঁটি খাওয়ার উপকারিতা
উপরোক্ত পুষ্টিগুণ ছাড়াও মটরশুঁটিতে আরো রয়েছে নানা রকম ভিটামিন (vitamin), মিনারেল (mineral), অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট (antioxidant) ও ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস্ (phytonutrient) যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্যে সত্যিই উপকারি। আসুন, সেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক।
চোখের স্বাস্থ্যে মটরশুঁটি
চোখের জন্যে প্রয়োজনীয় জৈব রঞ্জক (organic pigment) সমৃদ্ধ ক্যারোটিনয়েড লুটেইন (carotenoids lutein) রয়েছে মটরশুটিতে। সেই সাথে, জেক্সানথিন (zeaxanthin) নামক আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যারোটিনয়েড পাওয়া যায় মটরশুটিতে।
এসব পুষ্টি (Nutrients) চোখকে নানা রকম দীর্ঘ মেয়াদী রোগ (chronic diseases) থেকে রক্ষা করে। এর মাঝে রয়েছে রাতকানা রোগ, বয়সজণিত দৃষ্টিশক্তির অবক্ষয় (macular degeneration)। রাতকানা রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা সহজ হলেও macular degeneration এর ক্ষেত্রে বেশ জটিল। মটরশুঁটি হতে পারে এসব চক্ষুরোগ থেকে বাঁচার প্রাথমিক চিকিৎসা।
হজমশক্তি বৃদ্ধিতে মটরশুঁটি
হজমশক্তি বৃদ্ধির জন্যে মটরশুঁটি মহা উপকারি। কেননা, মটরশুঁটিতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে যা আমাদের দেহের হজম প্রক্রিয়াকে পাওয়ারফুল করে তোলে। ফাইবারের ফলে মল ত্যাগে ঝামেলা হয় না। এমনকি, কোষ্ঠকাঠিন্যের সম্ভাবণাও থাকে না।
তবে, আপনি যদি হজম সমস্যায় ভুগে থাকেন। বিশেষত, যদি প্রায়ই আপনার এমন হয় যে, কিছু কিছু খাবার আপনার হজম হতে চায় না। কিংবা, সাধারণ কোনও খাবারেও আপনার হজমে হট্টগোল তৈরি করে, তবে আপনাকে অবশ্যই দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় হজমশক্তি বৃদ্ধিকারক ১০টি খাবার রাখতে হবে।
আয়রণের ঘাটতি পূরণে মটরশুঁটি
মটরশুঁটি আয়রণের একটি দারুণ উৎস। এমনকি, মটরশুঁটিতে দুষ্প্রাপ্য ননহেম আয়রণও (nonheme iron) রয়েছে যা সাধারণত অ্যানিমেল মিট ছাড়া পাওয়া যায় না। তার মানে হচ্ছে মটরশুঁটি আয়রণের একটি ভাল বিকল্প সোর্স হতে পারে যা মটরশুঁটি খাওয়ার উপকারিতা হিসেবে অসাধারণ।
আমরা জানি, আয়রণের অভাবজণিত লক্ষণ থেকে বোঝা যায় শরীরে অ্যানেমিয়া হয়েছে যা মটরশুঁটির পক্ষে পূরণ করা সম্ভব না হলেও এটি আপনাকে সাহায্য করবে। আমাদের শরীরে যদি যথেষ্ট্য পরিমাণে আয়রণ না থাকে, তবে শরীর অক্সিজেন সমৃদ্ধ লৌহিত রক্তকণিকা বহন করতে পারে না যা হিমোগ্লোবিন ডিভিসিয়েন্সি বাড়ায়।
হাঁড় গঠনে মটরশুঁটি
প্রতি এক কাপ মটরশুঁটিতে আমাদের দেহের জন্যে প্রয়োজনীয় ভিটামিন কে-এর (Vitamin K) প্রায় ৪৪% পাওয়া যায়, যা হাড় গঠনে ভীষণ গরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভিটামিন কে হাড়ের ভেতরের ক্যালসিয়ামকে অ্যাংকোরিং হতে সাহায্য করে।
এছাড়াও, মটরশুঁটিতে থাকা ভিটামিন বি হাড়ের পরিচিত রোগ অস্টিওপরোসিস থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
ইমিউন সিস্টেমের কার্যকারিতায় মটরশুঁটি
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বা ইমিউন সিস্টেম উন্নত করতে প্রয়োজনীয় ভিটামিন সি এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে মটরশুঁটি। বিখ্যাত পুষ্টিবিদ Judith Benn Hurley এর লেখা Healing Foods বই থেকে জানা যায় প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ভিটামিন সি এর পুরোটাই পূরণ করতে পারে মাত্র এককাপ মটরশুঁটি।
এছাড়াও, flavinoid, carotenoid, polyphenols এবং phenolic acids সমৃদ্ধ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকায় মটরশুঁটি যে কোনও ধরণের ক্ষতের (infection) বিরুদ্ধে দুর্দান্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।
ব্লাড সুগার ব্যবস্থাপনায় মটরশুঁটি
মটরশুঁটি লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বা জি. আই. (low glycemic index) এর একটি বড় উৎস। জি. আই. ব্লাড সুগার লেবেলকে বাড়তে দেয় না, বিশেষত হঠাৎ করে প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।
এছাড়াও, মটরশুঁটির ফাইবার ও প্রোটিন ব্লাড সুগারকে স্লো ডাউন করে রাখে যা ব্লাড গ্লুকোজ ইমপ্রুভ করে টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীকে স্বস্তি প্রদান করে থাকে।
ক্যান্সার প্রতিরোধে মটরশুঁটি
মটরশুঁটিতে কমেস্ট্রোল (coumestrol) উচ্চ মাত্রার পলিফেনল (polyphenol) থাকে যা স্বাস্থ্য-প্রতিরক্ষামূলক প্রয়োজনীয় পদার্থ। আর বিভিন্ন ক্যান্সার গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে, পাকস্থলীর ক্যান্সার প্রতিরোধে মটরশুঁটির মতো ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট (phytonutrient) খুবই প্রয়োজন।
এছাড়াও, মেডিকেল সায়েন্সের ভাষ্য মতে, মটরশুঁটিতে থাকা টক্সিক কম্পাউন্ড স্যাপোনিন (saponin) প্রায় সব ধরণের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে থেরাপির মতো কাজ করে, যাকে therapeutic effects হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
হৃৎরোগ প্রতিরোধ মটরশুঁটি
মটরশুঁটিতে থাকা অদ্রবণীয় ফাইবার উপাদান (insoluble fiber content) হৃৎরোগ প্রতিরোধে ভাল ভূমিকা রাখে। সেই সাথে, স্ট্রোকের মতো গুরুতর অবস্থা থেকেও রেহাই দিতে পারে। উভয় অবস্থাই তৈরি হয় রক্তনালীর নানা রকম বাধা-বিপত্তির কারণে। আর মটরশুঁটিতে থাকা antioxidant ও anti-inflammatory উপাদান রক্তনালীর স্বাস্থ্য ভাল রাখে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে মটরশুঁটি
লো-ফ্যাট ফুড হিসেবে মটরশুঁটি ওজন বাড়তে দেয় না। এমনকি, মটরশুঁটি ক্যালোরির পরিমাণও অত্যন্ত কম। সেই সাথে হাই ফাইবারের ফলে ওজন কমাতে এটি ওতপ্রোতভাবে কাজ করে। ওজন নিয়ে ওজর পেশ করার আগে নিয়মিত মটরশুঁটি খাওয়ার অভ্যেশ করুন।
যৌনস্বাস্থ্যে মটরশুঁটি
মটরশুঁটি যৌনস্বাস্থ্যের জন্যে যারপরনাই উপকারি। বিশেষ করে, পূরুষের স্পার্ম বৃদ্ধি করতে ও শারীরিক উদ্যম ও গতিশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে ছোট্ট এই সবজিটি। মটরশুঁটিতে গ্লাইকোডেলিন (Glycodelin) নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ পদার্থ রয়েছে যা পূরুষের শুক্রানুকে শক্তিশালী করে তোলে।
শেষ কথা
মটরশুঁটি খাওয়ার উপকারিতা বলতে গেলে আরো অনেকগুলো বলা যাবে। আশা করি, উপরোক্ত ১০টি উপকারিতার জ্ঞানই আপনার জন্যে যথেষ্ট্য হবে। এও আশা করা যায় যে, এখন থেকে আপনি প্রচুর পুষ্টি সমৃদ্ধ এই সবজিটি আর না খেয়ে থাকতে পারবেন না। এখন তো শীতকাল চলছে, আর বাজারে মটরশুঁটির মহা উৎসবও দেখা যাচ্ছে। সেই সাথে, দামও এখন বেশ কমেছে। সুতরাং, ইচ্ছে মতো কিনতে ও খেতে পারেন।
Sumaiya Tabassum Ima says
মটরশুঁটি সম্পর্কে সুন্দর লেখা। সুস্বাদু এই সবজিটি আমরা অনেকেই খাই, কিন্তু সবাই এর উপকারিতাগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানি না। আমিও বিস্তারিত জানতাম না, লেখাটি পড়ে জানলাম।