বুক ব্যাথায় ভোগেননি- এমন মানুষ, বিশেষ করে এ-রকম বয়স্ক লোক আমাদের দেশে কমই আছে। ছোট কিংবা বড়, তরুণ কিংবা বৃদ্ধ, নারী কিংবা পুরুষ, প্রায় সব মানুষেরই কখনো না কখনো বুক ব্যাথা দেখা দিয়ে থাকে। তবে ভয় নেই, বুক ব্যাথা দূর করার দারুণ কিছু উপায়ও আছে। সেগুলো জানার আগে আসুন বুক ব্যাথা সম্পর্কে বিস্তারিত একটা আইডিয়া নিয়ে রাখা যাক-
বুকে ব্যথা বুঝতে হলে-
মানুষ আমাদের কাছে যেসব শারীরিক সমস্যা নিয়ে আসে, তার মাঝে অন্যতম একটি হলো বুক ব্যাথা। তবে, এই বুক ব্যাথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তির উপর নির্ভর করে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। অনেক সময় এটি আরো কিছু বিষয়ের উপর ভ্যারি করে। যেমন-
- কোয়ালিটি
- ইনটেনসিটি
- ডিউরেশন ও
- লোকেশন
বুক ব্যাথা সাধারণ, সামান্য, অনেক বেশি কিংবা মারাত্মক হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এটি হার্ট রিলেটেড সমস্যার কারণেও হতে পারে। তবে, সবসময় এটি হার্ট অ্যাটাকের কারণ হয় না। কিন্তু ডাক্তারের কাছে গেলে প্রথমেই হার্ট ডায়াগনোস্টিক করা হয়। কেননা, যদি তাই হয়ে থাকে, তবে রোগীর তো জীবন-মরণের বিষয়।
বুকে ব্যাথার ডায়াগনোস্টিক বা জরুরী পরীক্ষা
সাধারণ বুক ব্যাথা নিয়ে যখন কেউ আমাদের কাছে আসে, আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বড় ধরণের কোন টেস্ট দেই না। কিন্তু রোগী যখন বেশি বা তীব্র বুক ব্যাথা নিয়ে আসেন, তখন আমরা জরুরী ভিত্তিতে নিম্নে উল্লেখিত পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করে থাকি।
ইসিজি বা ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম: ইসিজি টেস্টের মাধ্যমে স্কিনের সাথে অ্যাটাস্ট থাকা ইলেকট্রোডস্ এর ভেতর দিয়ে রোগীর হার্টের ইলেকট্রিক্যাল অ্যাক্টিভিটি রেকর্ড করা হয়। এই ডায়াগনোসিসটির মাধ্যমে জানা যায় রোগী হার্ট অ্যাটাক করেছে কিনা। সাধারণত, হার্ট অ্যাটাক করলে হার্টের পেশীগুলোতে ইলেকট্রিক্যাল ইমপালস্ ঠিক মতো কাজ করে না। আর এটি দিয়েই আমরা বুঝতে পারি হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কিনা।
ব্লাড টেস্ট: বুক ব্যাথার রোগীদের হার্টের পেশীতে থাকা বিশেষ কিছু প্রোটিন বা এনজাইমের অতিরিক্ত লেভেল চেক করার জন্যে রক্ত পরীক্ষা করা হয়। হার্ট অ্যাটাকের কারণে ডেমেজ হওয়া হার্ট সেল রক্তে কয়েক ঘন্টার জন্যে প্রোটিন কিংবা এনজাইম লিক করে দিতে পারে। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এটি জানা যায়।
বুকের এক্স-রে: রোগীর ফুসফুসের অবস্থা, হার্ট ও প্রধান প্রধান রক্তনালির সাইজ ও শেপের মাঝে পরিবর্তণ বোঝার জন্যে বুকের এক্স-রে করা হয়ে থাকে। এই এক্স-রে দ্বারা উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও ফুসফুসের আরো অনেক সমস্যা ধরা পড়ে। বিশেষ করে ফুসফুস কলাপ্স করা কিংবা pneumonia হয়ে থাকলে এক্স-রে দিয়ে সেটি বোঝা যায়।
সিটি স্ক্যান (Computerized tomography): ফুসফুসে পালমোনারি অ্যামবোলিজম বা ব্লাড ক্লোট দেখা দিয়েছে কিনা তা বোঝা যায় সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে। Aortic dissection বা ধমনীর ব্যবচ্ছেদ বোঝার জন্যে বুক ব্যথার রোগীদের সিটি স্ক্যান করা হয়ে থাকে। জেনে নিন সিটি স্ক্যান কি ও কেন করা হয়।
বুকে ব্যাথা কেন হয়?
চিকিৎসার আগে জেনে নেয়া প্রয়োজন বুক ব্যাথার কারণ কি, কেন সব সময়, মাঝে মাঝে কিংবা হঠাৎ বুকে ব্যাথা হয়। মোটামুটি বুক ব্যাথার ২০টি কারণ রয়েছে। তবে, কমোন কারণগুলির মধ্যে দেখা যায়-
- গ্যাস
- এসিড রিফ্লাক্স
- কাশি
- হার্ট বার্ন
হার্ট-রিলেটেড কারণ
- হার্ট অ্যাটাক: হার্টে ব্লক তৈরি যা রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে।
- এনজাইনা: হার্টের দিকে সংযুক্ত রক্তনালিতে ব্লকেজ।
- পেরিকার্ডাইটিস: হার্টের চারপাশে প্রদাহ।
- মায়োকার্ডাইটিস: হার্টের পেশিতে প্রদাহ।
- কার্ডিওমিওপ্যাথি: হার্টের পেশিতে হওয়া একটি রোগ।
- এওরটিক ডিসসেকশন: হার্টের একটি জটিল অবস্থা।
গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল কারণ
- অ্যাসিড রিফ্লাক্স কিংবা হার্ট বার্ন।
- খাদ্যনালীতে সৃষ্টি হওয়া কোন সমস্যা।
- পিত্তথলি বা অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ।
ফুসফুস সংক্রান্ত কারণ
- নিউমোনিয়া
- নিউমোথোরাক্স
- ভাইরাল ব্রঙ্কাইটিস
- ব্রঙ্কোস্পাজম
- ব্লাড ক্লোট বা রক্ত জমাট বাঁধা বা পালমোনারি এম্বুলাস
হাঁড় ও পেশী রিলেটেড কারণ
- ক্রোনিক পেইন সিনড্রোমস
- ক্ষত বা ভাঙ্গা পাঁজর
- সোর মাসল
- সংকোচন ফ্র্যাকচার
- গুলি স্নায়ুর উপর চাপ
বুক ব্যাথা দেখা দিলে করণীয়
আপনার যদি মাঝে মাঝেই বুক ব্যাথা দেখা দেয়, কিংবা হঠাৎই যদি ফিল করেন যে বুকে ব্যাথা করছে, তবে আপনার প্রথম করণীয় হচ্ছে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া। ডাক্তার প্রথমেই যেটা করবে সেটা হচ্ছে বুক ব্যথার কারণ জানার চেষ্টা। এক্ষেত্রে, ডাক্তার আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারেন। যেমন-
- ব্যাথার শুরু কখন থেকে?
- কোন কোন সময়টায় বেশি ব্যথা করে?
- কি ধরণের ব্যথা, বুকে চিনচিন করে, না কি শক্ত করে কিছু একটা চেপে আছে মনে হয়?
- একবার ব্যথা উঠলে কতক্ষণ থাকে?
- ব্যথা কিভাবে আসে আর কিভাবে চলে যায়?
- বুকের ব্যথা কি শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে যায়?
- বুক ব্যথা ছাড়া আর কোনও সমস্যা আছে? যেমন- নি:শ্বাস নিতে সমস্যা, মাথা ঘোরা, মাথা ব্যথা কিংবা বমি বমি ভাব?
- আপনার কি হাই ব্লাড প্রেশার আছে? সেটার জন্যে কি ঔষধ খাচ্ছেন?
- সিগারেট খাওয়ার অভ্যাশ আছে, কিংবা অ্যালকোহল?
ইত্যাদি আরো অনেক প্রশ্ন করতে পারেন। যে প্রশ্নই করুন না কেন, আপনাকে অবশ্যই সঠিক উত্তর দিয়ে ডাক্তারকে সহযোগীতা করতে হবে, যাতে তিনি প্রাথমিকভাবে ব্যথার কারণ বুঝতে পারেন। কারণ যদি ধরা যায় আর ডাক্তার যদি অভিজ্ঞ হয়ে থাকেন, তবে আপনাকে কিছু মেডিসিন দিয়ে বিদায় দিতে পারেন।
আর যদি সাইন ও সিম্পটম থেকে কারণ খুঁজে না পাওয়া যায়, তবে ডাক্তার কিছু টেস্ট দিতে পারেন। এ-রকম অবস্থায় সাধারণত কি রকম টেস্ট করা হয়ে থাকে, তা উপরে আলোচনা করা হয়েছে।
বুকে ব্যাথার মেডিকেল ট্রিটমেন্ট
রোগীর ট্রিটমেন্ট নির্ভর করে বুকে ব্যথার কারণের উপর। যদি হার্ট অ্যাটাকের কারণে বুক ব্যথা হয়ে থাকে, তবে ইমার্জেন্সী ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে, হার্টে রক্ত প্রবাহ চালু করতে মেডিসিন প্রয়োগের পাশাপাশি সার্জারীর প্রয়োজন হতে পারে। যেমন, এনজিওগ্রাম করা, হার্টে রিং বসানো, বাইপাস সার্জারি, ইত্যাদি। আর যদি হার্ট-রিলেটেড সমস্যার কারণে না হয়, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র মেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।
বুকে ব্যথার মেডিসিন
এক্ষেত্রেও, বুকে ব্যথার প্রকৃত কারণ ও ধরণের উপর নির্ভর করে ডাক্তাররা ঔষধ দিয়ে থাকেন। তবে, সচরাচর বুক ব্যথার জন্যে আমরা যেসব ঔষধ দেই, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-
নাইট্রোগ্লিসারিন: হার্টের ধমনী শিথিল করার জন্যে সাধারণত জিহ্বার নিচে নাইট্রোগ্লিসারিন ট্যাবলেট দেয়া হয়। এটি হার্টের ভেতরে থাকা রক্তের শিরা-উপশিরাগুলোকে রিলাক্স করে তোলে, যাতে করে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে ব্লাড ফ্লো চালু হয়ে যায়।
অ্যাসপাইরিন: ডাক্তার যদি বুঝতে পারে যে আপনার বুকের ব্যথাটা হার্টের সঙ্গে রিলেটেড, তবে আপনাকে অ্যাসপাইরিন জাতীয় ঔষধ দিতে পারেন।
থ্রোমবোলিটিক ড্রাগ: আপনি যদি হার্ট অ্যাটাক করে থাকেন, তবে আপনাকে ক্লোট-বাস্টিং হিসেবে থ্রোমবোলিটিক ড্রাগ বা ঔষধ নিতে হতে পারে। এ ধরণের ঔষধ জমাট বাঁধা রক্তকে ডিসলভ্ করে স্বাভাবিক চলাচলে সাহায্য করে।
ব্লাড থিনার্স: এ জাতীয় ওষধও দেয়া হয়, যদি হার্ট বা ফুসফুসে রক্ত চলাচলে বাধা দেখা দেয়। অর্থাৎ, ব্লাড ভেসেলে যদি ক্লোট থাকে, তবে ব্লাড থিনার্স জাতীয় ঔষধ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
অ্যাসিড সুপ্রেসিং মেডিকেশন: যদি আপনার বুকে ব্যথা পাকস্থলীতে অ্যাসিড জমার কারণে হয়ে থাকে, তবে ডাক্তার আপনাকে অ্যাসিড নিবারণকারী ঔষধ দিতে পারেন।
এছাড়াও, কারণ ও ধরণ অনুযায়ী বুক ব্যথার জন্যে আরো নানা রকম মেডিসিন রয়েছে।
বুক ব্যথা প্রতিরোধ করবেন কিভাবে?
বুক ব্যথার অগ্রিম প্রতিকার না থাকলেও রয়েছে আগাম প্রতিরোধের ব্যবস্থা। জীবন যাপন প্রক্রিয়া কিছু পরিবর্তণ এনে অনায়াসেই বুক ব্যথা প্রতিরোধ করা যায়। আসুন, জেনে নেই বুক ব্যথা প্রতিরোধে করণীয়-
স্বাস্থ্যকর খাবার: শুধু বুক ব্যথার ক্ষেত্রেই নয়, যে কোনও অসুখ-বিসুখ থেকেই স্বাস্থ্যকর খাবার আপনাকে সুস্থ্য ও নিরাপদ রাখতে পারে। কাজেই, বেছে বেছে ভাল মানের খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন।
- হাই ব্লাড প্রেশার থাকলে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন।
- ডায়াবেটিস থাকলে অবশ্যই নিয়মতান্ত্রিক জীবন-যাপন করুন।
- অতিরিক্ত কোলেস্টোরেল জাতীয় খাবারগুলো বর্জণ করুন।
- সপ্তাহের অধিকাংশ দিনই কিছু না কিছু ব্যায়াম করার চেষ্টা করুন।
- ওজন বাড়ায় এমন খাবার থেকে দূরে থাকুন এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
ধূমপান কিংবা মদপানের অভ্যাশ থাকলে তা ত্যাগ করুন। অধিকাংশ মানুষেরই ধূমপানের অভ্যাশ থাকে আর চাইলেও ছাড়তে পারে না। জেনে নিন ধূমপান থেকে দূরে থাকার ১৩টি চ্যালেঞ্জিং উপায়।
Nur says
আমার বাবার একবার হার্ট এ্যাটাক হয়েছিল। আজ রাতে খাওয়ার পর হঠাৎ উনার বুকের বাম পাশটায় ব্যাথা করতে থাকে আর গলা জ্বলতে থাকে, সেই সাথে বমি বা অস্বস্থি বোধ শুরু হয়। এখন কি করণীয়? উনি অনেক দুশ্চিন্তা করেন+ প্রেসার আছে। দুইদিন ধরে প্রেসার লো।
Bipul chandra says
আমার স্ত্রীর সাথে মিলিত হওয়ার সময় প্রায়ই বুকের ডানপাশে ব্যথা হয়, খুব অসুস্থ বোধ করি।
আনিস says
আমার আজকে দুই বছর ধরে বুক ব্যাথা, কুমিল্লা মেডিকেলে অনেকবার গিয়েছি, ইসিজি, রক্ত, প্রস্রাব, এক্সরে, এই সব পরিক্ষা করে ডাক্তার কোনো রোগ দরতে পারেননি।
এসসিটাপ্রাম ৫’১০, প্রোপানল১০, মায়োলাক্স৫০, টুইস্ট ৫০০, ন্যাপ্রোক্সিন ৫০০ এই ট্যাবলেটগুলো খেলে ব্যাথা একটু কমে। কিন্তু একেবারে যায় না। এখন আমার কি করনীয় একটু বলবেন প্লিজ, গরিব মানুষ অনেক কষ্ট পাই মাঝে মাঝে শাসকষ্ট আসলে মোনাস ১০ খাই।