বিড়ালের ভালবাসায় বিভোর হই আমরা সবাই, বিশেষ করে আমাদের শিশুরা। তুলতুলে আর আদুরে এই পোষা প্রাণীটির প্রতি মানুষের ভালবাসা আদিম এবং অকৃত্রিম। এখানে মানুষে মানুষে ভালবাসার মতো কোনও স্বার্থ নেই। কিন্তু এই ভালবাসা যতই নি:স্বার্থ হোক না কেন, কখনো না কখনো ভালবাসার এই প্রাণীটি আপনাকে কামড় দিতে পারে। সেক্ষেত্রে, কি করণীয় জানা জরুরী। অর্থাৎ, আমাদের সকলেরই জেনে রাখা উচিৎ বিড়াল কামড় দিলে কি করা যাবে আর কি করা যাবে না।
বড়দের ক্ষেত্রে খুব একটা দেখা না গেলেও ছোটদের বেলায় প্রায়ই এমন হয়ে থাকে যে, আদর করার সময় বিড়ালের নখ লেখে শিশুদের শরীরে রক্তপাত ঘটে। কিংবা, কোনও কারণে বিড়াল যদি ক্ষেপে যায়, তখন রাগের মাথায় বিড়াল আঁচড় দিয়ে বসে কিংবা কামড় বসিয়ে দেয়।
অনাকাংখিতভাবে এরকম কিছু ঘটলে অনেক বাবা-মা’ই পেরেশান হয়ে যান। দৌড়ে ছুটে যান ডাক্তারের কাছে। বলে দেন তাড়াতাড়ি টিটেনাস ইনজেকশন দিয়ে দেন। আবার, কিছু বাবা-মা আছেন, যারা এটাকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না। কাজেই, ডাক্তার দেখানো তো দূরের কথা, একটু যে লবন পানি দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার করে দেবে, সেটাও করেন না।
উভয় ধরণের বাবা-মা বা অভিভাবকেরই জানা উচিৎ বিড়ালে কামড়ালে কি হয় এবং কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ নয়। আসলে শুধু কামড়ের ব্যাপারে নয়, বরং বিড়াল সম্পর্কে বিস্ময়কর কিছু তথ্য সবারই জেনে রাখা দরকার। এ তথ্যগুলো আদরণীয় এই পোষা প্রাণীটি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়াবে। তবে, বিশেষভাবে জানা প্রয়োজন বিড়াল যদি কামড় বা আঁচড় দেয়, তবে আমাদের করণীয় কি?
আসুন, তার আগে আরো কিছু বিষয় জেনে রাখা যাক-
বিড়াল কেন কামড়ায়?
বিড়াল তো আমরা পুষি, তবে এটি কেন কামড় দেয়? এটা একটা সাধারণ প্রশ্ন আর উত্তরটাও সাধারণভাবেই দিচ্ছি। বিড়াল অনেক কারণেই কামড় দেয়। আমাদের বুঝার চেষ্টা করতে হবে বিড়াল আমাদের সঙ্গে কি ধরণের কমিউনিকেট করার চেষ্টা করছে। হতে পারে, আপনার পোষা বিড়ালটি আপনাকে কোনও মেসেজ দিতে চাইছে। কিংবা, আপনার কোনও কাজ বন্ধ করতে চাইছে যেটা তার পছন্দ না।
বিড়াল আসলে কেন কামড় দেয়, এটা নিশ্চিতরূপে জানাটা অনেকটাই কঠিন। অধিকাংশ বিড়ালের মালিকরাই বিষয়টি বিভ্রান্তিকর বলে মনে করেন। এক মুহুর্ত তারা দাঁতের স্ট্রোকিং উপভোগ করতে পারে, পরের মুহূর্তেই আবার দাঁতগুলি বাইরে!
অনেক মালিকই মনে করেন, যখন বিড়ালরা কামড় দেয়, তখন তারা আপনাকে জানাতে চেষ্টা করে যে তারা বর্তমানে যে যোগাযোগটি গ্রহণ করছে তা তারা উপভোগ করছে না। অর্থাৎ, মালিকের সঙ্গে তাদের কমিউনিকেশন গ্যাপ হচ্ছে।
যেমন ধরুন, আপনার শিশুটি বিড়ালের সঙ্গে যেভাবে খেলছে, সেটা হয়তো বিড়ালের পছন্দ নয়। অর্থাৎ, খেলার ধরণটা তার ভাল লাগছে না, সে অন্য কোনও খেলা চাইছে যেমনটি সে অন্য বিড়ালের সাথে খেলে থাকে। এটা বোঝানোর জন্যেও অনেক সময় বিড়াল কামড় দিয়ে বসে।
আবার, কখনো দেখা যায় আপনার কিংবা আপনার সন্তাণের কোন আচরণে বিড়াল বেশ ক্ষেপে উঠেছে। কিংবা, মাইন্ড করেছে। এখন সে এটা কিভাবে জানাবে! তখন কামড় দিয়ে বোঝাতে চায়।
যাইহোক, বিড়াল যে কারণেই কামড় দিক না কেন, বিড়ালের কামড় থেকে কিন্তু ইনফেকশন হয়।
বিড়ালের কামড়ে ইনফেকশন হয় কেন?
বিড়ালের দাঁত অত্যন্ত শার্প এবং কেনাইন। যখন সে এই দাঁত দিয়ে কারো শরীরে কামড় দেয়, তখন ত্বকে খোঁচা লাগে। ছোট কিন্তু ধারালো খোঁচা যা গভীর ক্ষত তৈরি করতে পারে।
বিড়ালের কামড়ের খোঁচার সাথে তার মুখ থেকে এক ধরণের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া মানুষের শরীরে সহজেই প্রবেশ করতে পারে। এমনকি, আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে এই ব্যাকটেরিয়াগুলো বসবাসের পাশাপাশি বংশ বিস্তার করতে শুরু করে দেয়। ফলে, বিড়ালের কামড়ে মানব দেহে ইনফেকশন তৈরি হয়। আর এটাকে মেডিকেলের ভাষায় cellulitis বলে।
এই ইনফেকশন বা সেলুলাইটিস শুধু কামড় থেকে নয়, বরং আঁচড় থেকেও হতে পারে। এটা নির্ভর করে আঁচড় কতটা গভীরে প্রবেশ করছে।
বিড়ালের কামড় কি বিপদজনক?
বিড়ালের কামড় মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী উভয়ের জন্যেই বিপদজনক। কারণ, সব বিড়ালই তাদের মুখে এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া বহন করে থাকে। আর এই ব্যাকটেরিয়াগুলো অন্যান্য পশু এবং মানুষের শরীরে টিস্যু ইনফেকশন ঘটাতে পারে।
ক্ষতিকর এই ব্যাকটেরিয়ার নাম Pasteurella multocida যেগুলো যেগুলো সংখ্যায় অনেক। এগুলো সংক্রমিত হয়ে ত্বকে ক্ষত বা ঘা সৃষ্টি করে। এগুলো দেখতে লাল বর্ণের হয়ে থাকে এবং সংক্রমিত স্থান বেশির ভাগ সময়ই ফোলা থাকে। এই সংক্রমণ একটা টিস্যু থেকে অন্যান্য টিস্যুতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ কারণে বিড়ালের কামড় অবশ্যই বিপদজনক।
বিড়ালের কামড়ে ভয় পাওয়ার প্রয়োজন আছে?
মোটেই না। অনেকেই বিড়ালের কামড় খেয়ে ভয় পেয়ে যান। বিশেষ করে, কারো সন্তানকে যদি বিড়াল কামড় দেয়, তবে বাবা-মা আতংকিত হয়ে পড়েন। তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারেন কী করবেন বা কী করবেন না। তাদের প্রথমেই যেটা বোঝা দরকার সেটা হচ্ছে, বিড়ালের কামড় কতটা লেগেছে।
কামড় বা আঁচড় যদি খুব একটা বেশি না হয়, অন্তত যদি চামড়া ভেদ করে ভেতরে না ঢোকে এবং রক্তপাত না হয়; তবে ভয়ের কিছু নেই। কেননা, এটুকুর জন্যে তেমন কোনও ক্ষতিই হবে না। সাধারণ পানি বা লবণ পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললে উপরে লেগে থাকা ব্যাকটেরিয়া মরে যাবে।
তবে, বিড়ালের আঁচড়ে বা কামড়ে যদি ছিলে যায়, রক্ত বের হয়, তবুও ভয় না পেয়ে সচেতন হওয়া দরকার। এক্ষেত্রে, কি করণীয় সে সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
বিড়ালে কামড় দিলে জরুরী ভিত্তিতে করণীয়
বিড়াল কামড়ালে তাৎক্ষনিকভাবে আপনাকে যেটা করতে হবে সেটা হচ্ছে, কামড়প্রাপ্ত স্থানটি পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা। তবে, অবশ্যই সেটা রানিং পানি হতে হবে। যেমন, ট্যাপ ছেড়ে ধোয়া। অর্থাৎ, আবদ্ধ পানি দিয়ে ধোয়া যাবে না। মূল কথা একই পানি ব্যবহার করা যাবে না। বালতির পানি নিয়ে যদি ধুতে চান, তবে মগের মধ্যে পানি নিয়ে সেটা ঢালুন।
পাতলা আর নরম কোন কাপড় দিয়ে আলতোভাবে ঘষা দিতে পারেন। কিন্তু কোনভাবেই জোরে ঘষা যাবে না এবং শক্ত বা খচখচে কোনও কিছু ব্যবহার করা যাবে না।
ধোয়া বা পরিস্কার করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি সেটি হচ্ছে, কোনভাবেই কোন রকম জীবাণুনাশক বা অন্যান্য রাসায়নিক ব্যবহার করা যাবে না। কারণ, এটি টিস্যুর ক্ষতি করতে পারে। এমনকি, ক্ষত নিরাময়ে বিলম্ব করতে পারে। তবে, সাবান ব্যবহার করতে পারেন। কারণ, ভালভাবে পরিস্কার করার জন্যে অনেক ডাক্তারই সাবান ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন।
তবে, সবচেয়ে ভাল হয় আপনি যদি একটি হালকা লবণের দ্রবণ দিয়ে ক্ষতটি পরিষ্কার করতে পারেন। এটা প্রায় সব ডাক্তারেরই পরামর্শ। কেননা, লবণ হচ্ছে প্রাকৃতিক জীবাণুনাশক। অর্থাৎ, এটি জীবাণু ধবংশকারী। পদ্ধতি হিসেবে, ২ কাপ (500 মিলি) পানিতে ১ চা চামচ (5 মিলি) লবণ মিশ্রিত করে সেটা দিয়ে ধুতে পারেন। যদি রক্তপাত হয়ে থাকে, তবে পানি শোষণকারী ড্রেসিং বা ব্যান্ডেজ ব্যবহার করে ক্ষতটিতে সরাসরি চাপ প্রয়োগ করে রক্তপাত নিয়ন্ত্রণ করুন।
বিড়াল কামড় দিলে কি ডাক্তার দেখাতেই হবে?
অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে এবং সেটা যত দ্রুত সম্ভব। কারণ, বেশিরভাগ বিড়ালের কামড়ের ক্ষতগুলি এমন ক্ষুদ্র পাঙ্কচার তৈরি করে যা দিয়ে ত্বকের গভীরে প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে। যদি ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা না করা হয়, তবে চব্বিশ থেকে আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে একটি গুরুতর সংক্রমণ বিকাশ লাভ করতে পারে।
ডাক্তার সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন যাতে কামড়কৃত স্থান কিংবা অন্যান্য জায়গায় সংক্রমণের রিস্ক কেটে যায়। কিছু ক্ষত সারানোর জন্যে সেলাই করার প্রয়োজন হতে পারে যাতে তাড়াতাড়ি ক্ষত শুকিয়ে যায়। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডাক্তাররা সংক্রমণ প্রতিরোধে টিটেনাস ইনজেকশন দিয়ে থাকেন।
কামড়ের তীব্রতা এবং কামড়ের আশেপাশের পরিস্থিতিগুলির উপর নির্ভর করে ডাক্তার আপনাকে রেবিজ প্রফিল্যাক্সিস চিকিৎসা করার পরামর্শও দিতে পারে। এটি এক ধরণের ভ্যাক্সিন যা অধিকাংশ সময়ই আক্রান্ত ব্যক্তির জন্যে প্রয়োজন হয়।
ভ্যাক্সিন পাবেন কোথায়
বাংলাদেশের অধিকাংশ হাসপাতালেই ভ্যাক্সিন পাওয়া যায়। তবে, বেসরকারি হাসপাতালগুলো ভ্যাক্সিনের জন্যে বেশি পরিমাণে টাকা খরচ করিয়ে থাকেন যা অনেক রোগীর জন্যেই বহন করা কষ্টসাধ্য। আর সরকারী হাসপাতালগুলো এটি প্রায় বিনামূল্যেই দিয়ে থাকে। কিছু কিছু সরকারি হাসপাতাল সামান্য কিছু টাকা নিয়ে থাকে।
অনেকে আবার শুধুমাত্র টিকেটের মূল্যই নিয়ে থাকে। যেমন, ঢাকার বিখ্যাত মহাখালি সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে গেলে আপনাকে শুধু মাত্র ১০টাকা দিয়ে একটা টিকেট কাটতে হবে। আর কোনও খরচ লাগবে না। এই টিকেট দিয়েই আপনি আর কোনও খরচ ছাড়াই ৪ ডোজ অ্যান্টি র্যাবিস ভ্যাক্সিন নিতে পারবেন।
আগেই থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করুন
বিড়ালে কামড় দিলে Rabies ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রচুর সম্ভাবণা থাকে। শুধু মানুষ নয়, অন্য কোনও প্রাণীকেও যদি বিড়াল কামড় দেয়, তবে সে প্রাণীরও র্যাবিস রোগ হবে। আর সে প্রানী যদি আবার মানুষকে কামড় দেয়, তবে সেটা থেকে মানুষেরও এই ভাইরাস জণিত রোগটি হয়ে থাকে। সুতরাং, যারা বিড়াল পালেন, তাদেরকে আগে থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আর এই সতর্কতার প্রধান ধাপটি হচ্ছে আপনার পোষা প্রাণীকে র্যাবিস ভ্যাক্সিন দিয়ে রাখা।
পোষা প্রাণীকে র্যাবিস ভ্যাকসিন দেয়া থাকলে সেটি কামড় দিলেও আর তেমন কোনও ক্ষতি হয় না। একবার ভ্যাক্সিন দিলে ৫ বছর পর্যন্ত সেটার মেয়াদ থাকে। অর্থাৎ, আপনাকে ৫ বছর পর পর একবার করে আপনার পোষা প্রাণীকে র্যাবিস ভ্যাক্সিন দিয়ে নিতে হবে। এই ভ্যাক্সিন পাওয়া যায় ভেটেরেনারি ডাক্তারের চেম্বারে, এমনকি পোষা প্রাণীর খাবার-দাবার বিক্রি করে, এমন দোকানেও পাওয়া যায়।
আশা করি, বিড়াল কামড় দিলে করণীয় কাজগুলো সম্পর্কে ভাল করে বুঝে নিয়েছেন। এমনকি, জেনে নিয়েছেন বর্জণীয় কাজগুলো সম্পর্কেও। আপনার পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কাউকে বিড়ালে কামড় দিলে এখন আপনি অবশ্যই সুপরামর্শ দিতে পারেন, তাদেরকে সহযোগীতা করতে পারবেন। এ লেখাটি শেয়ার করেও আপনি অগ্রিম সহযোগীতা করতে পারেন যাতে এটি সবাই সংগ্রহে রেখে দিতে পারে।
Leave a Reply