আজকেই রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ জয়ী ফ্রান্স মুখোমুখি হবে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে। ক্রোয়েশিয়ার সাথে ফ্রান্সের হিসাব-নিকাশ অনেক পুরনো। সেই ৯৮ এর বিশ্বকাপের ফাইনালে হারার প্রতিশোধ নিতেই ক্রোয়েশিয়া আবার নতুন রুপে ফিরে এসেছে।
এবারের বিশ্বকাপে আগে থেকে কোন কিছুই ভবিষ্যৎ বাণী করা সম্ভব হচ্ছে না। সবার ফেভারিট ফ্রান্স হলেও ক্রোয়েশিয়াও কিন্তু কম না। তারা যদি চমক দেখিয়ে দেয় তাহলে আজকের বিশ্বকাপ ইতিহাস হয়ে থাকবে। ফ্রান্স এবারের বিশ্বকাপে প্রথম থেকেই ভাল খেলে আসছে। আর্জেন্টিনা বেলজিয়ামের মত দলকে হারিয়ে ফ্রান্স আজ বিশ্বকাপের ফাইনালে এসেছে।
চলুন দেখে নেয়া যাক ফ্রান্স যেভাবে ফাইনালে এসেছে।
ফ্রান্সের ফাইনাল যাত্রা
ফ্রান্স বনাম অস্ট্রেলিয়া
‘সি’ গ্রুপে ফ্রান্সের প্রথম ম্যাচ ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। কিন্তু প্রথম ম্যাচেই ফ্রান্সের ছন্দহীন খেলায় সমন্বয়হীনতার অভাবটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। প্রথমার্ধে তেমন কোনো সুযোগ তৈরি করতে পারেননি ফ্রান্সের স্ট্রাইকাররা। দলের অভিজ্ঞ খেলোয়াড় অঁতোয়ান গ্রিজমান, উসমান দেম্বেলে কিংবা ফ্রান্সের সবচেয়ে তরুণ খেলোয়াড় কিলিয়ান এমবাপে। কিলিয়ান এমবাপে এর আগে ইউরো কাপেও খেলেছেন।
দ্বিতীয়ার্ধে গিয়ে গ্রিজমানকে ফাউল করা হলে পেনাল্টি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন রেফারি। এটাই ছিল বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ভিএআর প্রযুক্তির সাহায্যে পেনাল্টি দেয়ার সিদ্ধান্ত। সফলভাবে স্পট কিক করে দলকে এগিয়ে নিয়ে যান আতলেতিকো মাদ্রিদের ফরোয়ার্ড নিজে।
এরপর সামুয়েল আউমতিতি নিজেদের ডি বক্সে এসে হ্যান্ডবল করার কারণে স্পট কিক থেকে ৪ মিনিটের মাথায় অস্ট্রেলিয়াকে সমতায় নিয়ে আসেন মাইল ইয়েডিনাক। একেবারে শেষ দিকে গিয়ে পল পগবার শটে বেহিচ আস্তে করে পা ছুঁয়ে বল চলে যায় সোজা অস্ট্রেলিয়ার জালে। এই গোলেই সি গ্রুপে সবার আগেই পুরো ৩ পয়েন্ট নিশ্চিত করে দিদিয়ের ফ্রান্স দল। ২-১ গোলে অস্ট্রেলিয়াকে হারায় ফ্রান্স।
ফ্রান্স বনাম পেরু
দ্বিতীয় ম্যাচে একাতেরিনবুর্গের মাঠে নামে ফ্রান্স। দেম্বেলের পরিবর্তে এই ম্যাচে অলিভিয়ে জিরুদকে একাদশে ফেরান দেশম। প্রথম ম্যাচের চেয়েও ফ্রান্স এই ম্যাচে অনেক ভালো খেলে। কিন্তু এই ম্যাচটি সমর্থকদের মন জয় করতে পারেনি।
দ্বিতীয়ার্ধের আগেই জাতীয় দলের হয়ে সবচেয়ে কম বয়সে বিশ্বকাপে গোল করে ফ্রান্সকে এগিয়ে নিয়ে যান কিলিয়ান এমবাপে। অন্যদিকে দ্বিতীয়ার্ধে অনেক চেষ্টা করেও গোল দিয়ে সমতায় আনতে পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয় পেরু। এই জয়ের মাধ্যেমি শেষ ১৬ তে নিজেদের স্থান নিশ্চিত করে ফ্রান্স। আর পেরু এখানেই রাশিয়া বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়। এই ম্যাচে ১ গোলে পেরুকে হারায় ফ্রান্স।
ফ্রান্স বনাম ডেনমার্ক
এই ম্যাচেই আগেই ফরাসিরা তাদের নক আউট পর্ব নিশ্চিত করে ফেলে। আর এই কারণে ডেনমার্কের বিরুদ্ধে ফ্রান্স তাদের ছয় জন সেরা খেলোয়াড় ছাড়াই মাঠে নামে। সেরা প্রথম পছন্দের ছয় জনকে ছাড়াই ফ্রান্স ডেনমার্কের বিপক্ষে মাঠে নামে কেবল এক পয়েন্টের জন্য। একটি পয়েন্ট পেলেই নিশ্চিত হবে গ্রুপ পর্বের সেরা স্থানটি।
অন্যদিকে এই খেলায় ডেনমার্ক ও ফ্রান্স দুই দলকেই ডিফেন্সে খেলতে দেখা যায়। কারণ, প্রতিপক্ষ ডেনমার্কের শেষ ষোলোয় যেতে কেবল ড্র করায় দরকার ছিল। এই কারণেই হয়তো দুই দলেই নিরাপদ পথে গোল না করে বরং তার চেয়ে রক্ষণের দিকেই বেশি মনোযোগ দেয়।
কিন্তু বিশ্বকাপের এই খেলায় প্রথম গোলশূন্য ড্রয়ের কারণে এবং খেলায় তেমন গুরুত্ব না দেয়ার জন্য মাঠেই সমর্থকদের কাছ থেকে বাজে মন্তব্য শুনতে হয় ফ্রান্সের তারকা খেলোয়াড় গ্রিজমান পগবা ও এমবাপেদের। এই নিয়ে ফ্রান্স দুই ম্যাচে জয়লাভ করে এবং এক ম্যাচে ড্র করে ৭ পয়েন্ট নিয়ে নিজ গ্রুপে সেরা স্থান লাভ করে শেষ ষোলোতে পা রাখে ফ্রান্স।
ফ্রান্স বনাম আর্জেন্টিনা (শেষ ষোলো)
কাজানে অনুষ্ঠিত শেষ ষোলোয় আর্জেন্টিনার বিপক্ষে খেলায় নামে ফ্রান্স। এই খেলায় দুই দলেই তাদের সেরাটা দিয়ে খেলে।
১৩ মিনিটে পেনাল্টি পেয়ে সোজা গোল করে দলকে এগিয়ে নেন গ্রিজম্যান। বিরতির আগেই ডি মারিয়া সমতায় আনেন। ৬৪ তম মিনিটে বাম পায়ের শটে দলকে এগিয়ে নেন কিলিমান এমবাপে। এই ম্যাচে ৪-৩ গোলে আর্জেন্টিনাকে হারায় ফ্রান্স।
ফ্রান্স বনাম উরুগুয়ে (কোয়ার্টার ফাইনাল)
সুয়ারেজের মত বার্সেলোনার তারকা খেলোয়ার ছিল উরুগুয়ের টিমে, অনেক ভাল খেলেছিল টিম উরুগুয়ে। কিন্তু তাদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে উরুগুয়েকে প্রথমবারের মতো উড়িয়ে দিয়ে শেষ চারে ষষ্ঠবারের মতো জায়গা করে নেয় ফ্রান্স। এই ম্যাচে ২-০ গোলে উরুগুয়েকে হারায় ফ্রান্স।
ফ্রান্স বনাম বেলজিয়াম (সেমিফাইনাল)
পাঁচ পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে যে বেলজিয়াম হারিয়ে সেমিফাইনাল পর্যন্ত এসেছে, তাদের সাথে জিতাটা ফ্রান্সের জন্য খুব কঠিন ছিল। খেলার প্রথম থেকেই লুকাকুর বেলজিয়াম বল দখলে নিয়ে আক্রমণে গ্রিজম্যানদের চেয়ে এগিয়ে ছিল। প্রথমার্ধে কোন গোলের দেখা পায়নি কোনো ফ্রান্স। বিরতির পর প্রথম সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গোল করে ফ্রান্স। একান্ন তম মিনিটেই ফ্রান্স কর্নার পায়। এই সুযোগেই গ্রিজমানের কর্নারের হেডে বল সরাসরি বেলজিয়ামের জালে পাঠান বার্সেলোনার ডিফেন্ডার খেলোয়াড় সামুয়েল উমতিতি।
বিশ্বকাপের শুরু থেকে বেলজিয়াম ভাল খেলেছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। এই ম্যাচেও তাদের অধিনায়ক এদেন আজার ও কেভিন ডে ব্রুইনে ভাল খেলেছেন এবং তারা অনেক সুযোগও তৈরি করেন। কিন্তু শত চেষ্টা করা স্বত্তেও তারা বিফল হয়।
এবারের বিশ্বকাপ আসরে এই প্রথমবারের মতো ফ্রান্সের বিপক্ষেই গোলশূন্য হয়ে বাড়ি ফিরে বেলজিয়াম। তাদের গোলকিপার কর্তোয়ার কথা না বললেই নয়। যিনি সবসময় সতর্ক আর রক্ষণাত্মকভাবে প্রতিটি আক্রমণকে বিপর্যস্ত করে দেন। তিনিও এবার ব্যর্থ হন। ফলে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠে ৯৮ এর বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স।
এখন কেবল অপেক্ষার পালা, আজকে রাতেই ঠিক হয়ে যাবে কে হচ্ছেন এবারের চ্যাম্পিয়ন। তাই আগে থেকে ভবিষ্যৎ বাণী না করে অপেক্ষাকৃত শ্রেয়।
Leave a Reply