দেশে পড়াশুনাকালীণ সময়েই বিদেশে পড়াশুনার প্রস্তুতি নিয়ে রাখা ভাল। কারণ, এমন হতে পারে যে, দেশের কলেজ কিংবা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পড়তেই বিদেশের কোন কলেজে কিংবা ভার্সিটিতে পড়তে যাওয়ার সুযোগ মিলে যেতে পারে। তখন যাতে হা-হুতাশ করতে না হয়, হাতের কাছে সবকিছু সহজেই পাওয়া যায় এবং আনন্দের সঙ্গেই বিদেশে পড়তে যাওয়া যায়, তাই পূর্ব প্রস্তুতির প্রয়োজন।
উচ্চ শিক্ষার জন্যে, বিশেষ করে বাইরের ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি অর্জণের জন্যে বিদেশে পড়তে যাওয়ার ইচ্ছা থাকে অনেকেরই। কিন্তু এর জন্য পড়াশুনার পাশাপাশি ঠিক কিভাবে তৈরি হতে হবে, তা বুঝে উঠতে পারেন না অনেকেই। ফলে, অনেক সময় সামান্য একটু প্রস্তুতির অভাবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় অনেক স্বপ্ন। হাতে আসা অনেক সুযোগ পেয়েও হারাতে হয়।
যেমন, টিউশন ফি ছাড়াই পড়া যায় অ্যামেরিকার ৮টি ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু না জানার কারণে এবং ঠিক মতো প্রস্তুতি না নেয়ার ফলে অনেকেই এসব সুযোগ নিতে পারেন না।
সুতরাং, বিদেশে পড়তে যাওয়ার অনেক আগে থেকেই ভালভাবে তৈরি হয়ে থাকা উচিৎ, যাতে সুযোগ এলেই তার সদ্ব্যবহার করা যায়। তাই, বিদেশে গিয়ে পড়াশুনা করার জন্যে সঠিক প্রস্তুতি নিতে আমাদের কিছু টিপস অনুসরণ করুন। এটা এ জন্যে যে যাতে সকল সম্ভাবনার জন্য তৈরি থাকতে পারেন এবং নিরাপদে বিদেশে গিয়ে পড়াশুনা করতে পারেন।
বিদেশে পড়াশুনার প্রস্তুতি নেবেন যেভাবে
১। স্কলারশিপের খোঁজ-খবর নিন
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এমন অনেক ইউনিভার্সিটি রয়েছে যারা ছাত্র-ছাত্রীদের ফ্রিতে পড়াশুনার জন্যে স্কলারশিপ দিয়ে থাকে। এমন নয় এই স্কলারশিপ শুধু মাত্র তাদের দেশের শিক্ষার্থীদের জন্যে, বরং অধিকাংশ স্কলারশিপই আন্তর্জাতিক, অর্থাৎ সব দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে। যেমন, কানাডার হাম্বার কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল এন্ট্রান্স ও ব্যাচেলর ডিগ্রি স্কলারশিপ যাতে যে কোন দেশের শিক্ষার্থীই অ্যাপ্লাই করতে পারবে।
এ রকম অনেক ইন্টারন্যাশনাল স্কলারশিপ রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বড় বড় ইউনিভার্সিটিতে। তবে, স্কলারশিপের জন্যে নির্দিষ্ট্য সময় দেয়া থাকে। যেমন, কোথাও জুনে, কোথাও জানুয়ারীতে। এসব খোঁজ-খবরের জন্যে আপনাকে সব সময় চৌকান্না থাকতে হবে। আর যখনই কোথাও স্কলারশিপের অফার দেখা যাবে, তখনই অ্যাপ্লাই করতে হবে।
২। ডকুমেন্টস তৈরি করে রাখুন
বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলে অবশ্যই আপটুডেট পাসপোর্ট তৈরি করে রাখুন। সম্ভব হলে যে দেশে যাচ্ছেন তার জন্য ভিসার আবেদন আগেভাগেই করুন। সাধারণত যাত্রার ছয় থেকে আট সপ্তাহ আগে ভিসার আবেদন করার প্রয়োজন হয়। আপনি যে ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যাবেন, তার সাথে এবং সে দেশের এমব্যাসির সাথে যোগাযোগ করে জেনে নিন আর কি কি প্রয়োজনীয় রিকোয়ারমেন্ট আছে।
আপনার পড়াশোনার সার্টিফিকেট, আপনার ইউনিভার্সিটি শিক্ষকদের দেয়া প্রশংসাপত্র, এক্সট্রা-কারিকুলার অ্যাকটিভিটির সার্টিফিকেট ইত্যাদি তৈরি করে রাখুন। এছাড়া ডাক্তারি সার্টিফিকেট, সম্ভব হলে ইন্সুরেন্স এবং আপনার গন্তব্য দেশে ব্যবহার করা যাবে, এমন এটিএম কার্ডের ব্যবস্থাও করে রাখুন। অনেক কাগজপত্র অনুবাদ করে নোটারাইজ করিয়ে নেয়ার দরকার হয়। এগুলো সব আগেই সেরে নিন।
৩। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে খোঁজ নিন
আপনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছেন, সে সম্পর্কে বিশেষভাবে ভাল করে খোঁজ-খবর নিন। জেনে নিন প্রতি সেমিস্টারে খরচ কি রকম হতে পারে। আলাদা কোন খরচ আছে কিনা, কোন বেনিফিট বা ডিস্কাউন্ট পাওয়ার সুযোগ আছে কিনা জেনে নিন। সেই সাথে কাজ করার সুযোগ আছে কিনা এবং থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা কোথায় সবচেয়ে ভালো হবে সেটাও জেনে নেয়ার চেষ্টা করুন।
আরও খোঁজ নিতে পারেন বাংলাদেশী ছাত্র ছাত্রীরা সেখানে কি পরিমাণ পড়াশোনা করে বা তাদের কোন ক্লাব আছে কিনা। এতে করে আপনি প্রয়োজনে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেতে পারেন যা আগে হয়তো চিন্তা করেননি। সুতরাং, বিদেশে পড়াশুনার প্রস্তুতি হিসেবে এ বিষয়টিকে অবশ্যই গুরুত্ব দেয়া উচিৎ।
৪। কোথায় থাকবেন সে ব্যবস্থা করুন
কোথায় গিয়ে থাকবেন সে চিন্তাভাবনা আগে থেকেই করে নিন। সাধারণত ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা হয় ইউনিভার্সিটির ডর্মে। কিংবা কম খরচের মধ্যে আশে-পাশে কোন ব্যক্তিমালিকানাধীন ফ্ল্যাটে। যেখানেই থাকেন না কেন, আগে থেকে ভাল করে খোঁজ-খবর নিয়ে তৈরি হয়ে যাবেন।
৫। যে দেশে যাচ্ছেন তার সম্পর্কে জানুন
সে দেশে যাওয়ার আগে কিছু সময় কাটিয়ে রিসার্চ করুন। সেই দেশের মানুষজন, তাদের সংস্কৃতি, বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এগুলো সম্পর্কে ভালো করে জেনে নিন। বিশেষ করে কি কি ধরনের সমস্যায় পড়তে পারেন এবং সেগুলোর সমাধানে কি করবেন তা জানার চেষ্টা করুন। সে দেশের সাধারণ আইন সম্পর্কেও জেনে নিন, যাতে ভুলে আইন ভেঙে বিপদে না পড়েন।
এগুলো জানা খুব কঠিন কিছুও নয়। সামান্য গুগল সার্চ দিয়েই এ তথ্যগুলো আপনি পেয়ে যেতে পারেন। আর এর চেয়েও বেশি যদি জানতে চান, তবে সে দেশে আপনার পরিচিত কেউ যদি আগে গিয়ে থাকেন, তাদের সাথে কথা বলুন।
এমব্যাসি এবং ইউনিভার্সিটির দেয়া ইনফর্মেশনগুলো ভালো করে পড়ুন, কারণ সেখানে প্রচুর জরুরী তথ্য দেয়া থাকে।
যদি ইংরেজিভাষী নয় এমন কোনও দেশে পড়তে যান, চেষ্টা করবেন তাদের ভাষাটা অন্তত প্রাথমিকভাবে জেনে যেতে। প্রায় সব প্রচলিত ভাষার কোর্স ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইন্সটিটিউট অব মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে করা সম্ভব। এছাড়া অনলাইনে বিভিন্ন কোর্স করতে পারেন।
৬। প্রয়োজনীয় ঠিকানা ও ফোন নাম্বার জেনে রাখুন
আপনি যে ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছেন, তার কাছাকাছি এলাকায় বাংলাদেশিদের কি কি সংস্থা আছে সে বিষয়ে ভাল করে খোঁজখবর নিয়ে যাবেন।
বিশেষ করে এমন একজন দুজন ব্যক্তির নাম ও ফোন নাম্বার নিয়ে রাখবেন, যাদেরকে আপনি অবশ্যই কোন বিপদ হলে ফোন দিতে পারেন। আর এই নাম্বার শুধুমাত্র ফোনে সেভ করে নিশ্চিত থাকবেন না, বরং এক টুকরো কাগজে নাম্বারগুলো লিখে পকেটে রাখুন।
৭। যাত্রাপথে করণীয়
যাত্রা পথে সতর্ক থাকুন, এবং আপনার ব্যাগ সামলে রাখুন। পাসপোর্ট, জরুরী ডকুমেন্ট, মোবাইল ও কিছু টাকা, বা সম্ভব হলে সে দেশে ব্যবহারযোগ্য ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড একটি সাইড ব্যাগে বহন করুন। এগুলো খুব সাবধানে রাখুন, যাতে হারিয়ে না যায়।
বিমানবন্দরে, এবং অন্যান্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টে বিভিন্ন ধরনের সতর্কবাণী এনাউন্সমেন্ট করা হয়, এ সকল বিষয়ে খেয়াল রাখুন। বিশেষ করে আপনার যদি কানেক্টিং ফ্লাইট থাকে। ডেস্কে গিয়ে দায়িত্বরত কর্মীদের কাছ থেকে ভালভাবে জেনে নিন আপনার ফ্লাইট কখন, কোথা থেকে ছাড়বে এবং সে জায়গায় কিভাবে পৌঁছাতে হবে। এ সব বিষয়ে কোন দ্বিধার অবকাশ নেই, কারণ একবার ফ্লাইট মিস হয়ে গেলে আপনাকে অনেক ঝামেলায় পড়তে হবে। এই কারণে সাথে শুকনো খাবার রাখতে পারেন।
অতিরিক্ত জিনিসপত্র নেবেন না। বাংলাদেশীদের স্বভাব হচ্ছে বিদেশে যাওয়ার আগে আমরা গাট্টি বোঁচকা বেঁধে নিই। কিন্তু বাস্তবে এতো বেশি জিনিস নিয়ে গেলে আপনি অনেক সমস্যায় পড়তে পারেন। যেমন, লাগেজ হারিয়ে যেতে পারে বা চুরিও হয়ে যেতে পারে। কাজেই যেসব জিনিস কম দামে পাওয়া যাবে বলে আপনি নিশ্চিত, সেগুলো শুধু শুধু টেনে নিয়ে যাবেন না। অপরিচিত মানুষের দেয়া জিনিসপত্র কখনওই বহন করবেন না।
ব্যাগে ছুরি, কাঁচি, নেইল কাটার, দেশলাই বা কোন ধরনের দাহ্য তরল পদার্থ ভুলেও নেবেন না।
প্লেনে সাধারণ ভদ্রতা মেনে চলুন। নামার সময় দরজার কাছে ভিড় করবেন না, ফ্লাইট ক্রুরা জানিয়ে দেবে কখন নামতে হবে, তাদের নির্দেশ অনুসরণ করুন।
৮। সে দেশে পৌছানোর পরে করণীয়
একবার পড়তে যখন চলে যেতে পেরেছেন, তখন সে অভিজ্ঞতাটি উপভোগ করুন। বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীদের সাথে মেলামেশার সুযোগ পাচ্ছেন, সেটি এড়িয়ে যাবেন না।
ঘর ভাড়া নেয়া বা কেনাকাটার সময় প্রতারণার হাত থেকে সতর্ক থাকুন। জেনে নিন কাছাকাছি বাংলাদেশের এমব্যাসি কোথায় আছে এবং কিভাবে সহজে সেখানে পৌঁছানো যেতে পারে। আর মনে রাখবেন, আপনি বিদেশে আপনার দেশের একজন প্রতিনিধি। কাজেই এমন কোন কাজ করবেন না যাতে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়।
সবকিছু গুছিয়ে নিতে পারলে বিদেশে পড়তে যাওয়া খুবই মজার একটি অভিজ্ঞতা হতে পারে। যদিও আপনার মাঝে অনেক কিছু মোকাবিলা করার মানসিকতা থাকতে হবে। আশা করি, এই লেখাটি আপনাকে বিদেশে পড়াশুনার প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করবে।
Leave a Reply