ভাবুন তো আজ থেকে এক দশক আগের কথা। তখন কেউ কি নকিয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোন ফোন কেনার কথা ভাবতো? নকিয়া তখন শুধু একটি কোম্পানির নাম ছিল না, এদেশের মানুষের কাছে ছিল একটা নির্ভরতা ও দারুণ আস্থার প্রতিক। কিন্তু এমন একটা সময় আসলো যখন নকিয়া তার সেই জৌলুস হারাতে শুরু করলো।
চায়না ফোন কোম্পানিগুলো তখনও এদেশের বাজারে প্রবেশ শুরু করেছিল মাত্র। আপনাদের মনে থাকবে হয়ত তাদের ফোন গুলোতে তখন তাদের নিজস্ব চ্যাপ্টা পিন ছাড়াও নকিয়ার চিকন পিনের চার্জারের লাইন বিদ্যমান ছিল। তারা ব্যাটারিও তৈরি করত নকিয়ার ফোনের ব্যাটারির মাপে অর্থাৎ তাদেরকে এদেশে ব্যবসা শুরু করতে হয়েছিল নকিয়ার প্রতি মানুষের আস্থার মানদণ্ড ধরে।
ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, এভরি চেয়ার ইজ আ মিউজিক্যাল চেয়ার’। নকিয়ার ভাগ্যেও তেমনটি ঘটেছিল। তাই এক দশক পরে নকিয়া আজ শুধুই কিশোর বয়সের প্রথম প্রেমের মত স্মৃতি বিজড়িত নস্টালজিয়ার নাম। সাদাকালো পর্দায় হিসহিস শব্দ তোলা স্নেক গেম আর ব্রান্ড টোন আজ শুধু গল্পের বিষয়। বহুল প্রচলিত চিকন পিনের চার্জার আজ একট উপহাসের বিষয়। জানুন, বাংলাদেশে নকিয়ার রাজত্ব, পতন ও প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে।
বাংলাদেশে নকিয়ার রাজত্ব, পতন ও প্রত্যাবর্তন
নকিয়া তো ফিরেছে, সেটা সবাই জানি। কিন্তু যে আস্থাটা ছিল সেটা ফিরেছে কি? আজ আমাদের কেউ দোকানে কোন ফোন কিনতে গেলে নির্দ্বিধায় নকিয়া বেছে নেব, না কি নকিয়া কিনতে গেলেই ভাবব কয়েক বার? উত্তর গুলো আমাদের সকলের জানা। কারণ নকিয়ার সেই চেয়ারটা হাত ছাড়া হয়েছে অনেক আগেই। স্যামস্যাং ছাড়াও এদেশে প্রচুর চায়না কোম্পানি প্রতাপের সাথে ব্যবসা করে যাচ্ছে, যারা মানুষের আস্থা জিতে নিয়েছেভালভাবেই। একই সাথে আমাদের দেশি কয়েকটি কোম্পানিও দাঁড়িয়ে গেছে। তাই নকিয়া তার হারানো রাজত্ব একচেটিয়াভাবে কখনোই ফিরে পাবে না এটা বলাই যায়।
নকিয়া এদেশে কেন মানুষের আস্থার ও নির্ভরতার প্রতিক ছিল এর কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে গুরুত্বপূর্ণ যেসব বিষয় আমাদের স্মৃতিতে ধরা দেয় সেগুলো হলঃ
শক্তিশালী হার্ডওয়ার
নকিয়া ফোনের হার্ডওয়ার ছিল তখনকার সময় সেরার সেরা। দীর্ঘদিন একটানা ব্যবহার করেও এর কোন বিচ্যুতি ঘটত না। শক্তপোক্ত হওয়াও এটি অসংখ্যবার আঘাতপ্রাপ্ত হয়েও টিকে থাকত বছরের পর বছর। তাই আজও যদি হঠাৎ আমরা পরিচিত সেই টোনের শব্দে চমকে উঠি পরক্ষণে মনে মনে ঠিকই বলি, নকিয়া বলে কথা।
ফুল চার্জে কয়েকদিন
নকিয়ার ফোনগুলো একবার চার্জ করলেই কমপক্ষে তিনদিনের জন্য টেনশন ফ্রি থাকা যেত। এর ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিশেষ করে বিদ্যুৎহীন অঞ্চলগুলোতে নকিয়ার ফোনগুলো খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে।
ক্যামেরা
নকিয়ার টু ম্যাগাপিক্সেল ক্যামেরাতে তখন যে মানের ছবি উঠত সেটির জন্য আজও আফসোস করতে হয়। হয়ত এই আফসোসটুকুর জন্য আমরা নকিয়াকে আজও স্মরণ করি।
প্রযুক্তি
তখন নকিয়া এদেশে তার সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিল নিঃসন্দেহে। থ্রিজি না থাকলেও নকিয়ার স্মার্ট ফোনে ভিডিও কলের জন্য ফ্রন্ট ক্যামেরা ঠিকই ছিল। ফোনের সামনে ক্যামেরা ছিল অথচ সেলফি নামটা প্রচলিত ছিল না। ইশ আমাদের চেয়েও নকিয়া কতই না এগিয়ে ছিল তখন!
কেন এমন অধ:পতন
২০০৭ সাল, অ্যাপল কোম্পানি প্রথম আইফোন বাজারে ছাড়ল। বাটন ছাড়া পুরো পর্দার এক ফোন যেখানে আঙুলের ছোঁয়াতে সব কাজ সম্পন্ন হত। স্বভাবত মানুষ কৌতুহলী হয়ে উঠল, কিন্তু অ্যাপলের দাম ছিল সাধারণের নাগালের বাইরে। তবে সে প্রযুক্তি টা কাজে লাগিয়ে উন্মুক্ত সফটওয়্যার অ্যান্ড্রয়েড তৈরি হল। মার্কেটে পিছিয়ে থাকা স্যামস্যাং অ্যান্ড্রয়েডকে গ্রহণ করল অপারেটিং সিস্টেম হিসাবে। আর উন্মুক্ত হওয়ায় অ্যান্ড্রয়েড এর অ্যাপস তৈরী হতে লাগল যত্রতত্র। মানুষের এমন কোন চাহিদা নেই যা নিয়ে অ্যান্ড্র্যয়েড অ্যাপস তৈরি হয়নি। নকিয়া ঠিক এই জায়গাটাতেই পিছিয়ে পড়ল। তারা আদের অপারেটিং সিস্টেমকে যুগোপযোগী না করে নিজেদেরটাতেই অটল থাকল। কিন্তু মানুষ ততদিনে আয়েশি হয়ে উঠছে। তাই নকিয়া ক্রমে বন্দি হল ফিচার ফোনে। তাদের স্মার্ট ফোন হাতছাড়া হয়ে গেল। সে জায়গাটা নিয়ে নিল স্যামস্যাং। পক্ষান্তরে অ্যান্ড্রয়েড উন্মুক্ত হওয়ায় কিছু চায়না কোম্পানিও কম দামে একই ফিচারের স্মার্টফোন বাজারে আনা শুরু করল। সাথে আমাদের দেশিও কিছু কোম্পানি তাদের নামে স্মার্ট ফোন বিক্রি শুরু করল এদেশে। ক্রমে নকিয়া অতীত ইতিহাস হয়ে গেল এদেশের বু্কে। এমনকি ২০১৩ সালে তারা তাদের স্মার্ট ফোন অংশ মাইক্রোসফটের কাছে বিক্রি করে দিয়ে ব্যবসার ইতি টানল।
কিন্তু ভাললাগার বিষয় হল নকিয়া আবার ফিরে এসেছে। তবে শুধু নামে ফিনিশিয় কোম্পানি এইচ ডি এম গ্লোবাল নকিয়ার ব্রান্ড নেম ব্যবহার করে ফোন বাজারজাত শুরু করেছে গতবছরেই। তবে এই কোম্পানি প্রাক্তন নকিয়ার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একই ছাতার নিচে নিয়ে আসায় এটা প্রায় আগের নকিয়ার কাছাকাছি, এমনটা বলেছেন এই কোম্পানির সাবেক সিইও।
তবে নকিয়া বেশ চমক নিয়েই ফিরেছে। তাদের প্রথম অ্যান্ড্রয়েড সিস্টেমের লঞ্চ করা ফোন নিঃশেষ হয়েছে নিমিষেই। এরপর তারা এদেশেও ২০১৭ সালের জুনে এনেছে কম বাজেটের উন্নত ফিচার সমৃদ্ধ স্মার্টফোন। যেমন এন ২, এন ৩। তবুও কথা থেকে যাচ্ছে মানুষের আস্থা কি ফেরাতে পেরেছে আদৌ? না কি পুরানো নস্টালজিয়া কে কাজে লাগিয়ে তারা ব্যবসা করতে চাচ্ছে। একসময়ের বহুল বিক্রিত ফিচার ফোন নকিয়া ৩৩১০ একইরূপে ফিরিয়ে আনার চিন্তাটা তেমনি ইঙ্গিত দেয়। তবে মানুষ যেহেতু এখন অনেক কিছুর স্বাদ নিয়ে অভ্যস্ত তাই নকিয়ার জন্য এদেশে নতুন করে আস্থার বাজার তৈরি করা একটা অগ্নিপরীক্ষাই বৈকি।
Leave a Reply