আপনি যদি একজন মেয়ে হয়ে থাকেন, তাহলে সম্ভবত আপনি অনেক আগেই পুরুষের হরমোন সংক্রান্ত অনেক কথাই শুনেছেন। মেয়েরা স্বভাবতই ছেলেদের সাথে নিজেদের তুলা করতে ভালোবাসে। কারণ তারা এটি জানতে আগ্রহী হয় যে শক্তি, সমর্থ, সৃজনশীলতা, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি বিষয়ে কে এগিয়ে রয়েছে।
এছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, মেয়েরা তাদের অনেক কাজেরই দায় হরমোনের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। একজন মেয়ে হিসেবে আপনার জেনে রাখা উচিত যে, আপনার কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণে আপনার হরমোন যতটা প্রভাব বিস্তার করে, একজন পুরুষের ক্ষেত্রেও হরমোনের সেই একই পরিমাণ প্রভাব রয়েছে।
পুরুষের হরমোন
এটি খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার যে, হরমোন পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের শরীরেই ক্ষেত্রেই প্রায় একই ধরনের কাজ করে থাকে। তবে পার্থক্যটা হলো, একটি মেয়ের শরীরে হরমোনের পরিমাণ বা প্রবাহ যেভাবে ওঠানামা করে, পুরুষদের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরুষদের হরমোন নারীদের চাইতেও অনেক বেশি বৈচিত্রময়। তাই চলুন জেনে নিই পুরুষের হরমোন সম্পর্কে অবাক করার মত কিছু তথ্য।
ছেলেদের শরীরেও অ্যাস্ট্রোজেন থাকে:
কি, অবাক হয়ে গেলেন। হ্যাঁ, নারীরা একাই অ্যাস্ট্রোজেন এর অধিকারী নয়। পুরুষদের শরীরে অ্যাস্ট্রোজেনের উপস্থিতি রয়েছে, তবে সেটা খুবই পরিমিত পরিমাণে। এটি তাদের শরীরের হাড়ের গঠনসহ মস্তিষ্কের বিভিন্ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করে থাকে।
আমরা প্রায় সকলেই জানি যে, টেস্টোসটেরন পুরুষদের ইরেকটিক্যাল ডিসফাংশন প্রতিরোধে সাহায্য করে। আপনি জেনে অবাক হবেন যে, যে কোন বয়সের পুরুষের শরীরে উপস্থিত অ্যাস্ট্রোজেনও টেস্টোসটেরনের মতোই ইরেকটিক্যাল ডিসফাংশন প্রতিরোধী হিসেবে অংশগ্রহণ করে। টেস্টোসটেরন এবং অ্যাস্ট্রোজেন এর সামঞ্জস্যের ব্যঘাত ঘটলেই পুরুষদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের কর্মক্ষমতা কমতে শুরু করে।
এছাড়া পুরুষদের মন মানসিকতার পরিবর্তণ এবং ওজন বেড়ে যাওয়া বা কমার পেছনেও অ্যাস্ট্রোজেন যথেষ্ট পরিমাণে ভূমিকা রয়েছে। তাই যাদের শরীরে এটির পরিমাণ কম, তাদের বিভিন্ন দক্ষতা ও মেধার ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা যাবে, এটিই অতি স্বাভাবিক। সত্য এটিই যে, টেস্টোসটেরন এবং অ্যাস্ট্রোজেন এর সামঞ্জস্যের ফলেই পুরুষদের মধ্যে এমন একটি ব্যক্তিত্বের সঞ্চার হয়, যাকে কিনা প্রতিটি মেয়েই ভালোবাসতে চাইবে।
অতিমাত্রায় টেস্টোসটেরন পুরুষদের জন্য ক্ষতিকর:
একজন পুরুষের শরীরে টেস্টোসটেরনের কাজ ও প্রভাব সম্পর্কে আপনি নিশ্চয়ই অবগত। আপনি হয়তো ভেবে থাকবেন যে, যত বেশি পরিমাণ টেস্টোসটেরন পুরুষ শরীরে থাকবে, ততই তার পক্ষে ভালো। আসলে ব্যপারটি তেমন নয়। টেস্টোসটেরনের অধিক্য পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়।
পুরুষদের ক্ষেত্রে তাদের শরীরে অতিমাত্রায় টেস্টোসটেরনের বৃদ্ধি তাদের লিভারের বিভিন্ন রোগসহ কোলেষ্টেরল এর পরিমাণ বহুগুণে বেড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী হয়। সম্প্রতি হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয় যে, পুরুষের শরীরে টেস্টোসটেরনের পরিমাণ প্রয়োজের চাইতে বৃদ্ধি পেতে থাকলে তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের শারিরীক দুর্বলতা সহ চুল পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
কিন্তু এর ভুক্তভোগী পুরুষেরা একা নয়, নারীরাও পুরষের এই সেক্স হরমোনটির দ্বারা যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত। নারীদের ক্ষেত্রে এটি তাদের ওজন বৃদ্ধির পাশাপাশি অনিয়মিত ঋতুস্রাবের মত জটিল সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আমেরিকার সেন্টার ফর ইয়ং ওমেনস হেল্থ রিসার্চ এর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে, মেয়েদের শরীরে এই হরমোনের পরিমাণ প্রয়োজনের চাইতে বেশি হওয়ার সাথে সাথে তাদের শরীরে, বিশেষ করে মুখমন্ডলের অংশে অনেক বেশি পরিমাণে লোম বৃদ্ধি করে। যা মোটেও একজন নারীর কাম্য হতে পারে না।
পুরুষদেরও মেনোপস হয়:
আমার সবাই জানি মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি অতি স্বাভাবিক একটি ঘটনা, যার সম্মুখীন তাদেরকে প্রায় প্রতি মাসেই হতে হয়। এ সময় তাদের পুরুষ সঙ্গী তাদের যথেষ্ট সমর্থন এবং সহযোগিতা করে করে থাকে। কিন্তু মজার ব্যপারটি হচ্ছে যে, অধিকাংশ পুরুষই জানেন না যে, এই ধরনের একটি ঘটনা তাদের সাথেও ঘটে। এটিকে অ্যান্ড্রোপজ বা মেল মনোপস বলা হয়ে থাকে।
একজন পুরুষের বয়স মোটামুটি চল্লিশ এর কাছাকাছি পৌছানোর পর পরই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে তাদেরেেক ওজনজনিত বিভিন্ন সমস্যা, উদ্দীপনার ঘাটতি এবং বিভিন্ন ধরনের যৌন সমস্যার সম্মুখীন হতে দেখা যায়।
এই একই ঘটনার ধারাবাহিকতায় সত্তর বছর বয়সের পর পুরুষদের মধ্যে স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়ার মত সমস্যা দেখা দিতে থাকে। যদিও এর চিকিৎসার জন্য টেস্টোসটেরন প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে, তথাপি এর মাধ্যমে কাঙ্খিত ফলাফর অর্জণ করা সব সময়, বলতে গেলে অধিকাংশ সময়ই সম্ভব হয় না।
একটু লক্ষ্য করে দেখুন তো, আপনার স্বামী কি তার কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে? বয়স ৫০ পার হওয়ার পর পরই তিনি কি প্রায় সময়ই বিভিন্ন কাজে বিরক্ত হয়ে উঠছেন বা পৃথিবী ভ্রমণের জন্য স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করতে চাইছেন? যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে হয়তো এটিই উপযুক্ত সময় তাকে হরমোন টেষ্ট করতে পরামর্শ দেওয়ার।
পুরুষদের হরমোন জনিত পরিবর্তনের লক্ষণ:
একজন পুরুষের শরীরে হরমোনের কারণে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটি নেতিবাচক পরিবর্তণ।
হরমোনগত পরিবর্তনের কারণে পুরুষদের মধ্যে অবসাদ ও ক্লান্তি বেড়ে যায়। যদিও সব ক্ষেত্রে অবসাদের জন্য হরমোনকে দায়ী করা যায় না। দীর্ঘসময় কাজের মধ্যে থাকার ফলে অবসাদ বা ক্লান্তি আসতেই পারে। তবে যদি সেটি অস্বাভাবিক হয়, তাহলে সেটির জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হরমোনই দায়ী।
- পুরুষেরা যদিও মেয়েদের মত নিজেদের সৌন্দর্য নিয়ে বেশি ভাবেন না। তবুও আপনি যদি লক্ষ্য করেন যে, আপনার পুরুষ সঙ্গীটির ত্বকে অনাকাঙ্খিতভাবে ব্রণের আবির্ভাব হয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবে সেটি নিরাময় হচ্ছে না, তাহলে ধরে নিতে পারেন যে আপনার পুরুষ সঙ্গীর শরীরে উচ্চমাত্রায় টেস্টোসটেরন রয়েছে।
- পুরুষদের শরীরে পশম বা লোম থেকেই থাকে। কিন্তু সেটি যদি যেখানে সেখানে উঠতে শুরু করে তবে তা অবশ্যই চিন্তার বিষয়। এটির জন্যের আগের মতই টেস্টোসটেরন দায়ী।
- ধরে নিন আপনার পুরুষসঙ্গী ঘুমিয়ে আছেন, হঠাৎ করেই তার ঘুম ভেঙে গেল এবং আপনি লক্ষ্য করলেন যে, পাখা চলা স্বত্বেও তিনি যথেষ্ট পরিমাণে ঘামছেন। গ্রীষ্মকালে যদিও এ ধরনের ঘটনা স্বাভাবিক। কিন্তু সেটি যদি বছরের অন্যান্য সময়েও অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে বুঝে নিন আপনার সঙ্গীর শরীরে ইস্ট্রোজেনের অভাব দেখা দিতে শুরু করেছে।
পুরুষের হরমোন এবং সে সংক্রান্ত বহু সমস্যা আমাদের অনেকেরই অজানা নয়। কিন্তু জানার পরেও কেন জানি আমরা এসব বিষয়ে খুব বেশি একটা গুরুত্ব দেই না। হরমোনগত পরিবর্তনের কারণে আমারে মধ্যে যে সমস্যাগুলি দেখা দেয়, তাকে আর দশটা রোগ বালাইয়ের সমতুল্য করে দেখার মতো মন মানসিকতার অভাব এখনও অনেকের মধ্যেই দেখা যায়। ফলে দিনের পর দিন পুরুষ শরীরের হরমোনের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বা কমে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন রোগে বা সমস্যায় ভুগতে থাকে।
একজন নারী হিসেবে আপনার উচিত আপনার পুরুষ সঙ্গীর আচার ব্যবহার এবং তার চলাফেরার প্রতি লক্ষ্য রাখা। যদি সে হরমোন ঘটিত কোন সমস্যার মুখোমুখি হয়, তাহলে তার প্রভাব সমানভাবে আপনার জীবনেও দেখা দেবে। তাই এমন কিছু ঘটলে যত দ্রুত সম্ভব আপনার পুরুষ সঙ্গীকে নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
Leave a Reply