পাঠ্য বইয়ের ভেতর লুকিয়ে কিংবা প্রথম রাতে ঘুমের ভান ধরে গভীর রাতে উঠে গিয়ে আলো-আঁধারীতে নিষিদ্ধ প্রেমের উপন্যাস পড়েছেন যারা, তারা জানেন এর কি আকর্ষণ! আসলে, জীবনে এমন একটা সময় থাকে যখন সিদ্ধ বা নিষিদ্ধ কোনকিছুরই ধার ধারতে মন চায় না, প্রেমের গল্প বা উপন্যাস হলেই হলো!
প্রেমের গল্প কে না পছন্দ করে! ব্যস্ত-সমস্ত পৃথিবীতে সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দুটি মানুষের মধ্যে ভালবাসার গল্প সবাইকে রোমাঞ্চিত করে। কিন্তু জাতি, ধর্ম, বর্ণ ভেদে এই ভালবাসা যদি নিষিদ্ধ হয়, তখন সে মানুষ দুটির একত্রিত হওয়ার বিষয়টি চমকপ্রদ একটা আবহের জন্ম দেয়। তাই, পাঠকদের আবেগের খোরাক জোগিয়ে বিশ্ব সাহিত্যে নিষিদ্ধ প্রেমের উপন্যাস বহু যুগ আগে থেকে স্বতন্ত্র অবস্থান ধরে রেখেছে।
‘ভালবাসা কোন সীমারেখা বা বাধা মেনে চলে না’ মুলত এই বিষয়টিকে উপজীব্য করেই বেড়ে উঠতে থাকে গল্পগুলো। সে অনুসারে মুল চরিত্রগুলোর আমৃত্যু প্রচেষ্টা, চড়াই-উৎরাইয়ের চিত্তাকর্ষক ঘটনাগুলো চূড়ান্ত পাঠক প্রিয়তা ধরে রাখে। এই পোস্টটিতে আপনি এ ধরণের ৭টি উপন্যাসের ব্যাপারে জানতে পারবেন যেগুলো বিশ্ব জুড়ে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছে।
বিশ্বের বিখ্যাত ৭টি নিষিদ্ধ প্রেমের উপন্যাস
আগের লেখায় বাংলাদেশের নিষিদ্ধ ১৫টি বই সম্পর্কে যারা জেনেছেন, তাদের কৌতুহলের মাত্রা নিশ্চয়ই ছাড়িয়ে গিয়েছে আন্তর্জাতিক সাহিত্যাঙ্গনে। তাই, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত এমন কিছু নিষিদ্ধ প্রেমের গল্প বা উপন্যাস নিয়ে আজকের আয়োজন যা পাঠক মনের সুপ্ত খোরাক যোগাবে। আসুন, নিষিদ্ধ বইগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক-
১/ ভ্লাদিমির নাবোকোভ-এর লোলিতা (১৯৫৫)
সাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত নিষিদ্ধ প্রেমের উপন্যাস- লোলিতা। ১২ বছরের সৎ মেয়ে ডোলোরেস হেজ-এর প্রতি প্রায় চল্লিশ বছর বয়স্ক সাহিত্যের প্রফেসর হাম্বার্ট-এর প্রেমকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে লোলিতার কাহিনী।
লোলিতার যাত্রা শুরু হয়েছিলো প্যারিসের গুপ্ত সাহিত্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টির মাধ্যমে। শিশুদের প্রতি যৌন নিপীড়নের দৃষ্টিভঙ্গি বিশদভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য বিতর্ক সৃষ্টির পাশাপাশি রীতিমত এক রকম বিপ্লব ঘটিয়েছিলো তৎকালীন সময়ে। টানা দুই বছর নিষেধাজ্ঞা জারি ছিলো বইটির উপর।
গভীরভাবে অপ্রীতিকর বিষয়টি ব্যতিরেকে নাবোকোভের শক্তিশালী গদ্যরচনা উপন্যাসটিকে মাত্রাতিরিক্তভাবে পাঠযোগ্য করে তুলেছিলো। লোলিতার সম্পাদক বিঃশ্বাস করেন যে, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য হুমকি এবং নৈতিক শিক্ষার প্রতীক- লোলিতা।
প্রথাগত রীতি বিবর্জিত পরিচালক স্ট্যানলি কুব্রিক ১৯৬২ সালে সর্বপ্রথম লোলিতাকে টিভি দর্শকদের সামনে নিয়ে আসেন। ফলশ্রুতিতে নাবোকোভ তার চিত্রনাট্যের কারণে অস্কার পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হন।
২/ গুস্তাভ ফ্লোবার্ট-এর মাদাম বোভারি (১৮৫৭)
মধ্যবৃত্ত শ্রেণীর এমা বোভারি তার গতানুগতিক দাম্পত্য জীবন থেকে মুক্তি পেতে বহু শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। শুধু এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে উপন্যাসটির কাহিনী নির্মিত হলেও ফ্লোবার্টের সৃজনশীল নৈপুণ্যে অভূতপূর্বভাবে ফুটে উঠে বোভারি চরিত্রটির উত্থান-পতন। আর এই কারণেই গুস্তাভের প্রথম উপন্যাসটিকে সবচেয়ে শক্তিশালী লেখনী হিসেবে বিবেচনা করা হয় মাদাম বোভারি-কে।
ব্যভিচারের কাহিনীর জন্য অভিযুক্ত হলেও ১৮৫৭ সালে প্যারিসে সর্ব প্রথম এর মুক্তি মেলে। দুই খণ্ডে প্রকাশিত মাদাম বোভারি সে বছর সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ে পরিণত হয়। পরবর্তীতে এর-ই রূপরেখায় তৈরী হয় শত শত রোমান্টিক উপন্যাস। শুধু তাই নয়, নাট্য ও সিনেমার জগতেও গল্পটি ব্যাপক জায়গা করে নেয়।
বিবিসি থেকে প্রথম টিভি সিনেমা হয় ১৯৬৪ সালে যার চিত্রনাট্য লেখেন জাইল্স কুপার। ভারতে ১৯৯৩ সালে কেতান মেহতা মায়া মেমসাব সিনেমা নির্মাণের মাধ্যমে মাদাম বোভারির দৃশ্যায়ন করেন।
৩/ ডি. এইচ. লরেন্স-এর লেডি চ্যাটার্লি’স লাভার (১৯৬০)
গল্পটা লেডি চ্যাটার্লি আর ম্যালোর্স-এর মধ্যে বেড়ে ওঠা পরকীয়া সম্পর্কের। লেডি চ্যাটার্লির স্বামী একজন বৃটিশ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা স্যার ক্লিফোর্ড চ্যাটার্লি আর ম্যালোর তার-ই অধীনস্থ একজন শ্রমিক শ্রেণীর কর্মচারী। স্যার ক্লিফোর্ড বেশ সম্পদশালী ও সুদর্শন হলেও ১ম বিশ্বযুদ্ধে আহত হয়ে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় অক্ষম স্বামীর প্রতি কর্তব্য এবং অনুপযুক্ত প্রেমিকের প্রতি আকর্ষণের মাঝে হতাশাগ্রস্ত লেডি চ্যাটার্লির অভিব্যক্তিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
পরকীয়া সম্পর্কের উপর রচিত উপন্যাসটি প্রকাশের জন্য পেঙ্গুইন বুক্স ১৯৫৯ এর অশ্লীল প্রকাশনা ধারায় অভিযুক্ত হয়েছিলো। মামলার রায়ে শেষমেষ বেকসুর খালাস পাওয়ায় প্রথম বারের মত ১৯৬০ সালে যুক্তরাজ্য জুড়ে উপন্যাসটি পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এমনকি প্রথম দিনেই বইটি খুব ভালো পরিমাণে বিক্রি হয়।
৪/ চার্ল্স ওয়েব-এর দ্যা গ্রাজুয়েট (১৯৬৩)
ধরাবাধা ক্যারিয়ারের পেছন ছোটা আর বন্ধু-আড্ডা-পার্টি; শুধুমাত্র এ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে রাজি নয় বেঞ্জামিন ব্র্যাডক। জীবনের ব্যতিক্রম মানে খুঁজতে যেয়ে প্রেমে পড়ে যায় বাবার বান্ধবী বায়োজ্যেষ্ঠ মিসেস রবিনসনের। মিসেস রবিনসন একদিকে যেমন বেশ আবেদনময়ী মহিলা, আরেক দিকে একজন রক্ষণশীল মা। দৃশ্যপট আরো জটিল হতে শুরু করে ঠিক যখন তার মেয়ে ইলেইন এসে দাড়ায় বেঞ্জামিনের সামনে।
এটি ছিলো প্রচলিত রীতি-নীতি বিরোধী লেখক চার্লস ওয়েবের প্রথম উপন্যাস, যেখানে তিনি নিজের কলেজ জীবনকে নির্লিপ্ত বিদ্রূপাত্মক ভঙ্গিতে প্রকাশ করেছেন। উপন্যাসটির কাহিনী নিয়ে ১৯৬৭ সালে নির্মিত একই শিরোনামের সিনেমাটি বেশ সফলতা লাভ করে। পরবর্তীতে বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় গল্পটি মঞ্চায়িত হয় বিভিন্ন ভাষায়।
৫/ জিনেট উইন্টারসন-এর অরেন্জেস আর নট দ্যা অনলি ফ্রুট (১৯৮৫)
গল্পের মুল চরিত্র চার্চে আশ্রিতা জিনেট নামের একজন তরুণী। এখানে ১৯৬০ এর দশকের মিশনারী সম্প্রদায়ের এক্সর্সিজম চর্চা এবং দুটো নারীর মধ্যে গড়ে ওঠা প্রণয়ের সম্পর্কের বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতাগুলো উঠে এসেছে। জিনেটের বয়ঃসন্ধিকালের ভেতর দিয়ে ভালবাসার শক্তির অনুসন্ধান এবং ধর্মীয় কৌতূহলের এক অভিনব পরিস্ফুটন ঘটেছে বইটিতে।
১৯৮৫ সালে প্রথম প্রকাশিত এই উপন্যাসটির মাধ্যমে উইন্টারসনের আংশিক-আত্মজীবনী লেখনীর সূচনা ঘটে।
নিরীক্ষামুলক এই বইটির জন্য উইন্টারসন হোয়াইটব্রেড ফার্স্ট নোভেল অ্যাওয়ার্ড পান। গল্পটির উপর ১৯৯০ সালে একটি বিবিসি সিরিজও নির্মাণ হয়। আটটি চ্যাপ্টারের এই বিশদ উপন্যাসটি ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের একাডেমিক ডিগ্রী জিসিএসই এবং এ-লেভেল এ অন্তর্ভুক্ত হয়।
৬/ আয়ান ম্যাক-ইওয়ান-এর অ্যাটোনমেন্ট (২০০১)
২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, যৌন হয়রানির মিথ্যে দায়ে দোষী সাব্যস্ত এবং আর্থ-সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য উপেক্ষা করে দুই মানব-মানবীর প্রেম; সব মিলিয়ে চিত্তাকর্ষক এক উপন্যাস আয়ান ম্যাক-ইওয়ান-এর অ্যাটোনমেন্ট। অপরিণত বয়সে সম্ভ্রান্ত পরিবারের সিসিলিয়া আর তাদের-ই গৃহপরিচারকের ছেলে রবির মধ্যে গড়ে ওঠে গভীর ভালবাসার সম্পর্ক। একটি মিথ্যে প্রণোদোনায় তাদের মাঝে ব্যবধান সৃষ্টি হওয়ার পর বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে আবার তাদের দেখা হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়।
সমালোচক এবং পাঠক; উভয় মহলেই বেশ ভালভাবেই সমাদৃত হয়েছিলো সুদূরপ্রসারী কাহিনীটি। পরিণতিতে ২০০১ সালে ফিকশন ক্যাটেগরিতে বুকার অ্যাওয়ার্ডের জন্য এটি তালিকাভুক্ত হয় এবং হোয়াইটব্রেড নোবেল অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয়। ২০০২ সালে ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক্স সার্কেল এবং বুকে পুরষ্কার লাভ করে।
শুধু তাই নয়, ২০০৭ সালে চার অংশের দীর্ঘ এই উপন্যাসটির উপর নির্মিত চলচ্চিত্র অ্যাটোনমেন্ট বাফটা এবং অস্কার পুরষ্কার জিতে নেয়।
৭/ ওরহ্যান পেমুক-এর দ্যা মিউজিয়াম অফ ইনোসেন্স (২০০৯)
এটি ধর্ণাঢ্য এক ব্যক্তির নিম্নবিত্ত এক নারীর প্রতি জীবনভর ঘোরের গল্প, যাকে সে যৌবনে ভালবেসে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলো। প্রেক্ষাপটটা ছিলো ১৯৭৫ এবং ১৯৮৪ এর মধ্যবর্তী সময়। পেমুক-এর এই নতুন কথাসাহিত্যটি রোমান্টিক আসক্তির প্রকৃতি নিরীক্ষণের ভেতর দিয়ে এক কল্পিত নগরীকে জীবন্ত করে তুলেছিলো।
নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী এই উপন্যাসটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো তুর্কী ভাষায়। প্রথিতযশা সংবাদপত্র ফিনেন্সিয়াল টাইম্স একে লোলিতা, মাদাম বোভারি এবং অ্যানা ক্যারেনিনা-এর মত কালজয়ী উপন্যাসগুলোর সমতুল্য বিবেচনা করেছিলো।
বইটিতে বর্ণিত যাদুঘরের আদলে পেমুক ইস্তাম্বুলে একটি যাদুঘর নির্মাণ করেন, যার উদ্বোধন হয় ২০১২ সালের এপ্রিলে। এটি মুলত উপন্যাসে উল্লেখিত দশকের সংস্কৃতি ও নিত্য দিনকার জীবনের শৈল্পিক সংগ্রহশালা।
নতুনত্ব ও ব্যতিক্রম ধারণার মেলবন্ধনের চাহিদার কারণে কালক্রমে রূপ বদলেছে নিষিদ্ধ প্রেমের উপন্যাসগুলোর। মিশ্র সংস্কৃতিতে এই কাহিনীগুলো কী রকম প্রভাব ফেলেছে বা ভবিষ্যতে ফেলতে পারে সে ব্যাপারে পাঠকদের সুচিন্তিত মতামত সময়ের দাবী। তাই, লেখাটি সোশ্যাল মিডিয়াতে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে আপনার অভিমত ব্যক্ত করতে পারেন। আর এ ধরণের যুগান্তকারী ও বিতর্কিত সাহিত্য সমগ্রের ব্যাপারে আরো জানতে চাইলে কমেন্ট বক্সে লিখে আমাদের জানাতে পারেন।
Leave a Reply