মশা কি আর মশা কিভাবে কামড়ায় তা আমাদের প্রায় সকলেরই জানা। আর ডেঙ্গু মশা যে কত ভয়ঙ্কর তা আমরা সবাই খুব ভাল করেই জানি। সারা বছরই মশার অত্যাচারে অস্থির থাকলেও বর্ষা এলে এই বিপদ যেন বেড়ে যায় হাজারগুণে। কারণ ডেঙ্গু মশার ডিম পাড়ার জন্য উপযুক্ত জায়গা হল বদ্ধ পানি। বর্ষা আসার সাথে সাথে যার পরিমাণ বাড়ে।
মশার ডিম যদিও খালি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু প্রতিবার রক্ত খাওয়ার পর একটি স্ত্রী মশা ১০০ থেকে ২০০টি ডিম পাড়ে। এমনকি, এডিস মশার ডিম শুকনো অবস্থায় বহুদিন টিকে থাকে, পানির স্পর্শ পেলেই আবার ফুটে যায়। এ কারণেই বৃষ্টি হলে মশার সংখ্যা বাড়ে।
ডেঙ্গু রোগ বহনকারী মশা কিন্তু শুধু পানিতে ডিম পাড়ে না। এরা ডিম পাড়ে স্যাঁতস্যাঁতে জায়গাতেও, যা খুব সহজে পানিতে ভরে যেতে পারে। পানিতে ভরে গেলেই ডিম ফুটে লার্ভা জন্মায়। খুব বেশি পরিমাণে পানিও কিন্তু লাগে না মশার ডিম ফুটতে। এমন কি প্লাস্টিকের প্যাকেটের মধ্যে জমে থাকা এক চিলতে পানিও হয়ে উঠতে পারে ভয়াবহ মৃত্যুফাঁদ।
বদ্ধ পানিতে এই লার্ভাগুলো আস্তে আস্তে বড় হয়ে আরও নতুন ভয়াবহ রক্তখেকো মশার জন্ম দেয়। আর ছড়িয়ে দিতে থাকে ডেঙ্গুর মত প্রাণঘাতী রোগ যা মশার কামড় থেকে যে ১০টি রোগ হয় তার মাঝে অন্যতম। এভাবেই চলতে থাকে এই প্রক্রিয়া। আর এই বিপদ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হল যতভাবে সম্ভব মশার ডিম ও লার্ভা ধ্বংস করে দেয়া।
ডেঙ্গু মশার ডিম ধংসের পাঁচটি সহজ উপায়
ডেঙ্গু মশার লার্ভা মারার সবচেয়ে ভাল সময় কিন্তু বর্ষা কাল। কারণ, শুকনোর সময় এই মশার ডিম কোথায় লুকিয়ে থাকবে আপনি টেরও পাবেন না। কথায় বলে, প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর, ডেঙ্গু মশা মারার চেয়ে ডেঙ্গু মশার ডিম ধ্বংস করা সহজ।
কিছু সাধারণ ঘরোয়া জিনিস ব্যবহার করে আপনি আপনার বাড়ির আশেপাশে জমে থাকা পানি থেকে মশার লার্ভা ধ্বংস করে এডিস মশার বিস্তার রুখতে পারেন।
ডেঙ্গু মশার ডিম জন্মানো প্রতিরোধ করুন
সবার আগে ডেঙ্গু মশার জন্মস্থানটি ধ্বংস করুন। বাড়ির আশে-পাশে বালতি, গামলা, ফুলের টব, এগুলোতে জমা পানি ঢেলে ফেলুন। ডাবের খোসা, পানির বোতল, প্লাস্টিকের প্যাকেট, ছেঁড়া জুতো, খেলনা পাতি এগুলো সব পরিষ্কার করে ফেলুন। কারণ এগুলো থেকেই পানি জমে ডেঙ্গু মশার বংশবিস্তার হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বড় বড় পাত্রে জমে থাকা পানি আপনি সহজেই খেয়াল করতে পারবেন। কিন্তু এসব ছোটখাট জিনিস আপনার চোখ এড়িয়ে যাবে।
মোটকথা, পানি জমে থাকতে পারে এমন সবকিছু পরিষ্কার করে ফেলুন, হয় নিরাপদ কোন জায়গায় ফেলুন, নয়তো শুকনো স্থানে তুলে রাখুন। ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে ফেলুন। সবরকম আবর্জনা সরিয়ে যত পরিষ্কার থাকতে পারবেন, আপনার এলাকায় ডেঙ্গু মশার অত্যাচার ততই কমবে।
তাই বলে ডেঙ্গু মশার ভয়ে আপনার প্রিয় দামী গাছ ফেলে দেয়ার প্রয়োজন নেই। বাগান পরিষ্কার করে রাখাই যথেষ্ট। আপনার যদি জলজ গাছ থাকে, তাহলে সেই গাছের পানি নিয়মিত বদলে ফেলুন। পানির মধ্যে মানিপ্ল্যান্ট জাতীয় গাছ বা ফুল রাখলেও একইভাবে পানি নিয়মিত বদলে দিন।
বড় পাত্রে যদি পানি ধরে রাখা দরকারী হয়, তবে পাত্রটি ঢেকে রাখুন। পাতলা একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখলেই মশা আর সেটিতে ডিম পাড়তে পারবে না। বাইরে থাকলে সূক্ষ্ণ নেট দিয়ে ডেকে রাখতে পারেন।
ড্রেন যাতে না আটকায় সে খেয়াল রাখুন। যতক্ষ্ণ ড্রেন বইছে ততক্ষ্ণ সমস্যা নেই, আটকে গেলেই সে পানিতে ডেঙ্গু মশা জন্মাতে পারবে।
একুয়ারিয়াম বা পুকুরের পানিতে মাছ থাকলে ভয় নেই, কারণ মাছ সাধারণত মশার ডিম খেয়ে ফেলে।
সরাসরি ডিম ধ্বংস করুন
কখনো কখনো হয়তো সব জমা পানি খালি করা বা নিয়ম করে বদলানো সম্ভব হতে না-ও পারে। কিন্তু তাই বলে তো মশার বংশকে বাড়তে দেয়া যায় না। তাহলে কি করবেন?
হ্যাঁ, কিছু উপায় আছে বই কি। সাধারণ কিছু গৃহস্থালী জিনিস ব্যবহার করেই আপনি ডেঙ্গু মশার ডিম মেরে আপনার আশেপাশের পরিবেশকে নিরাপদ রাখতে পারেন।
- তেল
হয়তো লক্ষ্য করেছেন পানির উপরে তেল ঢাললে হালকা একটা আস্তরণ পড়ে? এই আস্তরণের কারণেই মশা ডিম পাড়তে পারে না। শুধু তাই নয়, আগে থেকে পাড়া ডিম ও লার্ভা এই তেলের আস্তরণে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়।
তেল দিয়ে ডেঙ্গু মশার ডিম মারতে প্রাকৃতিক তেল, যেমন সয়াবিন বা পাম তেল ব্যাবহার করুন। ১ গ্যালন পানির জন্য এক চা চামচ তেলই যথেষ্ট। পুকুরে মাছ থাকলে এই পদ্ধতি ব্যবহার করবেন না। কারণ এতে মাছের ক্ষতি হতে পারে।
- আপেল সিডার ভিনিগার
ঘরোয়া চিকিৎসা বা প্রসাধনীর কাজে আপেল সিডার ভিনিগারের ব্যবহার আমরা অনেকেই করে থাকি। কিন্তু যা অঙ্কেই জানি না তা হল এই ভিনিগারের মধ্যে থাকা এসিড যে কোন মশার ডিম ও লার্ভা মেরে ফেলতে পারে মাত্র ১৮ ঘণ্টার মধ্যেই। ৮৫ ভাগ পানির মধ্যে ১৫ ভাগ আপেল সিডার ভিনিগার মেশালেই কাজ হবে। প্রয়োজনে বেশি ব্যবহার করলেও অসুবিধা নেই। মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর জন্য একটুও ক্ষতিকর নয় এটি।
প্রয়োজনে একে মশা তাড়ানোর কাজে (মসকুইটো রিপেলেন্ট) হিসেবেও ব্যবহার করতে পারেন। এর এক মাত্র অসুবিধাজনক দিকটি হল এর গন্ধ। কাজেই যতটুকু সম্ভব খোলা জায়গায় এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ রাখবেন।
- লিকুইড সাবান
ঘরে ব্যবহারের জন্য আপনার নিশ্চয়ই লিকুইড ডিশ সোপ আছে? থাকলে সামান্য একটু নিয়ে ছড়িয়ে দিন পানিতে। ডিশ সোপ না থাকলে সামান্য একটু শ্যাম্পু পানিতে গুলিয়ে নিতে পারেন। এক গ্যালন পানিতে মাত্র এক মিলি লিটার সাবানই যথষ্ট। এই পদ্ধতি আপনি বাগানেও ব্যবহার করতে পারেন। যেমন আপনার জলজ গাছ বা ফুলদানিকে রক্ষা করতে। সামান্য একটু সাবানে বেশিরভাগ গাছেরই কোন ক্ষতি হয় না। তবে একটু সেনসিটিভ প্রজাতির গাছে এই পদ্ধতি ব্যবহার করবেন না।
- ব্লিচ
ঘর পরিষ্কারের কাজে ব্যবহৃত ব্লিচ দিয়েও পানিতে জন্মানো মশার লার্ভা ধ্বংস করা যায়। ব্যবহারের আগে মনে রাখতে হবে ব্লিচ কিন্তু একটা খুবই বিষাক্ত পদার্থ, যা পরিবেশ এবং প্রাণিজগতের বিরাট ক্ষতি করতে পারে। একমাত্র আর কোন পথ খোলা না থাকলেই শুধু এই রাস্তাটি ধরবেন। নালা নরদমার নোংরা পানি পরিষ্কার করতেই শুধু এই পদ্ধতি ব্যবহার করা উচিত। বয়ে যাওয়া পানি যা খাবার পানির সাথে মিশে যাওয়ার আশঙ্কা আছে সেখানে ব্লিচ ব্যবহার ভুলেও ব্যবহার করবেন না।
পরিশেষে, ডেঙ্গু মশার ডিম ও লার্ভা ধ্বংস করার পাশাপাশি মশার কামড় খাওয়া থেকেও খুব সাবধান থাকা উচিত। এর কারণ শুধু ডেঙ্গু রোগ এড়ানোই নয়। পেট ভরে রক্ত না খেলে এডিস মশা ভালভাবে ডিম পাড়তে পারে না। যত বেশি রক্ত খাবে তারা ততই ডিম পাড়বে। তাই ডেঙ্গু মশার জন্মস্থান ধবংসের পাশাপাশি সতর্ক হয়ে মশার কামড় এড়িয়ে চলা উচিৎ।
Leave a Reply