পৃথিবীর যে কোন দেশেই ব্যবসা করার জন্য অনুমতি গ্রহণ করতে হয়। বেশিরভাগ দেশেই এই অনুমতিপত্র ট্রেড লাইসেন্স নামে পরিচিত। ব্যবসার জন্যে ট্রেড লাইন্সেস একটি অনিবার্য উপাদান। এটি ছাড়া ব্যবসা পরিচালনা করলে তা যে কোন সময় অবৈধ হিসাবে পরিগণিত হতে পারে।
অনেকেই জানেন কিভাবে ছোট ব্যবসা করে ধনী হওয়া যায়। ব্যবসা ছোট হোক আর বড় হোক, আপনি পৃথিবীর যে দেশেই ব্যবসা করতে ইচ্ছুক আপনাকে ঐ দেশের সরকার কর্তৃক নিযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে বাধ্যতামূলকভাবে ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এদেশে এখন পর্যন্ত ২৯৪টি ক্যাটাগরীতে মোট ১০৮৪ ধরনের ট্রেড লাইসেন্স প্রচলিত রয়েছে।
একেক ধরনের লাইসেন্স গ্রহণ করতে একেক ধরনের ফি প্রদান করতে হয়। আবার জেলা বা বিভাগীয় ভিত্তিতে এ ফি’এর কিছুটা তারতম্য দেখা দেয়। তাই ট্রেড লাইসেন্স করার পূর্বে যাবতীয় তথ্য অবশ্যই জেনে নেওয়া উচিত।
ট্রেড লাইসেন্স কি?
ট্রেড লাইসেন্স হচ্ছে ট্রেড করার অনুমতি পত্র যা একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসা করার জন্যে আইনগত অনুমোদন প্রদান করে থাকে। এটি সরকার কিংবা সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট সংস্থার দেয়া একটি লিগ্যাল ডকুমেন্ট যা যে কোন ব্যবসার বিভিন্ন কার্যকলাপ পরিচালনার জন্যে আইনগত বাধা দূর করে থাকে।
ট্রেড লাইসেন্স কেন প্রয়োজন?
অনেকের কাছেই ব্যবসা করার অনেক আইডিয়া রয়েছে, হোক সেটা অনলাইন বা অফলাইন। যেমন, হৈচৈ বাংলায় প্রকাশিত মেয়েদের জন্যে কিছু ব্যতিক্রমী ব্যবসা আইডিয়া থেকে কেউ কেউ ব্যবসা শুরু করেছেন এবং সফলও হয়েছেন। কিন্তু, ব্যবসার জন্যে কেন ট্রেড লাইসেন্স প্রয়োজন সেটা সবারই জানা দরকার।
বৈধভাবে ব্যবসায়িক কার্য্যক্রম পরিচালনার জন্যে ট্রেড লাইসেন্স প্রয়োজন- ব্যবসা করার জন্যে দেশের যে আইন-কানুন রয়েছে, তাতে কি কি করা যাবে আর কি কি করা যাবে না, সে-সব বিষয়ে সবিশেষ বিবরণ রয়েছে। ট্রেড লাইসেন্স ব্যবসার বৈধতা অর্থাৎ বিধি-নিষেধ মানার নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। ট্রেড লাইসেন্স না থাকলে আপনার ব্যবসাটি বা ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানটি সরকারের কাছে অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার জন্যে ট্রেড লাইসেন্স প্রয়োজন- আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট দিয়ে ব্যবসায়ীক লেন-দেন করা যায় না। বিশেষত, অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আপনার সাথে পার্সোনাল অ্যাকাউন্টে লেন-দেন করবে না। তাই, আপনার দরকার বিজনেস অ্যাকাউন্ট। আর ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া কোনও ব্যাংকই আপনাকে বিজনেস অ্যাকাউন্ট খুলতে দেবে না।
ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লোন বা পুুঁজি সংগ্রহের জন্যে ট্রেড লাইসেন্স প্রয়োজন- ভালভাবে ব্যবসা করার জন্যে, এমনকি ব্যবসাকে বড় করার জন্যে আপনার অধিক পুঁজির প্রয়োজন হবে। আর আপনি নিজে সেই বাড়তি পুঁজির যোগান দিতে সক্ষম নাও হতে পারেন। কাজেই, আপনাকে হয় কোন ব্যাংক থেকে কিংবা কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লোন নিতে হবে। আর ব্যাংক কিংবা প্রতিষ্ঠান, কোনটিই আপনাকে লোন দেবে না, যদি আপনি ট্রেড লাইসেন্স জমা দিতে না পারেন্
অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের জন্যে ট্রেড লাইসেন্সের প্রয়োজন- ব্যবসা করতে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক হবে। বিশেষ করে, ব্যবসায়ীক সম্পর্ক। সম্পর্কের খাতিরে অন্যদের সঙ্গে আপনার নতুন নতুন ব্যবসা তৈরি হবে। আর নানা রকম ব্যবসার জন্যে আপনাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। কিন্তু ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া আপনি কোনও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই চুক্তি করতে পারবেন না।
কিভাবে ট্রেড লাইন্সেস করবেন?
আমাদের দেশের যুব সমাজের মধ্যে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এদেশে প্রতিয়িনতই নিত্য নতুন প্রতিষ্ঠান আত্মপ্রকাশ করছে। আর প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্যেই ট্রেড লাইসেন্স বা ব্যবসার অনুমতি পত্র করতে হচ্ছে।
২০০৯ সালে সিটি কর্পোরেশন (কর) বিধি এর মাধ্যমে ট্রেড লাইসেন্স প্রদানের প্রচলন শুরু করা হয়েছিল। একজন উদ্যোক্তা তার ব্যবসা পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করে থাকে। আবেদনের সাথে তাকে বেশ কিছু সহায়াক কাগজপত্রও দাখিল করতে হয়। কর্তৃপক্ষ এগুলি যাচাইপূর্বক কোন ধরনের সমস্যা না থাকলে আবেদনকারীর নামে হস্তাস্তর অযোগ্য ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করে থাকে।
যেখান থেকে গ্রহণ করবেন:
আপনি যদি ঢাকার বাসিন্দা হয়ে থাকেন, তাহলে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন বরাবর আবেদন করে ট্রেড লাইসেন্স নিতে পারবেন। তবে, এলাকার উত্তর ভিত্তি করে ট্রেড লাইসেন্স সংক্রান্ত কাজের জন্য সিটি কর্পোরশনগুলি বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত হয়েছে। আপনি যে এলাকায় ব্যবসা করেন সেই অঞ্চলের অফিস থেকেই আপনাকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে।
এছাড়া যারা জেলা শহরগুলিতে বসবাস করেন, তারা তাদের পৌরসভা অফিসে আর যারা গ্রামে বসবাস করেন, তারা ইউনিয়ন পরিষদে নির্ধারিত ফরম পূরনের মাধ্যমে লাইসেন্স নিতে পারবেন।
ট্রেড লাইসেন্সের জন্যে প্রথমে আবেদন করতে হবে। আর আবেদনের জন্যে রয়েছে নির্ধারিত আবেদন পত্র যা আপনাকে নির্ভুলভাবে পূরণ করে জমা দিতে হবে। আবেদন পত্রে দুইটা অংশ রয়েছে। একটা আপনাকে পূরণ করতে হবে আর অন্যটা সংশ্লিষ্ট অফিস পূরণ করবে। ট্রেড লাইসেন্স এর আবেদন ফরম ডাউনলোড করতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন।
আবেদন করতে যে যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন:
- আপনার বয়স ১৮ বছর বা তার চাইতে বেশি হতে হবে।
- নারী পুরুষ উভয়েই আবেদন করতে পারবেন।
- আপনার অবশ্যই একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকতে হবে।
ক্যাটাগরী নির্বাচন:
ট্রেড লাইসেন্স নেওয়ার জন্য আপনাকে ব্যবসার ক্যাটাগরী নির্বাচন করতে হবে। আপনি যদি কোনভাবে ভুল ক্যাটাগরী নির্বাচন করেন, তবে তা পরবর্তীতে আপনার ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রেই সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
২০১৬ সালের গেজেট অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার সকল সিটি কর্পোরেশনসহ পৌরসভা ও ইউনিয়নের জন্য মোট ২৯৪ টি ক্যাটাগরীতে ট্রেড লাইসেন্স প্রদানের অনুমতি প্রদান করেছেন। সঠিকভাবে ফরমে ক্যাটাগরী নির্বাচন করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র:
ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণের জন্য ব্যবসা ভেদে বিভিন্ন ধরনের কাগজ পত্র প্রয়োজন হয়ে থাকে। কোন একটি দিতে ব্যর্থ হলে ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করা হয় না। চলুন, জেনে নেওয়া যাক কোন ধরনের ব্যবসার জন্য কি কি কাগজ প্রযোজ্য-
- সাধারণ ব্যবসার জন্য ট্রেড লাইসেন্স: বিভিন্ন দোকান বা সাধারণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য এ ধরনের ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করা হয়। এর জন্য দোকান ঘর বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেখানে অবস্থিত সেখানকার ভাড়ার রশিদ অথবা ভাড়ার চুক্তিপত্রের সত্যায়িত কপি, মালিকের জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি জমা দিতে হয়। এছাড়া হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের রশিদের কপিও জমা দেওয়া প্রয়োজন হয়।
- শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্যে ট্রেড লাইসেন্স: আপনার প্রতিষ্ঠানটি যদি কোন পণ্য উৎপাদনকারী ব্যাবসার সাথে সম্পৃক্ত থাকে, তাহলে আপনাকে শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে। এই লাইসেন্স নেওয়ার জন্য উপরে বর্ণিত কাগজপত্রসহ পরিবেশ অনাপত্তি পত্র, প্রতিষ্ঠানের অবস্থান চিহ্নিত করার জন্য মানচিত্র, ফায়ার লাইসেন্স এর কপি এবং এবং নির্ধারিত ফরম্যাটে অঙ্গীকারনামা এবং ২ কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি জমা দিতে হবে।
- ক্লিনিক অথবা ব্যক্তিগত হাসপাতালের ট্রেড লাইসেন্স: হাসপাতাল ও ক্লিনিকের জন্য ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রথম পয়েন্টে বর্ণিত কাগজপত্রের সাথে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অনুমতি পত্র প্রদান করা বাধ্যতামূলক।
- লিমিটেড কোম্পানির ট্রেড লাইসেন্স: আপনার প্রতিষ্ঠানটি যদি আরজেএসসি অনুমোদিত লিমিটেড কোম্পানী হয়ে থাকে, তাহলে প্রথম পয়েন্টে বর্ণিত কাগজপত্রের সাথে ইনকর্পোরেশন সার্টিফিকেট, মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেল, ইত্যাদি জমা দিতে হবে।
- অন্যান্য ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স: এছাড়া ছাপাখানা ও আবাসিক হোটেলের ক্ষেত্রে ডেপুটি কমিশনার কর্তৃক ইস্যুকৃত অনুমতি পত্র, রিক্রুটিং এজেন্সির ক্ষেত্রে মানবসম্পদ রপ্তানি ব্যুরো কর্তৃক প্রদত্ত লাইসেন্সের কপি, অস্ত্র ও গোলাবারুদের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অস্ত্রের বাজারজাত করনের লাইসেন্স, ঔষধ ও মাদকদ্রব্যের ক্ষেত্রে ঔধষ প্রশাসন কর্তৃক ইস্যুকৃত ড্রাগ লাইসেন্সের কপি এবং ট্রাভেলিং এজেন্সির ক্ষেত্রে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের অনুমতি পত্রের কপি প্রয়োজন হয়ে থাকে।
এছাড়াও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিবিধ কাগজপত্রের প্রয়োজন হয়। ট্রেড লাইসেন্সের নিয়মাবলিসহ অন্যান্য সকল বিষয় জানতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ওয়েবসাইট ভিজিট করুন।
ট্রেড লাইসেন্স এর আবেদনে কোন ধরনের মিথ্যা বা অসত্য তথ্য দিলে, কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করলে এবং ট্রেড লাইসেন্স সম্পর্কিত আইন কানুন মেনে না চললে যে কোন সময় কর্তৃপক্ষ উক্ত লাইসেন্স বাতিল করাসহ লাইসেন্সধারীর বিরুদ্ধে যে কোন ধরনের আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করার অধিকার সংরক্ষণ করেন। যদিও এ ধরনের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের পূর্বে লাইসেন্সধারীকে আত্মপক্ষ সমর্থন করে কারণ দর্শানোর সুযোগ দেওয়া হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে এমন অনেক উদ্যোক্তা রয়েছেন যারা ব্যবসার জন্যে ট্রেড লাইন্সেস গ্রহণ না করেই ব্যবসায়ীক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছেন। এর সংখ্যাটা খুব বেশি না হলেও এটি করা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও বেআইনী। এ ধরনের কর্মকান্ড সরকারের দৃষ্টিগোচর হলে জেল জরিমানা হতে পারে। কাজেই, ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা শুরু করে থাকলে, এখনই লাইসেন্স করে নিন।
আর যারা নতুন ব্যবসার জন্যে আইডিয়া খুঁজছেন, তারা কসমেটিক ব্যবসা শুরু করতে পারেন। এটি নতুন আইডিয়া না হলেও অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। কাজেই, জেনে নিন কিভাবে কসমেটিক ব্যবসা শুরু করবেন। আর শুরু করার আগে ব্যবসার জন্যে একটি সুন্দর নাম ঠিক করুন এবং ট্রেড লাইসেন্স করে নিন।
Leave a Reply