আমাদের সকলেরই চুল পাকার কারণ জেনে রাখা দরকার। বর্তমান আধুনিক লাইফ স্টাইলে তরুণ-তরুণীদের সবচেয়ে বড় সমস্যা অল্প বয়সে চুল পেকে যাওয়া। এর কারণ জানা থাকলে শুরু থেকেই সচেতন হয়ে চুল পাকা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে, বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সে চুল পাকা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এমন অনেকেই আছেন যাদের বৃদ্ধ হওয়ার আগেই ভিমরি খাওয়ার অবস্থা হয়, যখন দেখা যায় যে চুল পেকে সাদা হয়ে যাচ্ছে।
যদিও পাকা চুল কালো করার কিছু প্রাকৃতিক উপায় রয়েছে, তবু বিশ থেকে ত্রিশের ভেতর থাকা তরুণ বা তরুণীদের চুল পাকাটা সত্যিই খুব হতাশাজনক। আর এই হতাশা সৃষ্টি হয় যখন সমবয়সী অন্যদের কালো আর ঝলমলে চুল চোখে পড়ে।
মানুষের শরীরে লক্ষ লক্ষ হেয়ার ফলিকল রয়েছে। মূলত, এই ফলিকলগুলিই আমাদের মাথায় চুল তৈরি করে, চুলের রং-এ ভূমিকা রাখে। এমনকি, এটি ত্বকে, বিশেষ করে মাথার ত্বকে পিগমেন্ট সেল জেনারেট করে যাকে মেলানিন বা মেলানোসাইট নামে অভিহিত করা হয়।
মূলত মাথার ত্বকে থাকা ফলিকলে এই পিগমেন্টের অভাবই চুল পাকার মূল কারণ। চুলে যখন পিগমেন্ট কমতে থাকে, তখন চুল বাদামী রং ধারণ করে। আর যখন একেবারেই পিগমেন্ট থাকে না, তখন চুল সম্পূর্ণ পেকে যায়।
কিন্তু এই পিগমেন্টের অভাব দেখা দেয় কেন আর কেনইবা এটি চুল পাকিয়ে ফেলে, এটি একটি বিরাট বিস্ময়। আসুন, এই বিস্ময় সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক। অর্থাৎ, চুল কেন পাকে সে সম্পর্কে সব ধরণের সম্ভাব্য কারণগুলো ঘেঁটে দেখা যাক।
চুল পাকার কারণ
১. ভিটামিনের অভাবে চুল পাকে
ভিটামিন বি৬, বি১২, বায়োটিন, ভিটামিন ডি কিংবা ভিটামিন ই এর অভাব দেখা দিলে অল্প বয়সে চুল পাকার সম্ভাবণা রয়েছে। এর মাঝে ভিটামিন ডি-৩, ভিটামিন বি১২ এবং কুফার এর অভাবই চুল পাকায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে বলে জানিয়েছে মেডিকেল সায়েন্স। কেননা, ভিটামিন বা পুষ্টির অভাব চুলের পিগমেন্টেশনে প্রভাব ফেলে।
ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ট্রিকোলোজি বা আইজেটি এর এক রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে যে, বিশেষ কিছু ভিটামিনের অভাবে ২৫ বছরের নিচে অনেক যুবকের চুল পেকে যায়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, আমাদের শরীরে সিরাম ফেরিটিন নামক যে উপাদানটি আয়রন জমা করে এবং প্রয়োজনের সময় সাপ্লাই দেয়, সেটির মাত্রা যখন কমে যায়, তখন চুল পাকা শুরু হয়। সেই সাথে, ভিটামিন বি-১২ আর ভাল কোলেস্টরেল (HDL-C) এর অভাবও অল্প বয়সে অনেকের চুল পাকায় প্রচন্ড ভূমিকা রাখে।
সুতরাং, চুল পাকা প্রতিরোধে যে-সব ভিটামিন গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, সেগুলো হলো-
- ভিটামিন বি-৬
- ভিটামিন বি-১২
- ভিটামিন ডি
- ভিটামিন ই – জেনে নিন যেসব খাবারে সবচেয়ে বেশি ভিটামিন ই পাওয়া যায়।
- কুপার
- আয়রন
- এইচডিএল-সি
২. জেনেটিক কারণে চুল পাকে
অনেকের ক্ষেত্রেই অল্প বয়সে চুল বাদামী বা সাদা হয়ে যাওয়ার পেছনের প্রধান কারণ জেনেটিক। সুতরাং, আপনার ক্ষেত্রে খোঁজ নিয়ে দেখুন যে আপনার বাবা-মা বা দাদী-দাদীর মধ্যে কারো না কারো আর্লি অ্যাজে চুল পাকার সমস্যা ছিল।
ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ডার্মাটোলোজি, ভেনেরোলোজি এবং ল্যাপ্রোলোজি (IJDVL) এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী, তরুণ-তরুণীদের চুল পেকে যাওয়ার প্রধান কারণ জেনেটিক্সের সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ, রক্তের সম্পর্ক থাকা পূর্ব পূরুষদের কম বয়সে চুল পাকার কারণে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও সেই সমস্যা দেখা দেবে।
নোট: জেনেটিক অবস্থা আপনি কখনোই পরিবর্তণ করতে পারবেন না। তবে, চুল রং করে আপনি আপনার পাকা চুলের একটা অস্থায়ী সমাধান করতে পারেন।
৩. মানসিক চাপে চুল পাকে
প্রায় প্রতিটি মানুষই কখনো না কখনো, কোন না কোন মানসিক চাপে ভুগে থাকেন। সচরাচর মানুষ যেসব কারণে মানসিক চাপে পড়ে, সেগুলোর সঙ্গে জড়িত কিছু বিষয় হলো-
- ঘুমের সমস্যা
- উদ্বিগ্নতা
- খাদ্যাভ্যাশের পরিবর্তণ
- উচ্চ রক্তচাপ, ইত্যাদি।
Nature-এ প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে জানা যায়, চুল পাকার সঙ্গে স্ট্রেস বা মানসিক চাপ প্রবলভাবে জড়িত। স্ট্রেস এবং হেয়ার ফলিকলের পতন বা হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থাকলে ক্রমাগত চুল পাকবে। যখন ফ্রি রেডিকেলস-এ ড্যামেজ প্রতিরোধের জন্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট না থাকে, তখন অক্সিডেটিভ স্ট্রেস ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে।
ফ্রি রেডিকেলস আনস্টেইবল অনু যা সেলগুলোকে ড্যামেজ করে দেয়, বুড়িয়ে যাওয়াসহ আরো কিছু রোগের সৃষ্টি করে। অক্সিডেটিভ স্ট্রেস Vitiligo নামের একটা স্কিন পিগমেন্ট কন্ডিশন তৈরি করে যা চুল পাকার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
৪. অটো-ইমিউন ডিজিজ চুল পাকায়
শরীরের ইমিউন সিস্টেম যখন অটোমেটিক কিছু কাজ করা শুরু করে, মেডিকেলের ভাষায় যেটাকে ডিজঅর্ডার বলে, তখন শরীরের স্বাস্থ্যকর কিছু টিস্যু ক্ষতিগ্রস্থ্য হয়। ভুল বশত এই ইমিউন সিস্টেম যখন শরীরে অটো আঘাত হানে তখনই শরীরে কিছু রোগ সৃষ্টি হয় যেগুলোকে অটো-ইমিউন ডিজিজ বলে।
প্রায় ৮০ ধরণেরও বেশি অটো-ইমিউন ডিজঅর্ডার রয়েছে। আর মেডিকেল সায়েন্স দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, এসব ডিজঅর্ডার বা অযাচিত রোগ চুল পাকার অন্যতম কারণ। ইমিউন সিস্টেম যখন নিজ শরীরের সেলগুলোর উপর আক্রমণ চালায়, তখন যে রোগগুলো দেখা দেয়, সেগুলোর মাঝে alopecia এবং vitiligo চুলের পিগমেন্ট নষ্ট করে। যার ফলে, অকালে চুল পাকে।
৫. হরমোনের ভারসাম্যহীনতায় চুল পাকে
মানব দেহে যখন হরমোনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়, কিংবা হরমোনাল পরিবর্তণ দেখা দেয়, তখন থাইরয়েড ডিজঅর্ডার হয়। এই অবস্থাকে হাইপারথাইরোডিজম কিংবা হাইপোথাইরোডিজম বলে। এই রকম অবস্থাও চুল পাকার জন্যে দায়ী।
আমরা জানি, থাইরয়েড হচ্ছে প্রজাপতি আকৃতির গ্ল্যান্ড বা গ্রন্থি যা আমাদের ঘাড়ের গোড়ায় অবস্থিত। এটি মেটাবোলিজম বা বিপাকের মতো অনেক শারীরিক প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। মেডিকেল সায়েন্স বলছে, থাইরয়েডের স্বাস্থ্য চুলের রংকেও প্রভাবিত করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই থাইরয়েড অল্প বয়সে চুল পাকিয়ে ফেলে।
৬. চুলে কেমিক্যালের ব্যবহার পাক ধরায়
চুলে নিশ্চয়ই কেউ সরাসরি কেমিক্যাল ব্যবহার করে না। কিন্তু চুলের সৌন্দর্য্য বাড়াতে কিংবা খুশকি জাতীয় বিভিন্ন জিনিস তাড়াতে আমরা যেসব শ্যাম্পু বা সাবান ব্যবহার করি, সেগুলোর সাথে নানা ধরণের ক্ষতিকর কেমিক্যাল মেশানো থাকে। আর অনেক সময় এসব কেমিক্যালের কারণে চুল পেকে যায়।
চুলে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রসাধনীতে থাকা কেমিক্যাল প্রথমে মাথার ত্বকে অ্যালার্জিক ইনফেকশন তৈরি করে। পরবর্তীতে সেগুলো চুলের পিগমেন্ট নষ্ট করতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে কাল চুলকে সাদায় রূপান্তর করতে ভূমিকা রাখে।
৭. হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড চুল পাকার কারণ
চুলের ফলিকলগুলো অল্প পরিমাণে হাইড্রোজেন পারক্সাইড তৈরি করে যা চুলের শ্যাফটে অতিরিক্ত সময় জমে থাকে। এটি চুলে ব্লিচ করে এবং চুলকে ধূসর করে তোলে যা ক্রমান্বয়ে পাকতে শুরু করে।
৮. ধূমপানের কারণে চুল পাকে
বিভিন্ন মেডিকেল স্টাডি থেকে জানা গিয়েছে যে, ধূমপান প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে অল্প বয়সী তরুণ-তরুণীদের চুল পাকার একটি মেজর কারণ। ধূমপানের কারণে চুলের ফলিকলে মেলানিন উৎপাদনকারী নিউরাল ক্রেস্ট, মেলানোসাইটের ক্ষতি করে। ফলে, সেখানে অক্সিজেন সেল ড্যামেজ হয়ে যায় এবং ওই অংশের চুল পাকতে শুরু করে।
লাষ্ট ওয়ার্ডস্
চুল পাকার কারণ জানলেন। এখন নিশ্চয়ই এর প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে মন চাইছে। জেনে রাখুন এটাকে রিভার্স করা বা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে, আশার কথা যে পাকা চুল প্রতিরোধের উপায় আছে। তার আগে জানতে হবে আপনার ক্ষেত্রে চুল পাকার কোন কারণটি দায়ী। একজন ডার্মাটোলোজিস্টের পরামর্শ নিয়ে চুল পাকার সঠিক কারণটি আগে খুঁজে বের করুন। এরপর, সেই কারণের উপর নির্ভর করে চিকিৎসা নিন।
Leave a Reply