কাজ-কর্ম যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতার জন্যে জীবনে অনেক ক্রেডিট নিয়েছেন বা অন্যদের নিতে দেখেছেন। কিন্তু এটি সেই ক্রেডিট নয় যা দ্বারা আপনার ভাব প্রকাশ পাবে। এই ক্রেডিট মানে বাকী। আর এই বাকীর কার্ডের নাম ক্রেডিট কার্ড।
ক্রেডিট কার্ডকে একটি পোস্ট পেইড সিম হিসেবে ভাবতে পারেন। পোস্ট পেইড সিমে আপনি সারা মাস খরচ করতে থাকবেন, যত খুশি তত কথা বলবেন বা আচ্ছা মতো ইন্টারনেট ইউজ করবেন, আর মাস শেষ বিল দেবেন। ক্রেডিট কার্ডও তেমনি, যত খুশি তত কেনা-কাটা, বিল-পে, কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে যেমন খুশি তেমন খরচ আর একটা নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ।
আপনি যদি জানেন ডেবিট কার্ড কি আর কিভাবে কাজ করে, তবে ক্রেডিট কার্ডের সঙ্গে পার্থক্যটা ধরতে পারবেন। একটা হচ্ছে আপনার যা আছে তাই খরচ করা আর অন্যটা হচ্ছে আপনার কাছে ক্যাশ থাক আর না থাক, একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত ইচ্ছে মতো খরচ করা। আসুন, বাকীর বাবা এই ক্রেডিট কার্ড সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানা যাক।
ক্রেডিট কার্ড কি?
ক্রেডিট কার্ড হচ্ছে গ্রাহকদের প্রতি ব্যাংক কিংবা অন্য যে কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দ্বারা ইস্যুকৃত একটা প্লাস্টিক কার্ড। এর আরেক নাম পেমেন্ট কার্ড। এটি দিয়ে মোটামুটি সব ধরণের পেমেন্ট দেয়া যায়। আর এই পেমেন্টটা দেয়া হয় মূলত ব্যাংকের ফান্ড থেকে যা গ্রাহক মূলত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের কাছ থেকে ধার হিসেবে পেয়ে থাকেন। তবে, এই ধারটা গ্রাহককে আবার শোধ করে দিতে হয়।
ক্রেডিট কার্ড হোল্ডারকে এই ধার নেয়া এবং শোধ করার ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। এইসব শর্তের মধ্যে অ্যাপ্লিকেবল ইন্টারেস্ট, অতিরিক্ত চার্জ, মাসিক কিংবা টাইম ওয়াইজ বিলিং ডেট, ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় থাকে। গ্রাহক যদি কখনো এই সব শর্তের কোনটি ভঙ্গ করেন, তবে তার ক্রেডিট কার্ড পেনাল্টি খেয়ে থাকে।
ক্রেডিট কার্ডের কনসেপ্ট কার?
পৃথিবীতে প্রথম ক্রেডিট কার্ডের ধারণা দেন অ্যামেরিকান লেখক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিধ এডওয়ার্ড বেলামি। তিনি তার ইউটোপিয়ান উপন্যাস “Looking Backward”-এ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের কনসেপ্ট নিয়ে কথা বলেন।
তবে, তার কনসেপ্ট ছিল মূলত নাগরিকদের জন্যে। দেশের যে কোনও নাগরিক সরকারের কাছ থেকে লোন নিয়ে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে খরচ করবে আর একটা সময় সেটা শোধ করে দেবে। যতদূর জানা যায় এডওয়ার্ড বেলামির এই কনসেপ্টকে কাজে লাগিয়েই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেডিট কার্ড নিয়ে আসে।
তবে, ১৯৫৮ সালের আগ পর্যন্ত ক্রেডিট কার্ডের এই ফিনান্সিয়াল সিস্টেমটি কেউ ডেভেলপ করতে পারেনি। এর আগে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানই এই প্রচেষ্টা চালিয়েছে কিন্তু সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৮ সালে Bank of America প্রথমবারের মতো ফ্রেসনো এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় ক্রেডিট সিস্টেম ডেভেলপ করতে সক্ষম হয় যার নাম দেয়া হয়েছিল BankAmericard আর এটিই ছিল পৃথিবীর প্রথম মডার্ন ক্রেডিট কার্ড।
ক্রেডিট কার্ড কারা পায়?
চাইলেই যে কেউ ক্রেডিট কার্ড পেতে পারে না, এর জন্যে এলিজিবিলিটি লাগে। সাধারণত তারাই ক্রেডিট কার্ড পায় যাদের একটা স্টিডি ইনকাম সোর্স রয়েছে। সেটা হোক চাকরি থেকে বেতনের মাধ্যমে কিংবা ব্যবসা থেকে আয়ের মাধ্যমে। আয়ের পাশাপাশি আপনি যে ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে চান, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সে ব্যাংকে আপনার অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে।
ক্রেডিট কার্ড পেতে কি কি লাগে?
বাংলাদেশের যে কোনও ব্যাংক কিংবা ফিনান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রেডিট কার্ড পেতে হলে নিম্নোক্ত জিনিসগুলো লাগে।
- জাতীয় পরিচয় পত্র।
- টিন সার্টিফিকেট।
- চাকরিজীবির ক্ষেত্রে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার কিংবা স্যালারি সার্টিফিকেট এবং ৩ মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট।
- ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্স, Memorandum of Association এবং ৩ মাসের ব্যাংক ট্রানজেকশন স্টেটমেন্ট।
এছাড়াও যে ব্যাংক থেকে গ্রাহক ক্রেডিট কার্ড নিতে চান, সে ব্যাংকের পলিসি অনুযায়ী আরো কিছু অতিরিক্ত কাগজ-পত্র জমা দিতে হতে পারে।
ক্রেডিট লিমিট কি?
যদিও ক্রেডিট কার্ড দিয়ে আপনি ক্রেডিটে কেনা-কাটা করতে পারেন, কিন্তু তার একটা রেঞ্জ আছে। আর এই রেঞ্জকেই ক্রেডিট লিমিট বলে। অর্থাৎ, ক্রেডিটে খরচ করার জন্যে ব্যাংকের পক্ষ থেকে আপনার জন্যে যে লিমিট নির্ধারণ করে দেয়া হয়, সেটাই ক্রেডিট লিমিট।
আপনি কিছুতেই এই লিমিটের বেশি খরচ করতে পারবেন না। তবে, একবার লিমিট শেষ হয়ে যাওয়ার পর যদি আপনি সেটা শোধ করে দেন, তবে আবার নতুন করে লিমিট পাবেন। এই ক্রেডিট লিমিট মূলত গ্রাহকের আর্থিক অবস্থা, অবস্থান ও লেন-দেনের উপর নির্ভর করে।
একজন সাধারণ চাকরিজীবির জন্যে যে লিমিট নির্ধারণ করা হয়, একজন ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে সেটা ভিন্ন। কারণ, উভয়ের আর্থিক অবস্থা এক নয়। আর এই অবস্থার উপর নির্ভর করেই একজনের সর্বোচ্চ খরচের লিমিটেশন নির্ধারণ করা হয়। চাকরিজীবির ক্ষেত্রে তার মাসিক বেতনের পরিমাণ আর ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে তার ট্রানজেকশনের পরিমাণের উপর ভিত্তি করেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রাহকের ক্রেডিট লিমিট ঠিক করা হয়ে থাকে।
ক্রেডিট লিমিট আরো বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন-
- ক্রেডিট লাইন
- লাইন অব ক্রেডিট
- স্পেন্ডিং লিমিট
কোন ব্যাংকের ক্রেডিট লিমিট কত?
ক্রেডিট লিমিট নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। কারণ, ব্যাংক পলিসি অনুযায়ী একেক ব্যাংকের লিমিট একেক রকম। তাছাড়া, একটা ব্যাংকের কয়েক ধরণের ক্রেডিট কার্ড থাকে আর কার্ডের ধরণ অনুযায়ীও লিমিট নির্ধারিত হয়ে থাকে। তবে, বিভিন্ন ব্যাংকের মাঝে একটা কমোন লিমিট হচ্ছে-
- ১০ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা।
- ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা।
- ৫ লাখ টাকা থেকে ৫০ লক্ষ টাকা।
কোন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের ফি কত?
এটাও নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। কারণ, একেকটা ব্যাংকের বাৎসরিক ফি এর পরিমাণ একেক রকম। অন্যদিকে কার্ডের ধরণ অনুযায়ীও ফি এর পরিমাণের পরিবর্তণ হয়ে থাকে। তবে, মোটামুটি একটা কমোন ফি হচ্ছে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা।
কোন ব্যাংকের কি কি ক্রেডিট কার্ড আছে?
গ্রাহকদের সুবিধার জন্যে বাংলাদেশের প্রায় সব ব্যাংকেরই ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। তার মাঝে বেশিরভাগ ব্যাংকের একাধিক কার্ড রয়েছে। গ্রাহকদের প্রয়োজনীতা আর ব্যাংকের পলিসি অনুযায়ী প্রতিটি ব্যাংকই ভিন্ন ভিন্ন ক্রেডিট কার্ড দিয়ে থাকে। আসুন, কয়েকটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড সম্পর্কে জানা যাক।
ব্র্যাক ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড সমূহ-
- ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড।
- গোল্ড ক্রেডিট কার্ড।
- ক্লাসিক ক্রেডিট কার্ড।
- সিগনেচার ক্রেডিট কার্ড।
- প্ল্যাটিনাম ক্রেডিট কার্ড।
ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড সমূহ-
- ভিসা গোল্ড ক্রেডিট কার্ড।
- ভিসা গোল্ড ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট কার্ড।
- ভিসা প্লাটিনাম ক্রেডিট কার্ড।
- ভিসা ক্লাসিক লোকাল ক্রেডিট কার্ড।
- ভিসা ক্লাসিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট কার্ড।
- মাস্টার কার্ড ক্লাসিক লোকাল ক্রেডিট কার্ড।
স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড সমূহ-
- ভিসা সিগনেচার ক্রেডিট কার্ড।
- ভিসা সিলভার ক্লাসিক ক্রেডিট কার্ড।
- প্লাটিনাম ভিসা/ মাস্টার কার্ড ক্রেডিট কার্ড।
- স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড গ্রামিনফোন ক্রেডিট কার্ড।
- সুপার ভেল্যু টাইটানিয়াম ক্রেডিট কার্ড।
- গোল্ড ভিসা/ মাস্টার ক্রার্ড ক্রেডিট কার্ড।
সিটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড সমূহ-
- সিটি আলো অ্যামেরিকান এক্সপ্রেস ক্রেডিট কার্ড।
- অ্যামেরিকান এক্সপ্রেস গ্রীণ ব্লু ক্রেডিট কার্ড।
- অ্যামেরিকান এক্সপ্রেস প্লাটিনাম ক্রেডিট কার্ড।
- অ্যামেরিকান এক্সপ্রেস গোল্ড ক্রেডিট কার্ড।
ইস্টার্ন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড সমূহ-
- ইবিএল ভিসা গোল্ড ক্রেডিট কার্ড।
- ইবিএল ভিসা ক্লাসিক ক্রেডিট কার্ড।
- ইবিএল ভিসা সিগনেচার লাইট ক্রেডিট কার্ড।
- ইবিএল ভিসা প্লাটিনাম ক্রেডিট কার্ড।
- ইবিএল ভিসা সিগনেচার আসসি-শিল্ড ক্রেডিট কার্ড।
- ইবিএল ভিসা উইমেন প্লাটিনাম ক্রেডিট কার্ড।
ক্রেডিট কার্ড নাম্বার কি?
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের পক্ষ থেকে গ্রাহককে যে প্রাইমারি নাম্বারটি দেয়া হয় সেটিই ক্রেডিট বা পেমেন্ট কার্ড নাম্বার। এটি মূলত একজন গ্রাহকের ইউনিক আইডেনটিফিকেশন নাম্বার যা দিয়ে গ্রাহকের কার্ড আইডেনটিফাই করা হয়। কিছু কিছু ক্রেডিট কার্ডের নাম্বার আর ব্যাংক কার্ডের নাম্বার একই হয়ে থাকে। এটি ব্যাংকের নথি বা সার্ভারে যেমন স্টোর করা থাকে, তেমনই থাকে গ্রাহককে দেয়া কার্ডের উপরে। এই নাম্বারটি সব সময়ই ১৬ ডিজিটের হয়।
ক্রেডিট কার্ড কিভাবে কাজ করে?
ছোট বা যে কোনও কেনা-কাটার মূল্য পরিশোধের জন্যে সাধারণত ক্রেডিট কার্ডটিকে একটি কার্ড রিডারের ভেতর ঢুকানো হয় যাতে এটি সিকিউরিটি চিপস্ রিড করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে কার্ড হোল্ডারকে বিলিং জিপ কোর্ড দিতে হয়। যখন পারচেসের জন্যে কার্ড সোয়াইপ করা হয়, তখন বিক্রেতার ক্রেডিট কার্ড টার্মিনাল ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানের টার্মিনালে নক করে দেখে নেয় কার্ডটি ভেলিড কিনা এবং যথেষ্ট পরিমাণে ক্রেডিট রয়েছে কিনা। যদি থাকে তো পারছেস হয়ে যায়, আর না থাকলে ডিনাই করে দেয়া হয়।
অনলাইন পারচেসের ক্ষেত্রে, গ্রাহককে তার কার্ড নাম্বার, এক্সপায়ার ডেট এবং সিকিউরিটি কোড দিতে হয়। সেই সাথে, নাম এবং বিলিং অ্যাড্রেসও দিতে হয়। যাবতীয় সব তথ্য দেয়ার পর, বিল পেয়িং বাটনে ক্লিক করলে অটোমেটেড সিস্টেম সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা কার্ড ইস্যু করা প্রতিষ্ঠানের সাভারে গিয়ে তথ্যের ভেলিডিটি এবং অর্থের পরিমাণ চেক করে নেয়। আর বিলটাও অটোমেটিক সিস্টেমেই ট্রান্সফার হয়ে যায়।
ক্রেডিট লাইন লিমিট কিভাবে কাজ করে?
প্রতিবার পারচেস কিংবা বিল পে করার পর, ক্রেডিট লাইন লিমিট থেকে অ্যামাউন্ট কমতে থাকে। যেমন, আপনার ক্রেডিট লিমিট যদি ৫০ হাজার হয়, আর আপনি যদি প্রথম পারচেসে ১৫ হাজার খরচ করেন, তবে আপনার কার্ডে ৩৫ হাজার ক্রেডিট থাকবে। এভাবে, আপনি যদ খরচ করবেন, তত কমতে থাকবে। এক পর্যায়ে যদি আপনি সব খরচ করে ফেলেন, তবে পরবর্তীতে আর পারচেস করতে পারবেন। কারণ, আপনার লিমিট শেষ, আর লিমিট ক্রস করার কোনও সুযোগই নেই।
আবার, আপনি যখন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যাংককে ক্রেডিট শোধ করে দেবেন, তবে আবার নতুন করে ৫০ হাজার টাকার লিমিট পাবেন। এই প্রক্রিয়াটাকেই ক্রেডিট লাইন লিমিট বলা হয়।
ক্রেডিট কার্ডের সুবধা সমূহ
ব্যাংকিং ব্যবস্থাপণার দুর্দান্ত সুবিধাজনক ব্যবস্থার নাম ক্রেডিট কার্ড। যার ফলে, সাধারণ গ্রাহক থেকে শুরু করে ছোট, বড় সব ব্যবসায়ীর কাছেই ক্রেডিট কার্ডের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। মূলত, বিশেষ কিছু সুবিধার জন্যেই এই জনপ্রিয়তা বা ব্যবহারের আধিক্য। আসুন, ক্রেডিট কার্ডের সেই সুবিধাগুলো জেনে নেয়া যাক-
নগদ অর্থ বহন থেকে নিরাপদ: নগদ অর্থের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে সবারই এবং সেটা প্রায় সব সময়ই দরকার হয়। কিন্তু পকেটে বা মানিব্যাগে অর্থ বহনটা আমাদের দেশে তেমন একটা নিরাপদ নয়। একদিকে, যেমন হারিয়ে যাওয়ার চান্স রয়েছে, অন্যদিকে পকেট মারিং বা চুরি হওয়ার ভয় রয়ছে। এই ভয়টা দূর করে দিচ্ছে ক্রেডিট কার্ড। কেননা, ক্রেডিট কার্ড থাকলে আর পকেটে টাকা নিয়ে ঘুরার প্রয়োজন হয় না। বরং, প্রয়োজনের মুহূর্তে কার্ড দিয়েই কাজ সেরে নেয়া যায়।
বলতে পারেন, কার্ড যদি হারিয়ে যায়, তখন!
হুম, তখনো আপনার অর্থ নিরাপদ। কারণ, কার্ডটি যে খুঁজে পাবে, সে কিছুতেই আপনার কার্ডে থাকা টাকা-পয়সা খরচ করতে পারবে না। যেহেতু, সে আপনার পিন নাম্বার জানে না, সেহেতু তার পক্ষে ট্রানজেকশন সম্ভব নয়। আর যদি কোনভাবে আপনার পিন নাম্বার জেনেও যায়, তবু আপনি আপনার কার্ডটিকে নিরাপদ রাখতে পারেন। জাস্ট ব্যাংকে একটা ফোন দিয়ে কার্ড লক করে দেবেন।
বাকীতে কেনা-কাটা: ক্রেডিট মানেই বাকী। সুতরাং, বুঝতেই পারছেন যে ক্রেডিট কার্ডের সবচেয়ে বড় সুবিধাই হচ্ছে বাকীতে ক্রয় করা। ধরুন, আপনার জরুরী একটা জিনিস কেনা প্রয়োজন, কিন্তু আপনার কাছে নগদ টাকা নেই; এক্ষেত্রে ক্রেডিট হতে পারে আপনার বন্ধু যে আপনাকে জিনিসটি কেনার জন্যে টাকা ধার দেবে।
আবার, এমনও হয় যে আপনি অনেক দিন ধরেই একটা বিশেষ জিনিস খুঁজছেন, কিন্তু কোথাও পাচ্ছেন না। একদিন কোনও একটা কাজে কোথাও গেলেন আর আপনার সেই বিশেষ বস্তুটি বিক্রি হতে দেখলেন। কিন্তু পকেটে টাকা না থাকার কারণে জিনিসটি কিনতে পারছেন। এক্ষেত্রে, পকেটে যদি ক্রেডিট কার্ড থাকে, তবে কোনও চিন্তা নেই, সঙ্গে সঙ্গে কিনে নিতে পারছেন।
চাকরিজীবিদের ক্ষেত্রে আরো একটা বড় সুবিধা হচ্ছে, তারা চাইলে কোনও দামী জিনিস একসঙ্গে কিনতে পারে না, যেহেতু বেতন লিমিটেড। কিন্তু ক্রেডিট কার্ড থাকলে তারা যে কোনও দামী আসবাব কিনতে পারেন আর কার্ডের মাধ্যমে আস্তে আস্তে ব্যাংককে সেটা শোধ করে দিতে পারেন। তবে, এক্ষেত্রে তাদের নির্ধারিত ডেটের দিকে খেয়াল রাখতে হয়।
সুদবিহীন ঋণ নেয়া যায়: অনেক ক্রেডিট কার্ডেই সুদবিহীন ঋণ সুবিধা রয়েছে। তবে, সেটা একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে। গ্রাহক যদি ওই নির্দিষ্ট করে দেয়া সময়ের মধ্যে ক্রেডিট শোধ করে দিতে পারেন, তবে আর বাড়তি টাকা বা সুদ দিতে হয় না।
এ-রকম জিরো পার্সেন্ট ইন্টারেস্টে বাইরের দেশের প্রায় সব ক্রেডিট কার্ড দিয়েই ঋণ নেয়া যায়। আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো এই শূন্য শতাংশ ঋণ সুবিধা এখনো ব্যাপকভাবে চালু না করলেও অনেক কার্ডেই সীমিত পরিসরে এই সুবিধা রয়েছে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে মূল্য ছাড় পাওয়া যায়: বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য বিক্রির জন্যে ক্রেডিট কার্ড পেমেন্টের ক্ষেত্রে ক্যাশ ব্যাক অফার দিয়ে থাকে। এই সমস্ত অফারের আওতায় কেনা-কাটা করলে আপনি যে টাকার পণ্য কিনবেন, সেই টাকা পে করার পর একটা অংশ ফেরত পাবেন। তার মানে, আপনি শুধু ব্যয়ই করছেন, সেই সাথে আয়ও করছেন। আর এই সুবিধাটি আপনি কেবল তখনই পাবেন যখন আপনার কার্ড রয়েছে এবং আপনি কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করছেন।
অনেক সময় ক্রেডিট কার্ড হোল্ডারদেরকে স্পেশাল ডিসকাউন্ট দেয়া হয়। যেমন, ধরা যাক একটা পণ্যের দাম পনের হাজার টাকা। কিন্তু স্পেশাল ডিসকাউন্টে ক্রেডিট কার্ড হোল্ডাররা সেটি কিনতে পারবেন চৌদ্দ হাজার টাকায় যা সাধারণ ক্রেতাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীরা আরো অনেক ছাড় ও সুবিধা পেয়ে থাকেন। যেমন, এয়ার টিকেটের ক্ষেত্রে মূল্য ছাড়, বড় আর আবাসিক হোটেলে থাকার ক্ষেত্রে ডিসকাউন্ট, ইত্যাদি।
রিওয়ার্ড পয়েন্ট অর্জণ করা যায়: ক্রেডিট কার্ডের একটা বড় সুবিধা হচ্ছে রিওয়ার্ড পয়েন্ট যা পরবর্তীতে অর্থে রূপান্তর করা যায় কিংবা পয়েন্ট দিয়ে পণ্য কেনা যায়। সাধারণত, কেনা-কাটার উপর ভিত্তি করে এই পয়েন্ট দেয়া হয়। আবার, অনেক সময় লেন-দেনের স্বচ্চতার জন্যে ব্যাংক কতৃপক্ষ খুশি হয়ে গ্রাহককে রিওয়ার্ড দিয়ে থাকে।
ক্রেডিট স্কোর বাড়ানো যায়: ক্রেডিট কার্ডের নিয়মিত ব্যবহার করা কিংবা ঘন ঘন কার্ড ব্যবহার করে কেনা-কাটা করলে ক্রেডিট স্কোর বাড়ে। আবার, সময় মতো ক্রেডিট বিল পরিশোধ করলেও স্কোর বাড়তে থাকে। আর এই স্কোর দিয়ে তখন ক্রেডিট লিমিট বাড়ানোসহ আরো অনেক সুবিধা ভোগ করা যায়।
কার্ড পরিবর্তণ করা যায়: উপরেই আলোচনা করেছি যে, একটা ব্যাংকের একাধিক ক্রেডিট কার্ড রয়েছে যেগুলোর প্রতিটিরই ভিন্ন ভিন্ন সুবিধা রয়েছে। আপনি একটি কার্ড নিয়েছেন বরে সারাজীবনই যে সেটি ব্যবহার করতে হবে এমন নয়। বরং, আপনার যদি কোন কারণে, হতে পারে ব্যায়ের আধিক্যের কারণে, সুদের হার বেশির কারণে কার্ডটি আপনার আর ভাল লাগছে না, তবে আপনি সেটি পরিবর্তণ করে অন্যটি নিতে পারবেন।
ক্রেডিট কার্ডের অসুবিধা সমূহ
ডেবিট বলেন, আর ক্রেডিট বলেন, সব কার্ডেরই সুবিধা যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে অসুবিধাও। কোনটির ক্ষেত্রে হয়তো কম, আর কোনটির ক্ষেত্রে বেশি। কিন্তু আমাদের সব সময়ই যে কোনও কিছু গ্রহণ করার আগে সেটির সুবিধা যেমন জানতে হবে, তেমনই জানতে হবে অসুবিধাও। আসুন, ক্রেডিট কার্ডের অসুবিধাগুলো জানা যাক-
ঋণের ফাঁদে পা: ক্রেডিট মানেই ঋণ। কাজেই, আপনি কার্ড ব্যবহার করছেন মানেই ঋণের ফাঁদে পা দিচ্ছেন যেখান থেকে কারো কারো পক্ষে পা সরানো কঠিন হয়ে যায়। যদিও আপনি ক্রেডিট কার্ড দিয়ে নিজের কাছে টাকা না থাকা সত্বেও প্রয়োজনীয় জিনিসটি কিনতে পারছেন, তবু আপনাকে সে টাকা পরিশোধ করতেই হচ্ছে। যদি ঠিক সময়ে পরিশোধ করা না হয়, তবে সুদে আসলে মিলে ঋণ আরো বাড়তে থাকে যেটাকে অনেকে মরণ ফাঁদ বলে থাকেন।
সুদের সাথে জড়ানো: আপনি কি কখনো ভেবেছেন আপনার ব্যাংক যে আপনাকে ক্রেডিটে ক্রয় করার সুযোগ দিচ্ছে, তাতে ব্যাংকের লাভ কি? হুম, মূল লাভই হচ্ছে সুদ। কাজেই, আপনি ক্রেডিট কার্ড ইউজ করা শুরু করলেন তো আপনি সুদের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন। আর আপনি যদি মুসলিম হয়ে থাকেন, তবে আপনার জেনে রাখা দরকার যে, কুরআন ও হাদিস উভয়টাতে আছে যে, যে সুদের সঙ্গে জড়ালো সে আল্লাহ্ ও তার রাসূলের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করলো। সুতরাং ভাই, মুসলিম হয়ে থাকলে আপনার কখনোই ক্রেডিট কার্ড নেয়া উচিৎ হবে না। কারণ, আল্লাহ্ এবং রাসূলের সঙ্গে যুদ্ধ করে আপনি কখনোই টিকতে পারবেন না। আপনার দুনিয়া এবং আখেরাত দুইটাই বরবাদ হয়ে যাবে।
অনিয়ন্ত্রিত ব্যয়: মানুষ যখন পকেট থেকে টাকা খরচ করে, তখন নানা রকম হিসেব নিকেশ করে। বিশেষ করে, পরবর্তী সময়ের কথা ভাবে। আজ সব খরচ করে ফেললে কাল কী করবো, এ-রকম ভাবনা তাকে পেয়ে বসে। তাই, সে চেষ্টা করে কম কম খরচ করতে। কিন্তু ক্রেডিট কার্ড থাকলে মানুষের মাথায় এ চিন্তাটা সচরাচর আসতে চায় না। যেহেতু, তাকে ক্যাশ দিতে হচ্ছে না, নিজের পকেট থেকে দিতে হচ্ছে না। কিন্তু পরে যে সে টাকা পকেট থেকেই যাবে, সে হিসেব আর মাথায় আসে না। ফলে, ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
বার্ষিক ফি বেশি: ডেবিট কার্ডের ক্ষেত্রে বার্ষিক ফি নেই বললেই চলে, শুধুমাত্র রক্ষণা-বেক্ষণ চার্জ হিসেবে বছরে ৫ থেকে ৬শ টাকা কেটে নেয়া হয়। কিন্তু ক্রেডিট কার্ডের একটা বাৎসরিক ফি রয়েছে এবং সেটা বেশ উচ্চ মূল্যের। বেশিরভাগ ব্যাংকের ক্ষেত্রেই মিনিমাম ১০ হাজার টাকা। কোনও কোনও ব্যাংকের বাৎসরিক চার্জ ২০ হাজার টাকারও বেশি।
এক্সট্রা ফি: বাৎসরিক ফি বাদেও ক্রেডিট কার্ডের আরো কিছু এক্সট্রা ফি রয়েছে। যেমন, ব্যালেন্স ট্রান্সফার ফি, লেট ফি, ওভারড্রাফট ফি, ট্রানজেকশনসহ আরো কিছু হিডেন ফি।
হিডেন ফি: ক্রেডিট কার্ডের এমন কিছু ফি রয়েছে যেগুলো হিডেন থাকে। অনেক সময় না জানা থাকার কারণে এইসব ফি দেখে গ্রাহকের মাথা খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু কিছু করার থাকে না। এইসব হিডেন ফি এর মধ্যে রয়েছে, ক্রেডিট লিমিট ক্রস করা, বিল পরিশোধের ডেট ওভার হয়ে যাওয়া, ইত্যাদি।
ক্রেডিট কার্ড দিয়ে গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট করে দেয়া একটা অ্যামাউন্ট পর্যন্ত টাকা দিয়ে বাকীতে কেনা-কাটা করতে পারে। এক্ষেত্রে, গ্রাহকের কেনা-কাটার মূল্য তার ব্যাংক বা ফিনানশিয়াল প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করে থাকে যা কার্ড পাঞ্চের মাধ্যমে বিক্রেতা গ্রহণ করে নেয়। এটা ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়ের জন্যেই ভাল বা প্রয়োজন। আধুনিক জীবন ব্যবস্থায় আমাদের ক্রেডিট কার্ডের প্রয়োজন হতেই পারে। কিন্তু, ক্রেডিট কার্ড কোন কোন কাজে ব্যবহার করা যায় আর কোন কোন কাজে যায় না, সেটা যেমন জানা থাকা দরকার, তেমনই এর প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য সব খরচ সম্পর্কেও জেনে রাখা দরকার।
Md Ruhan says
ধন্যবাদ, ক্রেডিট কার্ড সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম। ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা এবং অসুবিধাগুলো জেনে খুব ভাল লাগলো।
md yasin says
আসসালামু আলাইকুম। ক্রেডিট কার্ডের তথ্যগুলো খুব ভাল লাগলো, তবে আমার মনে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করাটা হালাল নয়।