আমরা সবাই কমবেশি ক্রিকেট খেলা দেখতে বা খেলতে অনেক ভালবাসি। ছোটবেলা থেকে অনেকেই স্বপ্ন দেখেন বড় হয়ে সে একজন নামকরা ক্রিকেটার হবেন। ক্রিকেটে আমরা কেউ কেউ ব্যাটসম্যান, উইকেটকিপার, পেস বোলার বা স্পিনার হতে চাই। তবে, আপনি যে ভূমিকাতেই ক্রিকেটার হতে চান না কেন, ফিল্ডিং সবাইকেই করতে হয়। আর তাই, একজন ভাল ফিল্ডার দলের জন্য অপরিহার্য।
ফিল্ডিংয়ের কথা চিন্তা করলে সবার আগে আমাদের যে নামটি আসে সে হল দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক ক্রিকেটার জন্টি রোডস। ক্রিকেটের ফিল্ডিংয়েকে যিনি অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন। তিনি যখন ফিল্ডিংয়ে দাঁড়াতেন, তখন তাঁকে ফাঁকি দিয়ে বল যেন কিছুতেই সীমানা পার হতে পারতো না। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘যেখানেই বল আসুক না কেন, আমি সেখানেই ওটা ধরতে চাইতাম।’
আর এজন্যই জন্টি রোডসকে সুপারম্যান, সুপার ফিল্ডার, ফ্লাইং বার্ড নামে অভিহিত করা হত। ক্রিকেটাররা সবার জন্যেই আইডল, তাদেরকে উঠতি ক্রিকেটারসহ সাধারণ মানুষরাও অনুসরণ করে থাকে। ৫ জন ক্রিকেটারের ৫টি ভাল গুণ যদি শিখে নেয়া যায়, তবে যে-কেউ জীবনে সফল হবে! সফল হবে ক্রিকেট মাঠেও।
একজন ভাল ক্রিকেটার হওয়ার পেছনে আপনাকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে ফিল্ডিংকে। তাহলে, হয়তো জন্টি রোডসের মত করে আপনিও হতে পারবেন একজন সুপার ফিল্ডার। তো, চলুন, ক্রিকেটে একজন ভাল ফিল্ডার হওয়ার জন্য বেশ কিছু উপায় রয়েছে, তার মধ্যে আজ আমরা গুরুত্বপূর্ণ ১০টি উপায় জেনে নিই।
ক্রিকেট ফিল্ডিংয়ে ভাল করার উপায়
এর আগে আমরা বিখ্যাত বোলারদের দেয়া ১০টি গুরুত্বপূর্ণ ফাস্ট বোলিং টিপস নিয়ে লিখেছিলাম যা আমাদের অনেক পাঠকই পছন্দ করেছে। এবার, আমাদের পাঠকদের জন্যে রয়েছে ফিল্ডিংয়ে ভাল করার টিপস্। আশা করি, যারা এই টিপস্গুলো আয়ত্ত করতে পারবেন, তারা ভাল ফিল্ডার হতে পারবেন। চলুন এবার, টিপস্গুলো দেখে নেয়া যাক-
- ১. বল করার সময়ে নিজের অবস্থান দৃঢ় রাখা
- ২. ক্যাচ ধরার মূহুর্তে নিজের হাতকে সঠিক পজিশনে রাখা
- ৩. বলের গতিবিধির দিকে সব সময় নজর দেওয়া
- ৪. বল বা ব্যাটসম্যানকে ঠিকমত দেখা যায় এমন পজিশনে আছেন কিনা তা নিশ্চিত করা
- ৫. সীমানার দিকে যাওয়া বলকে কুড়িয়ে আনার জন্য দলের অন্য ফিল্ডারের সহযোগিতা নেওয়া
- ৬. ফিল্ডিংয়ের জন্য নিজস্ব কিছু অনুশীলনের সরাঞ্জম ক্রয় করা
- ৭. ‘লং বেরিয়ার’ টেকনিক ব্যবহার
- ৮. লম্বা থ্রো করার জন্য মৌলিক কিছু টিপস আয়ত্ব করা
- ৯. ফিল্ডিংয়ের সময় নিজেকে শরীরকে সবসময় চাঙ্গা রাখা
- ১০. ফিল্ডিংয়ে নিজের যতটুকু সীমানা রয়েছে তা কভার করার বিষয়ে সতর্ক থাকা
১. বল করার সময়ে নিজের অবস্থান দৃঢ় রাখা
আপনি যেখানেই ফিল্ডিং করুন না কেন, আপনাকে সব সময় নিজের ফিল্ডিংয়ের অবস্থানে দৃঢ় থাকতে হবে। আপনি যদি ফিল্ডিংয়ের সময় বেশি হাঁটা-চলা করেন, তাহলে ব্যাটসম্যান যখন বলকে হিট করবে, তখন আপনার বলকে নিজের আয়ত্বের মধ্যে ধরতে না পারার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
আর বোলার যখন বল করতে প্রস্তুত হবে এবং আপনার ফিল্ডিং অবস্থান যদি ৩০ গজ বৃত্তের মধ্যে হয়ে থাকে, তাহলে আপনাকে ব্যাটসম্যানের দিকে কিছুটা ঝুঁকে থাকতে হবে। অর্থাৎ, নামাজের সময় আমরা যেমন রুকুতে যাই, অনেকটা সে রকমভাবে থাকতে হবে। তবে, রুকুতে যতটা আমরা ঝুঁকে থাকি, অতটা করা যাবে না। অর্থাৎ, আপনাকে কিছুটা ঝুঁকে থাকতে হবে এবং সেই সাথে আপনার হাত দুটো খোলা রাখতে হবে। যাতে বল ধরার সময় সহজেই বলকে নিজের হাতের মুঠোয় ধরতে পারেন।
২. ক্যাচ ধরার মূহুর্তে নিজের হাতকে সঠিক পজিশনে রাখা
আপনি ফিল্ডিংয়ে মাঠের যে অবস্থানেই দাড়ান না কেন, আপনার কাছে ক্যাচ বিভিন্ন অবস্থানে আসতে পারে। যেমন- অনেক উঁচুতে থাকা বল ক্যাচ ধরা। আপনার মাথা থেকে বুক পর্যন্ত উঠে আসা ক্যাচ ধরা। মাটি থেকে সামান্য উচ্চতায় ক্যাচ ধরা। বাম দিকে বা ডান দিকে লাফ দিয়ে ক্যাচ ধরা।
ক্যাচ ধরার মূহুর্তে আপনাকে আপনার নিজের হাত সঠিক অবস্থানে রাখতে হবে এবং আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে, হাতের মুঠো যেন ভেজা বা ঘাম না থাকে। আর এ জন্য, আপনাকে ফিল্ডিং করার মূহুর্তে একটি রুমাল দিয়ে বা প্যান্টে হাত বার বার মুছে নিতে হবে।
অনেক উঁচুতে থাকা বল ক্যাচ ধরার কিংবা বুক বরাবর কোন ক্যাচ ধরার জন্য দুটি উপায়ে ক্যাচ ধরা যায়। একটি হল রিভার্স কাপ পদ্ধতিতে এবং অন্যটি হল অর্থোডক্স কাপ পদ্ধতিতে।
রিভার্স কাপ পদ্ধতিতে ক্যাচ ধরা: উঁচুতে থাকা বল ক্যাচ ধরার সময় আপনাকে সবার আগে বলের পজিশন বুঝে এগিয়ে আসতে হবে। এরপর, আপনার দু’হাতের উপরি অংশ থাকবে আপনার মুখের দিকের কিছুটা সাইডে নিচের অংশে এবং দু’হাতের হাতের তালুর অংশ পাশাপাশি রাখতে হবে। নিচের ছবিটির মত করে আপনার দুটি বৃদ্ধাঙ্গুল একটি আরেকটির উপরে থাকবে, যাতে লম্বা ক্যাচ নেওয়ার সময় বলের গতির জেরে হাতের ফাঁক গলে ক্যাচ মিস না হয়।
অর্থোডক্স কাপ ক্যাচ পদ্ধতিতে ক্যাচ ধরা: এ পদ্ধতিতে উঁচু ক্যাচ ধরার জন্য আপনার দু’হাত অনেকটা আমাদের নামাজের সময় মোনাজাত যেভাবে ধরি ঠিক সে রকম করে হাতের পজিশন রাখতে হবে। নিচের ছবিটির দিকে খেয়াল করুন, ঠিক এরকম হাতের অবস্থান রেখে ক্যাচ ধরতে হবে।
৩. বলের গতিবিধির দিকে সব সময় নজর দেওয়া
ফিল্ডিংয়ের সময় একজন ফিল্ডারকে সব সময় বলের গতিবিধির দিকে নজর রাখার প্রয়োজন হয়। আপনার দৃষ্টি যদি বলের দিকে না থাকে, তাহলে অনেক গতিতে আসা উড়ন্ত বলকে আপনি ক্যাচে পরিণতি নাও করতে পারেন। কিংবা গড়িয়ে আসা বলকে ধরতে নাও পারেন। আর তাই, সব সময় বলের গতিবিধির দিকে নজর দিতে হবে।
৪. বল বা ব্যাটসম্যানকে ঠিকমত দেখা যায় এমন পজিশনে আছেন কিনা তা নিশ্চিত করা
আপনি ফিল্ডিংয়ে যে অবস্থানে দাঁড়ান কেন, আপনাকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে আপনি এমন অবস্থানে দাঁড়াবেন যেন আপনি ব্যাটসম্যান এবং ব্যাটসম্যানের শট নেওয়া বলকে ঠিকমত দেখতে পান। আপনার দৃষ্টির সীমানায় অন্য কোন ফিল্ডার বা লেগ আম্পায়ার (দ্বিতীয় আম্পায়ার) যদি থাকে, তাহলে সেই অবস্থান কিছুটা পরিবর্তণ করে দাঁড়ান, যেন আপনি ঠিকমত ব্যাটসম্যান এবং বল দেখতে পান।
৫. সীমানার দিকে যাওয়া বলকে কুড়িয়ে আনার জন্য দলের অন্য ফিল্ডারের সহযোগিতা নেওয়া
আমরা ক্রিকেট খেলায় অনেক সময় দেখে থাকি একটি বল সীমানার দিকে যাচ্ছে, আর সেই বলটির পেছনে দু’জন ফিল্ডার দৌড়ে যাচ্ছে। একজন ফিল্ডার যখন বলটি সীমানার কাছে থাকা অবস্থায় বল থামিয়ে এক হাত দিয়ে বলটি অন্য ফিল্ডারের দিকে ছুঁড়ে মারে, তখন সেই দ্বিতীয় ফিল্ডার বলটি ক্রিজের দিকে ফেরত পাঠায়। এতে করে, বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানরা দৌড়িয়ে বেশি রান নিতে পারে না।
ঠিক এই রকম কাজটি করার জন্যই আপনাকে অন্য ফিল্ডারের সহযোগিতা নিতে হবে এবং অবশ্যই দু’জন ফিল্ডারের মাঝে ভাল বোঝাপড়া থাকতে হবে।
৬. ফিল্ডিংয়ের জন্য নিজস্ব কিছু অনুশীলনের সরঞ্জাম ক্রয় করা
আপনার ফিল্ডিংয়ের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য আপনাকে ফিল্ডিংয়ের কিছু সরঞ্জাম ক্রয় করা উচিত। সরঞ্জামগুলো হচ্ছে-
- ফিল্ডিং নেট
- প্লাস্টিক স্টাম্প
- ক্যাচেট বোর্ড
- রিবাউন্ড নেট
ফিল্ডিং নেটঃ ফিল্ডিং অনুশীলনে বল থ্রো বা নিক্ষেপ করার সময় বল যেন অন্য কোন স্থানে না যায়, তার জন্য ফিল্ডিং নেট ব্যবহার করা হয়।
প্লাস্টিক স্টাম্পঃ ফিল্ডিং নেটকে প্লাস্টিক স্টাম্পের পেছনে রেখে বল নিক্ষেপ করে স্টাম্পে লাগানোর জন্য প্লাস্টিক স্টাম্প খুব ভাল একটি সরঞ্জাম।
ক্যাচেট বোর্ডঃ উইকেট রক্ষক এবং স্লিপ ফিল্ডারের ক্যাচ অনুশীলনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম হচ্ছে ক্যাচেট বোর্ড।
রিবাউন্ড নেটঃ অনেকটা ক্যাচেট বোর্ডের মত এটিও ক্যাচ অনুশীলনের জন্য খুব ভাল একটি সরঞ্জাম।
৭. ‘লং বেরিয়ার’ টেকনিক ব্যবহার
লং বেরিয়ার টেকনিক হচ্ছে গড়িয়ে আসা বলকে একটি পা বলের দিকে ভাঁজ করে একটা বেরিকেড দিয়ে রাখার মত করে দু হাত দিয়ে বল ধরা। এটি ফিল্ডিংয়ের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যবহার। এতে, বেরিকেডের মত করে ভাঁজ করা পায়ের ফাঁক গলে বল বেরিয়ে যেতে পারে না।
৮. লম্বা থ্রো করার জন্য মৌলিক কিছু টিপস আয়ত্ব করা
সীমানার কাছে থাকা ফিল্ডারকে বলকে অনেক জোরে থ্রো বা নিক্ষেপ করতে হয় পিচে থাকা অন্য ফিল্ডার বা উইকেটকিপারের কাছে। আর এই থ্রো বা নিক্ষেপ করার জন্য অনেকটা শক্তি ব্যয় করতে হয়। আর এটি অনেক সময় কঠিনও বটে। কারণ, যদি লম্বা থ্রো করার জন্য আপনার যথেষ্ট অনুশীলন না থাকে, তাহলে হয়তো আপনার হাতের কাঁধের অংশে বা কনুই অংশে ব্যথা অনুভব করতে পারেন।
আর তাই, লম্বা থ্রো করার জন্য আপনাকে আপনার একজন সঙ্গী ফিল্ডার নিয়ে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে নিয়মিত অনুশীলন করা উচিত। প্রায় ২০ থেকে ৩০ মিনিট এটা করা উচিত। এই সময়ের মধ্যে অনুশীলন করা হয়ে গেলে, আপনার সঙ্গী ফিল্ডারকে আরও বলুন আরও কিছুটা দূরে যেতে। এভাবেই প্রতিদিন অনুশীলন করলে লম্বা থ্রো করতে আপনার কোন সমস্যা হবেন না।
উপরের এই টিপসের পাশাপাশি আপনি চাইলে জিমে গিয়ে রাবারের একটি ব্যান্ডের হাতল ধরে সামনের দিকে হাত প্রসারিত করেও এই অনুশীলনটি করতে পারেন।
৯. ফিল্ডিংয়ের সময় নিজেকে শরীরকে সবসময় চাঙ্গা রাখা
ফিল্ডিংয়ের সময় একজন ফিল্ডারকে সবসময় নিজের শরীরকে চাঙ্গা রাখতে হবে। ফিল্ডিংয়ের সময় আলসেমিভাবে বা ঝিমিয়ে থাকলে তা একজন ফিল্ডারের জন্য বিব্রতকর বিষয়। আর তাই, ফিল্ডিংয়ের সময় সবসময় নিজের শরীরকে চাঙ্গাভাব রাখতে হবে। আর এটা করার জন্য আপনাকে বলের দিকে নজর দেয়ার পাশাপাশি বোলারকে মাঝে মাঝে উৎসাহ ব্যঞ্জক কথাবার্তা বলতে পারেন। আর এতে বোলারের পাশাপাশি আপনি নিজেও চাঙ্গা থাকবেন।
১০. ফিল্ডিংয়ে নিজের যতটুকু সীমানা রয়েছে তা কাভার করার বিষয়ে সতর্ক থাকা
আপনি ফিল্ডিংয়ের সময় যে অবস্থানেই থাকুন, আপনার নির্ধারিত সীমানার মধ্যে থাকা বলকে যেন আপনি কাভার (নিজের আয়ত্বের মধ্যে রাখা) করতে পারেন, সেই বিষয়ে আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে। আপনার সীমানার মধ্যে আসা বলকে অনেক সময় লাফিয়ে ধরতে হতে পারে। আর তাই, এসবের জন্য আপনাকে যথেষ্ট অনুশীলন করা উচিত, যদি আপনি একজন ভাল ফিল্ডার হতে চান।
উপরের ক্রিকেট ফিল্ডিংয়ে ভাল করার উপায় হিসেবে যে নিয়মগুলো দেয়া হলো, সেগুলো যদি আপনি ফিল্ডিংয়ের অনুশীলন করেন, তাহলে আপনার ফিল্ডিংয়ের দক্ষতা অনেকটাই বেড়ে যাবে। এছাড়া, ফিল্ডিংয়ের বিষয়ে কোচের পরামর্শ সব সময় মেনে চলা উচিত। আর অবশ্যই নিজের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখবেন। কারণ, একজন ভাল ফিল্ডার বলুন, কিংবা ব্যাটসম্যান বা বোলার, আপনাকে সবার আগে ফিট থাকতে হবে।
Leave a Reply