ওপেন হার্ট সার্জারি – শুনলেই হার্টবিট শুরু হয়ে যায়, তাই না! এটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানলে হার্টবিট বাড়বে না, বরং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
হার্ট, বা আমাদের হৃদপিণ্ড, শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর একটি। এটি রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছে দেয় পুরো শরীরজুড়ে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে হার্টের স্বাভাবিক কার্যক্রমে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
অনেক সময় চিকিৎসার জন্য হার্টে বড় ধরনের অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয়, যাকে বলা হয় “ওপেন হার্ট সার্জারি”।
এই লেখায় আমরা জানব ওপেন হার্ট সার্জারি কী, কেন এটি করা হয়, কীভাবে করা হয়, ঝুঁকি ও প্রস্তুতি সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সকল তথ্য।
এক নজরে দেখে নিন যা আছে এই লেখায়-
ওপেন হার্ট সার্জারি কী?
ওপেন হার্ট সার্জারি (Open Heart Surgery) হলো এমন একটি অস্ত্রোপচার, যেখানে চিকিৎসক বুকের হাড় (sternum) কেটে হৃদপিণ্ডে সরাসরি প্রবেশ করেন এবং হার্টের অভ্যন্তরীণ গঠন বা রক্তনালীতে (coronary arteries) কোনোরকম সার্জিকাল কাজ করেন।
এই অপারেশনে সাধারণত হার্ট-লাংস মেশিন ব্যবহার করা হয়, যা রক্ত সঞ্চালন ও শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ সাময়িকভাবে চালিয়ে রাখে যখন হার্ট বন্ধ থাকে।
ওপেন হার্ট সার্জারির অন্যান্য নাম
ওপেন হার্ট সার্জারির প্রচলিত আরেকটি নাম হলো “Traditional Heart Surgery“, বাংলা করলে হয় – “পরম্পরাগত হৃদযন্ত্র অস্ত্রোপচার”।
এছাড়া নির্দিষ্ট কাজের ভিত্তিতে আরও কিছু নামও ব্যবহার হয়, যেমন:
- Coronary Artery Bypass Surgery (CABG) – এটি ওপেন হার্ট সার্জারির এক বিশেষ ধরণ, যেখানে ব্লক হয়ে যাওয়া হার্টের রক্তনালী বাইপাস করে নতুন পথ তৈরি করা হয়।
- Sternotomy Procedure – যেহেতু এই অপারেশনে বুকের হাড় কাটা হয়, তাই কখনো কখনো এটি এই নামে পরিচিত।
- Cardiac Surgery – এটি একটি সাধারণ নাম, যা হার্ট সংক্রান্ত যেকোনো অস্ত্রোপচার বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, তবে ওপেন হার্ট সার্জারিও এর অন্তর্ভুক্ত।
মানুষ কেন “অন্য নাম” খোঁজে?
বিভিন্ন কারণে মানুষ “ওপেন হার্ট সার্জারির অন্যান্য নাম” জানতে চায়:
- চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনে ভিন্ন নাম লেখা থাকতে পারে।
- ইন্টারনেটে তথ্য খোঁজার সময় ভিন্ন শব্দ ব্যবহৃত হয়।
- মেডিক্যাল রিপোর্ট বা প্রবন্ধে ইংরেজি টার্ম বা শর্টফর্ম থাকে।
- আত্মীয়-স্বজনের চিকিৎসা সম্পর্কিত আলোচনায় পরিষ্কার ধারণা দরকার হয়।
ওপেন হার্ট সার্জারির প্রধান কারণসমূহ
ওপেন হার্ট সার্জারির মাধ্যমে হার্টের অভ্যন্তরীণ সমস্যা ঠিক করা হয়, যা সাধারণ ওষুধ বা ছোট অস্ত্রোপচারে সম্ভব হয় না। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই সার্জারির প্রয়োজন কেন পড়ে? চলুন জেনে নেই ওপেন হার্ট সার্জারির প্রধান কারণগুলো, এবং কোন পরিস্থিতিতে এটি অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
করোনারি আর্টারি ডিজিজ (Coronary Artery Disease – CAD)
হার্টের চারপাশে থাকা রক্তনালিগুলোতে (coronary arteries) চর্বি বা প্লাক জমে ব্লক তৈরি হলে, হার্ট ঠিকভাবে রক্ত পায় না। এতে হার্ট অ্যাটাক বা হৃদস্পন্দনজনিত সমস্যা হতে পারে।
সমাধান: এই অবস্থায় Coronary Artery Bypass Grafting (CABG) নামক ওপেন হার্ট সার্জারি করা হয়, যেখানে ব্লক হওয়া ধমনীর বিকল্প নতুন রক্তপথ তৈরি করা হয়।
হার্টের ভাল্ভ সমস্যা (Valve Disease)
হার্টে চারটি ভাল্ভ থাকে, যেগুলো রক্ত চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে। জন্মগতভাবে বা বয়সজনিত কারণে এই ভাল্ভগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
সমাধান: ভাল্ভ যদি ঠিকমতো খোলে বা বন্ধ না হয়, তাহলে ওপেন হার্ট সার্জারির মাধ্যমে ভাল্ভ রিপেয়ার বা ভাল্ভ প্রতিস্থাপন করা হয়।
জন্মগত হার্টের সমস্যা (Congenital Heart Defects)
অনেক শিশু জন্ম নেয় হার্টের গঠনে সমস্যা নিয়ে, যেমন — হোল ইন হার্ট, ভুলভাবে যুক্ত ধমনী, বা একটি চেম্বার অনুপস্থিত।
সমাধান: এই ধরনের জটিল ত্রুটি শুধুমাত্র ওপেন হার্ট সার্জারির মাধ্যমেই চিকিৎসা করা সম্ভব।
হার্ট ফেইলিওর ও হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট
যখন হার্ট তার স্বাভাবিক কাজ একেবারেই করতে পারে না এবং জীবন হুমকির মুখে পড়ে, তখন একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায় হার্ট প্রতিস্থাপন (Heart Transplantation)।
সমাধান: এটি একটি উন্নত মানের ওপেন হার্ট সার্জারি যেখানে একজন ডোনারের হার্ট প্রতিস্থাপন করা হয়।
হার্টের অ্যানিউরিজম (Aneurysm)
হার্ট বা তার সংযুক্ত ধমনীতে কোনো অংশ দুর্বল হয়ে ফেঁপে গেলে তা অ্যানিউরিজম বলে। এটি ফেটে গেলে জীবনঘাতী হতে পারে।
সমাধান: এই বিপজ্জনক অবস্থায় ওপেন হার্ট সার্জারির মাধ্যমে অ্যানিউরিজম অপসারণ বা প্রতিস্থাপন করা হয়।
ইনফেকশন বা ইনফ্লামেশন
হার্টের আবরণী (pericardium) বা ভাল্ভে সংক্রমণ (endocarditis) হলে তা চিকিৎসায় না সারলে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে।
সমাধান: সংক্রমিত অংশ কেটে ফেলা বা প্রতিস্থাপন করাই একমাত্র উপায় হয়।
কখন দ্রুত ওপেন হার্ট সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে?
ওপেন হার্ট সার্জারি সাধারণত আগে থেকে পরিকল্পনা করে করা হয়। তবে কিছু জরুরি শারীরিক লক্ষণ ও অবস্থা আছে, যেখানে দ্রুত সার্জারি না করলে জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। এই ধরনের অবস্থাকে বলা হয় “emergency cardiac condition”।
আসুন জেনে নেই কোন পরিস্থিতিতে অবিলম্বে হার্ট সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।
তীব্র বুকে ব্যথা (Severe Chest Pain)
যদি হঠাৎ বুকের মাঝখানে বা বাম দিকে তীব্র চাপ বা ব্যথা শুরু হয়, বিশেষ করে ব্যথা যদি কাঁধ, হাত বা চোয়ালে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে তা হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ হতে পারে।
যদি ব্যথার উৎস হার্টের ধমনীতে ব্লক হয়ে থাকে, এবং অবস্থা গুরুতর হয়, তাহলে ওপেন হার্ট সার্জারির মাধ্যমে বাইপাস (CABG) করতে হতে পারে।
শ্বাসকষ্ট বা হাপানি-জাতীয় সমস্যা (Shortness of Breath)
- হাঁটলে বা বসে থাকলেও শ্বাস নিতে কষ্ট হয়?
- শুয়ে পড়লে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে?
এসব লক্ষণ হার্ট ফেইলিওরের দিকেই ইঙ্গিত করে, যেখানে হার্ট রক্ত পাম্প করতে পারছে না। এর ফলে ফুসফুসে পানি জমতে পারে।
এই অবস্থায় দ্রুত চিকিৎসা এবং প্রয়োজনে ওপেন হার্ট সার্জারি প্রয়োজন হতে পারে।
অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন বা অ্যারিদমিয়া (Irregular Heartbeat)
- হঠাৎ হৃদস্পন্দন খুব দ্রুত বা ধীর হয়ে যাওয়া
- বুক ধড়ফড় করা
- মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
এসব উপসর্গ যদি হয়, তবে বুঝতে হবে হার্টের বৈদ্যুতিক সংকেত ঠিকমতো কাজ করছে না। কখনো কখনো হার্টের নির্দিষ্ট অংশে সার্জারি করে এই অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়।
স্ট্রোক বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া (Sudden Unconsciousness or Stroke)
হার্টে রক্ত চলাচল ব্যাহত হলে তা মস্তিষ্কেও রক্ত সরবরাহ কমিয়ে দিতে পারে, যার ফলে স্ট্রোক বা অজ্ঞান হওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে।
- হার্টের ভাল্ভ বা ধমনীতে সমস্যার কারণে এমন হলে দ্রুত সার্জারির প্রয়োজন হয়।
হার্টের ভাল্ভ হঠাৎ নষ্ট হয়ে যাওয়া (Valve Rupture or Severe Leakage)
যদি হার্টের কোন ভাল্ভ আচমকা ছিঁড়ে যায় বা অত্যধিক রক্ত লিক করতে থাকে, তখন তা দ্রুত ভাল্ভ প্রতিস্থাপন (valve replacement) করতে হয়।
- এই ধরনের অবস্থা একেবারে জরুরি, কারণ এতে রক্ত চলাচল সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হতে পারে।
হার্টে ইনফেকশন বা ইনফ্লামেশন (Endocarditis, Pericarditis)
হার্টের অভ্যন্তরে জীবাণু সংক্রমণ হলে তা হার্ট টিস্যু ধ্বংস করতে পারে।
- যদি অ্যান্টিবায়োটিকে কাজ না হয় বা ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ে, তবে দ্রুত হার্টের সংক্রমিত অংশ সার্জারির মাধ্যমে কেটে ফেলতে হয়।
হার্ট অ্যানিউরিজম বা ধমনীর ফেটে যাওয়া (Aneurysm Rupture)
হার্ট বা তার আশেপাশের ধমনী দুর্বল হয়ে গিয়ে ফুলে গেলে (aneurysm), সেটি যদি ফেটে যায় তাহলে তৎক্ষণাৎ সার্জারি না করলে মৃত্যু হতে পারে।
- এটা একটি লাইফ-থ্রেটেনিং এমার্জেন্সি, যেখানে এক মুহূর্তও দেরি করা ঠিক নয়।
ওপেন হার্ট সার্জারির জন্য কিভাবে সঠিক ডাক্তার বাছাই করবেন?
ওপেন হার্ট সার্জারি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
ওপেন হার্ট সার্জারি হলো এমন এক জটিল অস্ত্রোপচার, যা হৃদযন্ত্রের অভ্যন্তরীণ গঠন, ধমনী, ভাল্ভ বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশে সোজা হস্তক্ষেপের মাধ্যমে করা হয়। এই সার্জারির সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে আপনি কোন ডাক্তার বা সার্জনকে নির্বাচন করছেন তার ওপর।
আসুন জেনে নেই কিভাবে আপনি একজন অভিজ্ঞ, দক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য কার্ডিয়াক সার্জন নির্বাচন করতে পারেন।
ওপেন হার্ট সার্জারির জন্য ডাক্তার বাছাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ ধাপসমূহ-
ডাক্তারের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা যাচাই করুন
একজন ওপেন হার্ট সার্জনের মূল যোগ্যতা হওয়া উচিত:
- MBBS + MS (General Surgery)
- MCh in Cardiothoracic & Vascular Surgery (CTVS)
এছাড়া, খেয়াল রাখুন:
- ডাক্তার কত বছর ধরে হার্ট সার্জারি করছেন
- কতগুলো ওপেন হার্ট সার্জারি করেছেন
- সফলতার হার (Success rate) কেমন
কোন হাসপাতালে কাজ করছেন তা দেখুন
সার্জন যদি কোনো বিশ্বস্ত বা স্বনামধন্য হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, যেমন:
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (BSMMU)
- ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন
- ইউনাইটেড হাসপাতাল
- অ্যাপোলো হাসপাতাল
- স্কয়ার হাসপাতাল
- ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল
তবে ধরে নেওয়া যায় তিনি একটি মানসম্পন্ন ও প্রটোকলভিত্তিক পরিবেশে কাজ করেন।
রোগী ও পরিচিতজনের রিভিউ শুনুন
বর্তমান যুগে আপনি সহজেই জানতে পারেন:
- আগের রোগীরা সার্জন সম্পর্কে কী বলেছেন
- ফেসবুক, গুগল বা হাসপাতালের ওয়েবসাইটে রিভিউ
- আত্মীয় বা বন্ধুদের মধ্যে কেউ সার্জারি করিয়েছেন কি না, তাদের মতামত
- বেশি নেতিবাচক অভিজ্ঞতা থাকলে সেই সার্জনকে এড়িয়ে চলুন।
প্রথম সাক্ষাতে ডাক্তারের আচরণ পর্যবেক্ষণ করুন
ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করার সময় খেয়াল করুন:
- তিনি কি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন?
- কি ধরণের সার্জারি লাগবে সে ব্যাখ্যা কি স্পষ্টভাবে দিচ্ছেন?
- তিনি কি ঝুঁকি, খরচ ও প্রক্রিয়া নিয়ে খোলাখুলি কথা বলছেন?
একজন ভালো সার্জন সবসময় রোগীর এবং তার পরিবারের সঙ্গে পরিষ্কার ও সহানুভূতিশীলভাবে কথা বলেন।
সার্জারির পর সাপোর্ট সিস্টেম কেমন?
শুধু সার্জন নয়, তার মেডিক্যাল টিম, নার্স, রিহ্যাব টিম কেমন তা-ও গুরুত্বপূর্ণ।
সার্জারির পরে:
- ICU কেয়ার কেমন?
- রুগীর পর্যবেক্ষণ কীভাবে হয়?
- জরুরি কলে সার্জন বা টিমের সাড়া কেমন?
ব্যয় ও বীমা কাভারেজ যাচাই করুন
সবচেয়ে নামী সার্জনের কাছেও চিকিৎসা নিতে গেলে বাজেট জানা জরুরি।
- খরচ কি আপনার সামর্থ্যের মধ্যে?
- আপনি যে স্বাস্থ্য বীমা (Insurance) করেছেন তা এই ডাক্তার বা হাসপাতালে চলবে কি না?
অনেক সময় সরকার অনুমোদিত কিছু হাসপাতালেও ভালো সার্জারি হয় তুলনামূলক কম খরচে।
আপনার মন কি সন্তুষ্ট?
সব দিক থেকে একজন সার্জন ভালো হলেও যদি আপনি তার প্রতি আত্মবিশ্বাসী না হন, তাহলে দ্বিতীয় মতামত (Second opinion) নিন।
- হৃদযন্ত্র নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত না নিয়ে ভালোভাবে যাচাই করে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
ওপেন হার্ট সার্জারির প্রস্তুতি
ওপেন হার্ট সার্জারি আগে যথাযথ শারীরিক, মানসিক ও পারিবারিক প্রস্তুতি নেওয়া আবশ্যক। সঠিকভাবে প্রস্তুতি নিলে সার্জারির ঝুঁকি কমে, সেরে ওঠার গতি বাড়ে এবং রোগীর আত্মবিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়।
কেন প্রস্তুতি গুরুত্বপূর্ণ?
একটি সফল ওপেন হার্ট সার্জারির জন্য প্রস্তুতি নিচের তিনটি বড় বিষয়ে সাহায্য করে:
- সার্জারির সময় ও পরবর্তী জটিলতা কমানো
- চিকিৎসক ও হাসপাতালকে প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া
- রোগীর মানসিক সাহস ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি
ওপেন হার্ট সার্জারির জন্য ধাপে ধাপে প্রস্তুতি-
প্রাথমিক মেডিকেল চেকআপ ও পরীক্ষাসমূহ
- সার্জারির আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা করা হয়:
- ইসিজি (ECG): হৃদস্পন্দনের নিয়মিতা যাচাই
- ইকোকার্ডিওগ্রাম (Echocardiogram): হৃদযন্ত্রের ভাল্ভ ও রক্তপ্রবাহ বিশ্লেষণ
- এক্স-রে (Chest X-ray): ফুসফুস ও হার্টের আকৃতি বোঝা
- ব্লাড টেস্ট: রক্তের গ্রুপ, চিনির মাত্রা, ইনফেকশন চেক
- করোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাফি (যদি প্রয়োজন হয়): ধমনিতে ব্লক চিহ্নিত করতে
এসব রিপোর্ট দেখে সার্জনেরা নির্ধারণ করেন কী ধরনের অস্ত্রোপচার প্রয়োজন।
ওষুধ সংক্রান্ত প্রস্তুতি
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু ওষুধ বন্ধ রাখতে হতে পারে, যেমন:
- ব্লাড থিনার (aspirin, warfarin), ডায়াবেটিসের ওষুধ
- যেসব ওষুধ চালু রাখতে হবে, সেগুলোর তালিকা লিখে রাখুন
- কোনো অ্যালার্জি থাকলে অবশ্যই চিকিৎসককে জানান
ধূমপান ও অ্যালকোহল বন্ধ করা
সার্জারির আগে অন্তত ২-৪ সপ্তাহ ধূমপান ও অ্যালকোহল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা জরুরি।
এগুলো:
- রক্তে অক্সিজেন সরবরাহ কমায়
- ফুসফুসে জটিলতা তৈরি করে
- সার্জারি পরবর্তী সেরে ওঠার গতি ধীর করে
মানসিক প্রস্তুতি ও সাহস
ওপেন হার্ট সার্জারি শুনলেই অনেকেই ভয় পান, কিন্তু মনে রাখবেন:
- আধুনিক চিকিৎসায় সার্জারির সফলতার হার অনেক বেশি
- ভয় নয়, আত্মবিশ্বাস এবং পরিবারের সহায়তা সবচেয়ে জরুরি
- আপনি চাইলে মনোবিজ্ঞানী বা কাউন্সেলরের সাহায্য নিতে পারেন
শারীরিক পরিচ্ছন্নতা ও হাইজিন
- সার্জারির ১ দিন আগে গোসল করুন ও শরীর পরিষ্কার রাখুন
- শরীরে সংক্রমণ বা কাটা/ঘা থাকলে জানান
- চিকিৎসকের নির্দেশ মতো অপারেশনের জায়গার চুল শেভ করা হতে পারে
হাসপাতালে ভর্তি ও সঙ্গে যা রাখবেন
সার্জারির আগের দিন বা সকালে ভর্তি হতে হতে পারে। সঙ্গে রাখবেন:
- প্রয়োজনীয় রিপোর্ট ও ওষুধ
- হালকা জামাকাপড় ও টুথব্রাশ/তোয়ালে
- পরিচয়পত্র ও বীমার কাগজ
প্রিয়জনের ফোন নম্বর বা পরিচিত কেউ সঙ্গে রাখুন
পরিবারের প্রস্তুতি
- সার্জারির সময় পরিবারের কাউকে হাসপাতালে থাকতে হবে
- সার্জারির সময়, আইসিইউ ও ওয়ার্ডে স্থানান্তর সম্পর্কে ধারণা রাখুন
চিকিৎসকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখুন
সার্জারির আগের দিন কী করবেন?
- হালকা খাবার খাবেন
- রাত ১০টার পর কিছু খাবেন না (NPO নির্দেশ)
- চাপমুক্ত থাকতে চেষ্টা করুন
- মেডিক্যাল টিমের দেওয়া নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলুন
ওপেন হার্ট সার্জারি কীভাবে করা হয়?
ওপেন হার্ট সার্জারি বহু ধাপে ও অত্যন্ত নিখুঁতভাবে করা হয়। নিচে ধাপে ধাপে এই সার্জারির প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করা হলো:
ধাপ ১: অস্ত্রোপচারের জন্য প্রস্তুতি
- রোগীকে একটি অপারেশন থিয়েটারে (OT) নেওয়া হয়
- জেনারেল অ্যানেসথেশিয়া (ঘুমের ওষুধ) দিয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করা হয়
- রোগীর বুক, হাত, পা-তে ইলেকট্রোড লাগানো হয় হৃদস্পন্দন মনিটরের জন্য
- বুকের অংশ জীবাণুমুক্ত করা হয় ও সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া হয়
ধাপ ২: বুক খোলা (Median Sternotomy)
- অস্ত্রোপচারের সময় চিকিৎসক বুকের মাঝ বরাবর একটি কাট (incision) করেন
- এরপর স্টার্নাম বা বুকের হাড় কেটে হৃদযন্ত্রে পৌঁছান
- হার্টে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় অংশে সরাসরি পৌঁছাতে হয়
ধাপ ৩: হার্ট-লাং মেশিনে রক্ত চলাচল স্থানান্তর
- হার্ট অপারেশনের সময় রক্ত চলাচল অব্যাহত রাখতে রোগীকে Heart-Lung Machine-এর সাথে সংযুক্ত করা হয়
- এই যন্ত্রটি হার্ট ও ফুসফুসের কাজ সাময়িকভাবে übernimmt
- তখন হার্ট থামিয়ে চিকিৎসক নিরাপদে তার উপর কাজ করতে পারেন
ধাপ ৪: হৃদযন্ত্রে সার্জারি
হৃদযন্ত্রের সমস্যা অনুযায়ী চিকিৎসক নিচের যেকোনো একটি বা একাধিক কাজ করেন:
- করোনারি বাইপাস (CABG): ব্লক ধমনী পাশ কাটিয়ে নতুন রক্ত চলাচলের পথ তৈরি
- ভাল্ভ রিপেয়ার বা রিপ্লেসমেন্ট: নষ্ট হার্ট ভাল্ভ মেরামত বা নতুন ভাল্ভ বসানো
- হার্ট হোল বন্ধ (Hole Closure): জন্মগত ছিদ্র বা গঠনগত ত্রুটি মেরামত
- অ্যারিদমিয়া সার্জারি: অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন সংশোধন
এই ধাপটি সবচেয়ে জটিল এবং সময়সাপেক্ষ (৩–৬ ঘণ্টা পর্যন্ত লাগতে পারে)।
ধাপ ৫: হার্ট চালু করা ও রক্তপ্রবাহ ফিরিয়ে আনা
- অপারেশন শেষ হলে হার্ট-লাং মেশিন থেকে রক্তপ্রবাহ আবার হার্টে ফিরিয়ে আনা হয়
- ধীরে ধীরে হৃদযন্ত্র স্বাভাবিকভাবে স্পন্দন করতে শুরু করে
- নিশ্চিত হওয়া হয় যে সবকিছু ঠিকমতো কাজ করছে
ধাপ ৬: বুক সেলাই ও শেষ পর্যায়ের কাজ
- স্টার্নাম বা বুকের হাড় ধাতব তার দিয়ে জোড়া দেওয়া হয়
- কাট অংশ সেলাই করা হয়
- বুকের মধ্যে সাময়িকভাবে ড্রেনেজ টিউব বসানো হয়, যাতে রক্ত বা তরল জমে না থাকে
- সব কিছু ঠিক থাকলে রোগীকে ধীরে ধীরে অজ্ঞানতা থেকে ফিরিয়ে আনা হয়
সার্জারির পরবর্তী পর্যায় (Post-Operative Care)
- প্রথমে রোগীকে ICU-তে ২৪–৪৮ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়
- হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ, অক্সিজেন ও ফুসফুসের কার্যকারিতা নজরে রাখা হয়
- ধীরে ধীরে রোগীকে বসানো, হাঁটানো ও খাওয়ানো শুরু হয়
- সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য ৬–১২ সপ্তাহ সময় লাগে
সার্জারির পর পুনরুদ্ধার
- সাধারণত ৭-১০ দিন হাসপাতালে থাকতে হয়।
- ৬-৮ সপ্তাহে বুকের হাড় পুরোপুরি জোড়া লাগে।
- চিকিৎসকের পরামর্শমতো ফিজিওথেরাপি ও ধাপে ধাপে হাঁটা শুরু করা হয়।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ এবং স্ট্রেসমুক্ত জীবনধারা অনুসরণ করতে হয়।
ওপেন হার্ট সার্জারির ঝুঁকি সমূহ
যদিও আধুনিক চিকিৎসায় ওপেন হার্ট সার্জারির সাফল্যের হার অনেক বেড়েছে, তবুও এটি এখনো একটি বড় ও ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন হিসেবে বিবেচিত।
জটিল অস্ত্রোপচার, সচেতনতা ও সাবধানতাই সাফল্যের চাবিকাঠি
আসুন জেনে নেই ওপেন হার্ট সার্জারির সম্ভাব্য ঝুঁকি, কারণ ও করণীয় সম্পর্কে।
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ (Bleeding)
হার্ট সার্জারিতে বুকের হাড় কাটা হয় এবং অনেক ধমনীতে কাজ করা হয়। এর ফলে:
- অপারেশনের সময় বা পরে অতিরিক্ত রক্তপাত হতে পারে
- অনেক ক্ষেত্রে রক্ত দিতে হতে পারে
- ড্রেনেজ টিউব দিয়ে রক্ত বের করে দিতে হয়
ইনফেকশন (Infection)
যে কোনো সার্জারির মতো, ওপেন হার্ট সার্জারিতেও ইনফেকশনের ঝুঁকি থাকে:
- চামড়ার কাটা জায়গায়
- বুকের হাড়ে (sternal wound infection)
- এমনকি ফুসফুস বা রক্তে সংক্রমণও হতে পারে
ডায়াবেটিস, ধূমপান বা দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকলে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়ে।
ফুসফুসের জটিলতা (Lung complications)
অপারেশনের পর অনেক রোগীর শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে তরল জমা বা নিউমোনিয়ার মতো সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে যারা:
- ধূমপায়ী
- আগে থেকে ফুসফুসের রোগে ভুগছেন
- বয়স বেশি
তাদের জন্য ঝুঁকি বেশি।
স্ট্রোক বা মস্তিষ্কের সমস্যা
হার্ট-লাং মেশিন ব্যবহারের কারণে:
- ছোট রক্ত জমাট বা এয়ার বাবল মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারে
- অস্থায়ী বা স্থায়ী স্ট্রোক হতে পারে
- স্মৃতিভ্রংশ বা কনফিউশনও দেখা দিতে পারে
হার্ট অ্যারিদমিয়া (Arrhythmia)
- সার্জারির পরে অনেক সময় হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হতে পারে:
- খুব দ্রুত (Tachycardia) বা খুব ধীরে (Bradycardia)
- কখনোই খুব বেশি গুরুতর হয় না, কিন্তু পর্যবেক্ষণ দরকার
- প্রয়োজনে পেসমেকার বা ওষুধ ব্যবহার করা হয়
কিডনি সমস্যা
- কিছু রোগীর ক্ষেত্রে সার্জারির পরে কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যেতে পারে:
- যারা আগে থেকেই কিডনি সমস্যায় আছেন
- অথবা অনেক ঘন্টা ধরে সার্জারি হয়েছে
- তাদের জন্য ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হতে পারে
মানসিক ও আবেগগত সমস্যা
- সার্জারির পরে অনেকে কিছু সময়ের জন্য:
- বিষণ্ণতা (depression)
- উদ্বেগ
- ঘুমের সমস্যা
- মেমোরি ও মনোযোগের দুর্বলতা অনুভব করেন
সাধারণত কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এসব সমস্যা কেটে যায়।
মৃত্যুঝুঁকি (Risk of death)
যদিও আজকাল ওপেন হার্ট সার্জারির সফলতার হার ৯০–৯৮% এর বেশি, তবে:
- গুরুতর হার্ট ফেইলিউর
- বয়স অনেক বেশি হলে
- একাধিক শারীরিক সমস্যা থাকলে
এই সার্জারির মৃত্যুঝুঁকি ২–৫% পর্যন্ত হতে পারে।
কারা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন?
নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি:
- বয়স বেশি: বয়স ৭০ এর উপরে হলে ঝুঁকি বেড়ে যায়
- ডায়াবেটিস রোগী: সংক্রমণ ও সেরে ওঠার জটিলতা
- কিডনি/লিভার সমস্যা: অঙ্গের কার্যক্ষমতা কমে যেতে পারে
- ধূমপান: ফুসফুসে সমস্যা বাড়ায়
- পূর্বে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে: হার্ট দুর্বল থাকে
- ওজন বেশি বা খুব কম: অপারেশনের সহনশীলতা কম থাকে
কীভাবে ঝুঁকি কমানো যায়?
সার্জারির আগে ও পরে কিছু সতর্কতা মেনে চললে এই ঝুঁকিগুলো অনেকটাই কমানো সম্ভব:
- অভিজ্ঞ সার্জন ও উন্নত হাসপাতাল বেছে নিন
- আগে থেকে সব মেডিকেল রিপোর্ট জানিয়ে দিন
- ডায়াবেটিস, প্রেসার, কিডনি ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণে রাখুন
- ধূমপান ও অ্যালকোহল সম্পূর্ণ বন্ধ করুন
- সার্জারির পরে নিয়মিত রিহ্যাব ও ফলোআপ করুন
- মন ভালো রাখুন, পরিবারের সহায়তা নিন
উপসংহার
ওপেন হার্ট সার্জারি আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক অসাধারণ সাফল্য। যদিও এটি একটি বড় ধরনের অস্ত্রোপচার, তবে চিকিৎসক ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে এখন এই সার্জারির সফলতার হার অনেক বেশি। যদি চিকিৎসক ওপেন হার্ট সার্জারির পরামর্শ দেন, তাহলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই—সঠিক প্রস্তুতি ও পরিচর্যার মাধ্যমে একটি সুস্থ জীবন ফিরে পাওয়া সম্ভব।
Leave a Reply