যখন আপনি অনলাইনে আয় করার চিন্তা করবেন তখন প্রথম দিকে মার্কেটপ্লেস নিয়ে প্রশ্ন আসতে পারে আপওয়ার্ক নাকি ফ্রিল্যান্সার ভাল। বর্তমান সময়ে আপওয়ার্ক এবং ফ্রিল্যান্সার দুটি ওয়েবসাইট তুমুল জনপ্রিয়। দুটি ওয়েবসাইট থেকেই টাকা আয় করা যায় এবং কাজ পাওয়া গেলেও এদের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। এসব পার্থক্য জানা থাকলে আপনি সহজেই পছন্দের মার্কেটপ্লেসটি নির্বাচন করে নিতে পারবেন।
আউটসোর্সিং কাজের জন্যে সেরা ১০ মার্কেটপ্লেস রয়েছে। আর প্রত্যেকটি মার্কেটপ্লেসের বেশ কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা বিদ্যমান। তাই এসব সুবিধা এবং অসুবিধা জানার মাধ্যমে আপনার সময় ও অর্থ দুটিই বাঁচাতে সহায়তা করবে। আজকে আমি এ দুটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো যার উপর ভিত্তি করে আপনি ফ্রিল্যান্সিং কাজের জন্যে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
প্রথমত আমরা জানবো দুটি মার্কেটপ্লেসের পরিচয়। তারপর দুটি মার্কেটপ্লেসকে ফ্রিল্যান্সারের দৃষ্টিকোণ এবং যে কোনো একটি মার্কেটপ্লেস বেছে নেওয়ার কারণগুলো আলোচনা করবো। তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক আপনার জন্যে আপওয়ার্ক ভাল হবে নাকি ফ্রিল্যান্সার ভাল হবে।
আপওয়ার্ক নাকি ফ্রিল্যান্সার
আপওয়ার্ক কি
আপওয়ার্ক শুরুতে ইল্যান্স এবং ওডেস্ক নামে আলাদা দুটি ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস ছিল। পরবর্তীতে এই দুটি মার্কেটপ্লেস একত্রিত হয়ে নাম হয় আপওয়ার্ক। এই নামকরণ এবং একত্রিত হয় ২০১৫ সালে। আপওয়ার্কের বর্তমান কার্যালয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন ভিউতে। বর্তমানে স্টিফেন ক্যাস্রিয়েল আপওয়ার্কের সিইও হিসাবে কাজ করছেন।
আপওয়ার্কের দাবি অনুযায়ী তাদের মার্কেপ্লেসে ১৮০টি দেশের ১৪ মিলিয়ন ব্যবহারকারী রয়েছেন। ফ্রিল্যান্সাররা তাদের মার্কেটপ্লেস থেকে বাৎসরিক প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার আয় করে থাকে। বুঝতেই পারছেন তাদের মার্কেটপ্লেসে কি পরিমাণ কাজের চাহিদা। এছাড়া এই মুহূর্তে তাদের মার্কেটপ্লেসে ৮ মিলিয়ন নিবন্ধিত ক্লায়েন্ট রয়েছে এবং ১ লক্ষ জব রয়েছে। ফলে আপওয়ার্কে কাজ নিয়ে আপনাকে খুব একটা চিন্তা করতে হবে না।
ফ্রিল্যান্সার কি
ফ্রিল্যান্সার মূলত একটি মার্কেটপ্লেস যেখানে জব পোস্ট করা যায় এবং জব নেয়াও যায়। অর্থাৎ এখান থেকে আপনি যেমন কাজ পাবেন, তেমনি কাজ করিয়ে নেয়ার জন্য ফ্রিল্যান্সারও খুঁজতে পারবেন। পূর্বে আলোচনা করা আপওয়ার্কের মতই একটি ওয়েবসাইট এটি। এই মার্কেটপ্লেসটি যাত্রা শুরু করে ২০০৯ সালে। ম্যাট ব্যারি এর প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান সিইও। এর প্রধান কার্যালয় অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে।
এই মার্কেটপ্লেসে ৩০ মিলিয়নের বেশী নিবন্ধিত সদস্য রয়েছে যার মধ্যে ১৫ মিলিয়ন নিয়মিত কাজ করে। এই মুহূর্তে ৮৫ হাজারের বেশী জব রয়েছে তাদের মার্কেটপ্লেসে।
আশা করি দুটি মার্কেটপ্লেস সম্পর্কে কিছুটা পরিচয় পেয়েছেন যা আপনাকে আপওয়ার্ক নাকি ফ্রিল্যান্সার কোনটি ভাল হবে সেটা ঠিক করার প্রাইমারি স্টেজ শেষ করতে সাহায্য করেছে। এবার দুটি মার্কেটপ্লেসে কি কি সুযোগ সুবিধা পাবেন তার আলোচনায় চলে আসুন।
১. ইউজার ইন্টারফেস
আপওয়ার্ক – আপওয়ার্কের ইউজার ইন্টারফেস ডিজাইন তুলনামূলক সিম্পল এবং সহজ। খুব সহজে আপনি একাউন্ট খুলতে পারবেন। কিন্তু অ্যাকাউন্ট খোলার পর তাদের থেকে অবশ্যই অ্যাপ্রুভাল পেতে হবে।
ফ্রিল্যান্সার – ফ্রিল্যান্সারের মূল আকর্ষণ তাদের আকর্ষণীয় ড্যাশবোর্ড। এছাড়া তাদের ডিজাইন সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস। সুতরাং ইউজার ইন্টারফেসের দিক দিয়ে প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ অবস্থানে শ্রেষ্ঠ।
২. জবের প্রকারভেদ
আপওয়ার্ক – আপওয়ার্কে জবের ধরণ দুই ধরনের যথা:
- ঘণ্টা ভিত্তিক: ঘণ্টা ভিত্তিক জব হল আপনি আপনার প্রতি ঘণ্টা রেট নির্দিষ্ট করে দিবেন এবং ক্লায়েন্ট আপনাকে ভাড়া নেবে। যেমন ধরুন আপনি একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার এবং আপনার প্রতি ঘণ্টা রেট ২০০ ডলার। এখন কোন ক্লায়েন্ট যদি আপনাকে তার কাজের জন্য ভাড়া নিতে চায়, তবে সে যত ঘণ্টা আপনাকে দিয়ে কাজ করাবে, ততো ঘণ্টার সাথে ২০০ ডলার গুণ হবে। আপনি কত ঘণ্টা কাজ করছেন এটা তারা নিজস্ব ট্র্যাকিং সিস্টেম সফটওয়্যারের মাধ্যমে জেনে যাবে।
- মূল্য ভিত্তিক: মূল্য ভিত্তিক জব হল ক্লায়েন্ট যে কোনো একটি কাজের অফার করে পোস্ট করবে। সেখানে বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সাররা ইচ্ছা মত মূল্য দিয়ে বিড করবে। তারপর ক্লায়েন্ট যাকে ইচ্ছে করবে তাকে কাজ প্রদান করবে।
এছাড়া বিভাগ অনুযায়ী ভাগ করলে আপনি নিচের ১২টি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত যে কোনো একটি স্কিলে অভিজ্ঞ থাকলে জব পাবেন। প্রধানত নিচের এই ১২টি ক্যাটেগরিতে জব পাওয়া যায়।
- ওয়েব, মোবাইল ও সফটওয়্যার ডেভেলপ
- আইটি ও নেটওয়ার্কিং
- ডেটা সায়েন্স অ্যান্ড অ্যানালিটিক্স
- অনুবাদ
- ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আর্কিটেকচার
- ডিজাইন ও ক্রিয়েটিভ
- আইন সেবা
- রাইটিং
- অ্যাডমিন সাপোর্ট
- কাস্টমর সার্ভিস
- বিক্রয় এবং বিপণন
- অ্যাকাউন্টিং এবং পরামর্শ
উপরোক্ত এই ১২টি ক্যাটেগরির মধ্যে আপওয়ার্কে আপনি যে সকল ফ্রি-ল্যান্সিং জব করতে পারেন, সেগুলো সম্পর্কে আরো বিস্তারিতভাবে জেনে নিতে পারেন।
ফ্রিল্যান্সার – ফ্রিল্যান্সারের জবের ধরণ তিন ধরনের যথা:
- ঘণ্টা ভিত্তিক: ঘণ্টা ভিত্তিক জব হল আপনাকে নির্দিষ্ট ঘণ্টার জন্য ক্লায়েন্ট ভাড়া নেবে এবং আপনার রেট অনুযায়ী সে ঘণ্টা মাফিক অর্থ প্রদান করবে। এই পদ্ধতি মূলত আপওয়ার্কে ঘণ্টা ভিত্তিক জবের অনুরূপ।
- মূল্য ভিত্তিক: মূল্য ভিত্তিক কাজে ক্লায়েন্ট জব পোস্ট করে এবং সেখানে অন্যান্য ফ্রিল্যান্সাররা একটি রেট দিয়ে বিড করে থাকে।
- প্রতিযোগিতা ভিত্তিক: প্রতিযোগিতা ভিত্তিক জবের ধরন অনেকটা 99 ডিজাইন মার্কেটপ্লেসের মত। এখানে একজন ক্লায়েন্ট একটি লোগো ডিজাইনের জন্য অফার করে এবং অন্যান্য ফ্রিল্যান্সাররা তাদের লোগো সাবমিট করে থাকে। লোগো সাবমিটের ডেড লাইন পূর্ণ হওয়ার পর একজনকে বিজয়ী ঘোষণা করে এবং পূর্ব ঘোষণা মোতাবেক তাদেরকে অর্থ প্রদান করে।
এছাড়া তাদের এখানেও আপওয়ার্ক এর মত বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিভিন্ন ধরনের জব রয়েছে।
কাজের দিক দিয়ে আমি ফ্রিল্যান্সারকে এগিয়ে রাখব। কেননা এখানে আপনি তিন ধরনের কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। অথচ আপওয়ার্কে পাচ্ছেন আপনি মাত্র দুই ধরনের কাজ। যাইহোক, আপনি যদি এখানে কাজ করার জন্যে মনস্থির করে থাকেন, তবে জেনে নিন ফ্রিল্যান্সারে অ্যাকাউন্ট খুলে কিভাবে আয় করা শুরু করবেন।
৩. সাবক্রিপশন এবং ফি
আপওয়ার্ক নাকি ফ্রিল্যান্সার – এ দু’টির মধ্যে একটি বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে আপনাকে সাবক্রিপশন এবং ফি’র দিকটাও বিশেষ বিবেচনায় রাখতে হবে।
আপওয়ার্ক – আপওয়ার্ক ৫টি মাধ্যমে টাকা দিয়ে থাকে যথা:
- ডিরেক্ট ডিপোজিট
- পেপাল
- ব্যাংক ট্রান্সফার
- লোকাল ফান্ড ট্রান্সফার
- পাইওনিয়ার
প্রত্যেকটি পেমেন্ট পদ্ধতিতে সাধারণত ৩% চার্জ কেটে থাকে। আপওয়ার্কে জব বিড করার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ চার্জ দিতে হয়। এছাড়া তাদের প্রিমিয়াম মেম্বারশীপ সুবিধা রয়েছে। আর আপওয়ার্ক ফ্রিল্যান্সারের পেমেন্ট থেকে নির্দিষ্ট পার্সেন্টের ভিত্তিকে টাকা কেটে রাখে। যথা:
- প্রথম ৫০০ বা তার কমে ডলারের জন্য ২০%।
- ৫০১ থেকে ১০,০০০ ডলারে এ ১০%।
- ১০,০০১ ডলার বা তার উপরে ৫%।
ফ্রিল্যান্সার – ফ্রিল্যান্সারের মধ্যেও প্রিমিয়াম মেম্বারশীপ সুবিধা রয়েছে। আর তাদের পেমেন্ট নেয়ার পদ্ধতিও ফ্রিল্যান্সারের মত। ক্লায়েন্টের নিকট থেকে চার্জ করা হয় মোট টাকার ৩% এবং ফ্রিল্যান্সারদের থেকে চার্জ করা হয় ১০%।
ফি এর কথা চিন্তা করলে ফ্রিল্যান্সারের চার্জ খুব কম, তাই নতুনদের জন্য ফ্রিল্যান্সার ভাল হবে বলে আমি মনে করি। তবে বেশী বাজেটের কাজের জন্য আপওয়ার্কই সেরা। অর্থাৎ, আপনি যদি বেশি পরিমাণ আয় করতে চান, তবে আপওয়ার্কে কাজ করতে পারেন। পাশপাশি কাজ পাওয়ার তুলনামূলক সহজলভ্যতা যদি বিচার করেন, তবে ফ্রিল্যান্সার।
৪. সাপোর্ট
আপওয়ার্ক – আপওয়ার্কের সাপোর্ট সিস্টেমের তালিকা যথেষ্ট ভাল। আপনি এদের থেকে বিভিন্নভাবে ও নানা উপায়ে সাপোর্ট পেয়ে থাকবেন যথা:
- লাইভ চ্যাট
- ফোন
- অনলাইন ম্যাসেজ রিকোয়েস্ট সিস্টেম
- FAQ অপশন
ফ্রিল্যান্সার – ফ্রিল্যান্সারের সাপোর্ট সিস্টেমের দিকটাও যথেষ্ট ভাল। তবে আপনি এতে ফোন কল করে কোন সাপোর্ট সুবিধা পাবেন না। যেসব পদ্ধতিতে সাপোর্ট পাবেন:
- লাইভ চ্যাট
- অনলাইন ম্যাসেজ বা ইমেল
- FAQ অপশন
আপনি হয়তো ভাবতে পারেন এসব ওয়েবসাইটে সাপোর্ট দিয়ে আর কি করবো, ইনকাম করাটাই হচ্ছে আসল! সত্যিকার অর্থে যে কোন ওয়েবসাইটে কাজ করার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাদের সাপোর্ট সিস্টেম। আপনি কত দ্রুত এবং ভালো সাপোর্ট পাচ্ছেন সেটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় দেখা গেল আপনি ক্লায়েন্টের নিকট থেকে টাকা পেলেন না কিংবা আপনার একাউন্ট এ কোন সমস্যা হল, সে ক্ষেত্রে আপনি দ্রুত সাপোর্ট পেলে আপনার জন্য অধিক মঙ্গল জনক।
৫. বিল্ট ইন অ্যাপ
আপওয়ার্ক – আপনি যখন ঘণ্টা ভিত্তিক জব করবেন, তখন প্রতিনিয়ত ক্লায়েন্টকে আপনার কাজের আপডেট দেয়ার জন্য আপওয়ার্ক তাদের একটি সফটওয়্যার সরবরাহ করবে যা কিনা UpWork Team নামে পরিচিত। এই সফটওয়্যার এর মাধ্যমে বুঝা যাবে আপনি ঠিকমতো কাজ করছেন কিনা।
অর্থাৎ এই অ্যাপটি ফ্রিল্যান্সারের কম্পিউটারের স্ক্রিনশট, মেমো, অ্যাক্টিভিটি লগ এবং ছবি প্রেরণ করে থাকে। এর মাধ্যমে ক্লায়েন্ট আপনার কাজের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানার পাশাপাশি আপনি তাদের ঘণ্টা মাফিক কাজ করছেন কিনা সেটা বুঝতে পারে।
তাদের ডেস্কটপের জন্য সফটওয়্যারটি উইন্ডোজ ম্যাক এবং লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমে কাজ করে। এছাড়া অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস এর জন্য তাদের আলাদা আলাদা অ্যাপ রয়েছে।
ফ্রিল্যান্সার – আপওয়ার্ক এর মত ফ্রিল্যান্সারেরও নিজস্ব ফ্রিল্যান্সার ট্র্যাকিং সফটওয়্যার হয়েছে। তাদের ডেক্সটপ সফটওয়্যারটি আপনি ম্যাক, লিনাক্স এবং উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে ব্যবহার করতে পারবেন। এই সফটওয়ারের কার্যকারিতাও আপওয়ার্ক এর সফটওয়্যার এর মত। এছাড়া এর অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস সংস্করণ রয়েছে যার মাধ্যমে আপনি কাজে বিট করার পাশাপাশি অন্যান্য সকল কাজ সহজেই করতে পারবেন।
তবে বলে রাখা ভালো তাদের নিজস্ব অ্যাপ ছাড়া আপনি থার্ড পার্টি অ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন । বিল্ট ইন অ্যাপ এর দিক থেকে দুটি মার্কেটপ্লেস সমানে সমান। সুতরাং এদিক দিয়ে কাউকে এগিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
শেষ কথা
এবার আপনি ঠিক করুন আপনার জন্য আপওয়ার্ক নাকি ফ্রিল্যান্সার কোনটি ভালো। আমার দিক থেকে যদি বলতে হয়, তবে বলবো নতুনদের জন্য ফ্রিল্যান্সার এবং পুরাতন তথা অভিজ্ঞদের জন্য আপওয়ার্ক সেরা। তবে আমার কথায় সিদ্ধান্ত নিলে হবে না, আপনাকে আপনার সুবিধার কথা ভাবতে হবে এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
Leave a Reply