গরিলা গ্লাস শব্দটির সঙ্গে নিশ্চয়ই আপনার পরিচয় রয়েছে। শব্দটি আপনি অবশ্যই শুনেছেন, এমনকি এই শব্দের বস্তুটিও নিশ্চয়ই ব্যবহার করেছেন। এমনকি, হতে পারে এ মুহূর্তে আপনার হাতে যে স্মার্টফোনটি রয়েছে, সেটিতেই রয়েছে গরিলা গ্লাস।
যদি আপনার স্মার্টফোনটি বেশ পুরনো হয় আর তাতে গরিলা গ্লাস না থাকে, তবুও আমি ধরে নেবো কারো না কারো মোবাইলে এই গ্লাসটি আপনি ছুঁয়ে দেখেছেন। আর এখনকার প্রায় সব স্মার্টফোনেই গরিলা গ্লাস থাকে, না থেকে উপায় নেই। কারণ, এটি ছাড়া এখন আর কেউ স্মার্টফোন কিনতে চায় না।
আপনি যদি সম্প্রতি কোন স্মার্টফোন কিনে থাকেন, তাহলে এটির স্ক্রিন টাচ করে দেখুন কত মসৃণ আর স্বচ্ছ! সারাদিন ঘষাঘষি করেও এতে কোনও দাগ ফেলা যায় না, এটি এতটাই রেসিলিয়েন্ট।
কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, গরিলা গ্লাসটা আসলে কি, এটি কি দিয়ে তৈরি আর কিভাবেইবা কাজ করে! তবে, জানুন গরিলা গ্লাসের আবিস্কার ও বিস্তারিত ইতিহাস-
গরিলা গ্লাস কি?
গরিলা গ্লাস এমন একটি বিশেষ ধরণের গ্লাস যা সহজে ভাঙ্গে না, যাতে সহজে দাগ পড়ে না এবং যা টাচ স্ক্রিণের জন্যে সবচেয়ে বেশি উপযোগী। স্মার্টফোন, ট্যাবলেটসহ যাবতীয় টাচস্ক্রিন ডিভাইসকে দাগ পড়া থেকে বাঁচাতে, সামান্য আঘাতে ভেঙ্গে যাওয়া বা ফেটে যাওয়া থেকে প্রতিরোধ করতে গরিলা গ্লাস তৈরি করা হয়।
গরিলা নামের একটি বন্য প্রাণী রয়েছে যার গায়ের চামড়া ও শরীর ভীষণ শক্ত। সামান্য আঘাতে যার গায়ে তেমন কোন প্রভাব পড়ে না। মূলত, এই শক্তিশালী প্রাণীটির নামের সাথে মিল রেখেই টাচস্ক্রিন ডিভাইসগুলোর ডিসপ্লে গ্লাসের নাম দেয়া হয় গরিলা।
গরিলা গ্লাস কি দিয়ে তৈরি?
গরিলা গ্লাস মূলত আলকালি-অ্যালুমিনোসিলিকেট নামের এক ধরণের ম্যাটেরিয়্যাল, যা অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন আর অক্সিজেনের সমন্বয়ে তৈরি। এই ম্যাটেরিয়্যাল প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না আর এটি তৈরি করা হয়েছে যে কোন গ্লাসকে, বিশেষ করে স্মার্টফোন আর ট্যাবলেটের স্ক্রিনকে শক্ত, মজবুত আর মসৃণ করার জন্য।
গরিলা গ্লাসের প্রধান উপাদান আলকালি-অ্যালুমিনোসিলিকেট মূলত গ্লাসের একটি শিট। এটি প্রাথমিক পর্যায়ে পোর্টেবল ইলেকট্রোনিক্স ডিভাইসের কাভারের জন্যে তৈরি হলেও, বর্তমানে বহুবিধ কাজে ব্যবহার করা হয়।
গরিলা গ্লাস কে তৈরি করেন?
কোন ব্যক্তি নয়, গরিলা গ্লাস তৈরি করেছে একটি প্রতিষ্ঠান যার নাম কর্নিং ইনকর্পোরেশন। এটি গ্লাস, সিরামিক ও বিভিন্ন ধরণের ম্যাটেরিয়্যাল তৈরিতে বিশেষভাবে দক্ষ অ্যামেরিকার একটি মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানী।
কোম্পানিটি ১৯৬০ সালে প্রথম Project Muscle নামের একটি শক্তিশালি গ্লাস তৈরির প্রজেক্ট হাতে নেয়। কয়েক বছরের মধ্যেই তারা সফলতা পায় এবং ‘Chemcor’ নামের খুবই শক্তিশালি একটি গ্লাস তৈরি করে ফেলে। অটোমোটিভ, এভিয়েশন ও ফার্মাসিউটিক্যালস্ কোম্পানীগুলোতে এ গ্লাসটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে, রেসিং কার তৈরি করার কাজে এ গ্লাসটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
গরিলা গ্লাসের মূল উপাদানের আবিস্কারক কর্নিং ইনকর্পোরেশন হলেও, এই উপাদানটি এখন কোরিয়া ও তাইয়ানেও তৈরি হয়। তবে, এটি আবিস্কারের কৃতিত্ব কিন্তু কর্নিং ইনকর্পোরেশনই। যারফলে, প্রায় সকল স্মার্টফোনের স্পেসিফিকেশনে আমরা ‘কনিং গরিলা গ্লাস’ কথাটি দেখতে পাই।
গরিলা গ্লাস তৈরির গল্প
অধিকাংশ আবিস্কারের পেছনেই ফ্যান্টাস্টিক কোন গল্প থাকে। গরিলা গ্লাসের পেছনেও রয়েছে দারুণ ও মজার এক গল্প।
কর্নিং ইনকর্পোরেশনের একজন কেমিস্ট এক টুকরো গ্লাসের উপর একটি এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছিলেন। এক্সপেরিমেন্টটি শেষ হলে ডন স্টোকি নামের ওই কেমিস্ট খুব হতাশ হলেন। কারণ, তিনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন তার এক্সপেরিমেন্ট ভুল হয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু সায়েন্স ফিকশন মুভির মত ভুল এক্সপেরিমেন্ট থেকে যে একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে যাবে, সেটা ডন স্টোকি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি।
গ্লাস গলানোর চুল্লিতে ডন স্টোকি এক টুকরো সংবেদনশীল গ্লাস রেখে ৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ-মাত্রায় সেটি সেট করে দিয়েছিলেন। কিন্তু যান্ত্রিক ক্রুটির ফলে চুল্লির তাপ-মাত্রা সেট হয়ে যায় ৯০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে যা ডন স্টোকি জানতেন না। উপরন্তু চুল্লির তলানিতে আগের পরীক্ষার কিছু কেমিক্যাল পড়ে ছিল যা তিনি পরিস্কার করতে ভুলে গিয়েছিলেন।
এক্সপেরিমেন্ট অনুযায়ী তিনি আশা করেছিলেন, চুল্লির তলানিতে সামান্য কিছু লিকুইড গ্লাস থাকবে, যেটাকে তিনি লিথিয়াম সিলিকেট হিসেবে ব্যবহার করবেন। কিন্তু চুল্লির ঢাকনা খুলে তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, তাঁর লিথিয়াম সিলিকেট দুধের মত সাদা একটি সিরামিক প্লেটে রূপান্তরিত হয়ে চুল্লির নিচে পড়ে রয়েছে।
ডন স্টোকি প্লেটটি তুলে এনে নাড়া-চাড়া করে দেখছিলেন। হঠাৎ এটি তাঁর হাত থেকে ফ্লোরে পড়ে যায় এবং ভেঙ্গে যাওয়ার বদলে এটি বাউন্স খেতে শুরু করে। ব্যস্, তিনি বুঝে গেলেন ভুল এক্সপেরিমেন্ট থেকে কী অসাধারণ আবিস্কারটাই না তিনি করে ফেললেন নিজের অজান্তেই!
ইয়েস, ডন স্টোকি আবিস্কার করে ফেললেন পৃথিবীর প্রথম সিনথেটিক গ্লাস-সিরামিক, যার নাম পাইরোসিরাম। এটি অ্যালুমিনিয়াম থেকে হালকা, হাই-কার্বণ স্টিল থেকে শক্ত এবং সাধারণ সোডা-লাইম গ্লাস থেকে অনেক গুণ শক্তিশালী।
এই পাইরোসিরামই পাল্টে দেয় কর্নিং ইনকর্পোরেশনের ভবিষ্যৎ, রাতারাতি কোটিপতি বনে যায় কোম্পানীটি। কারণ, মিসাইল তৈরির একটি দামী উপকরণ এটি, মহাকাশযান তৈরিতেও ব্যবহৃত হয় এই রাসায়নিক উপাদান।
যাইহোক, পরবর্তীতে পাইরোসিরাম থেকে আলকালি-অ্যালুমিনোসিলিকেট, আর এটি থেকে গোরিলা গ্লাস তৈরি করে কর্নিং ইনকর্পোরেশন। আইফোন দিয়ে শুরু হলেও এই গ্লাসটি এখন প্রায় ৮৫ ভাগ স্মার্টফোনেই ব্যবহার করা হয়।
গরিলা গ্লাসের ইতিহাস
কর্নিং ইনকর্পোরেশন প্রথম গরিলা গ্লাস তৈরি করে ২০০৫ সালে। আর এটি প্রথম আইফোনের স্ক্রিনে ব্যবহার করা হয় ২০০৭ সালে। বর্তমানে এর ৫ম জেনারেশন চলছে যা আগের ৪ জেনারেশন থেকে অনেক বেশি কার্য্যকরী ও উপকারী।
তবে, প্রথম জেনারেশন মানে স্মার্টফোনে প্রথম গোরিলা গ্লাস ব্যবহারের পেছনেও রয়েছে আরেকটি গল্প, ঠিক গল্প নয়, অনেকটা ইতিহাস বলতে পারেন।
আইফোনে তখন প্লাস্টিকের গ্লাস ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এর স্থায়িত্ব ও স্ক্রেচ পড়া নিয়ে আইফোনের ডেভেলপার টিম দারুণ দুশ্চিন্তায় দিন পার করছিল। সবকিছু ঠিক আছে, শুধু ডিসপ্লেতে ব্যবহৃত গ্লাসের মানোন্নয়ের চিন্তা পেয়ে বসে তাদের।
এর মাঝে একদিন আইফোনের এক কর্মকর্তা নিউ ইয়র্ক টাইমস্ এ কর্নিং ইনকর্পোরেশনের গরিলা গ্লাস আবিস্কারের ঘটনাটি পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে এই ধরণের গ্লাস আইফোনের ডিসপ্লেতে ব্যবহারের কথা তাঁর মাথায় এলো। অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা শেষে সবাই মিলে কোম্পানীর চিপ এক্সিকিউটিভ অফিসার স্টিভ জবস্ এর কাছে গেলেন।
পরদিনই স্টিভ জবস্ নিজে কর্নিং ইনকর্পোরেশনের চেয়ারম্যানকে মেইল করলেন। আইফোন রিলিজ দেয়ার সময় যে দোর গোড়ায় এসে গড়াগড়ি খাচ্ছে, সেটাও তিনি মেইলে উল্লেখ করলেন। বিশ্ব বিখ্যাত কোম্পানী অ্যাপলের সিইও’র মেইল পেয়ে কর্নিং ইনকর্পোরেশনের কর্মকর্তারা যারপরনাই খুশি হলেও, চিন্তায় পড়লেন সময় নিয়ে। এত অল্প সময়ে কিভাবে কাজটি শেষ করবেন!
কিন্তু এমন লোভনীয় অফার হাত ছাড়া করতে রাজী নন কর্নিং ইনকর্পোরেশন। তাই, তারা রিস্কটি নিলেন এবং ‘প্রজেক্ট গরিলা গ্লাস’ নাম দিয়ে অ্যাপলের কাজটি হাতে নিলেন এবং নির্দিষ্ট সময়ের ভেতরেই প্রজেক্টটি সফলভাবে শেষ করে ফেললেন। ব্যস, সেই থেকেই শুরু হল, স্মার্টফোনে গরিলা গ্লাস ব্যবহারের প্রচলন।
গরিলা গ্লাস কিভাবে কাজ করে?
গরিলা গ্লাসের সিক্রেট হলো এর কেমিকেল প্রসেস যাকে আইওএন পরিবর্তণ বলে। আইওএন মূলত একটা অ্যাটম যা হয় একটা ইলেকট্রনকে ধরবে অথবা নষ্ট করবে যা নেট চার্জ বহন করে থাকে। ইলেকট্রন আবার সাব-অ্যাটোমিক এর নেগেটিভ পারটিকল। একটা আইওএন নেট চার্জ তখনই পজিটিভ হয় যখন এটা একটা এক্সর্টা ইলেকট্রন পায়। আর এটি তখনই পজিটিভ হয় যখন একটি ইলেকট্রন হারায়।
অ্যাটোমিক ইলেকট্রনগুলোর নিউরাল চার্জ থাকে। কারণ, ইলেকট্রনগুলো প্রোটনগুলোর সাথে মিশে গিয়ে পজিটিভ চার্জ তৈরি করে। এখন দেখার বিষয়, আইওএন কিভাবে গ্লাসের উপর প্রভাব ফেলে।
অ্যালুমিনোসিলিকেট গ্লাস শুরু থেকেই উৎপাদন প্রক্রিয়াতে সোডিয়াম আইওএন নিয়ে থাকে। কর্নিং এই গ্লাস শিটগুলোকে পটাশিয়াম আইওএন এর সাথে মিশিয়ে দেয়। ফলে, একটা অ্যাক্টিভ মেটাল তৈরি হয় যা যে কোন মেটালের আঘাতকে প্রতিহত করতে পারে।
কাজেই, আমরা দেখি যে গরিলা গ্লাসযুক্ত স্মার্টফোনগুলো শক্ত ফ্লোরে পড়ে গেলেও সেগুলোর ডিসপ্লে গ্লাস কোন রকম ক্ষতিগ্রস্থ হয় না। আবার, অন্য কোন মেটালের আঁছড়েও গ্লাসের উপর কোন দাগ পড়ে না। কারণ, গরিলা গ্লাস তৈরিতে যে অ্যাটোমিক সোডিয়াম দেয়া হয়, তা অ্যাটোমিক পটাশিয়ামের চেয়ে ছোট।
আপনি হয়তো ভাবতে পারেন যে, সংখ্যায় কম/ বেশি কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু খেলাটা এখানেই। আপনি যদি অ্যালুমিনোসিলিকেট গ্লাস থেকে সোডিয়াম আইওনগুলো বের করে আনেন আর সেগুলোকে পটাশিয়াম আইওএনের উপর রিপ্লেস করে দেন, তাহলেই দেখবেন যে গ্লাস শিটটি ক্রমশই সংকোচন হতে শুরু করেছে।
ধরুণ, আপনার একটি জাল আছে। জালের সূতোগুলো বেশ নমণীয় কিন্তু টান টান। জালের প্রত্যেকটা ফুটোতে একটা করে গল্ফ বল রয়েছে। এখন কল্পণা করুন যে আপনি সবগুলো গল্ফ বলকে বেস বল দিয়ে পাল্টে দিলেন। তাহলে, যা ঘটবে তা ঠিক আইওএন এর উপর অ্যাটোমিক পরিবর্তণের মতোই।
এখন, নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, এটি কিভাবে কাজ করে। সোডিয়ামের উপর পটাশিয়ামের পরিবর্তণের সঙ্গে গ্লাসের আইওনিক লেবেল পাল্টে যায়। পটাশিয়াম অত্যন্ত গরম হওয়ার কারণ এটাই। কর্নিং কোম্পানীর ভাষ্য মতে, সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের মিশ্রণ ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা অতিক্রম করলেই, এটি অ্যালুমিনোসিলিকেটে রুপান্তরিত হয়ে যায়। আর সেই সাথে, গ্লাসে এমন এক শক্তি তৈরি হয় যা যে কোন মেটালের আঘাতকে দারুণভাবে প্রতিহত করতে পারে।
যাইহোক, সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যার কারণে শেষের অংশটুকু একটু খটোমটো লাগাটা স্বাভাবিক। তবে, আপনি নিশ্চয়ই এ লেখাটি পড়ে গরিলা গ্লাস সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পেয়েছেন। যদি সত্যিই পেয়ে থাকেন, আর আমার এই ক্ষুদ্র লেখাটি আপনার ভাল লেগে থাকে, তবে আমার অনুরোধ থাকবে লেখাটি আপনার প্রোপাইলে শেয়ার করে অন্যদের জানানোর।
Leave a Reply