প্রাণীদের মধ্যে কুকুরই মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু, এই বন্ধুই হয়ে উঠতে পারে আচমকা শক্র। কারণ, প্রাণী তো প্রাণীই। তার মাঝে মানুষের মতো মানবিকতা যদিও থাকে, তবু এর পশুত্ব জেগে উঠাটা অস্বাভাবিক নয়। তাই, কুকুর কামড় দিলে কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ নয়, তা জেনে রাখা সব কুকুরপ্রেমিরই প্রয়োজন।
কুকুরপ্রেম সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ছোটদের মধ্যে। বড়রাও কুকুর পালতে ভালবাসেন বটে, তবে ছোটদের আগ্রহই বেশি থাকে এই পোষাপ্রাণীটির প্রতি। ছোটদের কাছে কুকুর খেলার সাথী। আর বড়দের কাছে প্রভুভক্ত হিসেবে রয়েছে কুকুরের দারুণ সুনাম। কিন্তু, যতই প্রভুভক্ত হোক না কেন, এই প্রাণীটি প্রায়ই মানুষকে কামড় দিয়ে বসে।
কুকুরের কামড় কোনও সাধারণ বিষয় নয়। কারণ, কুকুরের কামড় থেকে অনেক বড় ধরণের সমস্যা তৈরি হতে পারে। তাই, এই বিষয়টিকে বেমালুম ভুলে থাকা বা অহেতুক অবহেলা করা মোটেই উচিৎ নয়। তাই, জেনে নিন কুকুর সম্পর্কে যাবতীয় সকল তথ্য।
কুকুর কেন কামড় দেয়?
নানা কারণেই কুকুর মানুষকে, এমনকি তার মণিবকেও কামড় দিয়ে থাকে। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কুকুর যখন মানুষের কাছ থেকে কোন প্রকারের হুমকি (sudden threat) বোধ করে, তখনই সে কামড় দেয়ার জন্যে উদ্যত হয়। এটা অনেকটা নিজেকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করার জন্যে। সেই সাথে এটা একটা প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি (natural instinct) যা গৃহপালিত কুকুরসহ প্রায় সব ধরণের কুকুরের মধ্যেই বিদ্যমান।
এই কারণেই যারা কুকুর পালেন বা কুকুরের সাথে খেলতে বা মজা করতে ভালবাসেন, তাদের সকলেরই জেনে রাখা প্রয়োজন যে কী কী কারণে এটি কুকুর উদ্যত হয়ে উঠতে পারে। এমনকি, কামড় দিয়ে বসতে পারে। উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ নিচে দেয়া হলো-
- মা কুকুর তার কুকুরছানাকে যে কোনও ধরণের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে মানুষকে কামড় দিতে পারে।
- যে কোনও কুকুর নিজেকে এবং তার অঞ্চল বা তার প্যাকের সদস্যকে রক্ষা করতে গিয়ে মানুষকে কামড়াতে পারে।
- কোনও ঘুমন্ত কুকুরকে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় হঠাৎ করে জাগিয়ে দেয়ার কারণে সে ক্ষিপ্ত হয়ে কামড়ে দিতে পারে।
- অলসভাবে বসে থাকা কোনও কুকুরকে আচমকা পেছন দিক থেকে শব্দ করা কিংবা অন্য কোনও মাধ্যমে চমকে দেয়ার কারণে সে কামড় দিয়ে বসতে পারে।
- কুকুরের পাশ দিয়ে কোনও কারণে কেউ যদি দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করে, তবে কুকুর তাকেও তাড়া করতে পারে এবং কামড় বসিয়ে দিতে পারে।
- খেলাচ্ছ্বলেও কুকুর কামড় দিতে পারে। বিশেষ করে, বাচ্চাদেরকে। কারণ, কুকুর মনে করতে পারে যে, কামড় দেয়াও খেলার একটা অংশ এবং এটি বেশ মজার খেলা।
- একটি কুকুর যখন ভয়ঙ্কর কোনও পরিস্থিতিতে থাকে আর কেউ যদি ওই সময় তাকে ডিস্টার্ব করে, তবে কুকুরটি কামড় দেবে, এটাই স্বাভাবিক।
- কুকুর যদি অসুস্থ্য হয়, কিংবা শরীরেরর কোথাও কোনও আঘাত পাওয়ার কারণে ভাল বোধ না করে, তবে সে তার মনিবকেও কামড় দিতে পারে। কারণ, এই সময় সে কারো স্পর্শ চায় না, এমনকি তার প্রিয় মানুষের সংষ্পর্শ চায় না।
কুকুরের কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার টিপস্: কুকুরের বডি ল্যাংগুয়েজ বোঝার চেষ্টা করুন। দেখবেন যে, কামড় দেয়ার আগে সে সতর্কতামূলক কিছু শারীরিক অঙ্গভঙ্গি করে থাকে। ভাল করে খেয়াল করলে দেখবেন যে, তার চোখে-মুখে কিছু সতর্কতার চিহ্ণ ফুটে উঠেছে। যেমন, ঘেউ ঘেউ বা তর্জন গর্জন করা, অনমনীয় অঙ্গ-ভঙ্গি করা, বারবার এবং অতি দ্রুত লেজ নাড়ানো, ইত্যাদি। সুতরাং, ওই সময় সাবধান হয়ে যাবেন। তাকে বেশি ঘাঁটাতে যাবেন না।
কুকুরের কামড়ে কতটা শক্তি থাকে?
আপনি হয়তো মানতে চাইবেন না যে, কুকুরের কামড়ের সর্বোচ্চ শক্তি ২ হাজার পাউন্ড, কিন্তু এটাই সত্যি। তবে, সব কুকুরের কামড়ে এত শক্তি থাকে না। আর সবসময় এত শক্তি তারা ব্যয়ও করে না। আসলে, কুকুরের কামড়ে কতটা শক্তি থাকে, তা নির্ভর করে সে কতটা রাগের সাথে, কতটা ফোর্সের সাথে কামড় দিচ্ছে, ঠিক তার উপর।
যেমন, কুকুর যদি খেলাচ্ছ্বলে কামড় দেয়, তবে তার শক্তি খুবই সামান্য থাকবে। যদি সাধারণ রাগ থেকে কামড় দেয়, তবে আরেকটু বেশি শক্তি থাকবে। কিন্তু যদি প্রচন্ড রাগ থেকে কামড় দেয়, তবে তার কামড়ে অনেক শক্তি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে, কুকুরের কামড়ের শক্তি অনেকটা তার চোয়াল ও তার মুখের সাইজের উপরও নির্ভর করে। এমনকি, কুকুরের শারীরিক গঠনের উপর কামড়ের শক্তির পরিমাণ অনেকাংশেই নির্ভরশীল।
কুকুরের কামড় ও বিড়ালের কামড়ের মধ্যে পার্থক্য?
কুকুর ও বিড়াল উভয়টিই পোষা প্রাণী এবং দু’টোকেই মানুষ পালতে পছন্দ করে আর কোনটাই মানুষকে কামড় দিতে দ্বিধা বোধ করে না। তবে, বিড়াল কামড় দিলে করণীয় বিষয় খুব একটা জটিল নয়, যদি শুরুতেই ব্যবস্থা নেয়া হয়। কারণ, বিড়ালের কামড় সাধারণত কুকুরের কামড়ের চেয়ে কম বিপদজনক হয়ে থাকে।
তবে, অবস্থাভেদে কুকুরের কামড়ের চেয়েও বিড়ালের কামড় বেশি ক্ষতিকারক হতে পারে। এটা অনেকটাই নির্ভর করছে কামড়ের ধরণ এবং শরীরের কোথায় কামড় দিয়েছে সেই অবস্থানের উপর।
পশুদের কামড় বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে যে, বিড়ালের চেয়ে কুকুরের কামড়ই মানুষ বেশি খেয়ে থাকে। বিড়াল খুব কমই কামড়ায়। কিন্তু, কুকুরের কামড় খুবই কমোন একটা ব্যাপার। উভয়ের কামড়ের মধ্যে কিছু পার্থক্য তুলে ধরা হলো-
- বিড়াল সাধারণত মধ্য বয়সী মহিলাদেরকে বেশি কামড়ে থাকে। অন্যদিকে, কুকুর শিশুদেরকে বেশি কামড়ায়।
- কুকুরের চেয়ে বিড়ালের দাঁত বেশি ধারালো।
- কুকুরের কামড় যতটো না ভেতরে প্রবেশ করে বিড়ালের কামড় তার চেয়ে বেশি ভেতরে ঢুকে পড়ে।
- বিড়ালের চেয়ে কুকুরের কামড়ের ওয়েট থাকে বেশি।
- কুকুরের চেয়ে বিড়ালের কামড়ে বেশি ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবণা থাকে।
কুকুর কামড় দিলে কি হয়?
কুকুরের কামড় থেকে নানা রকম কমপ্লিকেশ তৈরি হতে পারে, যার মধ্যে ইনফেকশন, নার্ভ ও মাংশপেসী ড্যামেজ হওয়াসহ আরো কিছু ক্ষতিকর দিক রয়েছে।
ইনফেকশন
যে কোনও ধরণের ইনফেকশন হয় মূলত ব্যাকটেরিয়া থেকে। কুকুরের মুখে ব্যাকটেরিয়া বাস করে যা কুকুরের জন্যে ক্ষতিকর না হলেও মানুষের জন্যে ভয়াবহ। এসব ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে রয়েছে-
- স্ট্যাফাইলোকক্কাস (staphylococcus)
- পাস্তুরেলা (pasteurella)
- ক্যাপনোসাইটোফাগা (capnocytophaga)
এছাড়াও, কুকুরের কামড় থেকে MRSA (Methicillin-resistant Staphylococcus aureus) ইনফেকশন হতে পারে। এই ইনফেকশনটা হয় স্ট্যাফাইলোকক্কাস নামক ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু থেকে।
সাধারণত যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের ক্ষেত্রে কুকুরের কামড় থেকে ইনফেকশন হওয়ার চান্স বেশি। সুতরাং, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর উপায় জেনে নিন এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। এছাড়া, যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের ক্ষেত্রেও ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবণা প্রবল। সুতরাং, কুকুর কামড়ে দিলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন।
নার্ভ ও মাংসপেশী ড্যামেজ
কুকুরের কামড় যদি ত্বক বা চামড়া ভেদ করে অনেক ভেতরে প্রবেশ করে, তবে তা থেকে নার্ভ, মাংসপেশী এবং রক্তনালী (blood vessels) ড্যামেজ হওয়ার সম্ভাবণা থাকে। এমনকি, ছোট পর্যায়ের ক্ষত থেকেও এই ক্ষতি হতে পারে।
কুকুরের কামড় থেকে যেসব রোগ হয়
কুকুরের কামড় থেকে কমোনলি যে সমস্যাটা হয়, সেটা হচ্ছে ইনফেকশন। তবে, সবময়ই এবং সবার ক্ষেত্রেই যে ইনফেকশন হবে, তা নয়। কিন্তু, একবার যদি ইনফেকশন হয়ে যায়, তবে তা থেকে নানা রকম রোগ হতে পারে। তার মাঝে ৩টি কমোন এবং বড় ধরণের রোগ রয়েছে, যথা-
- সেপসিস (Sepsis)
- জলাতঙ্ক (Rabies)
- টিটেনাস (Tetanus)
সেপসিস সম্পর্কে বিস্তারিত
সাধারণভাবে সব কুকুরের কামড় থেকেই সেপসিস হতে পারে। তবে, যেসব পোষা কুকুরকে আগে থেকেই ট্রিটমেন্ট করা হয়, বিশেষ করে টিকা দেয়া হয়, তাদের ক্ষেত্রে সেপসিস হওয়ার সম্ভাবণা কম। সেপসিস হচ্ছে মূলত ইনফেকশনের রিঅ্যাকশন, যা কোনও কোনও ক্ষেত্রে জীবননাশের কারণ হতে পারে। সেপসিসের লক্ষণগুলো হলো-
- শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া কিংবা কমে যাওয়া।
- তীব্র ব্যথা হওয়া এবং সারাক্ষণই অস্বস্তি বোধ করা।
- দিনের বেলা অনেক এবং অস্বাভাবিক ঘুম হওয়া।
- যে কোনও সাধারণ বিষয় নিয়ে কনফিউশন তৈরি হওয়া।
সেপসিসের চিকিৎসা: কুকুরের কামড় খাওয়ার পর উপরোক্ত লক্ষণগুলো যদি কারো মাঝে দেখা দেয়, তবে ধরে নেয়া যেতে পারে যে আক্রান্ত ব্যক্তি সেপসিসে ভুগছেন। এক্ষেত্রে, ডাক্তার দেখানো জরুরী। চিকিৎসা হিসেবে ডাক্তাররা সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক এবং intravenous fluids দিয়ে থাকেন।
জলাতঙ্ক বা র্যাবিস সম্পর্কে বিস্তারিত
জলাতঙ্ক একটি গুরুতর ভাইরাল অবস্থা যা শরীরের সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমকে আক্রান্ত করে। সঠিক চিকিৎসা করা না হলে আক্রান্ত ব্যক্তি অল্প কিছু দিনের মধ্যেই মারা যেতে পারে। জলাতঙ্কের লক্ষণসমূহ-
- মাথাব্যথা, জ্বর এবং অন্যান্য ফ্লু।
- শারীরিক দূর্বলতা।
- কামড়ের চারপাশে চুলকানি বা কাঁটা জাতীয় অনুভূতি।
জলাতঙ্কের চিকিৎসা: জলাতঙ্ক হলে জলদি জলদি ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিৎ। জলাতঙ্কের চিকিৎসায় ডাক্তার সাধারণত যা দিয়ে থাকেন তা হচ্ছে series of rabies vaccines। এরপর রয়েছে rabies immune globulin।
টিটেনাস সম্পর্কে বিস্তারিত
টিটেনাস একটি ব্যাকটেরিয়া যা কুকুরের কামড় থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে থাকে এবং ইনফেকশনের সৃষ্টি করে। এটি একটি সিরিয়াস টাইপের ইনফেকশন, যার লক্ষণগুলো নিম্নরূপ-
- চোয়ালে ক্র্যাম্পিং হওয়া, খিল লাগা।
- পেশীতে খিঁচুনি উঠা, সাধারণত পেটের পেশিতে।
- খাবার গ্রহণে অসুবিধা হওয়া, বিশেষ করে খাবার গিলতে গলায় ব্যথা পাওয়া।
টিটেনাসের চিকিৎসা: টিটেনাসে আক্রান্ত রোগীকে সর্ব প্রথম যা দেয়া হয়, তা হচ্ছে টিটেনাস ভ্যাকসিন। এরপর, টিটেনাস বুষ্টার শট। কিংবা, অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়ে থাকে।
কিভাবে বুঝবেন কুকুরের কামড় থেকে ইনফেকশন হয়েছে?
কুকুর কামড় দিলেই যে ইনফেকশন হবে বিষয়টা এমন নয়। তবে, সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা করা না হলে ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে চিকিৎসা নেয়ার পরও ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবণা থাকে। নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো দ্বারা ধরে নেয়া যেতে পারে যে ইনফেকশন হয়েছে।
- কামড়কৃত স্থানের চারপাশে ফুলে যাওয়া, ঘামানো এবং লালচে অবস্থা।
- কামড়ের ফলে সৃষ্ট ব্যথা ২৪ ঘন্টার বেশি স্থায়ী হওয়া।
- ক্ষত স্থান থেকে পানি বা পুঁজ জাতীয় কোনকিছু নির্গত হওয়া।
- শরীরের আক্রান্ত স্থান নাড়াচাড়া করতে অসুবিধা বোধ করা।
- ক্ষতস্থানের চারপাশে সারাক্ষণ গরম অনুভব করা।
- জ্বর আসা, শরীর কাঁপা এবং রাতে অতিরিক্ত ঘামিয়ে ওঠা।
কুকুর কামড় দিলে কি করবেন?
কুকুরের কামড় খেলে করণীয় অনেক কাজ রয়েছে। যদি সেগুলো ঠিক মতো না করা হয়, তবে প্রথমে ইনফেকশন, পরে উপরে বর্ণিত রোগগুলোসহ আরো অনেক শারীরিক সমস্যা হতে পারে। কাজেই, কামড়ের পর করণীয় বিষয়গুলোকে অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। সুতরাং, আসুন জানা যাক কী কী করণীয় রয়েছে-
কামড় ও আঘাতের স্থান ইভালুয়েট করুন
এটা কি একটা সিঙ্গেল কামড়? নাকি মাল্টিপল? কামড়টা কি ছোট? নাকি বড় বা বিস্তৃত? কামড়টা মাংসতেই সীমাবদ্ধ নাকি হাঁড় পর্যন্ত লেগেছে? এসব কিছু আগে ইভালুয়েট করে নিতে হবে, এরপর সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে-
কামড় যদি সিঙ্গেল হয়, ছোট হয় এবং মাংসতেই সীমাবদ্ধ হয়, তবে আগে কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বণ করতে পারেন। পরে ধীরে সুস্থ্যে প্রয়োজন মাফিক ডাক্তারের কাছে যেতে পারেন। কিন্তু, কামড় যদি হয় মাল্টিপল, বিস্তৃত এবং হাঁড় পর্যন্ত, তবে দ্রুত গতিতে ডাক্তার দেখাতে হবে। যে কোনও হাসপাতাল বা ডাক্তারের চেম্বার থেকে আগে ইমার্জেন্সী ট্রিটমেন্ট নিতে হবে।
রক্ত পড়া বন্ধ করুন
কুকুরের কামড় যদি চামড়া বা ত্বক ভেদ করে, তবে রক্ত পড়া খুবই স্বাভাবিক। এতে বোঝা যায় যে, আক্রান্ত স্থানের রক্তনালি (blood vessel) ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। যদিও রক্ত পড়া একদিক থেকে ভাল, এটি জীবাণু বের করে দেয়, তবু এটি বন্ধ করাও জরুরী। নৈলে ক্রিটিক্যাল মেডিকেল কন্ডিশন তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে, যদি অতি মাত্রায় রক্তক্ষরণ হয়, তবে অবশ্যই সেটা বন্ধ করার স্টেপ নিতে হবে।
সুতরাং, যদি দেখেন যে আক্রান্ত স্থান থেকে রক্ত বের হচ্ছে, তবে আপনার প্রথম কাজ হচ্ছে রক্ত পড়া বন্ধ করা। পরিস্কার একটি কাপড় বা গজ দিয়ে রক্তাক্রান্ত স্থানে হালকা করে প্রেশার দিতে থাকুন, যতক্ষণ না রক্ত পড়া বন্ধ হয়। সাধারণত, ২ থেকে ৫ মিনিটের মাথায় রক্ত বন্ধ হয়ে যায়। মোদ্দা কথা হলো, রক্ত পড়া না বন্ধ পর্যন্ত ঠিক যেখান দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে সেখানে গজ বা কাপড় দিয়ে একটু জোরে প্রেশার দিতে থাকুন।
আক্রান্ত স্থান পরিস্কার করুন
কুকুরের কামড় যদি সাধারণ ও ছোট আকারের হয়, বিশেষ করে আক্রান্ত স্থান যদি রক্তাক্ত না হয়, তবে তো বেশ ভাল ব্যাপার। কিন্তু, আক্রান্ত স্থানে যদি কুকুরের দাঁত চামড়া ভেদ করে ভেতর পর্যন্ত গিয়ে থাকে এবং স্থানটি থেকে রক্ত নির্গত হয়, তবে অবশ্যই সেটি ভালভাবে পরিস্কার করে নিতে হবে।
পরিস্কার করতে গরম পানি এবং সাবান ব্যবহার করতে পারেন। এক্ষেত্রে, এন্টিসেফটিক সাবান (যেমন, ডেটল সাবান বা সেভলন সাবান) ব্যবহার করাটাই ভাল হবে। প্রথমে গরম পানি দিয়ে আলতো করে পরিস্কার করে নিন। ফার্মেসী থেকে সার্জিকেল তুলা কিনে নিয়ে ব্যবহার করতে পারেন।
যেসব স্থানে রক্ত দেখা যাচ্ছে, সেসব স্থানে হালকা একটু চাপ দিয়ে রক্ত বের করে দিন। এতে করে রক্তের সাথে জীবাণুগুলো বেরিয়ে যাবে। ভাল করে পরিস্কার হয়ে গেলে ব্যান্ডেজ করে নিন। সেই সাথে, একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া শুরু করুন, যাতে করে ভেতরে থাকা জীবাণুগুলো ধ্বংশ হয়ে যায় এবং বংশ বিস্তার করতে না পারে।
যদি আক্রান্ত স্থান এবং ক্ষতটি বড় ও গভীর হয়, তবে আগে পরিস্কার করে নিয়ে ডাক্তারের কাছে চলে যান। ডাক্তার বা হাসপাতাল যদি কাছাকাছি হয়, তবে পরিস্কার না করেই যেতে পারেন। এতে সুবিধা হবে যে, ডাক্তার আরো ভাল করে পরিস্কার করতে পারবেন। ফলে, আপনার ক্ষত স্থানটি পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত হওয়ার সম্ভাবণা থাকবে বেশি। ডাক্তার আপনাকে জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন বা ইনজেকশন দেবেন। সাদরে গ্রহণ করুন।
কখন ডাক্তার দেখাবেন
আসলে কুকুর কামড় দিলে সাধারণ মানুষের তৎক্ষণাতই ডাক্তার দেখনো উচিৎ। কারণ, সাধারণ লোকের মধ্যে অধিকাংশই ঠিক মতো করণীয় কাজগুলো করতে পারেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পরিবারের সদস্যরা পেরেশান হয়ে যায়। যারফলে, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না এবং সঠিক ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারে না। ফলে, সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্যে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়াই ভাল। তবে, যারা একটু সচেতন আছেন, তাদের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে ডাক্তারের কাছে না গেলেও চলে। কিন্তু, আপনাকে অবশ্যই তখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে-
- যখন কিছুতেই রক্ত বন্ধ করতে না পারবেন। বিশেষ করে, যদি রক্ত পড়া ১৫ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয়, দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাবেন।
- যদি চামড়া বিস্তৃতভাবে ছিঁড়ে থাকে কিংবা মাংসপেশী ছেদ করে কুকুরের দাঁত হাঁড় পর্যন্ত পৌছে গিয়ে থাকে। কারণ, তখন ইমাজেন্সী ভিত্তিতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে টিটেনাস শট নিতে হবে।
- ভিকটিম যদি আগে থেকেই ডায়াবেটিসের রোগী হয়ে থাকে।
- যদি ভিকটিমকে কোনও বিশেষ অসুস্থতার কারণে কেমোথেরাপি chemotherapy নিতে হয় আর এর মাঝেই কুকুর কামড়ায়।
- যদি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ বা ইনফেকশন হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। এটা বুঝবেন তখন, যখন দেখবেন যে আক্রান্ত স্থান লালচে হয়ে যাচ্ছে, ফোলা ফোলা ভাব দেখা দিচ্ছে কিংবা পানি বা পুঁজ জাতীয় কিছু বের হচ্ছে।
কুকুর কামড় দিলে কি করবেন না
পরিবারের কাউকে কুকুর কামড়ে দিলে অন্যরা তড়িঘড়ি করে নানা রকম কাজ করে বসেন। আর এতে করে অনেক কিছু ভুল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবণা থাকে। তাই, আগে থেকে যদি জেনে রাখা যায় যে, কী করা যাবে না, তবে আর ভুল হওয়ার সম্ভাবণা থাকে না। সুতরাং, নিম্নোক্ত বিষয়গুলো আগে থেকেই মনে রাখুন। যদি কুকুর কামড় দেয়, তবে-
- কোনও রকম টোটকা চিকিৎসা নেয়া যাবে না। যেমন, অনেকে বিশ্বাস করে যে, গরুর গোবর দিলে কুকুর কামড়ের পরবর্তী যে কোনও সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এগুলো ভুল বিশ্বাস।
- গ্রাম্য চিকিৎসা হিসেবে অনেকে হলুদ বাটা, মরিচের গুঁড়ো, কিংবা ঘি লাগিয়ে দিয়ে থাকেন। বিশেষ করে, গ্রামের মুরুব্বিরা এ কাজটি করেন। এটা কিছুতেই করা যাবে না।
- কোনও ধরণের অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল মলম (anti-microbial ointment) ব্যবহার করা যাবে না।
- আক্রান্ত বা ক্ষত স্থানটি সেলাই করা যাবে না।
- গোসল করা বন্ধ করা যাবে না, না হয় hydrophobia দেখা দিতে পারে।
কুকুরকে কিভাবে কামড় দেয়া থেকে বিরত রাখবেন?
- অপরিচিত কুকুরের সাথে মজা করতে যাবেন না। এমনকি, কুকুরের কাছাকাছিও হবেন না।
- যদি একান্তই অপরিচিত কুকুরের কাছে যেতে হয়, তবে গতিহীন থাকুন। বিশেষ করে, যদি দেখেন কুকুরটি আপনাকে পছন্দ করছে না, তবে নড়াচড়া করবেন না। বৃক্ষের মতো অনড় থাকুন। কুকুর সরে গেলে বা আপনার থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিলে আপনিও তাকে ছেড়ে যান।
- ছোট বাচ্চাদেরকে অপরিচিত কুকুরের কাছে যেতে দেবেন না।
- কুকুর থেকে দৌড়াবেন না। আর হঠাৎ যদি আক্রমণ করতে উদ্যত হয়, তবে চিৎকার করবেন না।
- কুকুরের সাথে খেলবেন না, বিশেষ করে অপরিচিত কুকুরের সাথে। এমনকি, পরিচিত হলেও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া কুকুরের সাথে খেলা করার কথা ভাববেন না।
- যদি কুকুরের আক্রমনে বা উদ্যত আচরণে আচমকা নিচে পড়ে যান, তবে বসে থাকুন বা শুয়া অবস্থায় থাকলে শুয়েই থাকুন, তৎক্ষণাৎ উঠবেন না। কুকুরটি শান্ত হলে পরে উঠুন।
- কুকুরের সাথে সরাসরি চোখের যোগাযোগ এড়িয়ে চলুন। অর্থাৎ, কুকুরের দিকে সরাসরি তাকাবেন না।
- যে কুকুর ঘুমাচ্ছে বা খাচ্ছে কিংবা বাচ্চা কুকুরের যত্ন নিচ্ছে, তাকে বিরক্ত করবেন না।
- কুকুরটিকে প্রথমে আপনাকে দেখতে এবং শুঁকে দেওয়ার অনুমতি না দিয়ে পোষাবেন না।
- কামড় দিলে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন।
- কুকুর পুষতে চাইলে দেখে-শুনে একটি শান্ত স্বভাবের কুকুর নিন।
উপসংহার
কুকুর কামড় দিলে কি হয়, কি করতে হয় এবং কিভাবে কুকুরের কামড় প্রতিহত করতে হয়, তার সবই বিস্তারিত জানলেন। সুতরাং, কখনোই কুকুরের কামড়কে অবহেলা করবেন না। যদি ভাবেন যে, আমি তো কুকুর পালি না, কাজেই আমার সমস্যা নেই; তাহলে ভুল করবেন। কারণ, কুকুরের কামড় কুকুর পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। যে কোনও সময় যে কোনও স্থানেই কুকুর কামড় দিতে পারে। খোদ ঢাকা শহরে প্রতি বছর ৬৬ হাজার মানুষ কুকুর কামড়ের শিকার হয়। আর কুকুরের কামড় থেকে সৃষ্ট জলাতঙ্গ রোগ প্রতি মিনিটে একজনের প্রাণ কেড়ে নেয়। এবার আপনি ভাবুন যে, আপনার কতোটা সচেতন হওয়া উচিৎ।
md ibrahim says
কুকুর কামড় দেয় কেনো?