যেহেতু বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে খুবই কম সংখ্যক নারী চলচ্চিত্র নির্মাতারা এসেছেন, সেহেতু তাদের মধ্যে থেকে সেরা নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা খুঁজে বের করাটা বেশ শক্ত ব্যাপার। তা সত্ত্বেও, কিছু প্রথিতযশা নারী নির্মাতা তাদের দুর্দান্ত অবদানের মাধ্যমে অনুপ্রেরণা রেখে গেছেন ভবিষ্যতে চলচ্চিত্র নির্মাণে নারীদের অংশগ্রহণের জন্য।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো চলচ্চিত্র পরিচালিকা ছিলেন রেবেকা। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার ঠিক আগের বছর তিনি ‘বিন্দু থেক বৃত্ত’ নামে একটি চলচ্চিত্র তৈরির মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তার পর থেকে অনেক নামী অভিনেত্রী চলচ্চিত্র নির্মাণে নিজের কৃতিত্ব রেখেছেন।
চলুন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সেরা নারী চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সম্পর্কে জেনে নেই।
বাংলাদেশের ৭ জন সেরা নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা
বাংলাদেশের সিনেমা জগতে নারীদের অগ্রযাত্রা খুব একটা কন্টকমুক্ত ছিলো না বৈকি। উল্লেখযোগ্য হারে অভিনেত্রীর আগমন ঘটলেও ঘাটতি ছিলো নারী পরিচালকের। এরই মধ্যে কিছু নাম এখনো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে।
১ / কোহিনূর আক্তার শুচন্দা
৭০ এবং ৮০ এর দশকের এই চাঞ্চল্যকর অভিনেত্রী ছিলেন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক জহির রায়হানের স্ত্রী। তিনি প্রায় দুই শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন। স্বামী পরিচালক হওয়ার সুবাদে ৭০ এর দশকের গোড়ার দিকেই তিনি ক্যামেরা এবং চিত্রনাট্যের খুটিনাটি শিখতে শুরু করেছিলেন।
৯০ এর দশকে চলচ্চিত্র জগৎ থেকে সরে গেলেও ২০০৮ সালে তিনি জহির রায়হানের কালজয়ী উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’ পরিচালনার মাধ্যমে ফিরে আসেন। স্বভাবতই আবার প্রশংসায় এবং পুরষ্কারের সয়লাবে সম্মানিত হন এই প্রতিভাবান অভিনেত্রী। সুচন্দা সেরা পরিচালক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার জিতেন এবং ২০১৯ সালে ফজলুল হক মেমোরিয়াল পুরষ্কারে ভূষিত হন।
তবে তাঁর প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্রটি ছিল ‘বিদেশ যাত্রা’ (১৯৯৮) । ১৯৯৯ সালে তাঁর দ্বিতীয় ছবিটি ছিল ‘সবুজ কোট কালো চশমা’। তিনি ৮০ এর দশক থেকেই জড়িতে ছিলেন চলচ্চিত্র প্রযোজনায়।
২ / শামীম আক্তার
শামীম আক্তার একই সাথে একজন চিত্রনাট্যকার, একজন পরিচালক এবং একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। ১৯৯১ সালে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের সাথে একটি কথাসাহিত্যিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘দ্যা কনভার্সেশন’ তৈরির মাধ্যমে সিনেমা জগতে তার পথচলা শুরু করেছিলেন। পরে ১৯৯৩ সালে ‘গ্রহনকাল’ এবং ২০১০ সালে ‘কালপুরবি’ পরিচালনা করেন। এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তিনি সিনেমা এবং টেলিভিশন প্রযোজনায় কাজ করার জন্য অনেক প্রস্তাব পেয়েছিলেন। ২০১৭ সালে তিনি ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের উপর “রিনা ব্রাউন” নামে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করেন।
পূর্ব পাকিস্তান আমলে তিনি প্রায়ই ৭০ এর দশকের সিনেমা দেখার জন্য প্রেক্ষাগৃহে যেতেন। সে সময়ের জন্য ব্যাপারটা খুবই দুঃসাহসিক ছিলো। কিন্তু এই নিবেদিত মনোভাবটিই তার ভেতর চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য এক অমোঘ আকর্ষণ তৈরি করে। ঋত্বিক ঘটক, আকিরা কুরোসাওয়া, বার্নার্ডো বার্তোলুচ্চির কাজগুলো দেখে তিনি খুবই অনুপ্রাণিত হোতেন।
এর বাইরে তিনি ১৯৮০ এর দশকে ‘চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন’-এর একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
৩ / নার্গিস আক্তার
২০০২ সালে ‘মেঘলা আকাশ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পরিচালনায় অভিষেক ঘটে নার্গিস আক্তারের। সিনেমাটি জাতীয় পুরষ্কারে সম্মানিত হয়েছিল। সেরা চিত্রনাট্য পুরষ্কার জিতেছিলেন নার্গিস। ২০০৫ সালে বহুবিবাহের অবিচারকে নির্দেশ করে তিনি সেলিনা হোসেনের গল্প অবলম্বনে তৈরি করেন ‘চার সতীনের ঘর’।
২০০৮ সালে এইডস সচেতনতার উপর ভিত্তি করে নির্মাণ করেন ‘মেঘের কোলে রোদ’। চলচ্চিত্রটি সেরা অভিনেত্রী এবং সেরা গল্প সহ ছয়টি বিভাগে ৩৩ তম জাতীয় পুরষ্কার অর্জন করে। ২০১০ সালে তাঁর চলচ্চিত্র ‘অবুঝ বউ’ এর মাধ্যমে কেবল বিনিয়োগকৃত অর্থই উঠে আসেনি, পাশাপাশি সেরা চিত্রনাট্য, সুর ও সম্পাদনা এই তিনটি বিভাগে ৩৫ তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার অর্জন করে।
৫ বছর বিরতির পর নার্গিস একটি বাণিজ্যিকভাবে সফল সিনেমা ‘পুত্র অহন পয়সাওয়ালা’ পরিচালনা করেন। এমনকি ২০১৭-এর ‘পৌষ মাসের পিড়ি’তে রোমান্টিক জনরা তৈরিতেও তিনি তার দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। তার সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘যৈবতী কন্যার মন’ এ বছরের ২৬শে মার্চ মুক্তি পেয়েছে।
৪ / রুবাইয়াত হোসেন
২০১১ সালে ‘মেহেরজান’ দিয়ে তরুণ নির্মাতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন রুবাইয়াত। সমালোচকদের নজর কাড়েন তখনই। নারী-বান্ধব কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করতে রুবাইয়াত সর্বদা বদ্ধপরিকর ছিলেন। সেই সূত্রে ২০১৫ সালে তার দ্বিতীয় ছবি ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’-এ তিনি সহকারী পরিচালক থেকে শুরু করে চিত্রগ্রাহক পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। স্বল্প পরিসরে মুক্তি পেলেও ছবিটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতি একটি শক্ত বার্তা দিতে সক্ষম হয়।
রুবাইয়াতের ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ২০১৯ সালে টরেন্টো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়েছিল। তৈরি পোশাক খাতে নারীদের বেতন বৈষম্য এবং সামাজিক অসুস্থতার প্রতি উপহাস করা এই ছবিটি বিদেশেও বহুল আলোচিত হয়েছে। টরিনো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এবং আফ্রিকান ডায়াস্পোরা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কৃত হয়েছিল Made in Bangladesh সিনেমাটি।
৫ / শাহনেওয়াজ কাকোলি
আর্ট ডিরেক্টর ও নাট্যকার শাহনেওয়াজ কাকোলি তার প্রথম ছবি ‘উত্তরের সুর’-এ নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবে বেশ নাম করে ফেলেন। এটি ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যানারে ২০১২ সালে মুক্তি পেয়েছিলো। চলচ্চিত্রটি সেরা চলচ্চিত্র সহ ৪ বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার জিতেছিলো।
কাকোলি নিজে জিতেছিলেন সেরা গল্পকারের পুরষ্কারটি। এখানে তিনি একজন পল্লী গায়ক এবং তাঁর পার্থিব উত্তেজনাকে দক্ষতার সাথে ৩৫ মিমি স্ক্রিনে চিত্রায়ন করেন। ২০১৫ সালে তিনি তৈরি করেন ‘নদীজন’, যা সেরা পার্শ্ব চরিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার জিতে নেয়। তার আরেকটি নির্মাণ ‘জলরঙ’ একই বছর মুক্তি পায়।
৬ / সামিয়া জামান
একজন নিবেদিত সাংবাদিক হিসেবেই তার মিডিয়াতে পথচলা শুরু। ৯০ এর দশকে তিনি বিবিসি এবং একুশে টেলিভিশনে সাংবাদিক এবং উপস্থাপক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ৮০ এর দশকে একজন সক্রিয় কর্মী হিসাবে শর্ট ফিল্ম আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত ছিলেন। বর্তমানে তিনি একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সম্পাদক হিসাবে কাজ করছেন।
সাংবাদিকতার কারণে ক্যামেরা এবং মিডিয়ার প্রতি তার বিশেষ অনুরাগ ছিল। আর এরই বিশদ পরিস্ফুটন ঘটেছিলো ২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রানি কুঠির বাকি ইতিহাস’ ছবিতে। ছবিটি স্বল্প পরিসরে মুক্তি পেলেও ইতিমধ্যে চলচ্চিত্রটির গানগুলি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
২০১৪ সালে, ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যানারে এবং সরকারী অনুদানে তার দ্বিতীয় ছবি ‘আকাশ কত দূরে’ প্রকাশিত হয়। ছবিটি দর্শকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছিল।
৭ / শবনম ফেরদৌসী
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার এবং অনন্যা সেরা দশের পুরষ্কার বিজয়ী এই চলচ্চিত্র নির্মাতা। ১৪ তম রেইনবো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ডকুমেন্টারি ‘বিষকাব্য’-এর জন্য সেরা শর্ট ফিল্মের পুরস্কার জিতেছিলেন শবনম ফেরদৌসী। জানুয়ারী ২০১৮ পর্যন্ত তিনি সর্বমোট ১৮ টি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সবথেকে মর্মস্পর্শী অধ্যায়টি ছিলো, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে অনেক যুদ্ধশিশুকে দেশের বাইরে পাঠানো হয়েছিল। যারা দেশে থেকে গিয়েছিলো, তারা নিজেদের জন্ম পরিচয় গোপন রেখে বড় হয়েছে। এদের মতো যারা নিজের দেশে থেকে পরিচয় সংকটের মধ্যে দিন যাপন করছে, তাদেরকে খুঁজে বের করেন প্রযোজক শবনম ফেরদৌসী।
অতঃপর এইভাবে পাওয়া তিন যুদ্ধ-সন্তানের জীবনের উপর ভিত্তি করে একটি ডকুমেন্টারি বানিয়ে ফেলেন ‘জন্মসাথী’ নামে। এটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার ২০১৬ তে সেরা ডকুমেন্টারি অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। চলচ্চিত্রটির প্রযোজনায় ছিলো একাত্তর টেলিভিশন এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
অবশেষে
এই নারী চলচ্চিত্র নির্মাতারা বাংলাদেশের সংস্কৃতি এবং প্রথা অনুসারে গল্প তৈরির উপায় দেখিয়েছেন। যদিও কয়েক দশক ধরে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছায়াছবিতে অনেক অভিনেত্রী এসেছেন, তবুও সিনেমা জগতে নারী চলচ্চিত্র নির্মাতাদের অভাবটা এখনো রয়ে গেছে। তাই এই অঙ্গনে আরো বেশি নারীদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। সুস্থ ও বিশ্বমানের চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি বিনোদনের কর্মক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমতা নিশ্চিত করার জন্যও এটি প্রয়োজন।
এ বিষয়ে আপনার গুরুত্বপূর্ণ মতামত আমাদের জানাতে পারেন। আর লেখাটি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে নতুন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে নারী নির্মাতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।
Leave a Reply