হরেকরকমের খাবার দেখলেই মন চায়, উদরপূর্তি হয়ে যাক! তারপর যখন উদর সহ্য করতে পারে না, তখন হয় হজমের সমস্যা। গ্যাস জমে পেট ফুলে যায়, পেট ব্যথা, ডায়রিয়া কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্যের আগমনও দেখা যায়। খাবার ঠিকমতো হজম না হলে সুস্থ মানুষও ভোগান্তিতে পড়েন।
আর যাদের হজমের সমস্যা লেগেই থাকে, তাদের এই সমস্যা থেকে হতে পারে আরও বড় ও কঠিন রোগ।
প্রতিদিনের ব্যস্ততার ফাঁকে বাছ-বিচার করে খাবার গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। খাদ্যতালিকায় থেকেই যায় মাত্রাতিরিক্ত জাংক ফুড ও আঁশহীন খাবার। আর এ কারণে হজমের সমস্যা বেড়ে যায়। এ সমস্যা থেকে তৈরি হয় আরো নানা রকম সমস্যা, যেমন-
- গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা
- আলসার
- পেট ব্যথা
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- মলদ্বার জ্বালাপোড়া
- ডায়রিয়া, ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের পেটের সমস্যা।
হজমের এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ঔষধের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নির্ভর করুন খাবারের ওপর।
বিভিন্ন মজার খাবার খেতে ইচ্ছা হলেও হজমের সমস্যার কারণে পারছেন না। তাহলে হজম শক্তি বাড়িয়ে নিন খাবারের মাধ্যমেই। সহজলভ্য ১০টি খাবার বৃদ্ধি করবে আপনার হজম শক্তি
হজম শক্তি বৃদ্ধিকারক খাবার
হজম শক্তি বাড়িয়ে নেয়ার ১২টি প্রাকৃতিক উপায় হিসেবে খাবার গ্রহণের গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি। কাজেই, প্রত্যেকেরই জেনে রাখা প্রয়োজন কোন খাবারগুলো হজম শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক। আসুন, সেই খাবারগুলো সম্পর্কে জানা যাক-
১/ আপেল
আপেলে থাকা পেকটিন নামক আঁশ খাবার হজম হতে দারুণভাবে সাহায্য করে। হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ডায়রিয়ার সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়।
খাদ্য যন্ত্রে ইনফেকশন সমস্যার ঝুঁকিও কমিয়ে দেয় পেকটিন। খাবার হজম না হলে অনেকের কোলনে জ্বালাপোড়ার উদ্রেক হয়। আর এ সমস্যা থেকে রেহাই দেয় আপেল।
২/ পেঁপে
বাজারে সারা বছরই আপনি পাবেন পেঁপে। কাঁচা বা পাকা দুইভাবেই দারুণ সুস্বাদু ও পুষ্টিকর এই ফলটি। পেঁপেতে রয়েছে হজম শক্তি বৃদ্ধিকারী উপাদান এনজাইম।
খাদ্যে থাকা প্রোটিন ফাইবারকে ভেঙে হজম প্রক্রিয়া সহজ করে তোলে এনজাইম। গ্যাস জমে পেট ফুলে ওঠা, কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়াসহ পেটের বিভিন্ন সমস্যা থেকে রেহাই পেতে পেঁপে দারুণ উপকারী।
৩/ আদা
রান্নায় ব্যবহৃত মশলা হিসেবে আদা সবার কাছে পরিচিত হলেও ঠান্ডার সমস্যা, বমি বমি ভাব দূর করা ও হজম শক্তি বাড়ানোর জন্য প্রাচীন সময় থেকেই এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ঘরোয়া ঔষধের তালিকায় আদার স্থান উপরের দিকেই।
আদা খাবার হজম প্রক্রিয়া সহজ করে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়। গলা-বুক জ্বালাপোড়া, বমি বমি অনুভূত হওয়া থেকে রেহাই দেয় আদা। খাবার হজম না হলে পেটে যে অস্বস্তির সৃষ্টি হয়, আদা খেলে সেটি কমে যায়।
৪/ দই
দুধ খেতে পছন্দ না করলেও অনেকেই দুধের তৈরি খাদ্য দই খেয়ে থাকেন। হজমের সমস্যা থেকে রেহাই পেতে দইকে করে নিন প্রিয় খাদ্য।
দইয়ে থাকে প্রোবায়োটিকস নামক একটি উপকারী ব্যাকটেরিয়া, যা হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে। হজম শক্তি বাড়ায় এবং পাকস্থলী ও খাদ্য নালীকে রাখে সুস্থ।
গ্যাস জমে পেট ফেঁপে ওঠা, কোষ্ঠকাঠিন্য কিংবা ডায়রিয়া সমস্যার সমাধান করে প্রোবায়োটিকস।
খাওয়ার পর হজমের সমস্যা থেকে রেহাই পেতে হজমের সমস্যায় ভুক্তভোগীদের সঙ্গী হয়ে যাক একটুখানি দই।
৫/ গোলমরিচ
রান্নায় ব্যবহৃত মশলা গোলমরিচ হজম শক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বেশ উপকারী।
পেটের প্রদাহ কমাতে এবং খাদ্য কোনো রকম অস্বস্তি ছাড়াই দ্রুত হজম করতে খাদ্যযন্ত্রকে সাহায্য করে গোলমরিচ।
গোলমরিচ বা পেপারমিন্টের পাতার নির্যাস থেকে তৈরি হয় পেপারমিন্ট অয়েল। এ তেলে থাকে মেন্থল নামক একটি উপাদান যা পেটের প্রদাহ, ফুলে যাওয়া, অস্বস্তি হওয়া সবকিছুর সমস্যা থেকে রেহাই দেয়।
পরিপাক নালীর পেশিগুলোকে নরম করে তোলে আর এতে হজম প্রক্রিয়া সহজ হয়।
পরিপাক তন্ত্র থেকে খাদ্য যাতে সহজেই হজম হয়ে যায় সেজন্য পেপারমিন্ট অয়েল গ্রহণ করুন।
৬/ বীট
বীট অত্যন্ত উপকারী একটি সবজিজাতীয় খাদ্য হলেও সবার কাছে তেমন পরিচিত খাদ্য নয়।
বীট কিংবা বীটরুট দেখতে অনেকটা শালগমের মতো। এটি অত্যন্ত আঁশযুক্ত পুষ্টিকর খাবার যা হজম সমস্যায় ভুক্তভোগীদের জন্য বেশ উপকারী। বীটরুটে থাকে পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম আর ফাইবার। এগুলো খাদ্য হজমের প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে।
১ কাপ বীটে ৩.৪ গ্রাম ফাইবার থাকে যা হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে এবং খাবার পাচন প্রক্রিয়া শেষে পরিপাকতন্ত্র থেকে অপ্রয়োজনীয় পরিশিষ্টগুলো বৃহদান্ত্র বা কোলনে জমা করতে সাহায্য করে। আর এতে পরিপাক তন্ত্র ও বৃহদান্ত্র দুটোই সুস্থ থাকে।
বীটরুট সবজি, সালাদ কিংবা ব্লেন্ড করে এর জুস বানিয়েও খেতে পারেন।
৭/ গাঢ় সবুজ শাক সবজি
হজমের সমস্যা সমাধানে মহৌষধ বলা যায় শাক সবজিকে। শাকসবজি আঁশযুক্ত হওয়ায় খাবার হজমে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। খাদ্য পরিপাক তন্ত্রে হজম প্রক্রিয়া শেষে পুরো বর্জ্য যেন বেরিয়ে যায় সেক্ষেত্রে শাকসবজিতে থাকা আঁশগুলোর ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
সবুজ শাক সবজিতে থাকা ম্যাগনেসিয়াম কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে রেহাই দেয়।
পালং শাক, ব্রকোলির মতো সবুজ শাকসবজিগুলো কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা কমিয়ে আনে এবং হজম শক্তি বৃদ্ধি করে শরীরকে রাখে সুস্থ।
২০১৬ সালের একটি গবেষণায় প্রকাশিত হয়, সবুজ শাকসবজির শর্করা উপাদান উপকারী ব্যাকটেরিয়া তৈরি করে যা আমাদের খাদ্যযন্ত্রের জন্য বেশ উপকারী এবং হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে।
৮/ শসা
শসা প্রায় প্রতিদিনকার খাবারেই সালাদ হিসেবে থাকে। শসা যেমন ফাইবারযুক্ত, তেমনি মিনারেল উপাদানেও ভরপুর। ক্যালসিয়াম, ফলেট, ভিটামিন সিসহ আরও অনেক উপকারী উপাদান রয়েছে শসাতে যা আমাদের হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে।
শসা পেটের বিভিন্ন সমস্যা কমিয়ে আনে। খাবার হজম না হলে গ্যাস জমে যাওয়া, অ্যাসিডিটি হওয়া, গলা-বুক জ্বালাপোড়া হওয়া, এমন কি আলসারের সমস্যা থাকলে শসা বেশ উপকারী এবং পেটকে আরাম দেয়।
শসাতে প্রচুর পরিমাণে পানি থাকে বলে এটি খাওয়ার মাধ্যমে পেটে জ্বালাপোড়া হওয়ার মাত্রা কমে আসে।
৯/ মিষ্টি আলু
শর্করা ও ম্যাঙ্গানিজ সমৃদ্ধ মিষ্টি আলু অনেক বেশি আঁশযুক্ত হয়ে থাকে। আর হজম শক্তির জন্য আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া খুব বেশি জরুরি। মিষ্টি আলু খেলে হজমের সমস্যা দূর হয়। গ্যাস্ট্রিক থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
যাদের আলসারের সমস্যা আছে তাদের জন্য মিষ্টি আলু অনেক উপকারী।
বাজারে সবসময় পাওয়া যায় না বলে অনেকে বাসায়ই মিষ্টি আলুর গাছ লাগিয়ে থাকেন। মিষ্টি আলুর শাকও কিন্তু অনেক বেশি পুষ্টিগুণসম্পন্ন এবং খেতেও বেশ সুস্বাদু।
১০/ কলা
প্রতিদিন একটি কলা, খাবার হজম সমস্যা সমাধান। সারা বছরই কলা বাজারে পাওয়া যায়। তাই, এই উপকারী খাদ্যটি সংগ্রহ করতে তেমন কষ্ট হয় না।
গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দূর করতে কলা বেশ উপকারী। ডায়রিয়া থেকে মুক্তি পেতে, পেটের সমস্যা কমাতে কলায় থাকা পটাশিয়াম ও ইলেকট্রোলাইটস উপাদানগুলো বেশ সক্রিয় ভূমিকা রাখে।
বুক-গলা জ্বালাপোড়া, পেটে প্রদাহ, খাবার হজম বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার সমস্যা থেকে রেহাই দেয় কলা।
এই ১০টি খাবার তো আপনাকে হজমের সমস্যা থেকে রেহাই দেবে, তবে কথায় আছে প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর। তাই, সময়ের স্বল্পতা থাকলেও দ্রুত খাওয়া এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত না খাওয়াই ভালো। এছাড়া, ভাজাপোড়া খাবার ও পানীয় যতটা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়া উচিত। এসব খাদ্য এড়িয়ে বরং স্বাস্থ্যকর খাদ্যের সমন্বয়ে খাদ্য তালিকা বানিয়ে সেটি অনুযায়ী খাবার গ্রহণ করলে হজমের সমস্যাকে পুরোপুরি দূর করা সম্ভব। নিয়ন্ত্রিত খাদ্যতালিকা খাবার হজমের সমস্যাকে দূর করে আর শরীর রাখে সুস্থ।
যদি অতিমাত্রায় হজমের সমস্যা হয়, তাহলে শীঘ্রই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
Leave a Reply