রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে শরীরে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পাবে। সেই লক্ষণগুলো যদি আপনার জানা থাকে, তবে বুঝতে পারবেন আপনার শরীরের সার্বিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কোন অবস্থায় রয়েছে।
এই লেখায় এমন কিছু লক্ষণ নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি যেগুলো আপনাকে জানান দেবে আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দূর্বল হয়ে গিয়েছে বা কমে গিয়েছে। তার আগে আসুন জেনে নেই-
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কাকে বলে?
সাধারণ জ্বর, সর্দি বা কাশি হলে তা নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। আবার শরীরের কোথাও কেটে গেলে নিজ থেকেই রক্তপাত বন্ধ হয়ে যেতে দেখি আমরা। কিছুদিন পরই কাটা স্থান সম্পূর্ণ আগের মত হয়ে যায়। সৃষ্টিকর্তা আমাদের শরীরে এমন ব্যবস্থা করে দিয়েছেন যাতে শরীর কোন কারণে অসুস্থ হলে শরীর নিজেই তা ঠিক করে নিতে পারে। এ চমৎকার ব্যবস্থাটিকেই বলা হয় রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা Immune System (ইমিউন সিস্টেম)।
ইম্যুনিটি সিস্টেম প্রতিটি শরীরেই সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে। যার ফলে আমাদের চারপাশে অসংখ্য রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু থাকা সত্ত্বেও আমরা রোগাক্রান্ত হই না।
কিন্তু কিছু কিছু কারণে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। আর এটার কিছু লক্ষণও রয়েছে যেগুলো দ্বারা আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ার লক্ষণ
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল থাকলে শরীরে কিছু বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। বৈশিষ্ট্যগুলো খেয়াল করলে আমরা সহজেই আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারব। চলুন এমন ১০টি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
তবে, আগেই বলে নেয়া ভাল যে, বৈশিষ্ট্যগুলো দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ১২ উপায় রয়েছে। আসুন, আগে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দূর্বল হওয়ার লক্ষণগুলো জানা যাক-
ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া
শরীরের কোথাও পুড়ে গেলে, কেটে গেলে বা আঁচড় লাগলে কিছুদিনের মধ্যে তা আপনা-আপনি ভালো হয়ে যায়। ক্ষতস্থানে নতুন চামড়া তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়াটি শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্ভূক্ত। যত দ্রুত ক্ষত সারবে, বুঝতে হবে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ততই উন্নত।
বিপরীতভাবে, ক্ষত সারতে সময় লাগলে, বুঝতে হবে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তুলনামূলক দুর্বল।
লাগাতার সর্দি-কাশি হওয়া
বছরে দুই থেকে তিন বার সর্দি বা কাশি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কারো ক্ষেত্রে আরো বেশিও হতে পারে। তবে, বারবার সর্দি-কাশি হওয়া দুর্বল ইম্যুনিটির লক্ষণ।
সর্দি-কাশির জীবাণু আক্রমণ করার তিন থেকে চারদিনের মধ্যেই শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায়। অ্যান্টিবডি সুপ্তভাবে এসব জীবাণুকে মেরে ফেলে। ফলে, সর্দি-কাশি হতে পারে না বা হলেও দ্রুত সেরে যায়।
কিন্তু লাগাতার সর্দি-কাশি হলে বুঝতে হবে শরীরের ইম্যুনিটি বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আর ঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না।
খাদ্য পরিপাক জনিত সমস্যা
ঘনঘন পাতলা পায়খানা, পেট ফাঁপা, পেটে গ্যাস হওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি দুর্বল ইম্যুনিটি নির্দেশ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যে সকল কোষ শরীরকে নিরাপত্তা দিয়ে থাকে, তাদের ৭০ শতাংশই থাকে পরিপাকনালীর কাছাকাছি।
আমাদের পরিপাকনালীতে কিছু উপকারী ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য অনুজীব রয়েছে। এরা আমাদের ইম্যুনিটি সিস্টেমের সদস্য। এসব অনুজীব দেহের জন্যে ক্ষতিকর অন্য অনুজীবদের ধ্বংস করে প্রতিরক্ষা দিয়ে থাকে।
শরীরে এদের সংখ্যা কম থাকলে ইম্যুনিটিও দুর্বল থাকে। যার ফলে ঘনঘন পাতলা পায়খানাসহ অন্যান্য সমস্যাগুলো প্রায়ই হতে থাকে।
অল্প পরিশ্রমে ক্লান্তি
অফিসের বড় কোন প্রজেক্ট বা বিশাল কোন অনুষ্ঠান আয়োজন শেষে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। বৈবাহিক বা পারিবারিক কোন অশান্তিতে প্রচণ্ড মানসিক চাপ পড়লেও শরীরে ক্লান্তি অনুভূত হয়। এটি স্বাভাবিক ধরে নেওয়া যায়।
কিন্তু খুব সামান্য পরিশ্রম, যেমন স্বাভাবিক হাঁটা-চলা, ঘরোয়া কাজ, রান্নাবান্না, সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে ওঠা ইত্যাদি কাজের পর অত্যধিক ক্লান্ত অনুভব করা মোটেই স্বাভাবিক নয়।
আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল এসোসিয়েশনের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, দীর্ঘ সময় ধরে চাপ নিয়ে কাজ করলে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায়।
এর কারণ হচ্ছে, অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে লিম্ফোসাইট ও শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা কমে যায়। এ দুটি কোষ জীবাণু বা রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে। এদের সংখ্যা কমে গেলে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সহজেই শরীরকে আক্রমণ করতে পারে।
ঘনঘন রোগাক্রান্ত হওয়া
কিছুদিন পরপরই রোগজীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়া শরীরের জন্যে অশনি সংকেত। একটি গবেষণার রিপোর্ট অনুযায়ী, কিছু বৈশিষ্ট্য কারো মধ্যে থাকলে বুঝতে হবে তার ইম্যুনিটি সিস্টেম দুর্বল। বৈশিষ্ট্যগুলো হলো-
- কানে সংক্রমণজনিত রোগ বছরে ৪ বারের বেশি হওয়া।
- বছরে ২ বার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া।
- ব্যাকটেরিয়া জনিত সাইনুসাইটিসে বছরে ৩ বারের বেশি আক্রান্ত হওয়া।
- বছরে ২ বারের বেশি কোন কারণে এন্টিবায়োটিক নেওয়ার প্রয়োজন হওয়া।
দিনের বেশিরভাগ সময় ক্লান্তি অনুভব করা
পর্যাপ্ত ঘুম শরীরের ক্লান্তি নিমিষেই দূর করে দেয়। তবে একটানা ঘুমের পরেও যদি ক্লান্তি অনুভূত হয়, তাহলে সেটা শরীরের জন্যে মঙ্গলজনক নয়।
এটি দ্বারা বুঝা যায় শরীরে সুপ্ত কোন জীবাণুর আক্রমণ হয়েছে। এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে শরীর প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চয় করছে বা ব্যবহার করছে। ফলে, সজীব থাকার মতো পর্যাপ্ত শক্তি শরীরে অবশিষ্ট থাকে না এবং ক্লান্তি অনুভূত হয়।
দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত বা ধীর গতিতে হওয়া
ধীর গতির দৈহিক বৃদ্ধি দুর্বল ইম্যুনিটির অন্যতম লক্ষণ। এটি সাধারণত বাচ্চাদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়। প্রাপ্তবয়স্ক বা বয়স্কদের ক্ষেত্রে দৈহিক বৃদ্ধি যাচাই করা সম্ভব হয় না।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এ বৃদ্ধি স্বাভাবিক না হওয়া অপুষ্টির লক্ষণ। এর ফলে শরীরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় উপকরণ অনুপস্থিত থাকে।
রক্তের সাথে সম্পর্কিত ব্যাধি
রক্ত ও রক্তপাতের সাথে সম্পর্কিত কিছু রোগব্যাধি দুর্বল ইম্যুনিটি নির্দেশ করে থাকে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-
- হিমোফিলিয়া,
- এনিমিয়া, ইত্যাদি।
এছাড়াও কিছু ব্লাড ক্যান্সার রয়েছে যেগুলো রক্তের সাথে সম্পর্কিত রোগ এবং দূর্বল প্রতিরোধ ব্যবস্থার নির্দেশ করে। যেমন-
- লিম্ফোমা,
- লিউকেমিয়া,
- মায়েলোমা, ইত্যাদি।
স্বতঃঅনাক্রম্য ব্যাধি
স্বতঃঅনাক্রম্যতা বলতে বুঝায় শরীরের রোগ প্রতিরোধকারী কোষগুলো যখন শরীরের ভালো কোষগুলোকেই ধ্বংস করতে থাকে। এর ফলে শরীর ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে।
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে বা অতিরিক্ত কমে গেলে এ সমস্যাটি হতে পারে। এ অবস্থায় আমাদের শরীর রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে সহজেই আমরা রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ি।
অ্যালার্জি বা চর্মরোগ
জীবাণু শরীরে প্রবেশ করতে চাইলে প্রথমেই যে অঙ্গটি বাধা দান করে তা হলো শরীরের চামড়া। বাধা দিতে না পারলে তখন চামড়ায় বিভিন্ন ধরণের চর্মরোগ দেখা দিয়ে থাকে। কারো কারো ক্ষেত্রে ত্বকে শুষ্কতা দেখা যায়।
এ ধরণের বৈশিষ্ট্য থাকলে বুঝতে হবে শরীরে পর্যাপ্ত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেই।
শেষ কথা
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যদি অন পয়েন্টে থাকে, তবে আপনি লাইভ সেভিং মুডে আছেন। আর যদি অফ বা অন-অফের মাঝামাঝি থাকে, তবে বুঝতে হবে এটি দূর্বল হয়ে গিয়েছে। যেসব লক্ষণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার দূর্বলতা প্রকাশ পায়, সেগুলো জানলেন। এগুলো ছাড়াও ব্যাক্তি বিশেষে আরো কিছু ভিন্ন ভিন্ন লক্ষণ থাকতে পারে। যেমন-
- মাঝে মাঝে অকারণেই জ্বর হওয়া।
- হাত ও পায়ের মাংস পেশীতে ব্যাথা অনুভত করা।
- সারা বছরই কোন না কোন ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন হওয়া।
- বিভিন্ন জটিল রোগ (ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, এইডস) থাকা।
- অপুষ্টিতে ভোগা, ইত্যাদি।
আপনার মধ্যে যদি উপরোক্ত লক্ষণগুলো দেখা যায়, তবে যে ৭টি খাবার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় সেগুলো খাওয়া শুরু করুন। আর যদি একাধিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়, তবে সাথে সাথেই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও অন্যান্য ব্যবস্থা নিন।
Jasmin Hasan says
রোগ প্রতিরোধ করা শরীরের একটি সাধারণ কার্যক্রম। কিন্তু নানা কারণে এই কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হতে পারে। আর তখনই দেখা দেয় নানা রকম লক্ষণ। সেই লক্ষণগুলোই জানতে পারলাম হৈচৈ বাংলার এই লেখাটি পড়ে।