সামাজিক জীবনে আধুনিকতার ছোঁয়া থাকার পাশাপাশি মানুষ নতুন নতুন অনেক রোগের সাথে পরিচিত হচ্ছে। ব্লাড প্রেসার (উচ্চ রক্তচাপ), ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, ইত্যাদি। ব্লাড প্রেশারের (উচ্চ রক্তচাপ) নাম অনেকে জানলেও চোখের প্রেসারের (গ্লুকোমা) নাম জানা মানুষের সংখ্যা নিতান্তই কম।
রক্তের যেমন প্রেসার রয়েছে তেমনি চোখেরও একটি নিদিষ্ট চাপ বা প্রেসার রয়েছে। চোখের স্বাভাবিক চাপ ১০ হতে ২০ মি মি অব মারকারি। কোন কারনে এই প্রেসার বেড়ে গেলে অপটিক নার্ভে সমস্যা হতে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই রোগ হেপাটাইটিস বি, সি এর মতো নীরব ঘাতক। চোখের এই নীরব ঘাতক সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষ জানেই না।
চোখের সমস্যা হিসেবে মানুষ রাতকানা রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানে। এছাড়া, সমাজের বেশির ভাগ লোক চোখের রোগ বলতে একটাই বুঝে থাকে, যা হচ্ছে চোখে ছানি পড়া।
আসলেও তাই। কারণ, সমগ্র দুনিয়ায় অন্ধত্বের এক নম্বর কারণ এই ছানি, ইংরেজীতে যাকে ক্যাটারেক্ট বলা হয়ে থাকে। কিন্তু আমরা কি অন্ধত্বের দুই নম্বর কারণটি জানি?
এটাই চোখের প্রেসার বা গ্লুকোমা।
অন্ধত্বের কারণের দিক থেকে এটা দ্বিতীয় হলেও অন্ধত্বের ধরনের দিক থেকে গ্লুকোমার গুরুত্ব অনেক উপরে। কারণ, ছানির জন্য যে অন্ধত্ব হয়, তা অস্থায়ী অন্ধত্ব (Reversible Blindness)। অর্থাৎ, অপারেশন করে সঠিক মাপের লেন্স বসিয়ে দিলে দৃষ্টি আবার আগের মত ফিরে আসে।
কিন্তু গ্লুকোমার জন্যে যে অন্ধত্ব হয়, তা স্থায়ী অন্ধত্ব (Irreversible Blindness)। অর্থাৎ, রোগের জন্য (গ্লুকোমা) যে ক্ষতি হয়ে গেছে, তা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। চিকিৎসায় উদ্দেশ্য হচ্ছে দৃষ্টি বর্তমানে যতটুকু আছে তা রাখার চেষ্টা করা।
গ্লুকোমা কি?
চোখের ভেতরের চাপ (Intraocular Pressure) বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে চোখের স্নায়ুর (অপটিক নার্ভ) ক্ষতিসাধন হয়। ফলে, ধীরে ধীরে আমাদের দৃষ্টিসীমা কমতে থাকে। একে নিয়ন্ত্রন করতে না পারলে একসময় দৃষ্টি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। তাই, একে বলা হয় সাইলেন্ট কিলার অব দ্যা ভিশন অর্থাৎ দৃষ্টির নীরব ঘাতক।
গ্লুকোমা কেন হয়?
চোখের ভেতর প্রতিনিয়ত এক প্রকার স্বচ্ছ পানি তৈরি হয় এবং একটি নির্দিষ্ট পথে চোখ থেকে বের হয়ে রক্তে মিশে যায়। যদি কোন কারনে এই পানি চোখে থেকে বের হওয়ার পথে বাধাপ্রাপ্ত হয়, তবে এই পানি চোখের ভিতর জমতে থাকে এবং চোখে ভেতরের চাপ (Intraocular Pressure) বাড়তে থাকে। ফলে গ্লুকোমার সৃষ্টি হয়।
গ্লুকোমা কাদের হয়?
- যারা ছোটবেলা থেকেই চশমা পরে, যেমন- দূরদৃষ্টি (Hypermetropia) অথবা ক্ষীণদৃষ্টি (Myopia), যাই হোক না কেন উভয়েরই পরিণত বয়সে গ্লুকোমা হতে পারে।
- যাদের বাবা-মা অথবা নিকটাত্মীয় (চাচা, ফুফু, মামা, খালা) এদের যে কারো গ্লুকোমা থাকলে পরিণত বয়সে তাদেরও গ্লুকোমা হতে পারে।
- চোখের অ্যালার্জির (চুলকানি) জন্য যারা দীর্ঘ দিন স্টেরয়েড জাতীয় চোখের ড্রপ ব্যবহার করেন, তাদের যে-কোন বয়সেই গ্লুকোমা হতে পারে।
- চোখের অভ্যন্তরে প্রদাহ (Uveitis-ইউবআইটিস) হলে এই রোগের উপযুক্ত চিকিৎসা সময় মতো না করলে এই রোগের কারণেও গ্লুকোমা হতে পারে।
- শ্বাসকষ্টের জন্য অনেকেই স্টেরয়েড জাতীয় বড়ি খেয়ে থাকেন। এসব বড়ি অনেকদিন খেলে চোখে ছানি পড়ার পাশাপাশি গ্লুকোমাও হতে পারে।
- যারা ডায়াবেটিস অথবা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, তারাও গ্লুকোমার ঝুঁকির মধ্যে আছেন।
- অনেক ক্ষেত্রে শিশুর জন্মগত ত্রুটির কারণেও শিশু অথবা কিশোর বয়সে গ্লুকোমা হতে পারে।
গ্লুকোমা থেকে বাঁচার উপায় কি?
- যারা ছোটবেলা থেকেই চশমা পরেন এবং যাদের বাবা-মা অথবা নিকটাত্মীয় কারো গ্লুকোমা আছে, তাদের বয়স ত্রিশের পর থেকে বছরে অন্তত একবার চোখের প্রেসার (IOP- Intraocular Pressure) মাপা উচিত। সেই সাথে চোখের ভেতরের স্নায়ু (Optic Nerve) পরীক্ষা করা উচিত। উদ্দেশ্য হলো রোগের শুরুতেই যাতে রোগ ধরা পড়ে।
- যাদের চোখে অ্যালার্জি (চুলকানি) আছে, তারা যে বয়সেরই হোক না কেন; ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া স্টেরয়েড ড্রপ ব্যবহার করবেন না। স্টেরয়েড ড্রপ ব্যবহারের আগে এবং পরে চোখের ভেতরের স্নায়ু (অপটিক নার্ভ) ও চোখের প্রেসার দেখা উচিত।
- যারা শ্বাসকষ্টের জন্য স্টেরয়েড জাতীয় বড়ি খাচ্ছেন, তাদের প্রতি তিন থেকে ছয় মাস অন্তর অন্তত একবার চোখের প্রেসার (IOP) মাপা উচিত।
- চোখের ভিতর প্রদাহ হলে অর্থাৎ চোখ লাল ও ব্যথা (Painful Red eye) হলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
- যাদের ডায়াবেটিস অথবা উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদের বয়স চল্লিশের পর থেকে বছরে অন্তত একবার চোখের ভেতরের রেটিনা, অপটিক নার্ভ ও চোখের প্রেসার দেখা উচিত।
- শিশুদের চোখ ঝাপসা হয়ে যাওয়া, চোখ বড় হয়ে যেতে থাকা, চোখ লাল হয়ে ব্যথা ও পানি পড়া; এসব ক্ষেত্রে দ্রুত চোখের ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।
গ্লুকোমার চিকিৎসা কি?
গ্লুকোমার চিকিৎসার অনেক পদ্ধতি আছে। যেমন-
- চোখের ড্রপ
- লেজার চিকিৎসা
- অপারেশন
চোখের ড্রপ (Anti Glaucoma Drugs): ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের মতো চোখের প্রেসারও ভালো হয়ে যাওয়ার মতো অসুখ নয়। একে সারা জীবন ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। আজকাল বাজারে অনেক আধুনিক গ্লুকোমার চোখের ড্রপ পাওয়া যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দুটি জিনিস মনে রাখতে হবে।
- এক. ওষুধ কখনোই বন্ধ করা যাবে না।
- দুই. নিয়মিত তিন থেকে ছয় মাস অন্তর চোখের প্রেসার মাপতে হবে, নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা দেখতে হবে।
লেজার চিকিৎসা: যাদের চোখে ড্রপ দেওয়ার লোক নেই অথবা ওষুধ দিতে ভুলে যান, যাদের চোখের ড্রপে প্রচন্ড অ্যালার্জি হচ্ছে; তাদের ক্ষেত্রে লেজার (Laser Trabeculoplasty) দ্বারা চিকিৎসা করার পরামর্শ দেয়া যেতে পারে।
তবে, লেজারের কার্যকারিতা সব সময় একই রকম থাকে না, ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তিন থেকে পাঁচ বছর পর পুনরায় লেজার ট্রাবেকুলোপ্লাস্টি করার প্রয়োজন হতে পারে। তাই, লেজার করার পরও নিয়মিত চোখের প্রেসার মেপে দেখতে হবে নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা।
অনেক ক্ষেত্রে গ্লুকোমা প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবেও করতে হয়। যেমন- লেজার আইরিডেকটমি (Laser Peripheral Iridotomy)।
অপারেশন: যাদের একাধিক ঔষধেও গ্লুকোমা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, অথবা যাদের গ্লুকোমার ক্ষতি অনেক বেশি হয়ে গেছে, অথবা যাদের সব সময় ঔষধ কেনার সামর্থ্য নেই, তাদের ক্ষেত্রে অপারেশন উপযুক্ত পদ্ধতি।
অপারেশন করলে যদি এটি কার্যকর হয়, তবে ঔষধ না দিয়েই গ্লুকোমা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তবে, অপারেশনের কিছু জটিলতা হতেই পারে, তা মাথায় রাখতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, গ্লুকোমা নামক দৃষ্টির নীরব ঘাতকের হাত থেকে আপনার চোখ বাঁচাতে হলে, রোগের শুরুতেই রোগ ধরা পড়া খুবই জরুরী। তাই, নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
Leave a Reply