ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা প্রয়োজন সবারই। কারণ, এটি শরীরের জন্যে সব সময়ই প্রয়োজন। যদিও ভিটামিন ডি গ্রহণ করার নানা উপায় রয়েছে, তবু এটি সব ধরণের প্রাকৃতিক খাবারে পাওয়া যায় না।
এটা কারো অজানা নয় যে, ভিটামিন ডি কি আর কেন প্রয়োজন। ওডিএস এর রিপোর্ট অনুযায়ী এটা স্বীকৃত সত্য যে, মানব দেহের হাঁড়, মাংসপেশী ও নার্ভের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে ভিটামিন ডি অত্যন্ত প্রয়োজন। এছাড়াও, এই ভিটামিনটি আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে সিম্পল, সুন্দর ও ভাল রাখতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।
অন্যদিকে ভিটামিন ডি এর অভাবে দেখা দিতে পারে হৃৎরোগ, অ্যাজমা, হাঁড়ের ক্ষয়, এমনকি ক্যান্সারের মতো জটিল সমস্যা। এছাড়াও, ত্বক কালো হয়ে যাওয়া, মেদ ভুড়ি বেড়ে যাওয়াসহ আরো কিছু ছোট বড় সমস্যা দেখা দিতে পারে।
প্রাকৃতিক ভিটামিন ডি
যখন আমাদের শরীরের ত্বক সরাসরি সূর্যের আলোতে এক্সপোজ করে, তখন প্রাকৃতিকভাবেই শরীরে ভিটামিন ডি উৎপন্ন হয়। এ কারণে এটিকে সানশাইন ভিটামিনও বলা হয়।
যারা নিয়মিত সূর্যের আলোতে বের হয়ে থাকেন, তাদের শরীরে ভিটামিন ডি এর তেমন একটা অভাব দেখা দেয় না। বিশেষ করে, যারা দৈনন্দিন রৌদ্রে কাজ করেন, তাদের তো এ নিয়ে চিন্তাই করতে হয় না।
কিন্তু এমন অনেকেই রয়েছেন যারা ত্বকের সমস্যার জন্যে সূর্যের আলোর সংষ্পর্শে যেতে পারেন না। আর মহিলাদের তো সচরাচর বাসা থেকে বের হওয়া হয় না। তাই, এ ধরণের লোকেরা প্রাকৃতিকভাবে ভিটামিন ডি গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। এদের জন্যে রয়েছে এমন কিছু খাবার যেগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ডি রয়েছে।
ভিটামিন ডি পাবেন যেসব খাবারে
ভিটামিন ডি অন্যান্য কিছু ভিটামিনের মতোই ফ্যাট সলিউবল যার মানে হচ্ছে আপনাকে ভিটামিন ডি গ্রহণের জন্যে ফ্যাট জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। মাছ, মাশরুম, ফর্টিফাইড মিল্ক, টোপু, টকদইসহ আরো অনেক খাবারেই ভিটামিন ডি আছে। আসুন, ভিটামিন ডি যুক্ত কিছু খাবার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক-
ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার
তৈলাক্ত মাছে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন ডি
সব ধরণের তৈলাক্ত মাছেই তুমুল পরিমাণে ভিটামিন ডি রয়েছে। তবে, বেশি তৈলাক্ত মাছ হিসেবে পরিচিতি রয়েছে স্যামনের। স্যামন মাছে যে পরিমাণ ভিটামিন ডি আছে, আর কোনও মাছে সেই পরিমাণ নেই। আর তৈলাক্ততা ও ভিটামিন ডি এর দিক দিক থেকে পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে ম্যাকেরেল ফিশ এবং তারপর আছে সার্ডিন।
কিন্তু এ ৩টি মাছই বিদেশী, যদিও এগুলো আমাদের দেশেও পাওয়া যায়। বিশেষ করে, স্বপ্ন, পিকিউএস, আগোরাসহ বড় বড় চেইন শপগুলোতে বিদেশী এই মাছগুলো প্রায়ই পাওয়া যায়। তবে, সাধারণ মানুষ সাধারণত এ-সব শপে যেতে অভ্যস্ত নন। তাই বলে কি তারা তৈলাক্ত মাছ খাবে না!
অবশ্যই খাবে। আমাদের দেশী মাছের মধ্যে অত্যন্ত তৈলাক্ত একটি মাছ হচ্ছে তেলাপিয়া। কাজেই, ভিটামিন ডি এর অভাব রোধ করতে খেতে পারেন কম দামী এই দেশী মাছটি। এছাড়াও, দেশী মাছের মধ্যে আরো একটি তৈলাক্ত মাছ হচ্ছে কার্পু, খেতে পারেন এই মাছটিও।
বিদেশী তৈলাক্ত মাছের তালিকায় আরো আছে হেরিং ও সার্ডিন। আর দেশী মাছের মধ্যে দারুণ সুস্বাদু একটি মাছ আছে যা প্রায়ই তৈলাক্ত হয়ে থাকে, সেটি হচ্ছে ইলিশ। কাজেই, বিদেশী মাছগুলো যদি সংগ্রহ করতে না পারেন, তবে ভিটামিন ডি এর জন্যে অবশ্যই দেশী তৈলাক্ত মাছগুলো খেতে ভুলবেন না।
- স্যামন, সার্ডিন ও হেরিংসহ অন্যান্য মাছে অ্যাভারেজ ২৫০ আইইউ ভিটামিন ডি রয়েছে।
- শুধু স্যামন মাছে রয়েছে ৯৯৮ আইইউ।
কড লিভার তেলে ভিটামিন ডি প্রচুর
কড লিভার অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি সাপ্লিমেন্ট। আপনি যদি তৈলাক্ত মাছ খেতে পছন্দ না করেন, তবে কড লিভার তেলের সাপ্লিমেন্ট হতে পারে আপনার জন্যে ভিটামিন ডি পাওয়ার সহজ উপায়।
কড মাছের লিভার থেকে সংগ্রহ করা হয় বলে এর নাম কড লিভার অয়েল। এই তেলে শুধু ভিটামিন ডি-ই নয়, রয়েছে প্রচুর সম্পূরক পুষ্টি গুণ। পাশাপাশি আমাদের শরীরের জন্যে প্রয়োজনীয় ৩টি এসিড রয়েছে কড লিভারের তেলে। এগুলো হল-
- EPA বা আইকোসেপেন্টিনোয়িক এসিড (Eicosapentaenoic Acid)
- অয়েলেও ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড
- DHA বা ডোকোসেহেক্সানোয়িক এসিড (Docosahexaenoic acid)
বুঝতেই পারছেন ভিটামিন ডি এর জন্যে কড লিভার অয়েল কত গুরুত্বপূর্ণ। আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন যে, ভিটামিন ডি হিসেবে আমাদের দেশের শিশুদেরকে প্রায়ই কড লিভার অয়েল দিয়ে তৈরি ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। ক্যাপসুল ছাড়াও এটি তেলের বোতলেও পাওয়া যায়।
- প্রতি ১ টেবিল চামুচ বা ৪.৯ মিলিলিটার কড লিভার অয়েলে ৪৪৮ আইইউ ভিটামিন ডি রয়েছে যা ৫৬% ডিভি।
মাশরুমে ভিটামিন ডি আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে
ভিটামিন ডি এর একটি ইতিবাচক সোর্স হচ্ছে মাশরুম যা সচরাচর সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। আর যে ভিটামিন ডি আমাদের শরীরে Aisle প্রডিউস করে তা একমাত্র মাশরুমেই পাওয়া যায়। এছাড়া, মাশরুম আরো কিছু নন-প্রটিফাইড খাবারেরও প্রধান উৎস।
সব ধরণের মাশরুমেই ভিটামিন ডি আছে প্রচুর পরিমাণে, তবু যে মাশুরুমগুলো সূর্যের অতি বেগুণী রশ্মিতে বড় হয়, সেগুলোতে এই পরিমাণটা আরো বেশি। আমাদের শরীর যেমন সূর্যের আলোতে ভিটামিন ডি তৈরি করে নেয়, তেমনই মাশরুমও প্রাকৃতিকভাবে সূর্যের আলোর সাহায্যে নিজেদের বডিতে ভিটামিন ডি উৎপন্ন করে থাকে। কাজেই, মাশরুমকে মনে করতে পারেন ভিটামিন ডি এর প্রাকৃতিক সোর্স।
- প্রতি ১০০ গ্রাম মাশরুমে রয়েছে ৭ আইইউ ভিটামিন ডি।
তবে, চাষের মাশরুমের চেয়ে বন্য মাশরুমে ভিটামিন ডি বেশি পাওয়া যায়। বিশেষ করে, বন্য মাশরুমে ভিটামি ডি২ এর পরিমাণ অনেক বেশি।
ডিমের কুসুম ভিটামিন ডি এর দারুণ উৎস
মাশরুম খেতে পছন্দ করেন না, এমন মানুষও আছেন অনেক। তাদের জন্যে ডিমের কুসুম হতে পারে ভিটামিন ডি এর একটি দারুণ বিকল্প। অর্থাৎ, নিয়মিত ডিমের কুসুম খেয়েই আপনি নিজের শরীরে ভিটামিন ডি এর চাহিদা পূরণ করতে পারেন। আবার, এটা মনে করবেন না যে কুসুমেই কেবল ডি ভিটামিন আছে, বরং ডিমের সাদা অংশেও এটি আছে, যদিও অল্প পরিমাণে।
- একটি সাধারণ ডিমের কুসুমে ৩৭ আইইউ বা ৫% ডিভি ভিটামিন ডি থাকে।
তবে সূর্যের এক্সপোজারের উপর নির্ভর করে এই পরিমাণটা কম বেশি হতে পারে। যেমন, যে-সব মুরগী বেশিরভাগ সময় আউটসাইডে থাকে এবং নিয়মিত সূর্যের আলো পায়, সে-সব মুরগির ডিমে ডি ভিটামিন বেশি থাকে। নর্মাল পরিমাণের চেয়ে ৩/৪ গুণ বেশি।
আবার, যে-সব মুরগীকে ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার খাওয়ানা হয়, সেগুলোর ডিমে আরো বেশি ভিটামিন ডি থাকে। আর এর পরিমাণটা প্রায়ই ৭ থেকে ৮ গুণ বেশি হয়ে থাকে যা কিনা কখনো কখনো ৬, ০০০ আইইউ এর সমান হয়ে যায়।
ফর্টিফাইড ফুডে প্রচুর ভিটামিন ডি থাকে
আমরা জানি, ভিটামিন ডি এর প্রাকৃতিক উৎস কম। আর যারা ভেজিটেরিয়ান, এমনকি মাছ খাওয়াও পছন্দ করেন না, তাদের জন্যে তো ভিটামিন ডি পাওয়াটা দুস্করই বটে।
তবে, চিন্তার কিছু নেই; কিছু ফুড প্রোডাক্টস্ রয়েছে যেগুলো ভিটামিন ডি দ্বারা ফর্টিফাইড করা। যেমন-
- গরুর দুধ
- সয়া মিল্ক
- অরেঞ্জ জুস
- সিরিয়াল
- ওট মিল, ইত্যাদি।
গরুর দুধ: ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, রিবোফ্ল্যাবিনসহ আরো নানা রকম পুষ্টি গুণে ভরপুর হলেও, গরুর দুধে ভিটামিন ডি খুব একটা নেই। কিন্তু প্রায় সব দেশেই এখন গরুর দুধকে ভিটামিন ডি যোগে ফর্টিফাইড করা হয়। তাই, এ-সব ফর্টিফাইড গরুর দুধ খেয়ে ভিটামিন ডি এর চাহিদা পূর্ণ করা যেতে পারে।
- প্রতি কাপ (২৩৭ মিলি) ফর্টিফাইড গরুর দুধে ১১৫ থেকে ১৩০ আইইউ বা ১৫ থেকে ২২ পার্সেন্ট ভিটামিন ডি থাকে।
সয়া মিল্ক: মিল্ক বলতে আমরা প্রাণীর দুধকেই বুঝে থাকি। যেমন, গরু, ছেড়া, ছাগলের দুধ, ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের অনেকেই জানেন না যে প্ল্যান্ট বেইজড্ কিছু দুধ রয়েছে যেগুলো মূলত প্রাণীজ দুধের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। আর এগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে সয়া মিল্ক।
তবে, সয়া মিল্ক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গরুর দুধের সাথে ভিটামিন ডি সহযোগে তৈরি করা হয়ে থাকে। কাজেই, সয়া মিল্ক হতে পারে আপনার ডি ভিটামিনের ঘাটতি পূরণের উপায়।
- ২৩৭ মিলি বা এক কাপ পরিমাণ সয়া মিল্কে আপনি ১০৭ থেকে ১১৭ আইইউ পরিমাণ ভিটামিন ডি পাবেন।
অরেঞ্জ জুস: বিশ্বের প্রায় ৭৫% মানুষই লেকটোজ টলারেট করতে পারে না, আবার ২ থেকে ৩% মানুষের গরুর দুধে অ্যালার্জি রয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের ভিটামিন ডি এর উৎস কি হবে তাহলে!
এদের কথা চিন্তা করেই কিছু কিছু দেশে ভিটামিন ডি সহযোগে অরেঞ্জ জুসকে ফর্টিফাই করা হয়। সেই সাথে, এই ফর্টিফাইড অরেঞ্জ জুসে কখনো কখনো ক্যালসিয়ামও মেশানো হয়।
- এক কাপ অরেঞ্জ জুসে প্রায় ১০০ আইইউ বা ১২% ভিটামিন ডি রয়েছে।
কাজেই, এ ধরণের অরেঞ্জ জুস খেলে একদিকে যেমন আপনি যথেষ্ট্য পরিমাণে ভিটামিন ডি পাবেন, অন্যদিকে আপনার ক্যালসিয়ামের অভাবও কাটবে।
সিরিয়াল ও ওটমিল: কিছু সিরিয়াল আর ওটমিলও ভিটামিন ডি দ্বারা ফর্টিফাই করা হয়ে থাকে। এ রকম হাফ কাপ বা ৭৮ গ্রাম খাবার আপনাকে ৫৪ থেকে ১৩৬ আইইউ পর্যন্ত ভিটামিন ডি সাপ্লাই দিতে পারে।
শেষ কথা: ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার সম্পর্কে মোটামুটি একটা আইডিয়া পেলেন। আশা করি, এখন থেকে নিয়মিত সে-সব খাবার গ্রহণের চেষ্টা করবেন, যে-সব খাবারে ভিটামিন ডি আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে।
তবে, একটা কথা মনে রাখবেন, সূর্য রশ্মির নিচে নিয়মিত সময় কাটানো আপনাকে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ভিটামিন ডি এর পরিপূর্ণতা এনে দিতে পারে। সুতরাং, প্রাকৃতিক এ উপায়টির দিকে বেশি নজর দেয়াটাই উত্তম হবে।
এটাও সত্যি যে, অনেক মানুষের ক্ষেত্রেই ঘরে বসে রৌদ্র পাওয়া কিংবা রৌদ্রে গিয়ে ঘুরে আসা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সুতরাং, এ ধরণের মানুষের জন্যে খাদ্যের মাধ্যমে ভিটামিন ডি গ্রহণই উত্তম উপায়।
Leave a Reply