বাংলাদেশে বৃহৎ পরিসরে যে ব্যবসাগুলি পরিচালিত হচ্ছে তার মধ্যে আমদানি ও রপ্তানি ব্যবসার অবস্থান সবার উপরে। আমদানি-রপ্তানি লাইসেন্স গ্রহণ করে বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেশ ও জাতির উন্নয়নে তাদের নিজ নিজ অবদান রেখে চলেছে অবিরত। একদিকে দেশের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্য যেমন আমদানি হচ্ছে অন্যদিকে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানিও করা হচ্ছে।
চলমান এই প্রক্রিয়া বাংলাদেশের জন্য আর্ন্তজাতিক বাজারে সুনাম বয়ে নিয়ে আসছে। বাইরের দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের মধ্যে ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রাদি, বিভিন্ন ধরনের মেশিনারী, খাদ্য সামগ্রী ইত্যাদি অন্যতম। আবার পাট, তৈরী পোশাক, ঔষধ ইত্যাদি রপ্তানি খাতের উল্লেখযোগ্য পণ্য।
আমদানি-রপ্তানি ব্যবসাটি অনেক বেশি ভালজনক ব্যবসা হলেও সবার পক্ষে এটি করা সম্ভব নয়। এটি অনেক ব্যয়বহুল একটি ব্যবসা যা করার জন্য বড় ধরনের পুঁজির প্রয়োজন। পাশাপাশি এ ধরনের ব্যবসার জন্য লাইসেন্স গ্রহণ করার পদ্ধতিটিও খুব একটা সহজ নয়।
তবে, যথাযথভাবে আবেদন করতে পারলে খুব সহজেই আমদানি-রপ্তানি লাইসেন্স পাওয়া যায়। আমদানি করার জন্য যে লাইসেন্সটি প্রদান করা হয় তাকে ইমপোর্ট রেজিষ্ট্রেশন সার্টিফিকেট (আইআরসি) ও রপ্তানির লাইসেন্সকে এক্সপোর্ট রেজিষ্ট্রেশন সার্টিফিকেট (ইআরসি) বলা হয়।
তাহলে, চলুন দেরী না করে জেনে নিই কিভাবে এটি পাওয়া সম্ভব।
আমদানি-রপ্তানি লাইসেন্স
প্রথম ধাপ: ব্যাংক ফি পরিশোধ করা-
আপনি আমদানি বা রপ্তানি যে লাইসেন্সই নিতে চান না কেন, তার জন্য আপনাকে অবশ্যই প্রথমে সরকার নির্ধারিত ফি জমা দিতে হবে। উভয় ক্ষেত্রেই এই টাকা ট্রেজারী চালানের মাধ্যমে জমা দিতে হয়। টাকা জমা দেওয়ার সময় কোড নং-১-১৭৩১-০০০১-১৮০১ খাতে জমা দিতে হবে।
এবার আসি কোন লাইসেন্স নিতে কত টাকা ফি জমা দিতে হবে সেই প্রসঙ্গে। রপ্তানি লাইসেন্স পাওয়ার জন্য নির্ধারিত ফি হচ্ছে ৭০০০ টাকা এর সাথে ১৫% ভ্যাট জমা দিতে হবে। আর যদি নবায়ন করতে চান, তাহলে অতিরিক্ত আরো ১০০০ টাকা জমা দিতে হবে।
আমাদের দেশে সাধারণত আমদানির জন্য ৬টি শ্রেণীতে লাইসেন্স প্রদান করা হয়ে থাকে। এক একটি শ্রেণীর ফি এক এক রকম। আর এটা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে আমদানির সর্বোচ্চ মূল্যসীমার উপর ভিত্তি করে। যেমন-
- আপনার মূল্যসীমা যদি ৫ লক্ষ টাকা হয়ে থাকে তাহলে ৫০০০ টাকা
- ২৫ লক্ষ হলে ১০০০০ টাকা
- ৫০ লক্ষ হলে ১৮০০০
- ১ কোটি হলে ৩০০০০ এবং
- ৫ কোটি হলে ৪৫০০০ এবং ৫ কোটির উর্দ্ধে হলে সেটা হয়ে দাড়াবে ৬০০০০ টাকায়।
উপরের মত এক্ষেত্রেও আপনাকে ১৫% ভ্যাট এবং নবায়ন করতে হলে অতিরিক্ত ১০০০ টাকা দিতে হবে।
দ্বিতীয় ধাপ: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করে অনলাইনে আবেদন করা:
আমদানি-রপ্তানি লাইসেন্স নিতে হলে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের ওয়েবসাইটে থাকা নির্দিষ্ট ফরম পূরণের মাধ্যমে আবেদন করা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়া যায়। আপনাদের সুবিধার্থে কাজগুলি ধাপে ধাপে বর্ণনা করছি।
আবেদনের জন্য প্রথমেই আপনাকে আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের অনলাইন লাইসেন্সিং মডিউলের ওয়েবসাইট ভিজিট করতে হবে। ওয়েবসাইটে থাকা নিউ রেজিষ্ট্রেশন বাটনে ক্লিক করে আপনার প্রাথমিক তথ্য প্রদান করে একটি ইউজার অ্যাকাউন্ট তৈরী করতে হবে। অ্যাকাউন্ট তৈরী হয়ে গেলে আপনাকে লগইন করে আমদানি বা রপ্তানির জন্য নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করতে হবে।
আবেদন ফরমে যে-সব তথ্য প্রদান করতে হয় সেগুলি হচ্ছে-
- পূর্ববর্তী লাইসেন্স থাকলে সেটির নম্বর ও মেয়াদকাল।
- কোম্পানীর নাম, ঠিকানা ও প্রতিষ্ঠানের ধরণ।
- কোম্পানীর ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন (টিআইএন) সার্টিফিকেট।
- ভ্যাট রেজিষ্ট্রেশন সার্টিফিকেট।
- কোম্পানীর মালিকের তথ্যাদি। পার্টনারশীপ বা লিমিটেড কোম্পানী হলে অংশীদার বা বোর্ড অব ডিরেক্টরের সদস্যদের তথ্য।
- ব্যবসাটির প্রতিনিধিত্বকারী ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন এর সদস্যপদের তথ্য।
- ট্রেজারী চালানের নম্বরসহ টাকার পরিমাণের তথ্য।
এসব তথ্য প্রদান করার পরবর্তীতে ফরমের একদম নীচের দিকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদি সংযুক্ত করতে হবে। সংযুক্ত করার জন্য কাগজগুলি সুন্দরভাবে স্ক্যানিং করে নিতে হবে। কোন কাগজ যদি একাধিক পৃষ্ঠার হয়ে থাকে, তাহলে সেটি অবশ্যই পিডিএফ ফরম্যাটে সেভ করতে হবে।
এবার আসি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল পর্বে। তবে আগেই বলে রাখি চেষ্টা করবেন সবগুলি কাগজের মূল কপি স্ক্যানিং করে দাখিল করতে। তবে কোনটির যদি মূলটি দাখিল করতে না পারেন, তবে অবশ্যই সেক্ষেত্রে ওই কাগজের সত্যায়িত কপি দাখিল করতে হবে।
চলুন জেনে নিই আবেদন দাখিলের জন্য যেসব কাগজপত্র প্রয়োজন হবে তার তালিকা।
- ট্রেড লাইসেন্স। যদি এখনো ট্রেড লাইসেন্স না করে থাকেন, তাহলে ট্রেড লাইন্সেস কি? কিভাবে ট্রেড লাইন্সেস করবেন? সেটা আগে জেনে নিন।
- চেম্বার অব কমার্স বা আপনার প্রতিষ্ঠান যে ব্যবসার সাথে জড়িত, সে ব্যবসায়ের প্রতিনিধিত্বকারী ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যতার প্রমাণপত্র বা সনদ পত্র।
- ব্যাংক এর আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রমাণপত্র বা ব্যাংক সলভেন্সী সার্টিফিকেট।
- আবেদনকারীর পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
- আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয় পত্রের কপি।
- লিমিটেড কোম্পানী হলে মেমোরেন্ডাম এন্ড আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশনের কপি।
- ইনকর্পোরেশন সার্টিফিকেটের কপি।
- ট্রেজারী চালানের কপি।
সকল তথ্যাদি ঠিকভাবে পূরণ করা ও প্রয়োজনীয় কাগজগুলি যথাযথভাবে সংযুক্ত করা হলে ফরমের একদম নিচে থাকা সাবমিট বাটনে ক্লিক করে আবদনটি দাখিল করুন। আবেদন দাখিল করা সফল হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি পিডিএফ ফাইল ডাউনলোড হবে। সেটি প্রিন্ট করে পরবর্তী কাজের জন্য সংরক্ষণ করুন।
তৃতীয় ধাপ: আবেদন পত্র সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেওয়া
আগের ধাপে যে পিডিএফ ফাইলটি ডাউনলোড করেছিলেন, এবার সেটিকে প্রিন্ট করে আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তর আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে দাখিল করতে হবে। আপনার যদি পূর্বে সার্টিফিকেট বা লাইসেন্স থেকে থাকে, তাহলে সেটিও একই সাথে জমা দিয়ে দিতে হবে। এ পর্যায়ে আপনার আবেদনটি অত্র দপ্তরে গৃহীত হয়েছে মর্মে পিডিএফ ফাইলের প্রিন্ট করা কপিটিতে সিলমোহর প্রদান করা হবে।
চতুর্থ ধাপ: সীলমোহর সম্বলিত আবেদন পত্র আপলোড করা
সীলমোহর সম্বলিত আবেদন পত্রটি এ পর্যায়ে আবার আপনাকে স্ক্যান করতে হবে এবং আপনার যে অ্যাকাউন্ট থেকে আবেদন করেছিলেন, সে অ্যাকাউন্টে লগইন করে আপলোড করে দিতে হবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে অল্প সময়ের মধ্যেই আপনার ইমেইলে লাইসেন্সের অনলাইন কপি পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
তবে আপনার কাগজপত্র পর্যবেক্ষণকারী যদি কোন কাগজপত্রে কোন ধরনের ত্রুটি পান, তাহলে তিনি আবেদনটি সাময়িকভাবে স্থগিত রেখে আপনাকে কি করতে হবে তার একটি নির্দেশিকা দিবেন। আপনি লগইন করে নির্দেশিকা অনুযায়ী কাগজ পুনরায় জমা দিয়ে রি-সাবমিট করলে তারপর আপনার আবেদনটি গ্রহণ করা হবে।
আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তর বাংলাদেশে আমদানি-রপ্তানি লাইসেন্স বিতরণের কাজটি করে থাকে। উপরে বর্ণিত প্রক্রিয়াগুলি সঠিকভাবে সম্পাদন করতে পারলে এবং আপনার প্রদত্ত সব তথ্যাদি নির্ভুল হলে উপরোক্ত দপ্তর আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে এই লাইসেন্স ইস্যু করে থাকে। তবে মনে রাখতে হবে এটি একটি নবায়নযোগ্য প্রক্রিয়া। তাই, সবসময় লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পূর্বেই সেটি নবায়ন করে নেওয়া জরুরী।
Leave a Reply