রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এ-রকম খাবারের সংখ্যা অনেক বেশি। আমরা জীবন ধারণের জন্য মূল শক্তি পাই খাদ্য থেকে। খাদ্য ব্যতীত মানুষ কল্পনা করা যায় না। তবে, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য দেহের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকা জরুরি। আর এই ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে খাবার যা আমরা সব সময়ই গ্রহণ করে থাকি।
আমাদের ঘরে এবং বাহিরে রয়েছে কোটি কোটি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাসসহ বিভিন্ন রোগ জীবাণু। এক রিসার্চে দেখা যায়, শুধুমাত্র বাতাসে থাকা ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার হিসাব করলে ডাইনিং রুমে এই হার ০.৯ এবং রুমের বাহিরে ১.৪। বুঝতেই পারছেন আপনার দেহে যদি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা না থাকে, তাহলে সারা বছর আপনি রোগাক্রান্ত থাকবেন।
রোগ জীবাণু দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, সৃষ্টিকর্তা রোগের পাশাপাশি রোগ দূর করার উপায়ও দিয়েছেন। আপনার দায়িত্ব শুধু উপায় জানা। ইতোমধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ১২টি উপায় নিয়ে আলোচনা করেছি। আজকে আলোচনা করবো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এ-রকম ১০টি খাবার নিয়ে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে যে-সব খাবার খাবেন
১. লেবু জাতীয় খাবার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
লেবু নামটি দেখে নিশ্চয়ই আপনার ভিটামিন সি এর কথা মনে পড়ে গিয়েছে। আর ভিটামিন সি কি ও কেন প্রয়োজন সেটাও আপনি জানেন। আরো জেনে রাখুন যে, ভিটামিন সি এর প্রধান উৎস লেবু এবং লেবু জাতীয় ফল। এছাড়া, ভিটামিন বি আর বিটা ক্যারোটিনের উৎস এই লেবু। লেবু জাতীয় ফল সব ঋতুতেই পাওয়া যায়। আর এ ধরণের ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম হল –
- কাগজী, বাতবী জাতীয় লেবু
- বাতাবি লেবু
- কমলা
- মাল্টা
- জাম্বুরা
লেবুতে সাইট্রিক এসিড থাকার কারণে এর স্বাদ টক হয়। লেবুর সবচেয়ে বড় গুণ, এটা আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ভিটামিন সি শ্বেত রক্তকণিকার উৎপাদন বৃদ্ধি করে। আর এই শ্বেত রক্তকণিকা বিভিন্ন ক্ষতিকর সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
লেবু ক্যান্সারের জীবাণু ধ্বংস করতে সক্ষম। লেবুতে থাকা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট আপনার ত্বক ভাল রাখে। ত্বকের মধ্যে কোন জীবাণু আক্রমণ করতে পারে না। পেটের বিভিন্ন রোগ যেমন, বদ হজম প্রতিরোধ করতে সক্ষম এই লেবু।
আমাদের দেহ ভিটামিন সি নিজে থেকে তৈরি করতে পারে না। এজন্য, ভিটামিন সি জাতীয় খাবার খাওয়া প্রয়োজন। আর এই ভিটামিনটি দেহের জন্য প্রতিদিনই প্রয়োজন। তাই, খাবারের তালিকায় লেবুকে প্রতিদিন স্থান দিতে পারেন।
২. ফুলকপি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
ফুলকপি ভিটামিন এবং মিনারেলে ভরপুর। ফুলকপিতে ভিটামিন এ, সি এবং ই এর পাশাপাশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফাইবার রয়েছে। ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিংক এবং আয়রনের উৎস এই ফুলকপি। জেনে অবাক হবেন, কচু-শাকের থেকে ২ গুণ বেশি ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় ফুলকপিতে।
ক্যান্সার, টিউমার, ব্লাড প্রেশার, ফুসফুস এবং পেটের বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করতে সক্ষম এই সবজি। ফুলকপিতে থাকা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট দেহের কোষগুলোকে বিভিন্ন ক্ষতিকর জীবাণু থেকে রক্ষা করতে পারে। ফলে, ক্যান্সার কিংবা ত্বকের রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
এছাড়াও, ফুলকপিতে রয়েছে-
- ২৭ ক্যালোরি
- ২৪ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম
- ১৬ গ্রাম মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম
- ২ গ্রাম প্রোটিন
- ৫১.৬ গ্রাম ভিটামিন সি
- ০.৩ গ্রাম ফ্যাট
- ৬১ মাইক্রোগ্রাম ফোলেট
- ৫ মিলিগ্রাম কার্বোহাইড্রেট
- ৪৭ মিলিগ্রাম ফসফরাস
- ২.১ মিলিগ্রাম ফাইবার
- ০.১৯৭ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন বি৬
- ২ মিলিগ্রাম সুগার
- ১৬.৬ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে
সুতরাং, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে শীতকালের এই সবজিটি নিয়মিত খাওয়া উচিৎ।
৩. রসুন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
আমাদের প্রতিদিনের খাবারের অংশ হল রসুন। রসুন ছাড়া তরকারী রান্নার ধাপ সম্পন্ন হয় না। কিন্তু এই রসুন কেবল খাবারের স্বাদ বৃদ্ধিই করে না, বরং আমাদের অনেক প্রয়োজনীয় ভিটামিনের অভাব পূরণ করার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ করে থাকে। রসুনে জিংক, ক্যালসিয়াম, আমিষ এবং ভিটামিন সি রয়েছে।
কৃমি দূর, হজমে সহায়তা, এ্যাজমা প্রতিরোধসহ হাড়ের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম এই রসুন। এক গবেষণায় দেখা যায়, রসুন রক্তচাপ কমাতে এবং শিরাগুলো ভাল রাখতে সহায়তা করে। রসুনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর মূল রহস্য হচ্ছে এর মধ্যে থাকা অ্যালিসিনের মতো সালফারযুক্ত উপাদান।
রসুন সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য-
- রসুনের বৈজ্ঞানিক নাম Allium sativum।
- বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রসুন উৎপাদন হয় চীনে।
- রসুন মুটিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে, পেটের মেদভুড়ি কমায়
- ক্ষতিকর কোলেস্টোরেল কমাতে সাহায্য করে রসুন।
- রসুন হার্টের জন্যে হেভি উপকারি।
- যৌণশক্তি বাড়াতে রসুনের ব্যবহার অনেক প্রাচীন।
- গ্লু বা সুপার গ্লু বানাতে রসুন ব্যবহৃত হয়।
৪. হলুদ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
রসুনের মত হলুদ আমাদের তরকারী রান্নার মূল উপাদান। তবে, এই উজ্জ্বল তিক্ত স্বাদের মসলাটি কয়েক বছর ধরে বাতের ব্যথা এবং হাড়ের ব্যথার চিকিৎসার ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
এছাড়া, গবেষণায় দেখা গেছে উচ্চমাত্রায় কার্কিউমিনের কারণে পেশীর ক্ষতি হ্রাস করতে সহায়তা করে হলুদ। তাই বলা যায়, হাড়ের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হলুদের গুরুত্ব অপরিসীম।
হলুদ সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য-
- হলুদের বৈজ্ঞানিক নাম Curcuma longa।
- সবচেয়ে বেশি হলুদ উৎপাদন হয় শ্রীলংকায়।
- কাটা-ছেঁড়ার ক্ষত সারাতে হলুদের ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
- হলুদ জ্ঞানবৃদ্ধিতে সহায়ক বলে প্রাচীণকালে মনে করা হতো।
৫. আদা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
অসুস্থ রোগীর ওষুধ হিসাবে আদার ব্যবহার সেই আদিকাল থেকে। মূলত গলা ব্যথা বা স্বরভঙ্গের ক্ষেত্রে আদা বেশ উপকারী। আদা গলা এবং অন্যান্য প্রদাহজনিত অসুস্থতা কমাতে সহায়তা করে। এছাড়া, আদা বমি বমি ভাব কমাতেও বেশ ভাল কাজ করে।
আদা দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা হ্রাস করতে সহায়তা করতে পারে এবং কোলেস্টেরল-হ্রাস করতে সক্ষম বলে প্রমাণিত। তাই, যারা বিভিন্ন সময় ব্যথা জনিত রোগে আক্রান্ত, তারা নিয়মিত আদা খেতে পারেন।
আদা সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য-
- আদার বৈজ্ঞানিক নাম Zingiber officinale।
- আদা কোন মশলার গাছ নয়, বরং গাছের ডাল।
- আদা গাছ ৪ ফুটের বেশি লম্বা হয় না।
- বিশ্বের মধ্যে চীনে সবচেয়ে বেশি আদা উৎপন্ন হয়
৬. পেঁপে
পেঁপেতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পটাসিয়াম, ভিটামিন বি এবং ফোলেট থাকে। পেঁপেতে থাকা সবগুলো উপাদান আপনার সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। ভিটামিন সি দিয়ে ভরপুর পেঁপে।
প্রতিদিনের জন্য যে পরিমাণ ভিটামিন সি প্রয়োজন তার ২২৪ শতাংশ পাওয়া সম্ভব পেঁপে থেকে। পেঁপেতে পাপাইন নামক একটি হজম এনজাইম রয়েছে, যা এন্টি-ইনফ্ল্যামেটরি প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ পেঁপে আপনার পেটের জ্বালাপোড়া দূর করতে সক্ষম।
পেপে সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য-
- পেপের বৈজ্ঞানিক নাম Carica papaya।
- পেপের আদি নিবাস মেক্সিকো, প্রতিবেশি আমেরিক, বর্তমানে সব দেশেই পাওয়া যায়।
- আমেরিকায় সেপ্টেম্বর মাসে একদিন পাপায়া মান্থ পালন করা হয়।
- সাদা পাউডার হিসেবে বিখ্যাত Meat Tenderizer এর মূল উপাদান পেপে।
৭. গ্রিন টি
গ্রিন এবং ব্ল্যাক উভয় চাতে এক ধরণের অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট, ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে। কিন্তু গ্রিন টি’তে এপিগ্যালোকোটিন গ্যালেট ও অন্য শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ইজিসিজি এর পরিমাণ অনেক বেশি। ইজিসিজি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে।
গ্রিন টি অ্যামিনো অ্যাসিড এল-থানাইনিনের একটি ভাল উৎস। এল-থানাইনিন আমাদের দেহের কোষগুলোতে জীবাণুর সংক্রামণ দূর করতে সহায়তা করে। এছাড়া, গ্রিন টি ওজন কমানো, হার্ট অ্যাটাক এবং মস্তিষ্কের অনেক ভয়ংকর রোগ থেকে রক্ষ করে।
গ্রিন টি সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য-
- গ্রিন টি’র বৈজ্ঞানিক নাম Camellia sinensis।
- গ্রীন টি এবং ব্ল্যাক টি একই গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়।
- অনেকে মনে করেন গ্রীন টি এসেছে জাপান থেকে, আসলে গ্রীন টি’র মূল দেশ চীন।
- তৃতীয় থেকে ৬ষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত গ্রীন টি রাজকীয় পানীয় হিসেবে বিবেচিত ছিল।
- গ্রীন টি মাঝে মাঝে তিতা লাগে, কারণ এতে Tannins নামে এক ধরণের পদার্থ আছে।
শেষ কথা
এই ছিল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এমন ৭টি খাবারের আলোচনা। উপরে উল্লেখিত খাবার ছাড়া আরও অনেক খাবার রয়েছে। এছাড়া, বিভিন্ন মৌসুমের ফল ও সবজি, ঐ মৌসুমের রোগ জীবাণু থেকে রক্ষা করে। তাই, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মৌসুমি ফল ও সবজি খাওয়া জরুরি।
Leave a Reply