আজকাল খুব পরিচিত একটা কথা হল গুগল ট্রান্সলেট যা অনলাইন অনুবাদক হিসেবে কাজ করে। কম্পিউটার ব্যবহারে যাদের অভিজ্ঞতা আছে তাঁরা নিশ্চয়ই কোন না কোন সময়ে এটা ব্যবহার করেছেন। তখন আপনার মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জেগেছে যে এটা আসলে ঠিক কি বা কিভাবে কাজ করে? আসুন জানি, গুগল ট্রান্সলেটর কি ও কিভাবে কাজ করে।
গুগল ট্রান্সলেট কি?
গুগলের ১৮টি ফ্রি সার্ভিস এর একটি হলো এই ট্রান্সলেট যা একটি যান্ত্রিক অনুবাদ ব্যবস্থা। কোন খরচ ছাড়াই এটা ব্যবহার করা যায় এবং ব্যবহার করাও খুব সহজ। সরাসরি গুগল সার্চের মাধ্যমে বা অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস বেসড মোবাইলে অ্যাপের মাধ্যমে সাধারণ ভোক্তারা এটা ব্যবহার করতে পারে।
এছাড়া প্রয়োজনে ওয়েবসাইট ইন্টারফেস হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। ২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে এই সেবাটি প্রথম শুরু হয়েছিল, আর আজ এটি প্রায় ১০৬টি ভাষা অনুবাদ করতে পারে। এর মধ্যে ৫৯টি ভাষা অফলাইনে, ৩৮টি ভাষা ক্যামেরার মাধ্যমে, ৫০টি ভাষা ছবি আপলোড করে, ৩২টি ভাষা কথাবার্তার মধ্যে, এবং ৯৩টি ভাষা হাতের লেখা থেকেই অনুবাদ করা যায়।
নিয়মিত ব্যবহৃত ফ্রেজগুলোর সন্ধান দেয়ার জন্য ২০১৩ সাল থেকে যুক্ত হয়েছে গুগল ফ্রেজবুক। অর্থাৎ মানুষের যে যে ধরনের অনুবাদের চাহিদা জাগতে পারে তার প্রায় সবগুলোই মেটানোর পথে এগোচ্ছে গুগল ট্রান্সলেটিং ব্যবস্থা।
গুগল ট্রান্সলেট কিভাবে কাজ করে?
গুগলের ভান্ডারে শত শত ভাষার লক্ষ লক্ষ শব্দ সংরক্ষিত আছে। এছাড়াও আছে বিভিন্ন ভাষার অনুবাদের সঙ্কলন – বই, রেকর্ড, দলিলপত্র ইত্যাদি। গুগলের অ্যালগরিদম এগুলো ব্যবহার করে শিখে নেয় একটি শব্দের প্রতিশব্দ অন্য ভাষায় কি হয় এবং এর অনুবাদটি কিভাবে হতে পারে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে এই শব্দ সংগ্রহের জন্য গুগলের সবচেয়ে বড় তিনটি উৎস হল বাইবেল, ইউ এস এ এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সংবিধান আর দলিলপত্র এবং রহস্যকাহিনী।
এছাড়া অনুবাদের মান বাড়াতে গুগল ক্রাউডসোর্স করে। এর মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবীরা সরাসরি অনুবাদ করে দেয় এবং গুগল ট্রান্সলেট সেগুলো আর্কাইভে সংরক্ষণ করে রাখে। এভাবে এমনকি বাগধারা বা প্রবাদ প্রবচনের অনুবাদও আস্তে আস্তে শিখে নিচ্ছে গুগল ট্রান্সলেট।
এছাড়া ২০১৬ সাল থেকে গুগল একটি আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে আরো উন্নত প্রক্রিয়ায় অনুবাদ করার জন্য।
তবে ব্যপারটি হচ্ছে গুগল ট্রান্সলেট একমাত্র ইংরেজি ছাড়া অন্য কোন দুই ভাষায় সরাসরি অনুবাদ করে না। যেমন আপনি যদি বাংলা থেকে স্প্যানিশে অনুবাদ করতে চান, এটি প্রথমে ইংরেজিতে অনুবাদ করে তারপর স্প্যানিশে নেয়া হবে।
মেশিন ট্রান্সলেশন কি মানুষের জায়গা নিতে পারে?
গুগলের এই মাল্টিলিংগুয়াল মেশিন ট্রান্সলেশন খুবই উপকারী একটা প্রোগ্রাম, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর দিনে দিনে আরও উন্নত হয়ে চলেছে এটি। তবে মানুষের মত অনুবাদ এই প্রোগ্রামটা এখনও করতে পারে না। শাব্দিক অর্থ সঠিকভাবে দেখালেও পুরো বাক্য অনুবাদে প্রায় সময়েই গোলমাল হয়। আর বাগধারা বা প্রবাদ থাকলে তো কথাই নেই। ছোট বাক্যের অনুবাদ বড় ও জটিল বাক্যের চেয়ে ভাল হয়।
এছাড়া সব ভাষার অনুবাদ করার দক্ষতা সমান নয় গুগল ট্রান্সলেট-এর। ইউরোপিয়ান ভাষাগুলোর অনুবাদ তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে ভাল হয়। বিশেষ করে যে ভাষাগুলোর শব্দ ও ব্যাকরণরীতিতে ইংরেজির সাথে মিল আছে। যেমন ফ্রেঞ্চ ও স্প্যানিশের অনুবাদ বেশ ভাল হয়। পক্ষান্তরে চাইনিজ ততটা ভাল হয় না।
বাংলা ভাষার অনুবাদঃ
গুগল ট্রান্সলেটিং টুল এখনো আমাদের ভাষা পুরোপুরি রপ্ত করে উঠতে পারেনি। কারণ, বাংলা ভাষার জটিল ব্যাকরণ, প্রবাদ প্রবচনের প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার; প্রসঙ্গভেদে ও শব্দের টান এবং পুনরাবৃত্তি ভেদে অর্থ বদলে যায়। আর গুগল এই জটিলতাগুলো এখনো ধরতে পারছে না। তবে, দিন দিনই গুগলের বাংলা অনুবাদের উন্নতি ঘটছে।
যেমন a stitch in time saves nine এর অনুবাদ “সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়” না করে করেছে “সময়ের একটি সেলাই নয়টি সেলাই সাশ্রয় করে”। আবার “শীত শীত লাগে” এর অনুবাদ আসছে, “It takes winter”।
এ কারণেই গুগল ট্রান্সলেট আজও মানুষের বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি। এমন কি গুগল নিজেও ব্যবসার কাজে অনুবাদ করতে নিজের প্রোগ্রাম ব্যবহার করে না!
মনে রাখবেন, ট্রান্সলেশনে ভুল পেলে সেটা রিপোর্ট করা যায় এখানে, এতে ভুলগুলো শুধরে নিতে গুগলের সুবিধা হয়।
অন্যান্য ট্রান্সলেশন অ্যাপঃ
গুগলের এই ট্রান্সলেট ছাড়াও আরও কিছু ট্রান্সলেশন অ্যাপ আছে বাজারে। বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ যেমন মাইক্রোসফট ট্রান্সলেট, আইট্রান্সলেট, ট্রিপলিংগো এগুলো কমন। আর পৃথিবীর বেশিরভাগ ভাষাই অনুবাদ করতে পারে বলে গুগল ট্রান্সলেট এর সুবিধা হল এটি সবচেয়ে বড়, প্রচুর শব্দের ভাণ্ডার রয়েছে এর , বিনা পাওয়া যায় কোন বিকল্প নেই।
গুগল ট্রান্সলেট এর প্রয়োজনীয়তাঃ
যতই খুঁত থাকুক না কেন, গুগলের এই স্টেটিসটিক্যাল মেশিন ট্রান্সলেশন ছাড়া আজকের দুনিয়া চলে না। বিশেষ করে অনুবাদক হিসেবে কাজ করি বলে আমি এর দরকারটা ভালভাবেই টের পাই। এক সময় যেখানে আমাকে দুটো মোটা মোটা ডিকশনারি নিয়ে বসতে হত, সেখানে এখন এক ক্লিকেই একটি শব্দের অর্থ পেয়ে যাচ্ছি। তবে পুরো বাক্য অনুবাদ করলে আমাকে আবার সেই অনুবাদের অনুবাদ করতে হয়, উল্টো কাজ বাড়ে। তাই আমি শুধু শব্দার্থ খুঁজে নিই।
এছাড়া ভাষা শেখার জন্য ভাল সাহায্য করে এটি। যারা কোন বিদেশি ভাষা শিখতে যায় তাদের নিয়মিতই গুগল ট্রান্সলেটের দ্বারস্থ হতে হয়। বিদেশী ভাষা হিসেবে ইংরেজী শেখার অনেক অ্যাপ আছে। তবুও, বিশেষ বিশেষ শব্দের অর্থ জানার জন্যে গুগলের এই টুলটি অত্যন্ত প্রয়োজন।
এছাড়াও ছোট ছোট অসংখ্য কাজে প্রতিনিয়ত ব্যবহার হচ্ছে এই প্রোগ্রাম। যেমন ধরুন আপনি বিদেশে বেড়াতে গেছেন – সে দেশের ভাষায় একটা শব্দ খুব জানা দরকার। যেমন আপনি খেতে চান, কিভাবে অর্ডার দেবেন বুঝতে পারছেন না। বা পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। রাস্তার সাইনটা পড়তে পারেন না। সহজেই গুগল ট্রান্সলেট দিয়ে অনুবাদ করে নিন। এছাড়া গুগল ফ্রেজবুক থেকে সহজেই কমন ফ্রেজগুলোর অনুবাদ নিয়ে ব্যবহার করতে পারেন।
ফেসবুকে কেউ একটা কমেন্ট করেছে বিদেশি ভাষায়। আপনি বুঝতে পারছেন না সে কি বলেছে। জাস্ট ট্রান্সলেশনটা দেখে নিন।
এরকম আরও বহু ব্যবহারই রয়েছে জনপ্রিয় এই প্রোগ্রামটির। এ কারণেই প্রতিদিন ৫০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে গুগল ট্রান্সলেট ব্যবহার করছে।
আধুনিক যুগের যে সব প্রযুক্তি মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করে দিয়েছে তার একটি হলো গুগল ট্রান্সলেট যা সময়োপযোগী সবচেয়ে ভাল অনুবাদ ব্যবস্থা। যদিও এখনও প্রোগ্রামটিতে অনেক খুঁত রয়ে গেছে, তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
Leave a Reply