স্মার্ট টিভি কি বা কি ধরণের টিভিকে স্মার্ট টিভি বলে? প্রথমটি খুবই সাধারণ একটি প্রশ্ন যা সংজ্ঞার দাবী রাখে আর দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর খুঁজলে এর কিছু ফিচার বা সুবিধার কথা চলে আসতে পারে। লাইভ টিভির বাইরেও যে আরো একটি বিশাল বিনোদনের জগৎ রয়েছে, তার অ্যাক্সেস পেতে স্মার্ট টিভি দারুণ সহায়ক। এর মানে একটি স্মার্ট টিভি দিয়ে যে কেউ অ্যাপস্, গেমস্, লাইভ স্ট্রিমিং এবং নেট ব্রাউজসহ আরো নানা কাজ করতে পারবে।
আসলে একটি স্মার্ট টিভি শুধু মাত্র বিনোদনের কেন্দ্র বিন্দুই নয় বরং অনলাইন বিশ্বের আরো নানা সুবিধা উপভোগ করতে সাহায্য করে। বিশেষ করে, অ্যাপ স্টোর, ইউটিউবসহ আরো বহুল ব্যবহৃত অনলাইন কন্টেন্টকে আমাদের দোরগোড়ায় হাজির করে। অর্থাৎ, আপনি চাইলে স্মার্ট টিভিতে ইউটিউব চালু করে দিতে পারবেন, যেহেতু এটি অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমে চলে এবং এটি মুভি স্ট্রিমিং সাপোর্ট করে। কিছু কিছু নতুন মডেলের স্মার্ট টিভিতে ভয়েস কন্ট্রোল করা যায় এবং সেই সাথে স্মার্ট হোম ইন্টিগ্রেশন করা যায়।
আপনাকে যে স্মার্ট টিভি কিনতেই হবে, এমন নয়। চাইলে আপনি আপনার স্মার্টফোনেই টিভি দেখতে পারেন। ফোনেই টিভি দেখার জন্যে বেশ কিছু অ্যাপস্ রয়েছে যেগুলো থেকে যে কোনটি ডাউনলোড করে টিভি দেখা শুরু করতে পারেন। তবে, স্মার্ট টিভি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে রাখতে তো কোনও সমস্যা নেই, আছে কি?
অবশ্য বর্তমান সময়ে প্রায় সব কোম্পানীই তাদের টিভিগুলোকে স্মার্ট টিভি বলছে। কিন্তু সব টিভিই কি স্মার্ট টিভি আর সেগুলো আসলে কতটা স্মার্ট আর কোন টিভি কি কি ফিচার অফার দিচ্ছে এবং এক ব্র্যান্ডের সঙ্গে অন্য ব্র্যান্ডের কি পার্থক্য রয়েছে তা নিয়ে ভাবনা থাকাই স্বাভাবিক। তাই, আমাদের জানতে হবে স্মার্ট টিভি বলতে আসলে আমরা কি বুঝি।
স্মার্ট টিভি কি
স্মার্ট টিভি মূলত একটি আধুনিক টেলিভিশন সেট যা ইন্টারনেটের সঙ্গে ইন্টিগ্রেট করা থাকে। সেই সাথে এটি ওয়েব টু জিরো ফিচারের সাথে সংযুক্ত করা থাকে যা একজন ইউজারকে অডিও, ভিডিও এবং মুভিসহ নানা রকম অনলাইন কন্টেন্ট ব্যবহারের সুবিধা দেয়। একই সঙ্গে স্মার্ট টিভিতে যে কোনও ধরণের স্টিল ছবিও ভিউ করা যায়।
প্রযুক্তিগত দিক থেকে কম্পিউটার, টেলিভিশন সেট এবং সেট টপ বক্সের একটি সুসম সমন্বয় হচ্ছে স্মার্ট টিভি। সাধারণ বা আগের টিভি মূলত ব্রডকাস্টিং নির্ভর আর স্মার্ট টিভি একটি ইন্টারঅ্যাক্টিভ মিডিয়া যা ইন্টারনেট মিডিয়া এবং অন-ডিমান্ড স্ট্রিমিং মিডিয়া এবং হোম নেটওয়ার্কিং অ্যাক্সেসের একটি দারুণ সমন্বয়।
প্রায় এক শতাব্দি ধরে চলে আসা প্রচলিত টিভি এখন অনেকের কাছেই ডাম্ব বা অচল হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছে। এইচডি টিভি এন্টেনা কিংবা ক্যাবল বা অন্য কোনও এ/বি সোর্স থেকে সিগন্যাল রিসিভ করা আর ট্রান্সমিশনের মধ্যেই প্রচলিত টিভি সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে স্মার্ট টিভি এই সকল সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে এসে আরো অনেক আধুনিক সুযোগ সুবিধার সমন্বয়ে প্রযুক্তির উৎকর্ষতা এনে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে, বিশ্বব্যাপী মানুষের এখন স্মার্ট টিভির দিকেই ঝোঁক বেশি।
আমাদের দেশে স্মার্ট টিভির প্রচলণ এখনো অতটা শুরু হয়নি। শহরের কিছু কিছু বাসায় যদিও স্মার্ট টিভি দেখা যাচ্ছে, গ্রামের দিকে মানুষ এখনো স্মার্ট টিভি সম্পর্কে জানেই না। তবে, আপনি শহরে থাকেন, আর গ্রামে থাকেন, আপনার স্মার্টফোন দিয়েই টিভি ও এসি কন্ট্রোল করতে পারেন। সে যাই হোক, আসুন স্মার্ট টিভি সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জেনে রাখি।
স্মার্ট টিভি সম্পর্কে বিস্তারিত
স্মার্টফোন এবং স্মার্ট হোম ডিভাইসের মতো স্মার্ট টিভিতে রয়েছে ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি এবং প্রায় সব ধরণের অ্যাপসই সাপোর্ট করে থাকে। ফলে, ইউটিউব ও নেটফ্লিক্সসহ প্রায় সব ধরণের প্লাটফর্ম থেকেই ভিডিও স্ট্রিমিং করা যায়। এমনকি, ফেসবুকসহ সব ধরণের সোশ্যাল সাইটও ব্রাউজ করা যায়। আর গেম খেলার সুবিধা তো রয়েছেই।
স্মার্ট টিভি কতটা স্মার্ট?
স্মার্ট টিভি অনেক স্মার্ট, একটা স্মার্টফোন দিয়ে আপনি যা যা করতে পারবেন, একটা স্মার্ট টিভিতেও সেগুলোর প্রায় সবই করতে পারবেন। স্মার্ট টিভির সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে নেট ব্রাউজিং যা একজন ইউজারকে পুরো অনলাইন বিশ্বের সবকিছুরই অ্যাক্সেস দিয়ে থাকে। অনেকেই স্মার্ট টিভিতে গেম খেলে দারুণ মজা পায়। আর ইউটিউব থেকে মুভি দেখার মজা তো রয়েছেই।
স্মার্ট টিভি কিভাবে কাজ করে?
স্মার্ট টিভিতে বিল্ট-ইন ইথারনেট পোর্ট এবং ওয়াইফাই থাকে। কিছু পুরনো ভার্সণের স্মার্ট টিভিতে অ্যাডাপটার কিংবা ওয়াইফাই ফাংশনালিটির প্রয়োজন হতে পারে।
একই নেটওয়ার্ক, ব্রডব্যান্ড রাউটার, ইথারনেট বা ইন্টারনেট কানেকশন ব্যবহার করে স্মার্ট টিভি অনলাইন কানেক্টিভিটি তৈরি করে। আমরা যেমন কম্পিউটার বা স্মার্টফোনকে ইন্টারনেটের সঙ্গে কানেক্ট করি, একইভাবে স্মার্ট টিভিকে ইন্টারনেটের সঙ্গে কানেক্ট করে সবকিছুই করা যায়। তবে, ওয়াইফাই যদি আনরিচেবল দুরত্বে থাকে, তাহলে কানেকশনটাকে অ্যাভেলেবল করতে হয়।
স্মার্ট টিভি ইন্টারনেট কানেকশন পাওয়ার পর, আইএসপি লগইন ইনফর্মেশন চায় এবং লগইন করার পরই পুরো অনলাইন দুনিয়া টিভিতে এসে পড়ে। টিভি অন হলেই একটা লম্বা মেন্যু দেখা যায় যেখানে ইউটিউব, নেটফ্লিক্সসহ সব ধরণের অ্যাপ স্টোরের ক্যাটেগরি দেখা যায়। এছাড়াও, কিছু বিল্ট ইন অ্যাপস্ থাকে যা টিভি ব্যবহারকে সহজ করে তোলে।
যখনই একজন ভিউয়ার মেইন মেন্যু থেকে কোন নিদির্ষ্ট ক্যাটেগরিতে ক্লিক করে, তখনই সেটি স্মার্টফোনের মতোই ইউজারকে ওই প্লাটফর্মে নিয়ে যায়। আর সেখানে ইউজার তার ফোন কিংবা কম্পিউটারের মতোই সব কন্টেন্ট দেখতে পায় যেখানে থেকে সে ইচ্ছা মতো কন্টেন্ট চুজ করতে পারে।
স্মার্ট টিভি কি কি অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করে?
স্মার্ট টিভির জন্যে বেশ কিছু অপারেটিং সিস্টেম রয়েছে। তার মাঝে বহুল ব্যবহৃত অপারেটিং সিস্টেমগুলো হল-
- রোকু অপারেটিং সিস্টেম
- ওয়েব অপারেটিং সিস্টেম
- অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম
- টাইজেন অপারেটিং সিস্টেম
- ফায়ার এডিশন অপারেটিং সিস্টেম
বিশ্বের প্রথম স্মার্ট টিভি কোনটি?
১৯৮০ সালের শুরুর দিকে জাপানে প্রথম ইন্টেলিজেন্ট টেলিভিশন রিসিভার আবিস্কৃত হয়। ব্রডকাস্ট টেলিভিশনের সিগন্যাল ইউজ করে মেমরিসহ এলএসআই চিপ ও কিছু প্রোগ্রামিংয়ের সমন্বয়ে প্রথম স্মার্ট টিভির রিসিভার বাজারে নিয়ে আসে একটি জাপানিজ কোম্পানী। ১৯৯৪ সালে ডিজিটাল এবং অ্যানালগ উভয় পদ্ধতি ব্যবহার করে এবং ডাটা প্রসেসিং সিস্টেম ও ইন্টেলিজেন্ট টিভি সিস্টেমের সমন্বয়ে স্মার্টটিভির একটি ডেমো ভার্সণ আসে। স্মার্ট টিভির এই ডেমো ভার্সণ দিয়ে টিভি থেকে যে কোনও প্রোগ্রাম রেকর্ড করা যেত।
২০০০ সালে প্রথম স্মার্ট টিভির আইডিয়াটা বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয় আর ২০১০ সালে কোরিয়ান ইলেকট্রোনিক কোম্পানী স্যামসাংই প্রথম স্মার্ট টিভি তৈরি করে। Pavv Bordeaux TV 750 নামের স্যামসাং এর সেই স্মার্ট টিভি দিয়ে মানুষ নিউজ, ওয়েদার, স্টক প্রাইস দেখে নিতো। আর সেই সাথে ইউটিউবের ভিডিও ভিউ করতো। একই সাথে, ইউজাররা টিভিকে কম্পিউটারের সাথে যুক্ত করতে পারতো এবং কম্পিউটারের স্ক্রিণকে টিভিতে এবং টিভির স্ক্রিণকে কম্পিউটারে রিপ্লেস করতে পারতো। এমনকি, বিশ্বের প্রথম সেই স্মার্ট টিভিতে ইউএসবি ড্রাইভ (পেন ড্রাইভ) ব্যবহার করা যেতো। ক্রমান্বয়ে স্যামসাং স্মার্ট টিভির আরো অনেক উন্নয়ন করে এবং বর্তমানে অনেক কোম্পানিই স্মার্ট টিভি বাজারে এনেছে।
কোন কোম্পানী স্মার্ট টিভি তৈরি করছে?
বর্তমানে প্রায় সব কোম্পানীই স্মার্ট টিভি তৈরি করছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত কোম্পানীগুলোর মধ্যে রয়েছে-
- স্যামসাং ইলেকট্রোনিক্স
- সনি কর্পোরেশন
- এলজি কর্পোরেশন
- প্যানসনিক কর্পোরেশন
- টিসিএল কর্পোরেশন
এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত কিছু কোম্পানী রয়েছে যারা স্মার্ট টিভি তৈরি ও বাজারজাত করছে। এদের মধ্যে আছে-
- শাওমি কর্পোরেশন
- সেনিও ইলেকট্রোনিক কোম্পানী লিমিটেড
- ভিডিওকন ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেড
- মাইক্রোম্যাক্স ইলেকট্রোনিক অ্যাপ্লায়েন্স
- স্যানসুই ইলেকট্রোনিক কোম্পানী লিমিটেড
- শিনশো ইলেকট্রোনিক কম্পায়েন্স
- মিটাশি ইলেকট্রোনিক্স লিমিটেড
- নেকসন ইলেকট্রোনিক্স প্রাইভেট লিমিটেড
- নোবল স্কিউডো লিমিটেড
- অনিডা ইলেকট্রোনিক ইন্ড্রাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড
- বিপিএল বা ব্রিটিস ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড
- ক্যানডেজ ইলেকট্রোনিক্স লিমিটেড
- ডাইওয়া গ্লোবাল ইলেকট্রোনিক্স লিমিটেড
- ইনটেক্স টেকনোলোজিস লিমিটেড
- কেবিন এশিয়া প্রাইভেট লিমিটেড
- কোডাক ইলেকট্রোনিক্স লিমিটেড
সব টিভিই কি স্মার্ট টিভি?
উন্নত বিশ্বে ব্যবহৃত প্রায় সব টিভিউ এখন স্মার্ট টিভি। আপনি হয়তো কিছু টিভি পেতে পারেন যেগুলো স্মার্ট বলা হলেও অতটা স্মার্ট নয়, পেতে পারেন আগেকার টিভিগুলোও। কিন্তু টিভি দেখার যে নতুন অভিজ্ঞতার সুযোগ এসেছে, সেখানে কেন আপনি সাধারণ টিভি দেখবেন? ৩২ থেকে ৭৫ ইঞ্চি, এমনকি তার উপরে ফোরকে কার্বড্ ডিসপ্লে নিয়ে সারা বিশ্ব মাতাচ্ছে স্মার্ট টিভিগুলো।
স্মার্ট টিভির অ্যাপস্ সুবিধা কি?
অধিকাংশ স্মার্ট টিভিতে এখন প্রচুর বিল্ট-ইন অ্যাপস্ থাকে। এর বাইরে আপনি চাইলে গুগল প্লে স্টোরে থাকা থার্ড পার্টির সকল অ্যাপস্ই ব্যবহার করতে পারবেন।
স্মার্ট টিভি কি স্মার্টফোনের সঙ্গে কানেক্ট করা যায়?
অবশ্যই। শুধু স্মার্টফোনই নয়, আপনি আপনার ব্যবহৃত সব ডিভাইসই স্মার্ট টিভির সঙ্গে কানেক্ট করতে পারবেন। যেমন, আপনার ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, ট্যাবলেটকে টিভি স্ক্রিণের সঙ্গে কানেক্ট করতে পারবেন এবং টিভি থেকে মোবাইল ও কম্পিউটারসহ সব ডিভাইসই অ্যাক্সেস করতে পারবেন।
কম্পিউটার ও ফোনের মতো স্মার্ট টিভিও কি হ্যাং করে?
সাধারণ উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ। যেহেতু, স্মার্ট টিভি কম্পিউটার ও ফোনের মতোই অপারেটিং সিস্টেম ও অন্যান্য ফিচার ব্যবহার করে, সেহেতু এটিও হ্যাং করতে পারে। এমনকি, কখনো কখনো ক্র্যাশও করতে পারে। তবে, ফোন কিংবা কম্পিউটারের মতো স্মার্ট টিভির ক্ষেত্রে সচরাচর এমনটি ঘটে না। আপনি যদি কম্পিউটার বা ফোনের মতোই এটির যত্ন নেন, তবে আপনার হ্যাং বা ক্র্যাশের ভয় নেই। এটি লাখে একটা টিভিতেই ঘটে থাকে।
স্মার্ট টিভি কি আর এটি সম্পর্কে আরো কিছু বিষয় আপনার জানা হয়ে গিয়েছে। এবার চাইলে আপনি একটি স্মার্ট টিভি কিনতে পারেন, উপভোগ করতে পারেন সব ধরণের অনলাইন কন্টেন্ট। সেই সাথে জেনে নিতে পারেন কিভাবে স্মার্ট টিভিতে কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের মতো স্ক্রিনশট নেবেন। আর কমেন্ট করে আমাদের জানাতে পারেন আপনার স্মার্ট টিভি দেখার অভিজ্ঞতা। এমনকি, এ লেখাটি সম্পর্কে যে কোনও প্রশ্ন করতে পারেন, যদি আপনার স্মার্ট টিভি সম্পর্কে আরো কিছু জানার থাকে।
Leave a Reply