হিমোগ্লোবিন একটি আয়রন-রিচ প্রোটিন। এটি রক্তের এমন একটি কম্পোনেন্ট যা শরীরের নানা প্রত্যঙ্গে অক্সিজেন প্রসেসিং করার জন্যে অপরিহার্য্য। বাতাস থেকে মুক্তভাবে আমাদের ফুসফুস অক্সিজেন নেয়। আর ফুসফুস থেকে অক্সিজেন নিয়ে শরীরের সব রকমের টিস্যু ও অর্গানগুলোতে সাপ্লাই দেয় এই হিমোগ্লোবিন। তাই রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ানোর প্রাকৃতিক উপায় জানা থাকা জরুরী।
হিমোগ্লোবিন শরীরে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের পাশাপাশি মেটাবোলিক প্রোডাক্ট কার্বন ডাইঅক্সাইড বের করে দেয়ার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে। শরীরের সমস্ত সেল থেকে হিমোগ্লোবিন কার্বন ডাইঅক্সাইড কালেকশন করে ফুসফুসে পাঠিয়ে দেয় আর ফুসফুস সেটাকে নি:শ্বাসের সঙ্গে বাইরে পাঠিয়ে দেয়।
হিমোগ্লোবিন মূলত কি আর আমাদের শরীরে হিমোগ্লোবিনের আসল কাজ কি সে সম্পর্কে আমরা মোটামুটি একটা ধারণা পেলাম। বোঝাই যাচ্ছে, রক্তে হিমোগ্লোবিনের অভাব দেখা দিলে শরীরে অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বণ ডাইঅক্সাইড বিকিরণে সমস্যা সৃষ্টি হয়ে যায়। আর সেই সাথে শরীর আরো নানা ধরণের সমস্যার সন্মুখীন হয়। যেমন-
- শারিরীক ও মানসিক ক্লান্তি
- মাংশপেশী ও হাঁড়ের দূর্বলতা
- মাথা ব্যথা – মাথা ঘোরা
- হার্ট বিট বেড়ে যাওয়া
- শরীরের ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
- নখের স্বাভাবিক শক্তি হারিয়ে ফেলা – নখ ভেঙ্গে যাওয়া
- ক্ষুধা মন্দা দেখা দেয়া
- হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসা
এসব সমস্যা দেখা দেয় সাধারণত রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে গেলে। জেনে নিন রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণ কি। আরো জেনে রাখুন এই মাত্রা যদি অত্যন্ত কমে যায়, তবে অ্যামেনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবণা শতভাগ। কাজেই আমাদের প্রত্যেকেরই রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়িয়ে নেয়ার প্রাকৃতিক উপায় জেনে রাখতে হবে।
রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ানোর প্রাকৃতিক উপায়
যদিও আয়রন সাপ্লিমেন্টসহ হিমোগ্লোবিন বাড়ানোর কিছু সাপ্লিমেন্ট রয়েছে, তবু সেটা পুরোপুরি কার্য্যকরী নয়। অর্থাৎ, আয়রন কিংবা ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট হিমোগ্লোবিনের অভাব পূরণ করতে পারে না। কাজেই, প্রাকৃতিক উপায়ের উপর ভরসা করতে হয় এবং এটিই সবচেয়ে ভাল উপায়।
১. ভিটামিন বি১২ ও আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খান
হিমোগ্লোবিনের জন্যে আয়রনের প্রয়োজনীয়তার কথা আমরা জানি। আয়রন ছাড়াও ভিটামিন বি১২ রক্তের লোহিত কণিকা বা হিমোগ্লোবিনের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারই হচ্ছে আয়রন ও ভিটামিন বি১২ এর আসল উৎস। এ রকম কিছু খাবার হল-
- মুরগী
- ডিম
- গভীর জলের মাছ
- লাল মাংশ
- কলিজার মতো কিছু অভ্যন্তরীণ অঙ্গ
এ সমস্ত খাবারে রয়েছে হিমি আয়রন। আর এটাই হচ্ছে সবচেয়ে উন্নত মানের আয়রন যা আমাদের শরীর ৪০% অ্যাবজর্ব করতে পারে। অন্যদিকে, খাবারে মাত্র ২০% নন-হিমি আয়রন রক্তের সঙ্গে প্রবাহিত হতে পারে। সুতরাং, যথাসম্ভব বেশি থেকে বেশি পরিমাণে হিমি আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে, যা রক্তে আয়রণ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধি করবে।
তথাপি, নন-হিমি আয়রণও শরীরের জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজন। কাজেই এ জাতীয় আয়রন সমৃদ্ধ খাবারের তালিকাটা দেখে নেয়া যেতে পারে। এ তালিকার বেশিরভাগই খাবারই শাক-সবজি টাইপের। যেমন-
- পালং শাক
- ব্রোকলি, বাঁধাকপি
- খেজুর, ডুমুর ও প্রুনসহ আরো কিছু শুকনো ফল
- সব ধরণের বাদাম
- সয়াবিন জাতীয় সব ধরণের পণ্য
গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ:
লাল মাংশ এবং গরু ও ছাগলের কলিজায় প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকলেও এগুলো খুব বেশি খাওয়া উচিৎ নয়। আয়রনের জন্যে সপ্তাহে একবার কিংবা দুইবার এ জাতীয় খাবার গ্রহণ করা যেতে পারে। বিশেষত, লাল মাংশ কোনভাবেই সপ্তায় দুইবারের বেশি খাওয়া ঠিক নয়।
গরু ও ছাগলের লাল মাংশের বিকল্প হিসেবে সাদা মুরগী এবং মাছ খাওয়া যেতে পারে। এগুলোতেও যথেষ্ট্য পরিমাণে আয়রণ রয়েছে।
যে কোন ধরণের মাংশ খাওয়ার আগে তা থেকে চামড়া এবং চর্বিগুলো ফেলে দিন।
২. ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খান
আমাদের শরীরের জন্যে খাদ্য থেকে আয়রন শোষণে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে ভিটামিন সি। কাজেই, প্রতিদিন কিছু না কিছু ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খান আর সেটা প্রাকৃতিক খাবার হলেই সবচেয়ে ভাল। ফলমূল ও শাক-সবজি ভিটামিন সি এর একটি বড় উৎস। যেমন-
- পেয়ারা
- কমলা
- লেবু
- আঙ্গুর
- সব ধরনের জাম
- বেল মরিচ
- টমেটো এবং
- সব ধরণের সবুজ শাক-সবজি।
গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ:
অনেক সময়ই সরাসরি ফল খাওয়ার চেয়ে ফলের জুস বানিয়ে খাওয়াটা আপনার কাছে অধিক পছন্দনীয় হতে পারে। সেক্ষেত্রে জুসের সঙ্গে চিনি মেশাবেন। আর যদি একান্তই মেশাতে হয়, তবে এক চা চামুচের বেশি নয়। সবচেয়ে ভাল হয় যদি চিনি না মিশিয়েই খেতে পারেন।
খালি পেটে ফল খাওয়ার চেয়ে ভরা পেটে ফল খাওয়া ভাল। সম্ভব হলে কিছু কিছু ফলের চামড়া না ফেলে চামড়াসহই খাওয়ার চেষ্টা করুন। এতে বেশি পরিমাণে ভিটামিন সি এর ঘাটতি পূরণ হবে।
সম্ভব হলে প্রতি বেলাতেই কিছু না কিছু ফল খান, বিশেষত যেগুলোতে ভিটামিন সি রয়েছে। সালাদের সঙ্গেও ভিটামিন সি যুক্ত শাক-সবজি ব্যবহার করুন।
৩. ভিটামিন এ ও বিটা-ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার খান
ক্লিয়ার দৃষ্টিশক্তি, স্বাস্থ্যকর দাঁত, নরম টিস্যু ও সুস্থ্য সুন্দর ত্বকের জন্যে ভিটামিন এ ও বিটা-ক্যারোটিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও, বিভিন্ন গবেষণা থেকে এটা প্রমাণিত যে বিটা-ক্যারোটিন ও ভিটামিন এ শরীরে আয়রনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।
গম ও ভূট্রা জাতীয় প্ল্যান্ট বেজড্ ভিটামিন আর বিটা-ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবারগুলোতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন রয়েছে। এছাড়াও, যেসব খাবারে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ রয়েছে সেগুলো নিয়মিত গ্রহণ করলে আয়রণের ঘাটতি পূরণ হবে এবং রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়বে।
ভিটামিন এ আর বিটা-ক্যারোটিন আছে এ রকম কিছু খাবার-
- মিষ্টি আলু
- পালং শাক
- গাজর
- কুমড়ো
- লাল মরিচ
- আম, ইত্যাদি।
৪. ফোলেট যুক্ত খাবার খান
ফোলেট ভিটামিন বি এর একটি টাইপ। অর্থাৎ, ৮ প্রকারের ভিটামিন বি এর মাঝে ফোলেট একটি যা মূলত ভিটামিন বি৯। এটি শরীরে হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
আমাদের শরীর হিমি আয়রণ উৎপাদনে ফোলেটের ব্যবহার করে থাকে। আর এই হিমি আয়রণ হিমোগ্লোবিনের একটি বিশেষ অংশ যা শরীরে অক্সিজেন বহনে ভূমিকা পালন করে। একজন ব্যক্তির শরীরে থাকা লোহিত রক্ত কণিকায় যথেষ্ট্য পরিমাণ ফোলেট না থাকলে, সে অ্যামেনিয়ার মতো মারাত্মক রোগের শিকার হতে পারে।
যেসব খাবারে প্রচুর ফোলেট পাওয়া যায়-
- গরুর মাংশ
- পালং শাক
- ভাত
- চীনা বাদাম
- কালো চোখ বিশিষ্ট মটরশুটি
- যকৃতের মতো শিমের বিচি
- অ্যাভোকাডো
- লেটুস, ইত্যাদি।
শেষ কথা
যদিও সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের মাধ্যমে একজন মানুষের শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ানো যায়, তবু সেটা উচিৎ নয়। কারণ, যেখানে দৈনন্দিন খাবারের তালিকা একটুখানি পরিবর্তণ করে রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ানোর প্রাকৃতিক উপায় রয়েছে সেখানে সাপ্লিমেন্ট নেয়া বোকামী ছাড়া বৈকি!
কারো শরীরে যদি হিমোগ্লোবিনের মাত্রা অত্যন্ত কমে যায়, তবে ব্লাড ট্রান্সফিউশনের মতো জটিল চিকিৎসা ব্যবস্থার দ্বারস্থ্য হতে হয়। কাজেই, ওই রকম পর্যায়ে যাওয়ার আগেই, অর্থাৎ সুস্থ্য থাকা অবস্থাতেই প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখতে হবে।
Leave a Reply