রাতকানা রোগের কথা আমরা অনেকেই শুনেছি। কেউ কেউ আবার আত্মীয়-স্বজন কিংবা প্রতিবেশীদের মধ্যে রাতকানা রোগীদের দেখেছিও। রাতকানা রোগ হলে রাতে দেখায় সমস্যা হয়, সমস্যা হয় অল্প আলোতে দেখায়ও। রাতকানা রোগ কি অর্থাৎ রাতকানা রোগটির সঠিক সংজ্ঞা না জানলেও আমরা সবাই বুঝি এটি কী ধরণের রোগ।
এ রোগ হলে রোগীর চোখের কী অবস্থা হয় তা আমরা অনেকেই স্বচক্ষে দেখেছি। না দেখলেও অসুবিধা নেই, আসুন জানি এ রোগ কি ও কেন হয় আর হলে কি করণীয়-
রাতকানা রোগ কি
রাতকানা এমন একটি রোগ যা হলে রাতে, অল্প আলোতে সবকিছু ঝাপসা ঝাপসা দেখা যায় কিংবা একেবারেই দেখা যায় না। মূলত রাতে দেখতে পাওয়ার অক্ষমতাই হচ্ছে রাতকানা রোগ। ইংরেজীতে এর দুটি নাম রয়েছে। সবচেয়ে কমন নামটি হচ্ছে নাইট ব্লাইন্ডনেস আর আরেকটি নাম হচ্ছে নিকটালোপিয়া যা একটি মেডিকেল টার্ম।
মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় এ রোগ আসলে কোন রোগ নয়। এটি মূলত চোখের নানাবিধ রোগের লক্ষণ, ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে যে ১০টি রোগ হয়, সেগুলোর মাঝে কিছু রোগের পূর্ব বা পরবর্তী লক্ষণ। আর সবচেয়ে বড় লক্ষণ হচ্ছে চোখের রেটিনা সমস্যা। আর রেটিনা যেহেতু চোখের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সেহেতু রাতকানা রাতকানা রোগ হলে অনেক সময় সেটি অন্ধত্বে রূপ নিতে পারে।
তবে এমন মনে করার কোন কারণ নেই যে রাতকানা রোগে আক্রান্ত হলেই সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যাবে। অথবা পুরোপুরি দৃষ্টিহীনদের কাতারে পড়ে যাবে। রাতকানা রোগ হলে প্রাথমিকভাবে যে সমস্যাটি হয় সেটি হচ্ছে রাতে দেখার প্রতিবন্ধকতা। তবে, দিনের বেলায় দেখতে কোন সমস্যাই হয় না।
রাতে বা কম আলোতে দেখতে সমস্যা হওয়ার এই ব্যাপারটি ঘটতে পারে ছোট থেকে বড় সবার বেলাতেই। তবে, ছোটদের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে এমন হয় যে, রাতকানা রোগীরা দিনের বেলায় অনেক আলো থেকে হঠাৎ অল্প আলোতে এলে চোখে দেখার সমস্যায় পড়েন।
আর এটি রাতকানা রোগী ছাড়া স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে, এতে ভয় পাবার কিছু নেই। আপনার যদি এমন হয়ে থাকে, তবে এটি মনে করার কোন কারণ নেই যে আপনার রাতকানা রোগটি হয়েছে। তবে, আলো থেকে অন্ধকারে কিংবা অন্ধকার থেকে আলোতে এসে ঠিক মতো দেখতে না পাওয়া কিংবা ঝাপসা ঝাপসা বা ঘোলা ঘোলা দেখা রাতকানা রোগের লক্ষণ।
আপনার যদি এ রকম হয়, তবে চোখের ডাক্তার দেখিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিন। এবার চলুন, রাতকানা রোগের লক্ষণ আর এর চিকিৎসা ব্যবস্থায় কী কী রয়েছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই-
রাতকানা রোগ কেন হয়?
রাতকানা রোগ কি সে সম্পর্কে আমাদের পরিস্কার একটা ধারণা হয়েছে। আসুন, এবার জানি এ রোগটি কেন হয়।
প্রত্যেক মানুষের চোখের রেটিনায় কোন্ ও রড নামে ২টি কোষ থাকে। দিনের বেলায় কোন্ কোষ সক্রিয় হয় অর্থাৎ বেশি আলোতে কোন্ কোষের মাধ্যমে চোখ বাইরের জগতের দৃশ্য ধারণ করে। ফলে দিনের উজ্জ্বল আলোতে দেখতে কারো সমস্যা হয় না।
অন্যদিকে রড কোষ অল্প আলোতে সক্রিয় হয় এবং রাতের বেলা দেখতে চোখকে সাহায্য করে থাকে। এই কোষে এক ধরণের প্রোটিন থাকে যাকে রোডপসিন বলে, এটি মূলত ফটো রিসেপ্টর হিসেবে কাজ করে। ভিটামিন ‘এ’ এর স্বপ্লতার ফলে এই রোডপসিন ঠিক মতো আলো সংশ্লেষণ করতে পারে না। ফলে, স্বল্প আলোতে ফটো রিসেপ্টর ঠিক মতো কাজ করে না। এটাই রাতকানা রোগের মূল কারণ।
এছাড়াও যে-সব কারণে রাতকানা রোগ হয়ে থাকে, সেগুলো নিচে আলোচনা করা হল-
জন্মক্রুটি থেকে রাতকানা রোগ হয়
গর্ভবতী মায়ের যদি ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব থাকে, তবে জন্মগতভাবে বাচ্চার রাতকানা রোগ হতে পারে। এছাড়াও, মায়ের যদি অন্য কোনও জটিল ধরণের রোগ থেকে থাকে, তবে বাচ্চা রাতকানা রোগ নিয়েই জন্ম নিতে পারে।
বংশগত ইতিহাসও রাতকানা রোগের কারণ
কারো বংশে যদি রাতকানা রোগের ইতিহাস থাকে। বিশেষ করে যদি দাদা, দাদি, নানা, নানি কিংবা বাবা বা মায়ের রাতকানা রোগের ইতিহাস থাকে, তবে পরবর্তী প্রজন্মেরও রাতকানা রোগ হতে পারে। তবে সব বংশেই যে রাতকানা রোগ থাকলে অন্যদেরও হবে, এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা নেই।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে বংশ পরম্পরায় রাতকানা রোগটি বিস্তার লাভ করে। তবে এটি মোটেই ছোঁয়াছে রোগ নয়, কাজেই একজন লোক থেকে আরেকজন লোকের রাতকানা রোগ হওয়ার সম্ভাবণা নেই, যদি তাদের মাঝে জেনেটিক সম্পর্ক না থেকে থাকে।
চোখে ছানি পড়লে রাতকানা রোগ হয়
সবার চোখেই লেন্স আছে, আমরা জানি। এই লেন্স যদি ঘোলাটে বা ধোঁয়াটে হয়ে যায়, তবে এটাকে আমরা ছানি পড়া বলি। আমরা অনেকেই মনে করি যে বয়স হয়ে গেলে চোখে ছানি পড়ে। এটি ঠিক নয়। হাই ব্লাড প্রেশার, এমনকি ডায়াবেটিসের কারণে যে কোন বয়সেই চোখে ছানি পড়তে পারে। চোখে ছানি পড়লে বা ক্যাটারেক্ট হলে রাতকানা রোগ হওয়ার সম্ভাবণা অনেক বেশি।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি থেকে রাতকানা রোগ হয়
লেন্স ছাড়াও চোখের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে রেটিনা যা স্নায়ু দ্বারা সৃষ্ট এক ধরণের সংবেদনশীল পর্দা। আমরা মূলত এই রেটিনার সাহায্যেই বিভিন্ন বস্তু দেখে থাকি। যদি চোখের এই রেটিনা কোন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে দৃষ্টিশক্ত ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে।
চোখের রেটিনার ভেতর এক ধরণের সুক্ষ্ণ রক্তনালি থাকে, অনেক সময় অক্সিজেনের অভাবে এখানে রক্তশূন্যতা তৈরি হয়। যারফলে রক্তনালিতে এক ধরণের প্রদাহ সৃষ্টি হয় এবং এই রক্তনালির ভেতর রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়, অনেক সময় বন্ধ হয়ে যায়। এটা হয় মূলত ডায়াবেটিক রোগীদের বেলায়, বিশেষ করে যারা নিয়ন্ত্রণহীন জীবন-যাপন করেন। ডায়াবেটিক রোগীদের এই ধরণের চক্ষু সমস্যা হলে সেটাকে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি বলে।
আর কারো যখন ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হয়, তখন অনেক সময়ই রাতকানা রোগ হয়।
মাইয়োপিয়া হলে রাতকানা রোগ হয়
কারো দৃষ্টির ক্ষমতা কমে গেলে অর্থাৎ দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে গেলে ডাক্তাররা বলেন যে তার মাইয়োপিয়া হয়েছে। আর এ রোগটি হলেও এটা থেকে ধীরে ধীরে রাতকানা রোগ হতে পারে। কাজেই দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ মনে হলে অবশ্যই চোখের ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ অর্থাৎ মাইয়োপিয়ার চিকিৎসা করা উচিৎ।
গ্লুকোমার ঔষধ গ্রহণ করলে রাতকানা রোগ হয়
গ্লুকোমা একটি চোখের রোগ যার মাধ্যমে চোখের অপটিক নার্ভ নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। এই রোগ থেকে মুক্তির জন্যে ওষুধ খেতে হয়। কিন্তু এ ধরণের ওষুধ দীর্ঘদিন ধরে সেবন করতে থাকলে আবার রাতকানা রোগ হওয়ার সম্ভাবণা থাকে।
ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে রাতকানা রোগ হয়
এটা নতুন করে বলার কিছু নেই, আমরা সবাই জানি যে ভিটামিন ‘এ’ এর ঘাটতি থাকলে রাতকানা রোগ হয় এবং এটিই রাতকানা রোগের সবচেয়ে বড় কারণ বলে বিশ্বব্যাপী বিবেচিত। যদি ভালভাবে ধারণা থাকে যে ভিটামিন ‘এ’ আসলে কি এবং কেন প্রয়োজন, তবে আমাদের খাদ্যভ্যাশে পরিবর্তণ এনে আমরা রাতকানা রোগ থেকে রক্ষা পেতে পারি।
আমরা জেনেছি, রাতকানা রোগ কি আর এটি কেন হয়। পাশাপাশি রাতকানা রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে সম্যক ধারণা আমাদেরকে এ রোগটির ব্যাপারে সচেতন করে তুলবে। রাতকানা রোগ থেকে বাঁচার জন্যে আমরা সব সময় আমাদের চোখের ব্যাপারে সতর্ক থাকবো। চোখের কোন সমস্যায় নিজ থেকে উদ্যোগী হয়ে কোন ঔষধ ব্যবহার করবো না। সব সময় আগে ডাক্তারকে চোখ দেখবো এবং ডাক্তারের পরামর্শ মতো চোখের ঔষধ ব্যবহার করবো।
Khokan roy says
রাতকানা রোগের চিকিৎসা আছে কি?
টি আই অন্তর says
রাতকানা রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে এই লেখাটাতেই একটা আইডিয়া দেয়া হয়েছে। লেখিকা, জেসিকা জেসমিনকে রাতকানা রোগের চিকিৎসার উপর বিস্তারিত একটা লেখা দেয়ার জন্যে অনুরোধ করা হয়েছে, আশা করি শীঘ্রই সেটি পাবেন।