কিংবদন্তি লেগস্পিনার শেন ওয়ার্নের মত লেগস্পিন বল করতে পারেন কয়েকটি টিপস জেনে।
ক্রিকেটের ইতিহাসে যে সমস্ত লেগস্পিনার স্মরণীয় হয়ে আছেন তাদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি লেগস্পিনার শেন ওয়ার্ন অন্যতম সেরা। কেউ কেউ তো অন্যতম শব্দটা না বলে তাকে সর্বকালের সেরা লেগস্পিনার হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
তিনিই প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে পেয়েছিলেন ৭০০ উইকেট। তিনি এখনও সবচেয়ে বেশি টেস্ট উইকেট সংগ্রাহকের তালিকায় আছেন ২য় স্থানে।
সর্বাধিক টেস্ট উইকেট শিকার করেছেন আরেক কিংবদন্তি স্পিনার শ্রীলংকান মুত্তিয়া মুরালিধরন। শেন ওয়ার্ন তার ১৪৩ টেস্টের ক্যারিয়ারের সংগ্রহ করেছেন সর্বমোট ৭০৮ উইকেট।
শেন ওয়ার্ন এক দিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও পেয়েছেন ২৯৩ উইকেট যা তার মোট আন্তর্জাতিক উইকেট সংখ্যাকে নিয়ে গেছে ১০০১ টিতে।
মাত্র দুইজন খেলোয়াড়ই এক হাজার উইকেটের মাইলফলক ছুঁতে পেরেছেন, যাদের একজন শেন ওয়ার্ন, অপরজন মুত্তিয়া মুরালিধরন।
তিনি ৯০’র শেষ হতে ২০০০ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার দাপুটে এবং বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা দলটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন।
শেন ওয়ার্নকে শুধু তার উইকেট নেওয়ার ক্ষমতার কারণেই সর্বকালের সেরা বলা হয় না। ব্যাটসম্যানকে লেগস্পিন দ্বারা ভীতি প্রদর্শন, তার দাপট দেখানো বোলিং রীতি এবং লেগস্পিন মায়াজালে ব্যাটসম্যানকে খাবি খাওয়ানোর আশ্চর্য ক্ষমতার কারণেই তিনি সর্বকালের সেরা লেগস্পিনার।
শেন ওয়ার্ন একবার বলেছিলেন-“ স্পিন হল এমন একটি শিল্প যা ব্যাটসম্যানকে ভাবতে বাধ্য করে যে আশ্চর্যজনক কিছু ঘটছে যা আগে ঘটেনি”।
শেন ওয়ার্নের এই চোখ ধাঁধানো সাফল্য এমনিতে আসেনি। শেন ওয়ার্ন প্র্যাকটিসে নিজের বৈচিত্রগুলো আরও নিঁখুত কুরতে ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করেছেন।
এমনিতেই বোলারদের নিজেদের সঠিক লাইন-লেন্থ পেতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়।
সেখানে লেগস্পিনারদের নিজের সঠিক লাইন-লেন্থ পেতে এবং একই সাথে নিজেদের বৈচিত্রগুলোকে আরও নিঁখুত করতে সবচেয়ে বেশী পরিশ্রম করতে হয়। শেন ওয়ার্নও তাই ঘন্টার পর ঘন্টা নেটে অনুশীলন করেছেন।
“স্পিনের রাজা” হিসেবে পরিচিত শেন ওয়ার্ন ১৯৯৩ সালের অ্যাশেজে মাইক গ্যাটিংকে আশ্চর্যজনক এক ডেলিভারীতে আউট করেছিলেন যে ডেলিভারীটি এখন “বল অব দ্যা সেঞ্চুরী” নামে বিখ্যাত।
এই ডেলিভারীটি এখনও নিয়মিত আলোচিত হয়।
চলুন আজ আমরা স্পিনের এই মহান কিংবদন্তির কাছ থেকে কিছু টিপস নিই আর জেনে নিই কিভাবে শেন ওয়ার্নের মত লেগস্পিন করব। আর আপনি যদি ফাস্ট বোলার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তবে জেনে নিন বিখ্যাত ফাস্ট বোলারদের দেয়া ১০ট কার্যকরী টিপস। আর যদি আপনি বোলার না হয়েও মূলত ব্যাটসম্যান হতে চান, তবে জেনে নিন রিচার্ড পাইবাসের দেয়া ১০ কার্যকরী ব্যাটিং টিপস্। যদি স্পিন বল করা শেখাই আপনার মূল উদ্দেশ্য হয়, তবে লেখাটি পড়তে থাকুন।
শেন ওয়ার্নের মত লেগস্পিন বোলিং টিপস-১
লেগব্রেক বোলিং
একজন দূর্দান্ত লেগস্পিনার হওয়ার প্রথম শর্ত হল বলটি কিভাবে স্পিন করানো যাবে তা শেখা।
লেগব্রেক হচ্ছে যে কোন লেগস্পিনারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডেলিভারী। অন্যকিছু শেখার পূর্বে একজন লেগ স্পিনারকে লেগব্রেক করা শিখতে হয়।
শেন ওয়ার্ন এ ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে-“আপনি বলের সঠিক লাইন, সঠিক লেন্থের কথা বলবেন। তবে সবার প্রথমে আপনাকে যা জানতে হবে তা হলো বলটিকে স্পিন করানো। যদি আপনি এই কাজটি করতে পারেন তবে আপনি যে শ্রেনীর বোলার এবং যেখানেই খেলুন উইকেট পাবেন। বেসিক জিনিসটি হ’ল বলের গ্রিপ – দুটি আঙ্গুলের নিচে, দুটি আঙ্গুলের উপরে।
“দুটি আঙ্গুলের নিচে, দুটি আঙ্গুলের উপরে”-এর মানে কি?
এর মানে হল আপনার তর্জনী ও মধ্যমা থাকবে বলের উপরে আর আপনার অনামিকা এবং কনিষ্ঠা থাকবে বলের নিচে। তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুল দুটির মাঝে ফাঁকা রখুন।
এই দুটো আঙ্গুলে ভর করে আপনি বল ছুঁড়বেন আর আপনার তৃতীয় আঙ্গুল বা অনামিকার নড়াচড়া বলে স্পিন তৈরীতে সহায়তা করবে।
একটি সুন্দর ও স্বাছ্যন্দময় গ্রিপ নিন। আপনার বোলিং হাত আপনার শরীরের পেছন থেকে ঘুরে বল ছুড়বে , এই ব্যাপারটি বলে স্পিন পাওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
আপনার বাহু এবং অনামিকা আঙ্গুলকে এমনভাবে ব্যবহার করুন, যাতে আপনি বল ছোঁড়ার সময় সর্বোচ্চ পরিমাণ ঘূর্ণন হয় এবং বল ডান দিক থেকে বাঁ দিকে ঘুরতে পারে (ডানহাতি বোলারদের জন্য)।
শেন ওয়ার্নের মত লেগস্পিন বোলিং টিপস-২
বলকে বাতাসে ভাসিয়ে দিন
বলকে বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়া বলতে বোঝায়, আপনি যখন কোন একটি বলকে বাতাসে হালকা ঝুলিয়ে ছুঁড়বেন, তখন বিপরীতে দিকের বাতাস বলের উপর ক্রিয়া করবে। যারফলে, বল পীচে বাউন্স করার পরপর খুব নিঁখুত একটি টার্ন করবে।
এই টার্ন ব্যাটসম্যানের দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়াবে।
উদাহরণস্বরূপ, যখন কোন একজন ডানহাতি ব্যাটসম্যান শেন ওয়ার্নের মুখোমুখী হয়, তখন অধিকাংশ সময় ব্যাটসম্যানের শরীরের বরাবর হালকা ভাসিয়ে বল ছোড়েন। এর ফলে বলটি ব্যাটসম্যানের ঠিক সামনে বাউন্স করে।
ব্যাটসম্যান যখন বলটি সোজা কিংবা আড় ব্যাটে খেলতে যায়, তখনই একটি শার্প টার্নের সম্মুখীন হয়। ফলে বল ব্যাটের কানায় লেগে স্লিপে থাকে ফিল্ডারের হাতে জমা হয়।
বলকে টার্ন বা ঘূর্নণ করাতে হলে আপনাকে তিনটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
- বল ছোড়ার সময় আপনার বাহুকে খুব বেশি উচ্চতায় উঠাবেন না এবং খুব বেশী নিচেও রাখবেন না। স্বাভাবিক উচ্চতায় রাখার চেষ্টা করুন। আপনি আপনার কবজি আর আঙ্গুলগুলোকে নমনীয় রাখুন যাতে ইচ্ছেমতো আঙ্গুল এবং কবজি নাড়াচাড়া করাতে পারেন।
মনে রাখবেন, আপনার নমনীয় কবজির আর আঙ্গুলের সঠিক ব্যবহার বলে টার্ন পেতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
- যখন বল আপনের হাত থেকে ছেড়ে দেবেন, তখন আপনার কব্জির জোর আর অনামিকা আঙ্গুলের নাড়ানোতেই বাতাসে বলের উপর সর্বাধিক ঘূর্ণনের সৃষ্টি হবে।
- নিশ্চিত করুন আপনি যখন বল ছুঁড়বেন, তখন যেন আপনার কাঁধ ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে আসতে পারে।
এই তিনটি উপাদান আপনার বলের ঘূর্ণন আরও বাড়িয়ে তুলবে এবং ব্যাটসম্যানের জন্য আপনার বল বুঝতে পারা অনেক কঠিন করে তুলবে।
শেন ওয়ার্নের লেগস্পিন বোলিং টিপস-৩
বলের গতি
লেগস্পিনের জন্য উপযুক্ত কোন গতি নেই। আপনি কোন গতিতে লেগস্পিন করছেন, তা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হল বলে স্পিন করানো।
আগেই বলেছি আপনি যদি বলে স্পিন করাতে পারেন, তবে আপনি যে গতিতেই বোলিং করুন না কেন, যে শ্রেণীর বোলার হোন না কেন, উইকেট পাবেন। তাই বলের গতির দিকে নজর না দিয়ে বলের স্পিনের দিকে নজর দিন।
আপনার স্বাভাবিক গতিতেই বোলিং করুন, যে গতিতে আপনি সবচেয়ে ভাল বোলিং করতে পারেন। আপনার স্বাভাবিক গতিতেই সর্বোচ্চ স্পিন পাওয়ার দিকে নজর দিন।
কোন কোন দিন বলে গতির ব্যাপারটি উইকেট এবং কন্ডিশনের উপর নির্ভর করতে পারে। তবে আপনি একটু স্লো বা কম গতির বোলিং করুন। কারণ জোরে বল করলে ব্যাটসম্যান সুযোগ পেয়ে যাবে বলের গতিকে ব্যবহার করে ব্যাটিং করার।
স্লো বা কম গতির লেগস্পিন করুন, এ ধরনের বলগুলো টার্ন করবে এবং ব্যাটসম্যানকে সম্ভাব্য ভুল করতে বাধ্য করবে।
শেন ওয়ার্নের মত লেগস্পিন বোলিং টিপস-৪
ব্যবহার করুন বৈচিত্র
শেন ওয়ার্নের কাছে লেগস্পিনের কিছু অসাধারণ বৈচিত্র ছিল। এ বৈচিত্রগুলো ব্যবহার করে তিনি সব সময়ই ব্যাটসম্যানকে অস্বস্তিতে রাখতেন এবং উইকেট নিতেন।
এর মধ্যে “ফ্লিপার” এবং “দ্যা রং আন” বা “গুগলি” শেন ওয়ার্নের খুব প্রিয় দুটি ভ্যারিয়েশন বা বৈচিত্র ছিল।
লেগস্পিনারদের জন্য ফ্লিপার খুব কঠিন একটি বল এবং আপনি যদি শেন ওয়ার্নের মত একেবারে নিঁখুত ফ্লিপার করতে চান, তবে এই নিয়ে আপনাকে কয়েক বছর কঠিন পরিশ্রম করতে হবে।
ফ্লিপার হল এমন একটি ডেলিভারী যা করার পর লেগস্পিনের মত বাঁক নেয়ার পরিবর্তে একটু নিচে হয়ে স্কিড করে সোজা চলে যায়।
অর্থ্যাৎ বল টার্ন করার কথা থাকলেও টার্ন না করে হালকা নিচু হয়ে সোজা চলে যায়। ফ্লিপার লেগস্পিনারদের অন্যতম প্রধান অস্ত্র আর বিশ্বব্যাপী ব্যাটসম্যানদের কাছে এক আতঙ্কের নাম।
বলকে প্রথাগত লেগস্পিনারদের মত ধরে রাখুন। তারপর বোলিং করতে চলে যান। এরপর প্রথাগত লেগ স্পিনের মত অনামিকা ব্যবহার না করে হাতের বুড়ো আঙ্গুলকে ব্যবহার করুন বল ঘোরাতে। সঠিকভাবে করতে পারলে এটি আপনার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অস্ত্র হবে।
“দ্যা রং আন” হল প্রথাগত লেগব্রেকের বিপরীত। একজন লেগস্পিনার (ডানহাতি) লেগব্রেক করলে বল ডান দিক থেকে বামদিকে টার্ন করে, “দ্যা রং আন” হল ঠিক এর উলটো।
অর্থ্যাৎ বল টার্ন করে বা দিকে না গিয়ে আরও ডানদিকে চলে যাবে।
এই ডেলিভারী করার পূর্বেও লেগব্রেকের মত বল ধরে রাখুন। এরপর যখন ডেলিভারী করতে যাবেন, তখন অনামিকাকে বিপরীতে দিকে চালিত করুন।
এই চারটি টিপস অনুশীলন করুন, আয়ত্বে নিয়ে আসুন। কারণ এই চারটি টিপস শেন ওয়ার্নকে সর্বকালের সেরা লেগস্পিনার বানিয়েছিল।
শেন ওয়ার্নের মত লেগস্পিন বোলিং টিপসগুলো আয়ত্বে আনতে পারলে আপনিও শেন ওয়ার্নের মত লেগস্পিন করতে পারবেন।
Leave a Reply