হ্যাকার শব্দের সাথে আজকাল প্রায় সবাই পরিচিত। যখন কোন ব্যক্তি বিনা অনুমতিতে কারো কম্পিউটার বা নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে, তখন তাকে আমরা হ্যাকার বলে জানি। তবে প্রত্যেক হ্যাকার খারাপ না। ভালো হ্যাকারদের হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার বলা হয়, এরা কম্পিউটার সুরক্ষা এবং সিকিউরিটি উন্নত করতে সহায়তা করে।
খারাপ হ্যাকারদেরকে ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার বলা হয়। ব্ল্যাক হ্যাট নামের মত তাদের চরিত্রটাও কালো। তারা মানুষের কম্পিউটার কিংবা নেটওয়ার্কে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করে ক্ষতি সাধন করে। এছাড়া কিছু আছে গ্রে হ্যাট হ্যাকার, এরা কখনো ব্ল্যাক আবার কখনো হোয়াইট হ্যাট হ্যাকারদের মত আচরণ করে।
হ্যাকার শব্দটিকে আমরা সাধারণত নেগেটিভ চোখে দেখে থাকি। তবে, আপনি জেনে অবাক হবেন যে এমন কিছু কারণ রয়েছে যার জন্যে আপনার ইথিক্যাল হ্যাকিং শেখা জরুরী। এ ধরণের হ্যাকাররাই মূলত হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার, যাদের কদর রয়েছে দুনিয়া জুড়ে, বিশেষ করে এই টেকনোলোজির যুগে।
একজন ইথিক্যাল হ্যাকারকে হায়ার করে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কোম্পানীগুলো। গুগল, মাইক্রসফট্ সহ বড় বড় টেকনোলোজি কোম্পানী এবং পৃথিবী বিখ্যাত আর্থিক কোম্পানীগুলো হাজার হাজার ডলার ব্যয় করে হ্যাকারদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। আপনি কি ভাবছেন এরা অন্যদের ওয়েবসাইট, অ্যাকাউন্ট তথ্য কিংবা কম্পিউটার হ্যাক করতে চায়?
মোটেই তা নয়, বরং এ-সব কোম্পানী নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হ্যাকার নিয়োগ দিয়ে থাকে। কারণ, একজন হ্যাকারাই যে কোন সিস্টেমের সিকিউরিটি হোল ধরতে পারে। এমনকি, একজন হ্যাকারই সবচেয়ে ভাল জানে অন্য হ্যাকাররা হ্যাক করার জন্যে কোন পদ্ধতি অবলম্বণ করতে পারে। তাই, এদের নিয়োগ দেয়া হয় ওই সব পদ্ধতি ব্যবহার বন্ধ করা, সিকিউরিটি হোল বের করে তার সমাধান দেয়ার জন্যে।
সত্যি বলতে কি, টেকনোলোজির এই যুগে হ্যাকিং পেশার মানুষদের দাম অনেক উপরে। তাই, যুগের সাথে তাল মেলাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনেক ছাত্র-ছাত্রীই পড়াশুনার জন্যে সাবজেক্ট হিসেবে বেছে নিচ্ছেন ইথিক্যাল হ্যাকিং।
আমার জানা মতে, আমাদের দেশের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এ বিষয়টি এখন পর্যন্ত অন্তভূর্ক্ত হয়নি। আপনি যদি উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের কথা ভেবে এ বিষয়ে পড়তে চান, তবে সাইবার সিকিউরিটি বা ইথিক্যাল হ্যাকিং শেখার সেরা ৩টি ওয়েবসাইট ব্যবহার করতে পারেন যেগুলো থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবেই আপনি হোয়াট হ্যাট হ্যাকিং শিখতে পারবেন।
যাই হোক, আপনাকে হ্যাকিং শেখায় উৎসাহিত করা এ লেখার মূল উদ্দেশ্য নয়। আসুন মূল টপিকে যাই, জেনে নেই পৃথিবীতে কুখ্যাত, পাশাপাশি বিখ্যাত কয়েকজন হ্যাকারের গল্প।
বিখ্যাত হ্যাকারের গল্প
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরণের হ্যাকিং কৌশল দেখিয়ে এ যাবৎ অনেক হ্যাকারই আলোচিত হয়েছেন, বিখ্যাত হয়েছে, হয়েছেন কুখ্যাতও। তার মাঝে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ৫ হ্যাকারের গল্প শুনুন আজ।
১. কেভিন মিটনিক
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিচার বিভাগ তাকে “মার্কিন ইতিহাসে মোস্ট ওয়ান্টেড কম্পিউটার ক্রিমিনাল” বলে অভিহিত করে। কেভিন মিটনিকের গল্প এত ভয়ংকর যে পরবর্তীতে Track Down নামে মুভি তৈরি হয়।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, কম বয়সীদের মধ্যে তিনি প্রথম সান মাইক্রোসিস্টেম এবং নোভেলের এর মত বড় বড় কোম্পানির কোড হ্যাক করে ফ্রি ফোন কল করতেন। এছাড়া NSA এর ফোন কল হ্যাক করেছিলেন। ডিজিটাল ইকুইপমেন্ট কর্পোরেশনের নেটওয়ার্ক হ্যাকিংয়ের জন্য এক বছরের কারাদণ্ডের পর মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু পরে তিনি আবার জাতীয় প্রতিরক্ষার ওয়ার্নিং সিস্টেম হ্যাক করে কর্পোরেট গোপনীয়তার তথ্য চুরি করেন।
শেষ পর্যন্ত মিটনিকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। ৫ বছর কারাদণ্ড ভোগের পর, তিনি কম্পিউটার সিকিউরিটির পরামর্শদাতা এবং পাবলিক স্পিকার হয়ে ওঠেন। বর্তমানে তিনি টুইটারেও সক্রিয়। তিনি এখন মিটনিক সিকিউরিটি কনসাল্টিং পরিচালনা করেন।
২. জনাথন জেমস
জনাথন জেমস, “comrade” নামে পরিচিত। তার গল্পটি খুব দুঃখজনক। তিনি খুব অল্প বয়সে হ্যাকিং শুরু করেন। বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক ও সরকারী নেটওয়ার্ককে হ্যাক করার জন্য তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। যদিও তিনি সে সময় খুব ছোট ছিলেন।
জেমস পরে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে কীভাবে কাজ করে তা জানার জন্য NASA এর নেটওয়ার্ক হ্যাক করে এবং সোর্স কোড ডাউনলোড করে (সেই সময়ে এর মূল্য $১.৭ মিলিয়ন সমমানের সম্পদ সমান)। NASA এর তদন্তের জন্য প্রায় তিন সপ্তাহ তাদের নেটওয়ার্ক কার্যক্রম বন্ধ রেখেছিল। এর জন্য খরচ হয়েছিল অতিরিক্ত ৪১ হাজার ডলার।
২০০৭ সালে বেশ কয়েকটি হাই-প্রোফাইল কোম্পানির নেটওয়ার্ক ক্ষতিকর আক্রমণের শিকার হয়েছিল। তখন সবাই জেমসকে সন্দেহ করে। তবে জেমস এই অপরাধ অস্বীকার করে। তিনি অস্বীকার করার পরও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে।
২০০৮ সালে জেমস আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যা নোটে লিখেছিল যে তিনি বিচার ব্যবস্থার প্রতি অস্থাশীল নয় এবং তিনি যে কাজ করেননি, তার জন্য তাকে বিনা দোষে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
৩. অ্যালবার্ট গনজালেজ
অ্যালবার্ট গনজালেজ শ্যাডোক্রু নামের একটি হ্যাকার গ্রুপের নেতা হিসাবে হ্যাকিং জীবন শুরু করেন। ক্রেডিট কার্ড নম্বর চুরি এবং বিক্রির পাশাপাশি জাল পাসপোর্ট, স্বাস্থ্য বীমা কার্ড, জন্ম সনদপত্র তৈরি করতো পরিচয় চুরির জন্য।
তিনি TJX কোম্পানি এবং হার্টল্যান্ড পেমেন্ট সিস্টেমের ডাটাবেসে হ্যাক করে তার সমস্ত সংরক্ষিত ক্রেডিট কার্ড নম্বরগুলো চুরি করে। দুই বছর ধরে ১৭০ মিলিয়ন ক্রেডিট কার্ড এবং এটি এম কার্ড নম্বর সংগ্রহ করার পর অ্যালবার্ট গনজালেজ ইন্টারনেটে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
গনজালেজকে ২০ বছরের জন্য কারাদণ্ড দেয়া হয় এবং ২০২৫ সাল মুক্তির জন্য নির্ধারিত হয়।
৪. কেভিন পোলসেন
কেভিন পোলসেন যিনি “Dark Dante” নামে পরিচিত। মিডিয়ার মতে তিনি “কম্পিউটার অপরাধের হানিবল লিকটার” ছিলেন। ১ই জুন ১৯৯০ সালে লস এঞ্জেলেস রেডিও স্টেশন KIIS-FM এ ভাগ্যবান কলের একটি প্রতিযোগিতা হয়। কেভিন এই রেডিও স্টেশনের সবগুলো ফোন লাইন হ্যাক করে এবং নিজেকে ১০২ তম ভাগ্যবান কল দাতা হিসাবে নিশ্চিত করে জয়ী হন। পুরস্কার হিসাবে জিতে নেন Porsche 944 S2 গাড়ি।
কেভিন ফেডারেল সিস্টেম হ্যাক করে, তথ্য চুরি কারণে FBI এর ওয়ান্টেড তালিকায় চলে আসে। পরে তাকে আটক করা হয়। শাস্তি হিসাবে ৫১ মাসের জেল এবং ৫৬ হাজার ডলার জরিমানা করা হয়।
১৯৯৫ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর কেভিন তার পথ পরিবর্তন করেন। তিনি সাংবাদিক হিসাবে কাজ শুরু করেন এবং বর্তমানে Wired এর একজন সহযোগী সম্পাদক। ২০০৬ সালে তিনি MySpace এ ৭৪৪ জন যৌন অপরাধীদের সনাক্ত করতে, আইন প্রয়োগকারীদের সহায়তা করেছিল।
৫. গ্যারি ম্যাককিনন
গ্যারি ম্যাককিনন ইন্টারনেটে “Solo” নামে পরিচিত। তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সামরিক কম্পিউটার হ্যাকার বলা হয়। তিনি UFO নিয়েও গবেষণা করেন।
ফেব্রুয়ারি ২০০১ থেকে মার্চ ২০০২ পর্যন্ত ১৩ মাস, ম্যাককিনন অবৈধভাবে মার্কিন সশস্ত্র বাহিনী এবং নাসার ৯৭টি কম্পিউটার অ্যাক্সেস করেন। তিনি দাবি করেন যে তিনি কেবলমাত্র ফ্রি শক্তি দমন এবং UFO কভার-আপ তথ্যের জন্য অনুসন্ধান করছেন। তবে মার্কিন কর্তৃপক্ষের মতে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল মুছে ফেলেছেন এবং ৩০০টিরও বেশি কম্পিউটারকে নষ্ট করেছেন, যার ফলে ৭০০,০০০ মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়।
তার অপরাধের জন্য তাকে কারাদণ্ড দেয় হয়। তবে তার জন্য তিনি আবার আপীল করেন এবং যুক্তরাজ্যের নাগরিক হওয়ায় তা কার্যকর হয় নি। ২০১২ সালে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব থেরেসা মে বলেন, মানবাধিকারের ভিত্তি অনুযায়ী, তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হবে না।
Leave a Reply