একজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হিসেবে ফোনে অতিরিক্ত ডাটা খরচ সব সময়ই আমার কাছে একটা বড় সমস্যার মতো মনে হয়েছে। যার কারণে ডাটা খরচ কমানোর উপায় নিয়ে আমাকে বারবার চিন্তা করতে হয়েছে। ঢাকায় থাকার সময় ইন্টারনেটর জন্য খরচ নিয়ে বেশি চিন্তা করতে হয় না। ব্রডব্যান্ড এখানে সহজলভ্য, জেলা শহরগুলোতেও অনেকটা তাই। কিন্তু যখন বাড়িতে যাই, তখন ইন্টারনেট খরচ বেশ মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, তখন মোবাইল ইন্টারনেট ছাড়া কোন ভিন্ন উপায় নেই।
আর আমাদের মোবাইল কোম্পানিগুলো ইন্টারনেট প্যাকেজের জন্য যে পরিমাণ দাম রাখে, তাতে না চাইলেও সেটিকে বেশ হিসেব করে ব্যবহার করতে হয়। অন্যদিকে স্মার্টফোনের বেশিরভাগ অ্যাপই সরাসরি অথবা ব্যাকগ্রাউন্ডে প্রচুর পরিমাণ ডাটা ব্যবহার করার কারণে দেখা যায়, নিজেদের অজান্তেই সেই হিসেব করা ডাটা প্যাকেজ শূন্য হয়ে এক সময় অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সও শূন্য হয়ে যায়।
কিন্তু এভাবে ফোনে অতিরিক্ত ডাটা খরচ নিশ্চয়ই আপনার আমার কারোরই কাম্য নয়। তাই এখন প্রশ্ন হচ্ছে—
মোবাইলে অতিরিক্ত ডাটা খরচ কমানোর উপায় কি?
মোবাইলে অতিরিক্ত ডাটা খরচ হলেও কিছুটা কৌশল অবলম্বন করে এটি বেশ অনেকটাই কমানো যায়। এরকম কিছু বিষয় নিয়েই নিচে আলোচনা করা হয়েছে। ফোনে অতিরিক্ত ডাটা খরচ কমানোর জন্য কৌশলগুলো প্রয়োগ করতে পারেন।
ভিডিও অটোপ্লে
থ্রিজি আর ফোরজি চলে আসার পর ভিডিও অটোপ্লে একটি ভালো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন ব্রাউজার বা অ্যাপে কোন রকম বলা কওয়া ছাড়াই যে কোন ভিডিও অটোমেটিক্যালি প্লে হয়ে যায় এবং সর্বনাশ করে ডাটা প্যাকেজের।
অতিরিক্ত ডাটা খরচ কমানোর জন্য তাই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ব্রাউজার কিংবা ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামের মতো অ্যাপের ভিডিও অটোপ্লে ফিচারটি বন্ধ করে দিন।
ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামে ডাটা সেভার
ভিডিও অটোপ্লে ছাড়াও এইচডি ফটো, ভিডিও আপলোড করে আপনার কেনা মেগাবাইটের বারোটা বাজাতে পারে ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামের মতো সোশ্যাল অ্যাপ। তবে এই সমস্যার সমাধানও রয়েছে অ্যাপগুলোতে। ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামের বিল্টইন ডাটা সেভার মুড ব্যবহার করে ডাটা খরচ কমাতে পারেন অনেকটাই।
কিভাবে অল্প ডাটা খরচে ফেসবুক ব্যবহার করবেন সেটা এখান থেকে আরও বিশদভাবে দেখে নিন।
হোয়াটস অ্যাপে অটো ডাউনলোড
হোয়াটস অ্যাপ বা এরকম মেসেজিং সার্ভিস যারা ব্যবহার করেন, তারা জানেন হোয়াটস অ্যাপের সমস্ত ডাটা অটোমেটিক্যালি ডাউনলোড হয়ে আপনার ফোন মেমরি বা মেমরি কার্ডে জমা হয়ে থাকে। শুধুমাত্র টেক্সট মেসেজের ডাটার জন্য খুব বেশি মেগাবাইট খরচ হয় না, খরচ হয় ছবি, অডিও বা ভিডিও ফাইল অটো ডাউনলোডের জন্য।
অনেক কনভারসেশন বা বিভিন্ন গ্রুপের এমন অনেক মিডিয়া ফাইলই থাকে, যেগুলো মোটেও আপনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু অটো ডাউনলোড অপশন অন করা থাকলে সেই অযাচিত ডাটাগুলো চান বা না চান ডাটা কানেকশন অন করা মাত্রই ডাউনলোড হওয়া শুরু করবে। ফলাফল, একগাদা অপ্রয়োজনীয় ছবি, অডিও, ভিডিও দিয়ে ফোনের জায়গা ভর্তি এবং অতিরিক্ত ডাটা খরচ।
এটি কমাতে তাই অটো ডাউনলোডের অপশনটি বন্ধ করে দিন। চিন্তার কিছু নেই; কোন ছবি, অডিও বা ভিডিও দেখার প্রয়োজন হলে সেটির উপরে চাপ দিয়ে মেনুয়ালি ডাউনলোড করে নিতে পারবেন।
ব্রাউজারে ডাটা রিডিউস ফিচার
অপেরা মিনি বা ইউসি ব্রাউজার যারা ব্যবহার করেছেন, তারা এই ফিচারটির সাথে পরিচিত। বর্তমানে ক্রোমসহ বিভিন্ন ডায়ানামিক ব্রাউজারে এই ফিচারটি যোগ করেছে।
এটি মূলত কোন ওয়েব পেজের বেসিক গঠন ঠিক রেখে ইমেজ রেজুলেশন, অ্যাড, স্টাইল, মিডিয়া ফাইল ইত্যাদি যথাসম্ভব কমিয়ে আপনাকে দেখানোর চেষ্টা করে। ফলে ব্রাউজিং এর সময় খুব অল্প ডাটা খরচে আপনাকে আসল কন্টেন্ট দেখায়।
তাই ফোনে অতিরিক্ত ডাটা খরচ কমানোর জন্য ব্রাউজারে ডাটা রিডিউস ফিচার অন করে রাখুন।
ব্যবহার করতে পারেন প্রিমিয়াম অ্যাপ
গেম খেলছেন, এক রাউন্ড শেষ হওয়ার পরপরই অন্য আরেকটি গেমে ভিডিও অ্যাড চালু হয়ে গেল! এরকম পরিস্থিতিতে কী কখনও পড়েছেন? কিংবা ডিকশনারি দরকার পড়ছে; মোবাইলের ডাটা অন করা, কিছুক্ষণ পরপরই স্ক্রিন জুড়ে বিশাল আকারের অ্যাড দেখাচ্ছে, পাশাপাশি নিচের ছোট্ট ব্যানার অ্যাড তো রয়েছেই।
অ্যাড দেখার এরকম বিরক্তিকর পরিস্থিতি সম্পর্কে কম বেশি সবাই অবগত। এতে করে যেমন, বিরক্তির জন্ম হয় তেমনি ডাটা খরচও হয় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে।
অ্যাড খারাপ জিনিস, এরকমটা নয়। ডেভেলপারদের পারিশ্রমিকের জন্যই অ্যাডের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু আপনি যদি একটু ডাটা খরচ সেভ করতে চান বা অ্যাড দেখার বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি পেতে চান, তাহলে এর বিকল্প উপায়ও রয়েছে। সেটি হচ্ছে প্রিমিয়াম অ্যাপের ব্যবহার। অল্প কিছু টাকা ব্যয় করে এসব অ্যাপ কিনে নিতে পারেন প্লেস্টোর থেকে। অ্যাড রিমুভের পাশাপাশি এক্সট্রা ফিচারও পেয়ে যাবেন বেশিভাগ ক্ষেত্রেই।
ব্যাকগ্রাউন্ড ডাটা রেস্ট্রিকশন
ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে মনে হয়, মোবাইল ডাটা খরচ কমানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় ব্যাকগ্রাউন্ড ডাটা রেস্ট্রিকশন অন করা। অনেক অ্যাপই রয়েছে যেগুলো আপনি অন না করলেও অটোমেটিক্যালি ফোন অন করলে বা ডাটা কানেকশন অন করলে ব্যাকগ্রাউন্ডে অন হয়ে যায়। সেই সাথে বিভিন্ন ডাটা সিনক্রোনাইজ করার জন্য আপনার কেনা মেগাবাইট আপনার অজান্তেই খরচ করতে থাকে।
আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি অ্যাপের এরকম অ্যাক্সেস বন্ধ করা বেশ ঝামেলার। সেক্ষেত্রে ব্যাকগ্রাউন্ড ডাটা রেস্ট্রিকশন অসাধারণ একটি সমাধান। এতে করে আপনি শুধুমাত্র যে অ্যাপটি যখন চালাবেন, তখন সেই অ্যাপটিই ডাটা খরচ করবে। বের হয়ে আসলে আর কোন ডাটা খরচ করবে না এবং স্ক্রিনের আলো নিভে গেলে সব ধরণের ডাটা খরচ বন্ধ হয়ে যাবে। Settings এর Data Usages অপশনটি থেকে এটি বন্ধ করতে পারবেন।
তবে ব্যাকগ্রাউন্ড ডাটা রেস্ট্রিকড করে রাখলে যেহেতু ব্যাকগ্রাউন্ডে কোন কিছুই আর ডাটা ব্যবহার করবে না, তাই কোন কিছু ডাউনলোড করে ব্রাউজার বা ডাউনলোড ম্যানেজার থেকে বের হয়ে আসলে ডাউনলোড বন্ধ হয়ে যাবে।
অ্যাপ আনইন্সটল
ডাটা রেস্ট্রিকশন ফিচারটি সব অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনেই রয়েছে। দুই একটি আছে ব্যতিক্রম সেগুলোর জন্য কিংবা আপনি যদি ডাটা রেস্ট্রিশকন ফিচার ব্যবহার করতে না চান, তাহলে অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ আনইন্সটল করতে পারেন। প্রিমিয়াম অ্যাপ যারা ব্যবহার করতে চান না, তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রজেয্য।
তাই যে অ্যাপগুলো সব সময় ব্যবহার করা হয় না, সেগুলো আনইন্সটল করে রাখুন। এতে করে অ্যাড এবং ব্যাকগ্রাউন্ড এক্টিভিটিতে ডাটা অপ্রয়োজনীয় ডাটা খরচের সম্ভাবনা একেবারেই থাকবে না। তাছাড়া, কিছু অ্যাপ আছে যেগুলো শুধু অতিরিক্ত ডাটা খরচই নয়, আপনার স্মার্টফোনের ব্যাটারিরও বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে।
সুবিধা অনুযায়ী প্যাকেজ কিনুন
এই কাজটি আমার ধারণা সবাই করার চেষ্টা করে। সব সিমেই রেগুলার ডাটা প্যাকেজগুলোর দাম অত্যান্ত চড়া। সব সময় যদি সেগুলো কিনে ব্যবহার করতে যাওয়া হয়, তাহলে ইন্টারনেটের জন্য খরচ এমনিতেই বেড়ে যাবে।
তাই সিমের বর্তমান অফারগুলো চেক করুন, সমস্যা না থাকলে সময় বেঁধে দেওয়া প্যাকেজগুলো কিনতে পারেন। ডাউনলোড বা অল্প সময়ের জন্য বেশি ডাটা প্রয়োজন হলে ব্যবহার করতে পারেন রবি বা এয়ারটেলের টাইমবেইজড প্যাক অর্থাৎ আইবাডি অ্যাপ থেকে যে ডাটা কেনা হয় সেটি।
এতে করে রাত একটা থেকে সকাল এগারোটার মধ্য কিনতে পারবেন মাত্র ১৫ টাকাতেই দুই ঘন্টার জন্য ১ জিবি ডাটা।
ডাটা সেভিং অ্যাপ
ফোনে অতিরিক্ত ডাটা খরচ কমানোর লক্ষে এ বছর বেশ কয়েকমাস আগে গুগল লঞ্চ করে তাদের ডাটা সেভিং অ্যাপ Datally. তাদের দাবী অনুযায়ী এটি ৩০% পর্যন্ত ডাটা খরচ কমাতে সক্ষম। Datally ছাড়াও প্লেস্টোরে ডাটা সেভিং এর জন্য প্রচুর অ্যাপ রয়েছে, ইচ্ছে করলে সেগুলো ব্যবহার করে দেখতে পারেন।
তবে আমার ডাটা সেভিং অ্যাপ ব্যবহারের অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। তাছাড়া, প্রক্সি সার্ভার ব্যবহার করে এসব অ্যাপের ডাটা মনিটরিং সিস্টেম আমার কাছে কেন জানি একটু অনিরাপদ লাগে। তাই এ ব্যাপারটি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার দায়িত্ব আপনার উপরে ছেড়ে দিচ্ছি।
ফোনে অতিরিক্ত ডাটা খরচ কমানোর জন্য উপরের উপায়গুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার করতে পারেন ফ্রি ওয়াই-ফাই। বর্তমানে আমাদের দেশের রেল স্টেশনগুলোতে ফ্রি ওয়াইফাই এর সুবিধা রয়েছে। এছাড়া বাস টার্মিনাল, রেস্টুরেন্ট, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, শপিংমল ইত্যাদিতে ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবহারের সুবিধা রয়েছে। প্রয়োজন মতো সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন ডাটা খরচ বাচাঁনোর জন্য। তবে এক্ষেত্রে নিজের নিরাপত্তার কথাটি মাথায় রাখতে হবে সবার আগে। পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহার করার সময় নিজেকে কিভাবে সুরক্ষিত রাখা যায় সেটি এখান থেকে জেনে নিন।
Leave a Reply