স্কুল বা কলেজে জীববিজ্ঞানের ক্লাসে অবশ্যই আপনি পরজীবি প্রাণী সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছেন। এদের কাজ হলো অপর কোন জীবের শোষণের মাধ্যমে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করা। অন্য কোন জীবের শোষণ ব্যাতিত এদের পক্ষে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। তাই আজীবনকাল ধরে এরা কোন না কোন জীবের শোষন করেই নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করে চলে।
আমাদের মধ্যেও এমন কিছু কিছু মানুষ রয়েছে যাদের স্বভাবে তারা এধরনের পরজীবি জীবদেরও হার মানায়। আর এদের কাজই হলো এমন মানুষের সন্ধান করে চলা, যার উপর নিজের সবকিছু চাপিয়ে দিয়ে তারা স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন করতে পারবে।
প্যারাসিটিক সম্পর্ক:
যে কোন ভালোবাসার সম্পর্কে একজন সঙ্গী অপরজনের জন্য সৌভাগ্য এবং ভালো সবকিছু বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু যে ধরনের সম্পর্কে একজন সঙ্গী অপরজনের জন্য ভালো কিছু করার পরিবর্তে তার জন্য ক্ষতিকর দিকগুলি নিজের স্বার্থকে উদ্ধার করার জন্য বয়ে নিয়ে আসে, তাকে প্যারাসিটিক সম্পর্ক বলা হয়। এধরনের সম্পর্কে একজন শুধুমাত্রই তার স্বার্থ এবং প্রয়োজন মিটানোর জন্য অন্যজনের উপর নির্ভরশীল থাকে এবং তাকে যথেচ্ছা ব্যবহার করে থাকে।
আমি বলছি না যে সম্পর্কের মাধ্যমে উপকার বা স্বার্থ উদ্ধার হওয়া সবক্ষেত্রে খারাপ। কিন্তু সেটি ভালো শুধুমাত্র তখনই, যখন এটি থেকে সম্পর্কে জড়িয়ে থাকা দু’জনই সমান সমানভাবে স্বার্থলাভ করবে। কিন্তু যখনই সেটি একতরফা হয় অর্থাৎ একজন শুধু সবকিছু ভোগ করেই যাচ্ছে এবং অপরজন তার যোগান দিয়ে চলেছে, তখনই সেটি প্যারাসিটিক সম্পর্ক হিসেবে বিবেচিত হয়।
পৃথিবীতে এমন একটি মানুষও নেই যে অন্যের দ্বারা ব্যবহার হতে চাইবে। বিশেষ করে ভালোবাসার মত সম্পর্কে প্রিয় মানুষটির দ্বারা ব্যবহার হওয়ার মত অনুভুতি একটি মানুষকে মুহুর্তের মধ্যেই মানসিকভাবে শেষ করে দিতে পারে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য এটাই যে, আমাদের মধ্যে অনেকেই প্রতিনিয়ত এধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করে যাচ্ছি। আর সেটা অনেকটা নিজের অজান্তেই। আপনার সাথে এমনটি হলে কিভাবে বুঝবেন চলুন জেনে নেওয়া যাক।
যেভাবে বুঝবেন আপনি প্যারাসিটিক সম্পর্কে জড়িয়ে আছেন:
যে সম্পর্কের মধ্যে শারিরীক এবং মানসিক নির্যাতনের প্রবণতা থাকে, সেগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্যারাসিটিক হয়ে থাকে। এর একটি বড় কারণ হলো, বেশির ভাগ প্যারাসিটিক তার সঙ্গীর উপর আবেগগত চাপ, অপরাধবোধ ইত্যাদি সৃষ্টির মাধ্যমে নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়। কারণ, তারা ভয় পায় যে তাদের সঙ্গী যে কোন মুহুর্তে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে।
আর এ কাজটি ভালোভাবে করার জন্য সে চাইবে আপনাকে যতটা সম্ভব একাকী করে রাখার। আপনার কাছের মানুষ যারা আপনার বিপদ আপদে এগিয়ে আসবে বা আপনাকে সান্তনা বা অনুপ্রেরণা প্রদানের মাধ্যমে আপনাকে স্বাভাবিক রাখবে, এমন সব মানুষ থেকে সে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার চেষ্টা করবে। যাতে আপনার উপর তার কর্তৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা বজায় থাকে।
প্রতিনিয়ত আপনার চলাফেরা, কথাবার্তা, পোশাক পরিচ্ছদ, দক্ষতা সবকিছু নিয়ে আপনাকে হেয় প্রতিপন্ন করা হবে। এমনকি, আপনাকে বুঝানো হবে যে আপনার কারণে যে কতটা কষ্টের সম্মুখীন হচ্ছে। এছাড়াও তারা নিজেরাই আপনার জন্য প্রতিকুল পরিবেশ সৃষ্টি করে, তারপর আপনাকে সমর্থন দেবার অভিনয় করতে থাকে, যাতে আপনার মনে হয় যে আপনি তাকে ছাড়া কিছুই না।
প্যারাসিটিক সম্পর্ক নির্ণয়ের জন্য যা বিবেচনা করতে হবে:
- যদি আপনাদের সম্পর্ক থেকে আপনি এবং আপনার সঙ্গী দু’জনেই লাভবান হয়ে থাকেন, তাহলে আপনাদের সম্পর্ক প্যারাসিটিক নয়। এধরনের সম্পর্ককে মিউচ্যুয়াস্টিক সম্পর্ক বলা হয়ে থাকে।
- যদি আপনাদের সম্পর্ক আপনার সঙ্গী লাভবান হন এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকেন, তাহলে আপনাদের সম্পর্ক কোন সন্দেহ ছাড়াই প্যারাসিটিক সম্পর্ক। আর এক্ষেত্রে আপনার সঙ্গী হচ্ছেন প্যারাসিটিক এবং আপনি তার হোষ্ট।
- যদি আপনারা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকেন, তাহলেও আপাদের সম্পর্ক প্যারাসিটিক নয়। আপনাদের মিউচ্যুয়াস্টিক সম্পর্ক। কিন্তু সেখানে অন্য কোন সমস্যা কাজ করছে, যা আপনাদের উভয়ের আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।
প্যারাসিটিক সম্পর্কের কিছু বাস্তব উদাহরণ:
- মনে করুন, আপনার গার্লফ্রেন্ড আপনার গাড়ী ব্যবহার করে এবং অফিস শেষে সে আপনাকে পিকআপ করতে ভুলে গেল। আপনি যখন বাসায় ফিরলেন, তখন সে আপনাকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিল যে সে শপিং করতে এটতাই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে আপনাকে পিকআপ করার কথা তার স্মরণেই ছিল না।
- আপনাদের সংসার চালানোর জন্যে হয়তো আপনাদের দুজনেরই কোন চাকরি করার প্রয়োজন। আর আপনার সঙ্গীকে আপনি সারা রাত ধরে সেটি বুঝালেন, যাতে সেও কোনভাবে অর্থউপার্জন করে সংসার চালাতে আপনাকে সাহায্য করে। কিন্তু পরদিন সকালে দেখলেন যে আপনি ঘুম চোখে উঠে যেয়ে কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেও সে ঠিকই আপনার আগের রাতের কথায় কর্ণপাত না করে ঘুমিয়ে আছে।
আপনার যা করণীয়:
যদি আপনি নিশ্চিত হয়ে থাকেন যে, আপনি প্যারাসিটিক সম্পর্কের জালে আটকা পড়েছেন, তাহলে সেটি সংশোধনের জন্য কিছু কাজ করতে পারেন।
- নিজেদের মধ্যে কথা বলুন এবং অবশ্যই কথা বলার সময় কোন ধরনের সংকোচবোধ ছাড়াই কথা বলুন। পূর্বে যা কিছু হয়েছে তার জন্য একে অপরের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং ক্ষমা করে দিন। তাছাড়া ভবিষ্যতে আপনার সঙ্গীর দ্বারা আপনার এবং আপনার দ্বারা তার যাকে কোন ক্ষতি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখুন।
- অন্যান্যদের কাছ থেকে মতামত, পরামর্শ এবং সহযোগীতা নিন।
- আপনার সঙ্গীকে সম্মান দিতে শিখুন।
- সে আপনাকে কষ্ট দিতে পারে, এমন ভয় থেকে বের হয়ে আসুন এবং ক্ষমা করতে শিখুন।
- পাওয়ার চাইতে দেওয়ার মধ্যে সুখ বেশি এটা বুঝতে শিখুন।
- সবশেষে যদি কোন ভাবেই এসব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব না হয়, তাহলে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পর্কের অবসান করার চেষ্টা করুন।
আপনার মনে হতেই পারে যে আপনি যাকে ভালোবাসেন, তার জন্য কিছু করাটা দোষের কিছু না। আমিও এটি স্বীকার করি যে অবশ্যই ভালোবাসার মানুষের জন্য কিছু করতে পারাটা আনন্দের এবং এর মধ্যে দোষের কিছুই নেই। কিন্তু আপনাকেও এটি মনে রাখতে হবে যে, যারা একে অপরকে ভালোবাসেন, তারা যতটুকু পান তার চেয়ে বেশি অন্য জনের জন্য করার চেষ্টা করেন।
একটি সম্পর্ক তৈরী হওয়ার পর সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে দুজনের মধ্যেই বিশ্বাস, আস্থা এবং একে অপরকে সহযোগীতা করার প্রবণতা ও প্রয়োজনও বাড়তে থাকে। আপনাদের সম্পর্কটি শুধুমাত্র তখনই আদর্শ এবং সুখকর হবে, যখন আপনার দু’জনই দুজনের প্রতি সমান দায়িত্ব নেবেন এবং একে অপরকে সহযোগীতা ও সমর্থন দেবেন।
Leave a Reply