খুব বেশী ঘুম কিংবা খুব কম ঘুম কোনটাই স্বাস্থ্যকর নয়। আপনি যদি মাত্রাতিরিক্ত ঘুমান বা খুব অল্প ঘুমান, দু’টি ক্ষেত্রেই আপনার স্বাভাবিক কাজকর্ম এবং চলাচলে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। আর সে ক্ষেত্রে, স্বাভাবিকভাবেই আপনার কাজের অগ্রগতি কমে যাবে এবং আপনি পিছিয়ে পড়বেন। অতএব মনে রাখতে হবে, আপনার প্রাণচঞ্চল এবং স্বতঃস্ফূর্ত দিনগুলোই কেবল মাত্র আপনার সফলতাকে বয়ে নিয়ে পারে। আর তাই সফলতা নিশ্চিত করতে অবশ্যই প্রয়োজন পরিমিত ঘুম।
সাম্প্রতিক গবেষণার এক প্রতিবেদনে American Journal of Health Promotion যে তথ্য প্রকাশ করে, তা থেকে অতিরিক্ত বেশী বা কম ঘুমের যে সব ঝুঁকি রয়েছে তার সত্যতা আবারও প্রমাণিত হয়। এখানে অবশ্যই বলা যেতে পারে, আমরা যারা স্বাস্থ্যকর জীবন নিয়ে প্রায়ই বিচলিত, তাদের জন্যে এ তথ্য অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বের দাবী রাখে।
যেহেতু ঘুমের খুব বেশী হেরফের হলে আমাদের কাজ করার আগ্রহকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়, সেহেতু এ নিয়ে বিচলিত বা চিন্তিত না হয়ে আর কোন উপায় থাকে না। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্বাস্থ্য-সচেতনতা ভিত্তিক সংস্থা প্রায় ছয় লাখ পেশাজীবীদের নিয়ে এক সমীক্ষা চালায়। সে সমীক্ষা থেকে যে ফলাফল পাওয়া যায় তা হল, কর্মজীবীদের অতিরিক্ত বেশী বা অত্যন্ত কম ঘুমের ফলে কর্মক্ষেত্রে বা কল-কারখানায় স্থবিরতা কিংবা উৎপাদন বিমুখতা দেখা দিতে পারে। কেননা এক্ষেত্রে, কর্মীদের কর্মদক্ষতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়।
- আরো পড়ুন: ঘুম না এলে যে ২০টি কাজ করতে পারেন
সম্প্রতি গবেষকগণ আরও একটি গবেষণায় দেখতে পান, যারা অতিরিক্ত বা অতি-অল্প ঘুমান, মানুসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকে তারা সঠিক বয়সের তুলনায় প্রায় দু’বছর এগিয়ে থাকেন। যার অর্থ হল, অপরিমিত ঘুম আপনার কাজের আয়ু কমিয়ে ফেলছে এবং আপনাকে তাড়াতাড়ি নির্জীব বা বুড়ীয়ে দিচ্ছে।
শুধু তাই নয়, এ সমীক্ষায় আরও যে সব তথ্য বেরিয়ে আসে তা হল, যারা ৬ ঘণ্টা থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমিয়ে থাকেন তাদের চেয়ে কম স্মৃতি শক্তি এবং কাজ করার ক্ষমতা থাকে তাদের যারা ৫ ঘণ্টার চেয়ে কম ঘুমান অথবা ৯ ঘণ্টার চেয়ে বেশী ঘুমান। এ গবেষণায় থেকে দেখা যায়, যে সব কর্মজীবী মানুষ ৫ ঘণ্টার কম ঘুমিয়ে অভ্যস্ত, কর্মক্ষেত্রে তাদের উপস্থিতিও কম। বিভিন্ন গবেষণায় আরও যে সব অর্থপূর্ণ তথ্য উঠে আসে তা হল; প্রয়োজনের তুলনায় খুব বেশী-ঘুম বা কম ঘুমিয়ে অভ্যস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অকাল মৃত্যুহার বেশী এবং তাদের বিভিন্ন রকম ক্রনিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকাও বেশী থাকে।
কেন আমাদের খুব-বেশী অথবা খুব-কম ঘুম হয়
এখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, মানুষ কখন এতো বেশী অথবা কম ঘুমায়? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের শরণাপন্ন হতে পারি; আসুন দেখে নেই চিকিৎসা বিজ্ঞান এ ক্ষেত্রে কী বলে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের গবেষণা মতে, বিষণ্ণতা এবং অপ্রতুল আর্থ-সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থা এই অস্বাভাবিক ঘুমের পিছনে প্রধানত দায়ী। এছাড়া আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, নানারকম অপ্রাপ্তি এবং বৈষম্য কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়োগ ব্যথা, যেখান থেকে জন্ম নেয় দুঃখ, কষ্ট, হতাশা। ফলে শারীরিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয় এবং তা থেকেই অতি-ঘুম বা নির্ঘুমের সূত্রপাত হয়।
অতি-ঘুমের পিছনে “হ্যাপেরসোমনিয়া” (Hypersomniya ) রোগকেও চিহ্নিত করা যেতে পারে। এটি একটি নিউরোলজিক্যাল ডিজ-অর্ডার ( Neurological Disorder), এ রোগ যদিও অনেক কারণেই সৃষ্টি হতে পারে, তবে সম্ভাব্য কারণটি কোন দুঃখ-কষ্ট এবং উদ্বিগ্নতা থেকে শরীরে বাসা বেঁধে থাকে বলে চিকিৎসকরা মনে করেন।
এছাড়াও প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্যগুণের অভাব দেখা দিলে, দুর্বলতাজনিত কারণেও এ লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এছাড়া আরও রয়েছে, কিছু নির্দিষ্ট ক্ষতিকর উপাদান নিয়মিত সেবন করা যেমন: এলকোহল, বিভিন্ন প্রকার ঔষধ; এমনকি চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রের নিয়মিত ঔষধের ক্ষেত্রও এমনটি হতে পারে। সর্বোপরি, কিছু মেডিকেল ডিজ-অর্ডার থেকে (Medical Disorder) এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
পরিমিত ঘুমই আমাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে
আসুন সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে আমরা পরিমিত ঘুমের অভ্যাস গড়ে তুলি। উপরের তথ্যগুলো থেকে আমরা পরিষ্কার হলাম একমাত্র পরিমিত ঘুমই আমাদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। অর্থাৎ খুব বেশী বা খুব কম ঘুম দু’টির যে কোনটিই আমাদের সুস্বাস্থ্যের জন্যে মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। যে সব কারণগুলো থেকে এ অবস্থার সূচনা হতে পারে, আমাদের উচিত প্রথমত সেগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া।
মনে রাখতে হবে প্রধানত আমাদের সুচিন্তাই পরিমিত ঘুমকে নিশ্চিত করতে পারে। বিভিন্ন সময় মনিষীরা বলে থাকেন, “সুচিন্তায় করে চিত্ত নির্মল”-তাই বলা হয়, একমাত্র নির্মল চিত্তের অধিকারী হওয়াই হউক আমাদের লক্ষ্য। কেননা চিত্তের নির্মলতার সাথে সাথে আমরা আমাদের পরিমিত ঘুমও নিশ্চিত করতে পারি।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কিছু বাজে অভ্যাস গড়ে উঠতে পারে, যা কিছু স্বাস্থ্যকর নয় অথবা অপরিমিত সেবন বা অভ্যাসে আসক্তির সৃষ্টি হয়, তা এড়িয়ে চলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া, পরিমিত ঘুম নিশ্চিত করতে দরকার শরীরের সুসম রক্ত চলাচল নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্যে নিয়মিত কিছু ব্যায়াম অভ্যাস করাও জরুরী। যেহেতু প্রয়োজনীয় ঘুম না হলে স্বাস্থ্য সচল রাখা কঠিন, সেহেতু আমাদের উচিত পরিমিত ঘুম নিশ্চিত করতে যে সব স্বাস্থ্যবিধি এবং শৃঙ্খল রয়েছে সে গুলো সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে সচেতনতার সাথে মেনে চলা।
আধুনিক জীবন যাপনের সাথে আমাদের অনেক সময়ই তাল মিলিয়ে চলতে হয়, এ ক্ষেত্রে ইচ্ছে থাকলেও অনেক সময় আমরা কিছু অনিয়ম এড়িয়ে যেতে পারিনা। তাই দেখা গেছে, আমাদের নতুন অভ্যাসের সাথে সাথে পুরানো অভ্যাস গুলোর ছন্দ পতন ঘটতে এবং ঘুমের অনিয়মিত সময় সূচির স্বীকার হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তে, কিন্তু সুস্বাস্থ্যের দিকে কথা চিন্তা করে আমাদের উচিত হবে, পরিমিত ঘুমের বিষয়ে যত্নবান হওয়া। এটাও ঠিক যে, আমরা সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা, তাই এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে যুক্তিযুক্ত। মোট কথা, যেন কোন অবস্থাতেই খুব বেশী ঘুম অথবা খুব কম ঘুম আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী হয়ে যেন না পড়ে সে দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা।
আমরা অনেক সময়ই আমাদের অনেক শারীরিক সমস্যাকে পাত্তা না দিয়ে একটি জটিল রোগের দিকে এগিয়ে যায়, যেমন: ঘুম বেশী হওয়া বা কম হওয়াকে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তেমন আমলে নিতে চাইনা, যা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে হয়ত আমাদের জীবনের ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। কিন্তু আমারা যদি একটু সচেতন হোই তাহলে এধরণের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারি। আধুনিক জীবনের অনেক সুযোগ সুবিধার মধ্যে চিকিৎসা বিজ্ঞানেরও রয়েছে অনেক আধুনিক অবদান, তাই শারীরিক কোন সমস্যাই দেরী না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং সুস্থ থাকুন।
Leave a Reply