আমরা সবাইতো মোটামুটি ফুটবল খেলা দেখি। কিন্তু কখনো কি খেয়াল করে দেখেছেন খেলা আরম্ভ হওয়ার আগে খেলোয়াড়রা মাঠে প্রবেশ করার সময় তাদের প্রত্যেকের সাথে একজন করে শিশু থাকে? জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময়ও প্রত্যেক খেলোয়াড়ের সামনে একজন করে শিশু দাঁড়িয়ে থাকে। এটা প্রতি খেলাতেই ঘটে থাকে। এই শিশুদেরকে বলা হয় মাসকট বা ইস্কর্ট অফ প্লেয়ার।
কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন কি কারণে খেলোয়াড়দের সাথে এই শিশুরাও মাঠে নামে? আজ থেকে বিশ পঁচিশ বছর আগে সেই আশির দশকের শেষেও এভাবে শিশুদের সাথে মাঠে আসার কোন নিয়ম ছিল না ফুটবলে। এমনকি ১৯৯০ সালের ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপের ফাইনালে কিংবা ১৯৯৪ সালের এফ এ কাপের ফাইনালেও প্রতি খেলোয়াড়ের সাথে একজন করে এমন মাসকট দেখা যায়নি।
সর্বপ্রথম খেলোয়াড়দের সাথে মাঠে এভাবে মাস্কট প্রবেশ করে ১৯৯৯ সালের এফএ কাপের ফাইনালে, এটাই ছিল প্রথমবারের মত মাস্কটসহ খেলোয়াড়দের প্রবেশ। তখন থেকেই শুরু হয়। এমনকি একজন করে মাস্কট তখনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও নিউক্যাসেলের প্রত্যেকটা টিমের সাথে মাঠে যেত। এর পরের বছরে অর্থাৎ ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপেও প্রথম প্রতিটি খেলোয়াড়ের সাথেই মাস্কট মাঠে প্রবেশ করে।
মূলত, ১৯৯৯ সালে থেকে এই মাস্কটের নিয়ম শুরু হলেও, যখন ইউনিসেফ ২০০১ সালে প্রথম “শিশুর জন্য হ্যাঁ বলুন” নামের একটি কর্মসূচি শুরু করে তখন থেকেই ফিফাও এই প্রচারণায় ইউনিসেফের সাথে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে এর পরের বছর দুই হাজার সালে অনুষ্ঠিত কোরিয়া বনাম জাপান বিশ্বকাপে এই নিয়ম প্রবর্তন করা হয়। এরপর থেকেই ফুটবলের সংঘটন ফিফা তাদের এই সিদ্ধান্ত বজায় রাখে। যে কারণে আমরা আজকের ম্যাচগুলোতে এই মাস্কট বা প্লেয়ার ইস্কটদের দেখতে পাই।
ইউনিসেফের এই কাজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একটিই। আর সেটা হল, বিশ্বব্যাপী সকল শিশুদের জীবনব্যবস্থাকে আরও বেশি সংরক্ষিত ও উন্নত করা। আর ফিফা এই কাজে ইউনিসেফকে সাথে নিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে শিশুদের জন্য ফুটবল ব্যতিক্রম কিছু করছে। আজকের যে শিশু সে হয়তো আগামীদিনের মেসি কিংবা রোলান্ডো হয়ে উঠতে পারে। এই অনুপ্রেরনায় শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়াই ফিফার মুল উদ্দেশ্যে।
ফিফা ২০০১ সালে এই নিয়ম পুরোপুরিভাবে জারি করলেও তার আসল কাজ দেখা যায় ২০০২ সালে। কারণ, এই সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ছিল নতুন চমক। ২০০২ এর বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রতিটি ম্যাচেই খেলোয়াড়দের সাথে ইউনিসেফ এর দেয়া ’শিশুদেরকে হ্যা বলুন’ লগো সম্বলিত টি-শার্ট পরে মাঠে নামে মাস্কটরা।
আর এখন প্রায় সব খেলাতেই এই মাস্কটদের দেখা যায়। এমনকি লীগের প্রত্যেক খেলার শুরুতেও এসব প্লেয়ার ইস্কটদের উপস্থিতি লক্ষ্য করার মত। যেখানে লীগ বা লীগের খেলোয়াড়দের জন্য ফিফার দেয়া এই নিয়ম মানার কোন লিখিত নিয়ম নাই। তবুও ক্লাবের সব খেলাতেই তাদের দেখা যায়।
কিন্তু কেন লীগেও মাস্কট ব্যবহার করা হয়? আসলে ব্যাপারটি কেবল ফিফার নিয়মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই বরং শিশুদের প্রতি যে সবাই সচেতন এবং দ্বায়িত্বশীল সেটাই প্রমাণ করে লীগের খেলাতে। তাছাড়া মাস্কট সারাবিশ্বে এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে, যার কারণ হিসাবে কেবল ফিফা কিংবা ইউনিসেফকেই দায়ী করা হয় না। আরও বিভিন্ন কারণেই এই মাস্কটদের আমরা মাঠে দেখতে পাই। যেকারণ গুলো কেবল লোকমুখেই শোনা যায়, আদৌ সত্য কিনা তা বলা যায় না।
অনেক সময় দেখা যায় উত্তেজিত দর্শকরা খেলার শুরুতেই বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের গায়ে এটা-ওটা ছুড়ে মারে ফলে খেলোয়াড়রা আহত পর্যন্ত হয়। এ কারণে শিশুরা মাস্কট হিসাবে থাকলে দর্শকদের এই আক্রমণ থেকে খেলোয়াড়দের সহজেই বাঁচানো সম্ভব।
কেউ আবার বলেন লীগগুলো তাদের খেলায় ইস্কর্ট ব্যবহার করে বাড়তি রোজগার করে থাকে। কেবলমাত্র বাড়তি আয়ের জন্য তারা মাস্কট ব্যবহার করে থাকে। এই কথা অবিশ্বাস করা যাবে না যে, মাস্কট ব্যবহার করার জন্য যে শিশুদেরকে নেয়া হয় তাদের পরিবার থেকে ক্লাবগুলো সহজেই টাকা নিতে পারে। কিন্তু সবাই এমনটা করে না। এক্ষেত্রে টাকা আয়ের চেয়ে বেশি বিবেচনা করা হয় শিশুদের অধিকার সুরক্ষার কথা। তাদের অধিকারকে হা বলা, খেলায় মনোরম পরিবেশ তৈরি করা, শিশুদের অনুপ্রেরণা দেয়া।
একবার ভেবে দেখুন মাঠে যখন খেলোয়াড়দের হাত ধরে কোমলমতি নিষ্পাপ শিশুরা হেঁটে যায়, তখন কত সুন্দর লাগে এই দৃশ্যটি। সাধারণত খেলোয়াড়রাও তাদের সাথে শিশুদের নিয়ে যেতে পছন্দ করেন। এ-সব শিশুদেরকে সাধারণত কোন স্কুল বা কোন সংগঠন থেকে অথবা কোন স্থানীয় ফুটবল টিম থেকে নেয়া হয়। ভেন্যু নিকটস্থ এলাকা থেকেই নেয়া হয়।
আপনি জেনে অবাক হবে কেবল শিশুরাই মাস্কট হয় তেমনটা না, ২০১৫ সালের মা দিবসে ডাচ ক্লাব অ্যজাক্স অ্যামস্টারডামের খেলোয়াড়রা মায়ের হাত ধরে মাঠে নামে। অন্যদিকে সাও পাওলো দলের খেলোয়াড়েরা একই বছরেই কুকুর নিয়ে মাঠে নামে।কেবলমাত্র কুকুরদের জন্য সচেতনতা বাড়াতেই তারা এই কাজ করে। আবার ২০১৬ সালে আরকেসি ওয়ালবিজেক নামের ডাচ ক্লাব ভ্যালেন্টাইন দিবস উপলক্ষে মাস্কট হিসাবে মডেলদের হাত ধরে মাঠে নামে।
ফিফা এই রকম বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করে থাকে, যা অন্যান্য সংগঠনের জন্য অবশ্যই শিক্ষণীয়। প্রতিবারের মত এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপেও আমরা শিশুদের হাত ধরে খেলোয়াড়দের মাঠে নামতে দেখেছি। কেবল ফুটবল খেলাতেই নয় ফিফা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক খেলাতেই মাস্কটদের দেখা যায়। অলিম্পিক থেকে শুরু করে ক্রিকেট, হ্যান্ডবল, হকিতেও এই নিয়ম দেখা যায়।
Leave a Reply