স্ট্রোক সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখা স্ট্রোককে প্রতিহত করার প্রাথমিক ধাপ।
হঠাৎ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর, আপনি জানেন, অবস্থা কত দ্রুত বদলে যায়! চারপাশটা কত কঠিন হয়ে ওঠে!
স্বজনরা সীমাহীন উৎকন্ঠায় অপেক্ষা করতে থাকে ডাক্তারের কাছ থেকে ভেতরের খবর পাওয়ার জন্যে। জরুরী বিভাগের ডাক্তাররাও ব্যস্ত হয়ে ওঠে আপনার কী হয়েছে তা জানার জন্যে।
লক্ষণ যদি হয় স্ট্রোক, তবে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। সেই সাথে শুরু হয়ে যায় বাবা-মা, ভাই-বোনদের অস্বাভাবিক হার্ট বিট।
সুতরাং, প্রতিটি স্বাস্থ্য সচেতন মানুষেরই স্ট্রোক সম্পর্কে স্ট্রং নলেজ রাখা উচিৎ। এতে সে যেমন নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, তেমনই পরিবারের সদস্য ও সকল বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনকে সচেতন করতে পারবে।
সুতরাং, চলুন স্ট্রোক সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আসা যাক।
স্ট্রোক কি?
স্ট্রোক একটি মেডিকেল ইমার্জেন্সি, যা ঠিক তখনই ঘটে যখন ব্রেনের ভেতর রক্তপ্রবাহ (Blood Flow) বাধাগ্রস্থ হয়। রক্ত ব্যতীত ব্রেনসেল বাঁচে না, ধীরে ধীরে মরে যেতে শুরু করে। আর দেখা দেয় নানা রকম সংকট, শারীরিক অক্ষমতা, এমনকি মৃত্যু।
স্ট্রোককে অধিকাংশ সময় ব্রেন স্ট্রোক কিংবা ব্রেন অ্যাটাকও বলা হয়ে থাকে।
আমাদের ব্রেনে যে Blood Vessel বা রক্তনালী রয়েছে, তাতে যদি কোনও কিছু দ্বারা ব্লক তৈরি হয়, তখন ব্রেনের কিছু অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আর এতেই দেখা দেয় ব্রেন স্ট্রোক।
মেডিকেল সায়েন্সে স্ট্রোক ক্ষণস্থায়ী ইস্কেমিক আক্রমণ (Transient Ischemic Attack) বা সেরিব্রোভাসকুলার অ্যাক্সিডেন্ট (Cerebrovascular Accident) নামেও পরিচিত।
ব্রেনের মাঝে এমন অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে গেল ব্রেনের কোন কোনও অংশ রক্ত থেকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও পুষ্টি সংগ্রহ করতে পারে না। আর অক্সিজেন ছাড়া ব্রেন সেল বেশি দিন বাঁচে না।
স্ট্রোক কেন হয়?
স্ট্রোকের কারণ অনেক। নানা কারণেই একজন মানুষ স্ট্রোকের শিকার হতে পারেন। তবে, তার মাঝে প্রধান ১০টি কারণ উল্লেখ করা হলো-
উচ্চ রক্তচাপ (High Blood Pressure)
এটাকেই স্ট্রোকের প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়। ডাক্তাররা সাধারণত এটাকে হাইপার টেনশন বলে থাকেন। আপনার ব্লাড প্রেশার যদি সাধারণত ১৩০/৮০ কিংবা তার চেয়ে বেশি হয়, তবে অবশ্যই আপনি স্ট্রোকের ঝুঁকিতে রয়েছেন। সুতরাং, ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং ব্লাড প্রেশার কন্ট্রোলের চেষ্টা করুন।
তামাক গ্রহণ – Smoking & Others
ধূমপান করা বা তামাক চিবানো স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়ায়। সিগারেটে ও তামাকে থাকা নিকোটিন রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। এমনকি, সিগারেটের ধোঁয়া ঘাড়ের প্রধান ধমনীতে চর্বি তৈরি করে। আর এটি ধূমপায়ীর রক্তকে ঘন করে এবং রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা তৈরি করে যা থেকে স্ট্রোক হয়। সুতরাং, স্ট্রোক থেকে বাঁচতে ধূমপান ত্যাগ করার তেরো উপায় জেনে নিন এবং আজই ধূমপান ছেড়ে দিন।
হৃদরোগ – Heart Diseases
বিভিন্ন ধরণের হৃদরোগ, বিশেষত defective heart valve স্ট্রোকের ঝুঁকি তৈরি করে। এমনকি, atrial fibrillation এবং অনিয়মিত হার্ট বিটও স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার কারণ। বিশেষত, বয়স্ক লোকদের ক্ষেত্রে irregular heartbeat প্রায় ২৫% স্ট্রোক সৃষ্টি করে।
ডায়াবেটিস – Diabetes
যাদের প্রায়ই উচ্চ রক্তচাপ থাকে এবং ওজন বেশি হওয়ায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাদের অধিকাংশই স্ট্রোকের ঝুঁকিতে থাকেন। কারণ, উভয়ই স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়ায়। ডায়াবেটিস আপনার রক্তনালীর ক্ষতি করে, যা স্ট্রোকের সম্ভাবনা অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয়। কারো রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি হলে সে যখন স্ট্রোক করে, তখন মস্তিষ্কে আঘাত বেশি হয়।
ওজন এবং ব্যায়াম – Weight & Exercise
কারো ওজন বেশি হলে স্ট্রোকের সম্ভাবনাও বেশি হয়। তাই, স্ট্রোক থেকে বাঁচতে ওজন কমান। ডায়েট কন্ট্রোল ছাড়াই ওজন কমানোর নানা উপায় রয়েছে। আপনি প্রতিদিন কিছু পরিশ্রমী কাজ করে আপনার ওজন কমাতে পারেন। প্রতিদিন দ্রুতবেগে ৩০ মিনিট হাঁটাহাঁটি করতে পারেন। পুশআপ দিতে পারেন।
ওষুধ – Medication
কিছু ওষুধ আপনার স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, রক্ত পাতলা করার ওষুধ, যা ডাক্তাররা হার্টের রোগীদের রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করার জন্যে প্রেসক্রাইব করে থাকেন। কখনও কখনও রক্তপাতের মাধ্যমে স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। এছাড়াও, জন্মনিয়ন্ত্রণ করার ঔষধগুলোতে low-dose estrogen থাকায়, সেগুলোও স্ট্রোককে উসকে দেয়।
বয়স – Age
যে কেউ স্ট্রোক করতে পারে, এমনকি গর্ভের বাচ্চারাও। সাধারণত, বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আর ৫৫ বছর বয়সের পরে সম্ভাবণা দ্বিগুণ হয়।
পরিবার – Family History
স্ট্রোক পারিবারিকভাবেও প্রবাহিত হতে পারে। অর্থাৎ, জেনেটিকভাবে কারো মাঝে স্ট্রোক আসতে পারে। পরিবারের কোন সদস্য, বিশেষত বাবা-মা কিংবা দাদা-দাদীর উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের হিস্ট্রি থাকলে, আপনারও সেসব দেখা দিতে পারে। আর এগুলো থেকে স্ট্রোক হতে পারে।
লিঙ্গ – Gender
পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা কম থাকে, বিশেষত একই বয়সের ক্ষেত্রে। তবে, বয়স্ক মহিলাদের বেলায় স্ট্রোক বেশি হয়ে থাকে এবং তাদের ক্ষেত্রে রিকোভার হওয়ার সম্ভাবণাও কম থাকে।
স্ট্রোকের সময় মস্তিষ্কে কী ঘটে?
মস্তিষ্ক আমাদের চিন্তা, আবেগ এবং ভাষার উৎস। মস্তিষ্ক আমাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে, মস্তিষ্ক আমাদের স্মৃতি সঞ্চয় করে। এমনকি, মস্তিষ্ক আমাদের নি:শ্বাস নেয়া, খাবার হজম করাসহ শরীরের আরো অনেক ফাংশন নিয়ন্ত্রণ করে।
সুতরাং, সঠিকভাবে শরীরের এ সমস্ত কাজ করার জন্য মস্তিষ্কের অক্সিজেন প্রয়োজন। আর স্ট্রোকের সময় মস্তিস্কে মূলত এই অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে, স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে ব্রেনের বিশেষ কিছু সেল ড্যামেজ হয়ে যায়। আর স্ট্রোকের রোগী স্মৃতি হারিয়ে ফেলে কিংবা শরীরের কোন অঙ্গ অকেজো বা অবশ হয়ে যায়, কিংবা কথা বন্ধ হয়ে যায়।
স্ট্র্রোকের কারণে যেসব জটিলতা তৈরি হয়
স্ট্রোক একটি মেডিকেল ইমার্জেন্সী, যা অনেক সময়ই জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। মানব মস্তিস্ক যেসব ফাংশন কন্ট্রোল করে, স্ট্রোক সেগুলোতে বাধার সৃষ্টি করে। ফলে, শরীরে নানা রকম জটিলতা তৈরি হয়। যেমন-
আচার-আচরণে পরিবর্তণ
স্ট্র্রোকের কারণে অনেক রোগীর মাঝে বিষন্নতা দেখা দেয়, উদ্বিগ্নতা তৈরি হয়। ফলে, কারো কারো আচার-আচরণে কিছু পরিবর্তণ দেখা দেয়। যেমন, পরিবার ও সমাজের সাথে অতি কথন কিংবা একেবারেই কথা না বলা। কিংবা, অদ্ভূত টাইপের কথা বলা, এমনকি অস্বাভাবিক আচরণ করা।
বাক-প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি
স্ট্রোক সচরাচর আমাদের ব্রেনে আঘাত করে থাকে। যার ফলে, অনেকের মাঝেই কথা বলায় সমস্যা দেখা দেয়। হয় কথা বন্ধ হয়ে যায়, অথবা তোতলামো তৈরি হয়। এমনকি, কোন কিছু পড়া, লেখা কিংবা বোঝার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।
অঙ্গহানি বা অসাড়তা ও ব্যাথা
স্ট্রোক অনেক সময়ই অসাড়তা সৃষ্টি করে, শরীরের কোনও অঙ্গ নিস্তেজ হয়ে যাওয়া, স্বাভাবিক স্বভাব হারিয়ে ফেলা, ইত্যাদি নানা ধরণের সমস্যা তৈরি করে। এমনকি, কারো কারো ক্ষেত্রে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। অনেক সময় স্ট্রোকের কারণে ব্রেন অ্যাফেক্ট হওয়ায় রোগী টেম্পারেচার সেন্স হারিয়ে ফেলে। ফলে, গরম কিংবা ঠান্ডা কোনও অনুভূতিই হয় না। এই অবস্থাকে মেডিকেলের ভাষায় সেন্ট্রাল স্ট্রোক পেইন বলে।
প্যারালাইসিস
সাধারণত যেসব স্ট্রোক ব্রেনের ডান পাশে আঘাত করে থাকে, সেসব স্ট্রোকের রোগীদের অধিকাংশই প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে থাকে। কেননা, মানব মস্তিস্কের ডান পাশ মূলত ডিরেক্ট মুভমেন্টের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
স্ট্রোক কত প্রকার ও কি কি?
মেডিকেল সায়েন্সের তথ্য মতে, মানুষের ৫ ধরণের স্ট্রোক হয়ে থাকে। প্রতিটি স্ট্রোকের ক্ষেত্রেই ব্রেনে ব্লাড ফ্লো বাধাগ্রস্ত হয় এবং মেডিকেল ইমার্জেন্সির প্রয়োজন হয়। এই ৫ ধরনের স্ট্রোক হলো-
- ইসকেমিক স্ট্রোক – Ischemic Stroke
- ক্ষণস্থায়ী ইস্কেমিক আক্রমণ (মিনি-স্ট্রোক) – Transient Ischemic Attack
- হেমোরেজিক স্ট্রোক – Hemorrhagic Stroke
- ব্রেন স্টেম স্ট্রোক – Brain Stem Stroke
- ক্রিপ্টোজেনিক স্ট্রোক (অজানা কারণে স্ট্রোক) – Cryptogenic Stroke (stroke of unknown cause)
ইসকেমিক স্ট্রোক – Ischemic Stroke
ব্লাড ক্লোট দ্বারা ব্রেনের ব্লাড ভেসেল বা রক্তনালীতে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে ইসকেমিক স্ট্রোক হয়। বেশিরভাগ স্ট্রোকই হচ্ছে এই প্রকারের, অর্থাৎ ইসকেমিক।
ইসকেমিক স্ট্রোকের লক্ষণ
এটা নির্ভর করছে ব্রেনের কোন অংশে স্ট্রোক এফেক্ট করেছে। ইসকেমিক স্ট্রোকের কমোন কয়েকটি লক্ষণ হচ্ছে-
- মুখ, বাহু বা পায়ে হঠাৎ অসাড়তা বা দুর্বলতা অনুভব হওয়া। প্রায়শই শরীরের একপাশে এমন অসাড়তা দেখা দিয়ে থাকে।
- কনফিউশন। কাউকে চিনতে না পারা কিংবা কারো কথা বুঝতে না পারা।
- কথা বলতে সমস্যা।
- মাথা ঘোরা, ভারসাম্য বা সমন্বয় হারানো বা হাঁটতে সমস্যা।
- দৃষ্টিশক্তি হ্রাস বা ডবল দৃষ্টি।
ইসকেমিক স্ট্রোকের কারণ
প্লাক (plaque) নামক একটি চর্বিযুক্ত পদার্থ (A fatty substance) ধমনীতে জমা হয় এবং ধমনীকে সংকুচিত করে। এই প্রক্রিয়াটিকে এথেরোস্ক্লেরোসিস (atherosclerosis) বলা হয় এবং এটি রক্তের প্রবাহকে ধীর করে দেয়। এতে ধীরে ধীরে রক্ত জমাট বাঁধতে থাকে আর এক সময় স্ট্রোক হয়।
এথেরোস্ক্লেরোসিস ছাড়াও আরো যেসব কারণে ইস্কেমিক স্ট্রোক হতে পারে-
- হার্ট অ্যাটাক।
- অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন।
- হার্টের ভালভের সমস্যা।
- ঘাড়ের রক্তনালীতে ইনজুরিই
- রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা
ইসকেমিক স্ট্রোকের প্রকারভেদ
সাধারণত দুই ধরণের ইসকেমিক স্ট্রোক দেখা যায় আর সেগুলো হলো-
- থ্রম্বোটিক স্ট্রোক (Thrombotic strokes)
- এম্বোলিক স্ট্রোক (Embolic strokes)
ইসকেমিক স্ট্রোকের রিস্ক ফ্যাক্টর
আপনার ইস্কেমিক স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি-
- যদি আপনার বয়স ৬০ বছরের বেশি হয়।
- আপনার যদি উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, উচ্চ কোলেস্টেরল বা ডায়াবেটিস থাকে।
- যদি আপনার হার্টবিট অনিয়মিত হয়।
- আপনি যদি ধূমপান করেন।
- আপনার পরিবারের মধ্যে স্ট্রোকের ইতিহাস থাকে।
মিনি স্ট্রোক – Transient Ischemic Attack
ইস্কেমিক স্ট্রোককে অনেক সময় মিনি স্ট্রোক (mini-stroke) বলা হয়ে থাকে। কারণ, এটি ক্ষণস্থায়ী। তাই, এর আরেক নাম Transient Ischemic Attack যাকে সংক্ষেপে TIA নামে ডাকা হয়।
এই ধরণের স্ট্রোক ব্রেনের ব্লাড ফ্লোতে ক্ষণস্থায়ী ব্লক (temporary blockage) তৈরি করে থাকে। আর এর স্থায়িত্বকাল সাধারণত কয়েক মিনিট কিংবা বড় জোর ২৪ ঘন্টা হয়ে থাকে।
Transient Ischemic Attack এর লক্ষণসমূহ
- শারীরিক অসাড়তা।
- শরীরের যে কোনও এক পাশের দূর্বলতা।
- কনফিউশন।
- মাথা ঘোরা কিংবা ব্যালেন্স হারানো।
- কথা বলা কিংবা কথা বোঝায় সমস্যা।
- দৃষ্টিশক্তির সমস্যা।
- প্রচন্ড মাথা ব্যথা।
Transient Ischemic Attack এর কারণ ও রিস্ক ফ্যাক্টর
Transient Ischemic Attack বা মিনি স্ট্রোকের কারণ ও রিস্ক ফ্যাক্টর ইসকেমিক স্ট্রোকের মতো একই রকম। তবে, মিনি স্ট্রোক অধিকাংশ সময়ই ইসকেমিক স্ট্রোকের ওয়ার্নিং। অর্থাৎ, Transient Ischemic Attack হলে ধরে নিতে পারেন যে শীঘ্রই আপনি ইসকেমিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারেন।
হেমোরেজিক স্ট্রোক – Hemorrhagic Stroke
হেমোরেজিক স্ট্রোক ঠিক তখনই হয় যখন মস্তিস্কের ভেতর ব্লিডিং হয় আর সেটা কাছাকাছি সেলগুলোকে ড্যামেজ করে ফেলে।
হেমোরেজিক স্ট্রোকের প্রকারভেদ
হেমোরেজিক স্ট্রোক দুই প্রকারের। কোন প্রকারের স্ট্রোকে আপনি আক্রান্ত হয়েছেন তা নির্ভর করছে কোথায় রক্তপাত হচ্ছে তার উপর।
- Subarachnoid হেমোরেজ
- Intracerebral হেমোরেজ
Subarachnoid হেমোরেজ: মস্তিষ্ক এবং মাথার খুলির মধ্যবর্তী স্থানে রক্তক্ষরণ হলে তাকে Subarachnoid হেমোরেজ বলে।
Intracerebral হেমোরেজ: মস্তিষ্কের ভিতরে রক্তক্ষরণ হলে তাকে ইন্ট্রাসেরিব্রাল হেমোরেজ বলে।
হেমোরেজিক স্ট্রোকের লক্ষণ
সাধারণত হেমোরেজিক স্ট্রোকের লক্ষণ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। সেটা কয়েক মিনিট কিংবা কয়েক ঘন্টা হতে পারে। হেমোরেজিক স্ট্রোক হলে লক্ষণ হিসেবে আপনি যা পাবেন-
- ভয়াবহ রকমের মাথাব্যথা।
- প্রায় সকল বিষয় নিয়েই কনফিউশন।
- বমি বমি ভাব হওয়া বা বমি করে ফেলা।
- আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা।
- দৃষ্টিশক্তির সমস্যা।
হেমোরেজিক স্ট্রোকের কারণ
- হাই কোলেস্টেরল
- ডায়াবেটিস
- হাই ব্লাড প্রেশার
- ধূমপান
- অতিরিক্ত মদপান
- অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ
- ব্লিডিং ডিজঅর্ডার
- কোকেন গ্রহণ
হেমোরেজিক স্ট্রোকের রিস্ক ফ্যাক্টর
- বয়স যখন ৬৫ কিংবা তার চেয়ে বেশি।
- ডায়াবেটিস যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
- অতীতে যদি কোনও স্ট্রোক হয়ে থাকে।
- পরিবারে যদি স্ট্রোকের ইতিহাস থাকে।
- ব্যায়াম না করা।
- শরীরে অস্বাভাবিক রক্তনালী থাকা।
হেমোরেজিক স্ট্রোকের জটিলতা
কারো হেমোরেজিক স্ট্রোক হলে নিম্নোক্ত জটিলতা দেখা দিতে পারে-
- স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া।
- চিন্তা-ভাবনা জণিত সমস্যা।
- খিঁচুনি উঠা।
- হৃদপিণ্ডজনিত সমস্যা।
- খাবার গিলতে সমস্যা।
- পানি পানে সমস্যা।
- স্থায়ী স্নায়বিক অক্ষমতা।
ব্রেন স্টেম স্ট্রোক – Brain Stem Stroke
এই স্ট্রোক ব্রেনের স্টেমে ঘটে বলে একে ব্রেন স্টেম স্ট্রোক বলে। অন্যান্য স্ট্রোক শরীরের একপাশ এফেক্ট করলেও এই স্ট্রোক শরীরের উভয় পাশই এফেক্ট করে।
ব্রেন স্টেম স্ট্রোকের লক্ষণ
এটা বোঝা খুবই কঠিন যে কেউ ব্রেন স্টেম স্ট্রোক করেছে। তারপরও কিছু সাধারণ লক্ষণ দেখে অনুমান করা যায় আর সেগুলো হলো-
- ভার্টিগো বা মনের বিশৃংখল অবস্থা।
- মাথা ঘোরা এবং ভারসাম্য হারানো।
- কিছু কিছু জিনিস বা সবকিছুকে ডবল দেখা।
- বমি বমি ভাব অথবা বমি করা।
- পাসিং আউট
- রক্তচাপ এবং শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা
- লকড ইন সিন্ড্রোম, শুধুমাত্র চোখ নাড়ানো।
ব্রেন স্টেম স্ট্রোকের কারণ
- হেমোরেজ
- ব্লাড ক্লোট
- হঠাৎ মাথা বা ঘাড় নড়াচড়ার কারণে ধমনীতে ইনজুরি।
ব্রেন স্টেম স্ট্রোকের রিস্ক ফ্যাক্টর
- ডায়াবেটিস
- ধূমপান
- হাই ব্লাড প্রেশার
- হৃৎরোগ
স্ট্রোকের লক্ষণ
স্ট্রোক বিভিন্ন ধরণের হলেও সেগুলোর লক্ষণ প্রায় একই ধরণের। কারণ, প্রতিটি স্ট্রোকই ব্রেনের ব্লাড ফ্লোতে এফেক্ট করে থাকে। তবে, ঠিক কী ধরণের স্ট্রোক হয়েছে তা জানার মূল মাধ্যম হচ্ছে মেডিকেল অ্যাটেনশন। ডাক্তাররা বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে ডিটেক্ট করে বলতে পারেন স্ট্রোকের ধরণ এবং সেই অনুযায়ী দিতে পারেন চিকিৎসা।
তবে, স্ট্রোকের কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে আর সেগুলো জানার একটা সাধারণ উপায় হচ্ছে FAST মেথড। এই মেথড মূলত স্ট্রোকের ওয়ার্নিং সাইন (Warning Sign) । যাইহোক, FAST মেথড দ্বারা জেনে নিতে পারেন স্ট্রোকের লক্ষণগুলো। FAST এর প্রতিটি অক্ষর দিয়ে নিজেকে নিচের প্রশ্নগুলো করুন।
Face: আপনি যখন হাসেন, তখন কি আপনার Face এর কোনও এক পাশ ঝুলে পড়ে?
Arm: আপনি যখন উভয় বাহু উপরে তোলেন, তখন কি একটি বাহু নিচের দিকে চলে যায়?
Speech: আপনার কথা-বার্তা কি অষ্পষ্ট? কথা বলতে সমস্যা হচ্ছে?
Time: যদি উপরের ৩টি বা কোনও একটিও লক্ষণ দেখা যায়, তবে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন, কেননা লক্ষণ বলছে আপনি স্ট্রোক করেছেন।
FAST মেথড এর বাইরে আরো যেসব লক্ষণ আছে-
- হঠাৎ বিভ্রান্তি (sudden confusion) দেখা দেয়া। যেমন অন্যরা কী বলছে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়া। কনফিউশন তৈরি হওয়া।
- স্বাভাবিক চলা-ফেরায় সমস্যা দেখা দেয়া। বিশেষত, হাঁটতে অসুবিধা হওয়া।
- হঠাৎ মাথা ঘোরা, কিংবা আকস্মিক তীব্র মাথা ব্যথা দেখা দেয়া।
- চিন্তার ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলা।
- সাধারণ কাজে সমন্বয় করতে না পারা।
- এক চোখ কিংবা উভয় চোখে ঝাপসা দেখা।
স্ট্রোকের চিকিৎসা
স্ট্রোক হলে চিকিৎসা করা অত্যন্ত জরুরী। কেননা, কার্যকরী চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী অক্ষমতা প্রতিরোধ করতে পারে এবং জীবন বাঁচাতে পারে।
তবে, কী ধরণের চিকিৎসা অধিক কার্যকর তা নির্ভর করে কী ধরণের স্ট্রোক হয়েছে তার উপর।
সাধারণত কিছু ঔষধের মাধ্যমেই স্ট্রোকের চিকিৎসা করা হয়ে থাকে, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সার্জারীর প্রয়োজন দেখা দিতে পারে।
থ্রম্বোলাইসিস (Thrombolysis) – “ক্লট বাস্টার” মেডিসিন
যদি ইস্কেমিক স্ট্রোক হয়, তবে অ্যালটেপ্লেস (alteplase) নামক ইনজেকশন দিয়ে খুব সহজেই চিকিৎসা করা যায়। এই ইনজেকশন জমাট বাঁধা রক্তকে দ্রবীভূত করে এবং মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ পুনরুদ্ধার করে।
ক্লট-বাস্টিং বা অ্যালটেপ্লেস নামক এই ইনজেকশনের ব্যবহার থ্রম্বোলাইসিস নামে পরিচিত।
স্ট্রোক হওয়ার পরে যত দ্রুত Alteplase ইনজেকশন দেয়া যায়, এটি তত দ্রুত কাজ করে। সর্বোচ্চ কার্যকারিতা পাওয়া যায় যদি স্ট্রোক হওয়ার ৪/৫ ঘন্টার মধ্যে দেয়া যায়।
থ্রম্বেক্টমি (Thrombectomy)
থ্রম্বেক্টমি একটা ইমার্জেন্সি চিকিৎসা পদ্ধতি, যা কিছু সংখ্যক গুরুতর ইস্কেমিক স্ট্রোকের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।
থ্রম্বেক্টমি একটা সার্জারি যার মাধ্যমে রক্তনালী থেকে ব্লাড ক্লোট বা ব্লক কেটে বের করে আনা হয় আর এটি রক্ত জমাট বাঁধা দূর করে এবং মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করে।
তবে, মস্তিস্কের বড় ধমনীতে রক্ত জমাট বাঁধার কারণে যে ইস্কেমিক স্ট্রোক হয়, Thrombectomy শুধুমাত্র সেক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে, স্ট্রোকের পরে যত তাড়াতাড়ি থ্রম্বেক্টমি করা যায়, এটি তত তাড়াতাড়ি কাজ করে।
অ্যাসপিরিন এবং অন্যান্য অ্যান্টিপ্লেটলেট (antiplatelets)
বেশিরভাগ লোককে ইস্কেমিক স্ট্রোক হওয়ার পরে চিকিৎসা হিসেবে সরাসরি অ্যাসপিরিন দেওয়া হয়। ব্যথানাশক হওয়ার পাশাপাশি, অ্যাসপিরিন একটি অ্যান্টিপ্লালেটলেট, যা অন্য ক্লোট বা ব্লক তৈরির সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট (Anticoagulant)
অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট একটি কেমিকেল সাবটান্স যা রক্তকে পাতলা করার জন্যে ব্যবহার করা হয়। ভবিষ্যতে নতুন রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করার জন্য কিছু স্ট্রোকের রোগীকে Anticoagulant দেওয়া হয়।
ব্লাড প্রেশার মেডিসিন
স্ট্রোকের রোগীর ব্লাড প্রেশার যদি অনেক বেশি হয়ে থাকে, তবে প্রেশার কমানোর জন্যে বিশেষ কিছু মেডিসিন, ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার, বিটা ব্লকার, আলফা-ব্লকার, ইত্যাদি দেয়া হয়ে থাকে।
স্ট্যাটিনস (Statins)
কিছু স্ট্রোকের রোগীকে স্ট্যাটিনস নামক ঔষধ দেয়া হয়, যা রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয়। কোলেস্টেরলের মাত্রা বিশেষভাবে বেশি না হলেও কোন কোন রোগীকে স্ট্যাটিন দেওয়া হতে পারে। কারণ এটি আপনার কোলেস্টেরলের মাত্রা যাই হোক না কেন স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
এছাড়াও, স্ট্রোকের রোগীর সার্জারিসহ আরো অনেক চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। স্ট্রোকের ধরণ এবং রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে সেসব চিকিৎসা দেয়া হয়।
স্ট্রোক সম্পর্কে কিছু ভুল তথ্য
আমাদের দেশের মানুষের কাছে স্ট্রোক সম্পর্কে নানা রকম ভুল তথ্য এবং ভুল বিশ্বাস রয়েছে। যেমন, অনেকেই মনে করেন যে স্ট্রোক কেবল মাত্র বয়স্কদের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। অথচ, বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা গিয়েছে যে, শতকরা ২৫ ভাগ স্ট্রোকের রোগী তরুণ-তরুণী।
কেউ কেউ মনে করেন, স্ট্রোক হলে অনেক কষ্ট হয়, ব্যথা লাগে; কিন্তু এমন স্ট্রোকের রোগী পাওয়া যায় যারা কোনও ব্যথাই বোধ করেন না। কারো কারো ধারণা স্ট্রোক করলে বোঝার উপায় নেই। এটাও ভুল। কেউ মনে করেন স্ট্রোক জেনেটিকভাবে আসে না। এভাবে স্ট্রোক সম্পর্কে নানা রকম ভুল ধারণা পোষণ করেন অনেকে।
স্ট্রোক প্রতিরোধের উপায়
স্ট্রোক অবশ্যই প্রতিরোধযোগ্য। আপনি চাইলে আজ থেকেই স্ট্রোক প্রতিরোধের প্রচেষ্টা শুরু করতে পারেন। জেনে নিন কিভাবে স্ট্রোক থেকে রক্ষা পাবেন-
- সু্ন্দর ও সুশৃংখল জীবন-যাপন করুন।
- স্বাস্থ্যকর খাবার খান।
- ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
- ওজন বাড়তে দেবেন না।
- নিয়মিত কিছু না কিছু ব্যায়াম করুন।
- অ্যালকোহল গ্রহণ বন্ধ করুন।
- ডায়াবেটিস থাকলে প্রপার চিকিৎসা নিন।
- ধূমপানের অভ্যাশ থাকলে ত্যাগ করুন।
উপসংহার
স্ট্রোক সম্পর্কে স্ট্রং কিছু পয়েন্ট জেনেছেন। আশা করি, এ ব্যাপারে আপনার চেয়ে বেশি জানা লোকের সংখ্যা খুবই কম। নিজে সচেতন হোন, স্ট্রোক সম্পর্কে পরিবারের সদস্যসহ অন্যান্যদের সচেতন করুন।
Leave a Reply