আপনি নিশ্চয়ই সিটি স্ক্যান শব্দটির সাথে পরিচিত। এমনকি এমনও হতে পারে যে জীবনে একবার না একবার আপনার সিটি স্ক্যান করা হয়েছে। অথবা, আপনি নিজে আপনার পরিবারের কোনও সদস্য কিংবা পরিচিত কাউকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছেন আর ডাক্তার তার সিটি করিয়েছে। কিন্তু সিটি স্ক্যান আসলে কি ও কেন করা হয়, তা আপনি বিস্তারিতভাবে জানেন না, যেমন আমরা অনেকেই জানি না।
এটি জানার জন্যে ডাক্তার, নার্স কিংবা মেডিকেল প্রপেশনাল হতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। মানুষ হিসেবে যেহেতু আমাদেরকে প্রায়ই অসুস্থায় পড়তেই হয় এবং কখনো না কখনো সিটি স্ক্যান করতে হয়, তাই এটি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে রাখা জরুরী।
সিটি স্ক্যান কি?
এম.আর.আই (MRI) সম্পর্কে বিস্তারিত যারা জেনেছেন, তাদের এবং অন্যান্যদের জন্যে আজ সিটি স্ক্যান সম্পর্কে বিস্তারিত নিয়ে হাজির হলাম। প্রথমেই জানা যাক সিটি স্ক্যান আসলে কি।
কম্পিউটারাইজড্ (Computerized) শব্দটি থেকে C আর টমোগ্রাফি (Tomography) শব্দ থেকে T নিয়ে CT আর তার সাথে scan মিলে সিটি স্ক্যান। অর্থাৎ, কম্পিউটাইরাইজড্ টমোগ্রাফি স্ক্যান এর সংক্ষিপ্ত রূপ সিটি স্ক্যান।
সিটি স্ক্যান এর আরেক নাম CAT স্ক্যান।
এটি দিয়ে ডাক্তার হিসেবে আমরা মূলত আপনার শরীরের ভেতরে (Inside your body) তাকিয়ে দেখি। অর্থাৎ, আপনার শরীরের ভেতরে তৈরি হওয়া সমস্যাটাকে বের করে এনে দেখি। এই বের করার কাজটি যিনি করেন, অর্থাৎ আপনার সিটি স্ক্যান করার জন্যে যে ব্যক্তিটি মেডিকেল প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেন, তাকে রেডিওলোজিস্ট বলা হয়। কিংবা রেডিওলোজি টেকনোলোজিস্ট বলা হয়ে থাকে। একজন রেডিওলোজিস্ট সাধারণত শরীরের যে-সব অর্গানের সিটি স্ক্যান করে থাকেন, সেগুলো হলো-
- মাথা
- মেরুদন্ড
- কাঁধ
- বুক
- পেট
- হার্ট
- হাঁটু, ইত্যাদি।
সংজ্ঞা দিতে হলে বলতে হয়, সিটি স্ক্যান একটি মেডিকেল ইমেজিং টেকনিক যা দিয়ে রোগীর শরীরের ভেতরগত অবস্থার স্ক্যান করা হয়। ইমেজ বা ছবি তোলা হয়, যে ছবি দেখে ডাক্তার হিসেবে আমরা বুঝতে পারে আপনার শরীরের ভেতর কী হয়েছে। যেমন, বুক ব্যথার ট্রিটমেন্ট ও মেডিসিন ঠিক করার আগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে ছবি তুলে দেখে নেয়া হয় কি কারণে ব্যথা হচ্ছে।
তবে, এই ছবি কোনও সাধারণ ছবি নয়। এটি রেডিওলোজির মাধ্যমে তোলা নন-ইনভেনসিভ ছবি।
তবে, এই ছবি কোনও সাধারণ ছবি নয়। এমনকি এক্স-রে এর মাধ্যমে যে ছবি তোলা হয় তার সাথে অনেক মিল থাকলেও এটি কিন্তু এক্স-রে নয়।
এক্স-রে ও সিটি স্ক্যান এর মধ্যে পার্থক্য
- সিটি স্ক্যান অনেকগুলো এক্স-রে এর কম্বিনেশন। রোগীর শরীরের বোন টিস্যু এবং অন্যান্য অর্গানের একাধিক ছবি তুলে সেটাকে কম্বাইনড্ করে ফিল্মের মাধ্যমে উপস্থান করে সিটি স্ক্যান। অন্যদিকে, এক্স-রে শুধুমাত্র সিঙ্গেল স্ক্যান করে বিশেষ কোনও অর্গানের অবস্থা ভিউ করে।
- সিটি স্ক্যান একজন রোগীর নানা রকম অর্গানের থ্রিডি ইমেজ ভিউ করে। অন্যদিকে এক্স-রে কেবল মাত্র টু-ডি ভিউ শো করে।
- এক্স-রে শরীরের অর্গানে অংকুরিত হওয়া কোনও অস্বাভাবিকতা ছবির মাধ্যমে তুলে আনে। অন্যদিকে, সিটি স্ক্যান সেটার ডিটেইলস্ ভিউ উপস্থাপন করতে পারে। যেমন, যদি বুকের এক্স-রে করা হয়, তবে সিটি স্ক্যান সেখানে খুঁজে পাওয়া সমস্যাটিরস ক্লোজ লোকেশন ভিউ করে এবং সেটা কিভাবে ফরমেশন হচ্ছে তাও এক্সামাইন করে দেখায়।
- এক্স-রে শুধু মাত্র দেহের টিস্যুগুলির ডেনসিটি এক্সামাইন করতে পারে। অপরদিকে, সিটি স্ক্যান ডেন্স টিস্যু, সফট্ টিস্যু, রক্তনালি এবং হাঁড়সহ আরো অন্যান্য অনেক কিছুই এক্সামাইন ও ভিউ করে থাকে।
- এক্স-রে সাধারণত বুক বা পিঠে করা হয়। কিন্তু, সিটি স্ক্যান শরীরের যে কোনও অংশ স্ক্যান করতে পারে।
সিটি স্ক্যান ও এমআরআই এর মধ্যে পার্থক্য
এমআরআই ও সিটি স্ক্যান এর মধ্যে প্রধান প্রধান পার্থক্য-
- স্ক্যান করার জন্যে সিটি স্ক্যান এক্স-রে ইউজ করে আর এমআরআই ম্যাগনেট ও রেডিও ওয়েব ইউজ করে।
- স্পাইনাল কর্ড এক্সামাইন করার জন্যে সিটি স্ক্যানের পরিবর্তে এমআরআই বেশি উপযুক্ত।
- এমআরআই যেখানে টেনডন্স ও লিগামেন্ট শো করতে পারে, সিটি স্ক্যান সেটা পারে না।
- নিউমোনিয়া কিংবা ক্যান্সার নির্নয় এবং বুক ব্যাথার কারণ জানার জন্যে এমআরআই এর চেয়ে সিটি স্ক্যান বেশি কার্য্যকর।
- ব্রেনে রক্তক্ষরণ, বিশেষ করে ইনজুরির পর যে ব্রেনের ভেতর মাঝে মাঝে যে ইন্টারনাল ব্লিডিং হয় তা সিটি স্ক্যান এমআরআইয়ের চেয়ে বেশি নিখুঁত রেজাল্ট দিতে পারে।
- ব্রেন টিউমার ক্লিয়ারলি বোঝার জন্যে সিটি স্ক্যানের চেয়ে এমআরআই বেশি ইফেকটিভ।
সিটি স্ক্যান কেন করা হয়?
সিটি স্ক্যানের নানা রকম ব্যবহার রয়েছে। তবে, বিশেষভাবে ইনজুরি ইভালুয়েট, হার্ট অ্যাটাক ডিটেকশনসহ বিভিন্ন ডিজিজ ডায়াগনোসিস করার জন্যে সিটি স্ক্যান করা হয়। আরো সহজভাবে বোঝার জন্যে নিচে যে-সব রোগের জন্যে সিটি স্ক্যান করা হয়, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দেয়া হলো।
- শরীরের কোথাও টিউমার, ক্যান্সার ও এ জাতীয় রোগ নির্ণয়ের জন্যে।
- ব্লাড ক্লোট বা ইনফেকশনের সঠিক অবস্থান জানার জন্যে।
- মস্তিস্কে সৃষ্টি হওয়া রক্তক্ষরণ কিংবা অন্যান্য ব্রেন ডিজিজ ফাইন্ড আউট করার জন্যে।
- সার্জারী, রেডিয়েশন থেরাপি এবং বায়োপসির সঠিক গাইড লাইন বা প্রসিডিউর ঠিক করার জন্যে।
- হার্ট অ্যাটাকসহ যাবতীয় হার্টের রোগ নির্ণয়ের জন্যে।
- শরীরে রক্ত চলাচলে বাধা-বিপত্তি বা ব্লকেজ ডায়াগনোসিস করার জন্যে।
- ফুসফুস ও লিভারের রোগ, রোগের ধরণ, ইত্যাদি জানার জন্যে।
- ইনজুরি, ফ্র্যাকচার, হাঁড়ভাঙ্গা বা বোন ডিজঅর্ডার ডায়ানোসিসের জন্যে।
- মূত্রনালিতে পাথর আছে কিনা তা ডিটেক্ট করার জন্যে।
- যে কোনও ধরণের ইন্টারনাল ব্লিডিং বা ইনফেকশন ফাইন্ড আউট করে কার্য্যকরী ব্যবস্থা নেয়ার জন্যে।
এছাড়াও, কিছু মেডিকেল কন্ডিশনের কারণে যাদের এমআরআই করা সম্ভব হয় না, তাদের ক্ষেত্রে সিটি স্ক্যান করতে হয়।
সিটি স্ক্যান এর প্রকারভেদ
- সিটি এনজিওগ্রাফি
- সিটি বোন স্ক্যান
- কার্ডিয়াক সিটি
- সিটি অ্যাবডোমেন
- সিটি স্ক্যান কিডনি
- হেড সিটি
- সিটি স্ক্যান অব দ্যা স্পাইন
- পেলভিক সিটি স্ক্যান
- সিটি নেক
- সিটি চেষ্ট, ইত্যাদি।
সিটি স্ক্যানের পূর্ব প্রস্তুতি
- বিশেষ কিছু রোগ নির্নয়ের ক্ষেত্রে ডাক্তার আপনাকে সিটি স্ক্যানের আগে অন্তত ২ থেকে আড়াই ঘন্টা খালি পেটে থাকার পরামর্শ দিতে পারেন।
- সিটি স্ক্যান শুরুর আগে আপনার শরীরে থাকা যে কোনও ধরণের মেটাল এবং জুয়েলারী প্রোডাক্ট খুলে ফেলতে হবে। যেমন, বেল্ট, আংটি, ঘড়ি, ইত্যাদি।
- বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্রে ক্লিয়ার ভিউ পেতে ডাক্তার আপনাকে ওই অঙ্গের উপর লিকুইড জাতীয় মেডিসিন মেখে নিতে পারেন। কিংবা, মুখেও আপনাকে কোনও ঔষধ খাওয়াতে পারেন।
- যাদের ডায়াবেটিস আছে, যাদের একটি মাত্র কিডনি এবং যাদের বয়স ৭০ এর উর্ধ্বে, তাদের ক্ষেত্রে সিটি স্ক্যানের আগে বিশেষ কিছু টেস্ট করা লাগতে পারে। বিশেষ করে, ব্লাড টেস্ট।
সিটি স্ক্যান কিভাবে করা হয়?
- এক্স-রে, এমআরআই এবং সিটি স্ক্যান করার জন্যে হাসপাতালগুলোতে আলাদা রুম রয়েছে। রোগীকে প্রথমে সে রুমে নিয়ে যাওয়া হয়।
- রুমের ভেতর সিটি স্ক্যানারের সামনে একটি টেবিল থাকে, যেটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লম্বা আকৃতির হয়ে থাকে, রোগীকে সেই টেবিলের উপর শুইয়ে দেয়া হয়।
- শুয়ে থাকা অবস্থায় রোগীকে নড়া-চড়া করতে নিষেধ করা হয়ে থাকে। কেননা, নড়াচড়ার কারণে স্ক্যান করা ছবিগুলো ঝাপসা হয়ে উঠতে পারে।
- স্ক্যানার চালুর আগে, টেকনোলোজিস্ট রোগীকে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে নি:শ্বাস ধরে রাখতে বলে থাকেন।
- সিটি স্ক্যানার যখন চালু করা হয়, তখন এর ভেতরে থাকা সেন্সরটি দ্রুত ঘুরতে শুরু করে আর স্ক্যানার তখন ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলের ছবি নিতে থাকে। একই সাথে, এক্স-রে টিউবও ঘুরে ঘুরে সেই ছবিগুলো প্রিন্ট করতে থাকে, ঠিক যেমন এক্স-রে মেশিন প্রিন্ট করে থাকে।
- স্ক্যান করা শেষ হয়ে গেলে ইমেজগুলো একজন রেডিওলোজিস্টের কাছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যে পাঠানো হয়ে থাকে।
সিটি স্ক্যান এর খরচ কেমন?
সিটি স্ক্যানের ধরণ এবং হাসপাতালের নীতি-নির্ধারণী অনুযায়ী এর ব্যয় বা খরচে কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। তবে, এভারেজ বা সাধারণ খরচগুলো নিচে দেয়া হলো-
- প্লেইন সিটি স্ক্যান ফর ব্রেইন ——————— ৩৫০০ টাকা।
- সিটি ব্রেইন ও অরবিট ——————— ৭০০০ টাকা।
- ব্রেইন কনট্রাস্ট ——————— ৩৫০০ + কনট্রাস্ট কস্ট।
- সিটি ব্রেইন ও পিএনএস ——————— ৭০০০ টাকা।
- টেম্পোরাল বোন (এইচআরসিটি) ——————— ৫৫০০ টাকা।
- ফেসিয়াল বোন ——————— ৫২০০ টাকা।
- সিটি সার্ভিক্যাল স্পাইন ——————— ৬০০০ টাকা।
- সিটি ডর্সাল স্পাইন ——————— ৫৫০০ টাকা।
- সিটি নেক কনট্রাস্ট ——————— ৫২০০ টাকা।
- সিটি হিপেটিক এনজিওগ্রাম ——————— ১২০০০ টাকা।
- সিটি চেষ্ট (প্লেইন, কনট্রাস্ট, এইচআরটিসি) ——————— ৫২০০টাকা।
- অ্যাবডোমেন (আপার ও লোয়ার) ——————— ৫২০০ টাকা।
- অ্যাবডোমেন (পুরোটা) ——————— ৯৫০০ টাকা।
এছাড়াও, সিটি স্ক্যানের আরো অনেক ধরণ রয়েছে এবং সেগুলোর খরচও ভিন্ন ভিন্ন। এখানে আর বেশি উল্লেখ করলাম না। আপনি যে কোনও হাসপাতালে গিয়ে ওদের রেট লিস্ট চাইলে ওরা আশা করি দিয়ে দেবে যেখান থেকে আপনি সব ধরণের সিটি স্ক্যানের দাম জানতে পারবেন।
যাওয়ার আগে ইসিজি কি ও কেন করা হয় এবং ইসিজির খরচ সম্পর্কে লেখা আমার আরেকটি পোস্ট পড়ে নিতে পারেন। এতে মেডিকেল টেস্ট ও ট্রিটমেন্ট সম্পর্কে আপনার জ্ঞানের পরিধি বাড়বে, আশা করি।
Md Tuhin Islam says
ধন্যবাদ স্যার, সিটি স্ক্যান নিয়ে জানার দারুণ ইচ্ছে ছিল, অনেক ভালো লাগলো কাংখিত বিষয়ে লেখা পেয়ে।