মাছ খাওয়ার মানুষ হিসেবে বাঙালীদের বেশ সুনাম রয়েছে যা মাছে-ভাতে বাঙ্গালী প্রবাদটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু, সামুদ্রিক মাছের উপকারিতা এখনো বাঙালীদের বোধগম্য নয়। না, আমি সব বাঙালীর কথা বলছি না। বেশিরভাগ বাঙ্গালী, মানে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই মাছ খাওয়ার ব্যাপারে যতোটা সচেতন, সামুদ্রিক মাছের ক্ষেত্রে তাদের ততোটা উৎসাহ দেখা যায় না। এর একটা বড় কারণ সামুদ্রিক মাছের স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে না জানা।
কারো কারো জানা থাকলেও আমাদের দেশে, বিশেষ করে ঢাকায় সামুদ্রিক মাছের বাজার কোথায়, সে সম্পর্কে সঠিক আইডিয়া না থাকায় খাওয়া হয় না অনেকেরই। তবে, এমন কিছু মানুষ হয়তো আপনার আশে-পাশেই পেয়ে যাবেন, যারা দূর দূরান্ত থেকে কষ্ট করে হলেও উপরোক্ত বাজারগুলোতে গিয়ে সামুদ্রিক মাছ কিনে থাকেন। কারণ, তারা সামুদ্রিক মাছের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে পুরোপুরি জানেন।
আপনার যদি জানা না থাকে, তবে এই লেখাটা পড়ে আজই জেনে যাবেন। আর যদি জানা থাকে, তবে সেটা আরেকটু ঝালাই হয়ে যাবে। সুতরাং, চলুন সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
সামুদ্রিক মাছের উপকারিতা
সামুদ্রিক মাছে প্রচুর পুষ্টি
সামুদ্রিক মাছের সবচেয়ে বড় যে লাভটি নিয়ে খাদ্য বিশারদরা কথা বলেন, সেটি হচ্ছে এর পুষ্টিগুণ। কারণ, সামুদ্রিক মাছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এবং মিনারেল রয়েছে যা আমাদের শরীরে সামগ্রিক পুষ্টির যোগান দেয়। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য-
- ভিটামিন এ
- ভিটামিন বি
- ভিটামিন ডি এবং
- ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড।
ভিটামিন এ কি আর কেন প্রয়োজন, সেটা তো আমরা জানি। এটি আমাদের চোখের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার পাশাপামি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়। আর শরীরে শক্তি উৎপাদন, বিপাক প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা এবং মনোযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভিটামিন বি এর ভূমিকা ভীষণভাবে উল্লেখযোগ্য।
অন্যদিকে, সামুদ্রিক মাছে থাকা ভিটামিন ডি হাঁড়ের স্বাস্থ্য ভাল রাখে, খাদ্য থেকে ক্যালসিয়াম শোষণ করে এবং ইমিউন সিস্টেমকে কার্যকার রাখে। সেই সাথে, শরীরে কোষের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে। আর সামুদ্রিক মাছের সবচেয়ে বড় উপাদান ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের বিকল্প তৈরি করা আমাদের শরীরের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং, এটি পেতে হলে সামুদ্রিক মাছ খেতেই হবে। কারণ, ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড-
- হার্ট ভাল রাখে, হার্টবিট নিয়ন্ত্রণ করে, উচ্চ রক্তচাপ কমায় এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে সাহায্য করে।
- ব্রেনের ফাংশন পরিচালনায় সাহায্য করে, দৃষ্টিশক্তি ও নার্ভের উন্নতি সাধন করে এবং প্রেগন্যান্সির সময় মহিলাদের জন্যে এইড হিসেবে কাজ করে।
- ডিপ্রেশন বা হতাশা, ডিমেনশিয়া বা ভুলোরোগ, এলজাইমার বা হাঁপানী এবং এডিএইচডি বা বাচ্চাদের ব্রেন ডেভেলপমেন্ট সমস্যার ক্ষেত্রে অত্যন্ত উপকারি ভূমিকা পালন করে।
- ডায়াবেটিস ও মেটাবোলিক সিন্ডোমের ঝুঁকি কমায়। গ্লুকোজ এবং ইনসুলিন মেটাবোলিজমের উপর পজিটিভ ইফেক্ট ফেলে।
এছাড়াও সামুদ্রিক মাছ ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসে পরিপূর্ণ। শক্তিশালী হাঁড় তৈরিতে ক্যালসিয়ামের প্রয়োজনীয়তার কথা কে না জানি! আর আমাদের হার্ট, মাংসপেশী ও নার্ভের নানারকম ফাংশনের জন্যেও ক্যালসিয়াম প্রয়োজন। অন্যদিকে, হাঁড়ের পাশাপাশি দাঁতের ফরমেশনের জন্যে ফসফরাস প্রয়োজন। এমনকি, কার্বোহাইড্রেড ও ফ্যাট থেকে প্রোটিন নিয়ে আমাদের শরীরের সেল ও টিস্যুগুলোতে সঠিকভাবে সাপ্লাইয়ের জন্যে ফসফরাসের ভূমিকা অনস্বীকার্য যা আমরা সামুদ্রিক মাছ থেকে পেয়ে থাকি। সামুদ্রিক মাছ থেকে আরো যেসব মিনারেল পাওয়া যায়, সেগুলো হলো-
- আয়রন
- জিংক
- আয়োডিন
- ম্যাগনেসিয়াম
- সেলেনিয়াম, ইত্যাদি।
সামুদ্রিক মাছ ব্রেন পাওয়ার বুস্ট করে
ব্রেন আমাদের হাঁটতে, কথা বলতে, চলাফেরা করতে, দেখতে, গন্ধ নিতে, মনে রাখতে এবং চিন্তা করতে সাহায্য করে। ব্রেনের এই কার্যক্ষমতাকে অ্যাক্টিভ এবং ফাংশনাল রাখার জন্যে, অর্থাৎ ব্রেনের স্বাস্থ্য ভাল রাখার জন্যে যেসব খাবার প্রয়োজন, তার শুরুতেই রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড। আর, এটি সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় সামুদ্রিক মাছে।
প্রাপ্ত বয়স্কদের ব্রেন পাওয়ারকে বুস্ট করতে যেমন ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড প্রয়োজন, তেমনই বাচ্চাদের ব্রেনের সঠিক ডেভেলপমেন্টের জন্যেও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর উভয়ের জন্যেই ডাক্তার এবং খাদ্য বিশারদরা সামুদ্রিক মাছ সাজেষ্ট করে থাকেন। কারণ, সামুদ্রিক মাছে দুই ধরণের ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়।
- EPA – Eicosapentaenoic Acid
- DHA – Docosahexaenoic Acid
এই দুই প্রকারের ফ্যাটি এসিডের কোনটাই আমাদের শরীর ইন্টারনালি উৎপাদন করতে পারে না। কাজেই, খাদ্যের মাধ্যমেই এই দুই ধরণের ফ্যাটি এসিড গ্রহণ করতে হবে। আর আমিষ জাতীয় খাদ্য হিসেবে সামুদ্রিক মাছই শ্রেষ্ঠ যা থেকে ইপিএ এবং ডিএইচএ পাওয়া যায়।
সামুদ্রিক মাছ হার্টের স্বাস্থ্য ভাল রাখে
সামুদ্রিক মাছ হার্টকে সুস্থ্য, সবল ও কার্য্যকর রাখে। সব মানুষের জন্যেই হার্টের সুস্থ্যতা জরুরী, হোক সে নারী কিংবা পূরুষ, শিশু কিংবা বৃদ্ধ। কারণ, হার্টই একটা মানুষকে হাসি মুখে রাখতে পারে। হার্ট কোনভাবে হ্যাম্পার হলেই হাসিমুখ আর থাকে না। তাই, হার্টকে সুস্থ্য রাখতে ওমেগা-৩ প্রয়োজন, আর এর জন্যে দরকার সামুদ্রিক মাছ।
উচ্চ মাত্রার প্রোটিন আর অল্প পরিমাণের স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকার কারণে সব দিক থেকেই সামুদ্রিক মাছ হার্টের জন্যে হেল্পফুল। হার্টের সমস্যা থেকে যেসব রোগের সৃষ্টি হয় সেগুলোকে cardiovascular ডিজিজ বলে। আর যে কোনও ধরণের cardiovascular সমস্যার সমাধান রয়েছে সামুদ্রিক মাছে। যেমন, অ্যারিথমিয়াস, স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের মতো কার্ডিওভাসকুলার রোগগুলির ঝুঁকি কমাতে নিয়মিত সামুদ্রিক মাছ খেতে পারেন। সামুদ্রিক মাছ যেভাবে হার্টের উপকার করে-
- হার্ট এবং সামগ্রিক শরীরের জন্যে ক্ষতিকর ট্রাইগ্লিসারাইড কমায়।
- রক্ত জমাট বাঁধা থেকে রক্তনালীকে রক্ষা করে।
- ক্ষতিকর উচ্চ রক্তচাপ হ্রাস করে।
- হার্ট স্ট্রোক এবং হার্টফেলের মতো জটিল ঝামেলা এড়াতে সাহায্য করে।
- অনিয়মিত ও অনিয়ন্ত্রিত হার্ট বিট ঠিক করে দেয়।
সামুদ্রিক মাছ জয়েন্টের জন্যে খুবই ভাল
হাঁটুসহ শরীরের যে কোনও জয়েন্টের যারপরনাই উপকার করে সামুদ্রিক মাছ। জয়েন্টের রোগ আর্থ্রাইটিস বা বাত রোগের বাহুল্য কমাতে সামুদ্রিক মাছে থাকা ফ্যাটি এসিড অত্যন্ত কার্য্যকরী। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এটি অনেক ফলপ্রসূ। জয়েন্টের ক্ষেত্রে সামুদ্রিক মাছ আরো যেসব উপকার করে-
- খেলাধূলা করতে গিয়ে হাঁড়ে আঘাত পেলে তা সারাতে সাহায্য করে।
- অ্যাক্সিডেন্টের কারণে হাঁড় ভেঙ্গে গেলে জোড়া লাগাতে কাজ করে।
- হাঁড় বা জয়েন্টে যে কোনও ধরণের ক্ষত বা প্রদাহ তৈরিতে বাধা প্রদান করে।
- বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সকালে ঘুম থেকে উঠার পর হাত-পাঁয়ে যে ব্যথা অনুভব হয়, তা দূর করে।
সামুদ্রিক মাছ দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়
চোখের রোগ macular degeneration এর কারণে অনেকেরই দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ সামুদ্রিক মাছ এক্ষেত্রে তাদের জন্যে অত্যন্ত উপকারি। এটি তাদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেয়। আর যাদের এ রোগটি নেই, তাদের ক্ষেত্রে এটি হওয়ার সম্ভাবণা কমিয়ে দেয়।
সামুদ্রিক মাছ মানুষকে রাতের দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। নিয়মিত সামুদ্রিক মাছ খেলে চোখ উজ্জ্বল হয় এবং সুস্থ থাকে। এছাড়াও, সামুদ্রিক মাছের চোখের আরো যেসব উপকার করে-
- চোখ শুকিয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করে।
- ব্রেনের সঙ্গে চোখের কানেকশন তৈরি করা অপটিক নার্ভের ড্যামেজিং ডিজিজ গ্লুকোমা থেকে রক্ষা করে।
- মায়ের পেটে সন্তানের চোখের ডেভেলপমেন্ট ঘটাতে সাহায্য করে।
সামুদ্রিক মাছ ত্বক ভাল রাখে
হৃষ্ট-পুষ্ট তারুণ্যময় ত্বক কার না পছন্দ? আর এর জন্যে কত না ফিরিস্তির সাহায্য নেয় মানুষ, বিশেষ করে নারীরা! কিন্তু, সেটা কি খুব একটা টেকসই হয়? আপনি যদি কোমল, উজ্জ্বল আর তারুণ্যদীপ্ত ন্যাচারাল ত্বক পেতে চান, তবে নিয়মিত সামুদ্রিক মাছ খান।
ত্বকের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ময়েশ্চার তৈরিতে তুমুল ভূমিকা পালন করে সামুদ্রিক মাছ। ত্বক উজ্জ্বল করার জন্যে যেসব প্রসাধনী ব্যবহার করা হয়, সেগুলো ত্বকের যতটা উপকার করে তার চেয়ে বেশি উপকার করে সামুদ্রিক মাছ। এছাড়াও, সামুদ্রিক মাছের ফ্যাটি এসিড ওমেগা-৩ আরো যেসব উপকার করে-
- ত্বককে তেলতেলে হওয়া থেকে রক্ষা করে।
- ব্রনের উৎপাত থেকে রক্ষা করে মুখের সৌন্দর্য বাড়ায়।
- ত্বককে সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মি বা আলট্রা ভায়োলেন্ট রে থেকে রক্ষা করে।
সামুদ্রিক মাছ ডিপ্রেশন দূর করে
আমরা আগে জেনেছি সামুদ্রিক মাছ ব্রেনের জন্যে ব্যাপক উপকারি। জীবন থেকে প্রাপ্ত আঘাতের কারণে যাদের ব্রেনে নেগেটিভ চিন্তা বদ্ধমূল হয়ে যায়, তা থেকে ব্রেনকে জীবনের প্রতি পজিটিভ থিংকিং তৈরিতে সাহায্য করে সামুদ্রিক মাছের মূল উপাদান ফ্যাটি এসিড, ওমেগা-৩।
জীবন নিয়ে হা-পিত্যেষ করা হতাশা থেকে রক্ষা করে মনকে প্রফুল্ল রাখতে তাই নিয়মিত সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার চেষ্টা করুন। যারা ইতিমধ্যেই হতাশায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন, তাদের জন্যে যেমন এটি অত্যন্ত প্রয়োজন, তেমনই যারা হতাশা থেকে মুক্ত আছেন, তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবণা থেকে রক্ষা করতেও সামুদ্রিক মাছ খাওয়া দরকার।
সামুদ্রিক মাছ গর্ভবতী নারীদের জন্যে উপকারি
গর্ভবতী নারীদের নাম্বার ওয়ান চাওয়া হচ্ছে তার অনাগত সন্তানটি যেন সুস্থ্য থাকে, সবল থাকে, যেন সে সুন্দরভাবে ভূমিষ্ট হয়। পৃথীবিতে আসার আগে বাচ্চার যাবতীয় যা কিছু ডেভেলপ হয়, সেটার গোড়াপত্তন কিন্তু মায়ের পেটেই হয়ে থাকে। কাজেই, নারীর গর্ভে থাকা অবস্থাতেই অনাগত বেবির যত্ন নিতে হবে, তাকে প্রয়োজনীয় পুষ্টির সাপ্লাই দিতে হবে। আর এর মাঝে সেরা পুষ্টিকর খাদ্য হচ্ছে সামুদ্রিক মাছ।
সামুদ্রিক মাছ বাচ্চাদের ব্রেন ডেভেলপমেন্ট, বার্থ ওয়েট বাড়ানো, ফেটাল গ্রোথ উন্নত করাসহ যাবতীয় সকল উপকারই করে থাকে। এমনকি, সামুদ্রিক মাছে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডসহ যাবতীয় ভিটামিন এবং মিনারেল সন্তানের সেন্ট্রাল নার্ভ সিস্টেমকে নানাভাবে সাহায্য করে থাকে। তাই, গর্ভবতী মায়েদের বেশি বেশি সামুদ্রিক মাছ খাওয়ান।
শেষ কথা
সামুদ্রিক মাছের উপকারিতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেয়েছেন। আশা করি, এখন থেকে উপরোক্ত উপকারিতাগুলো পাওয়ার জন্যে নিয়মিত সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার চেষ্টা করবেন। যদি নিয়মিত না’ও পারেন, অন্তত সপ্তাহে কিংবা মাসে একবার হলেও পরিবারের সদস্যদের জন্যে সামুদ্রিক মাছের ব্যবস্থা করবেন।
Leave a Reply