জমিন থেকে আসমানের দূরত্ব ৩১৫ কোটি ৭২ লক্ষ কিলোমিটার। অথচ ঘাড় উঁচিয়ে উপরের দিকে তাকলেই আকাশটাকে মিলি সেকেন্ডের মধ্যে দেখা যায়। একবার ভাবুন, কী পরিমাণ রেজ্যুলেশন রয়েছে আমাদের দৃষ্টির ক্যামেরায়!
এখনকার প্রতিটি স্মার্টফোনেই ক্যামেরা থাকে আর প্রতিটি ক্যামেরায় রেজ্যুলেশন দেয়া থাকে। ৪ মেগাপিক্সেল, ৮ মেগাপিক্সেল, ১৬ মেগাপিক্সেল, ৩২ মেগাপিক্সেল, ইত্যাদি। ক্যামেরার রেজ্যুলেশন যত বাড়তে থাকে, মোবাইলফোনের দামও তত বাড়তে থাকে।
কিন্তু এ যাবৎ মানুষের তৈরি ক্যামেরার সর্বোচ্চ রেজ্যুলেশন ৪৯.৫ মেগাপিক্সেল। আর আল্লাহ্ সুবহানাহুতাআ’লা আপনার আমার দৃষ্টির ক্যামেরায় যে রেজ্যুলেশন দিয়েছেন তার পরিমাণ ৫৭৬ মেগাপিক্সেল। ভেবে দেখুন কী পরিমাণ পাওয়ারফুল আমাদের এই চোখ!
সৌন্দর্য উপভোগের জন্যে হোক আর দৈনন্দিন কার্যাবলী সম্পাদনের জন্যে হোক, চোখ আমাদের সবারই অমূল্য সম্পদ। এটি কোন রূপ ক্ষতিগ্রস্থ হলে আমাদের জীবনটাই ক্ষতির মুখে পড়ে যায়।
স্বাভাবিকভাবে আমাদের চোখ দূরের ও কাছের সমস্ত বস্তু দেখতে পায়। অন্ধকার থেকে আলোতে কিংবা আলো থেকে অন্ধকারে, যখনই যে অবস্থাতেই আমরা স্থান পরিবর্তণ করি না কেন, আমাদের চোখ সেই অবস্থার সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে। অল্প কিংবা বেশি আলো, রাত কিংবা দিন, যে কোনও অবস্থাতেই আমাদের চোখ যে কোনও কিছু দেখার জন্যে প্রাকৃতিকভাবেই সম্পূর্ণ সক্ষম।
যদি এর ব্যতিক্রম হয়, যদি আমাদের চোখ এই স্বাভাবিক কাজগুলো করতে অপারগ হয়, তবে বুঝতে হবে আমাদের চোখে সমস্যা দেখা দিয়েছে। আর চোখের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে রাতে কম দেখা কিংবা অল্প আলোতে কম দেখা বা একেবারেই না দেখা।
আর আমাদের চোখের এই অবস্থাটাকেই রাতকানা রোগ বলে যাকে আবার মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় Nyctalopia বলে। রাতকানা রোগ কি, এটি কেন হয় তা হয়তো আপনি আগে থেকেই জানেন। এবার জেনে নিন রাতকানা রোগের কয়েকটি লক্ষণ ও চিকিৎসা-
রাতকানা রোগের লক্ষণ
কারো রাতকানা রোগ হয়েছে কিনা তা জানার জন্যে অ্যামেরিকান অ্যাকাডেমী অব অপথ্যালমোলজি এএও নিম্নে বর্ণিত প্রশ্নগুলি করার পরামর্শ দিয়েছেন। অর্থাৎ, এই প্রশ্নগুলোর পজিটিভ উত্তর দ্বারা রাতকানা রোগের লক্ষণ বোঝা যাবে।
- অল্প আলোতে ঘরের ভেতর চলাফেরায় কি আপনার সমস্যা হয়?
- রাতে গাড়ি ড্রাইভ করতে কি কোন রকম অসুবিধার সন্মুক্ষীণ হচ্ছেন?
- মৃদু আলোতে কাউকে চিনতে কি অসুবিধা হয়?
- অন্ধকার থেকে আলোতে এসে নিজের চোখকে অ্যাডজাস্ট করতে কি দীর্ঘ সময় লেগে যায়?
- আলো থেকে হঠাৎ অন্ধকারে আসলে কি জিনিসপত্র দেখতে অসুবিধা হয়?
নিজের ঘর হোক আর অন্য কারো ঘর হোক, যদি অল্প আলোতে কোনও ঘরে চলাফেরায় সমস্যা হয় অর্থাৎ চোখে সবকিছু ঠিক মতো স্পষ্ট না হয়, তবে এটি রাতকানা রোগের লক্ষণ হিসেবেই বিবেচিত।
রাতে আমাদের অনেকেরই গাড়ি চালানোর প্রয়োজন হয়। গাড়ি চালাতে গিয়ে যদি এমন হয় যে কাছের কিংবা দূরের গাড়িগুলোকে ঝাপসা ঝাপসা লাগে, তবে বুঝতে হবে এটিও রাতকানা রোগের লক্ষণ।
অত্যন্ত পরিচিত লোক, অফিসের কলিগ কিংবা পাড়ার প্রতিবেশী অথবা ঘনিষ্ঠ্য বন্ধু। সব সময়ের চেনা এই লোকটিকেই হঠাৎ যদি মৃদু আলোতে দেখে চিনতে না পারা যায়, তবে লক্ষণ তো ভাল না বলতেই হবে। ধরে নিতে হবে রাতকানা রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছে।
অনেকক্ষণ কিংবা অল্প সময় রোদে থাকার পর যখন ছায়ায় আসা হয়, তখন যদি ছায়ার সঙ্গে চোখের অ্যাডজাস্ট না হয়, তবে রাতকানা রোগের লক্ষণ আছে বলেই মনে করতে হবে। আবার রাতে দেখতে সমস্যা হয় না, সবকিছুই ঠিকঠাকই আছে বলে মনে হয়। কিন্তু যখনই রাতে উজ্জ্বল আলো থেকে অন্ধকারে যাওয়া হয় আর তখনই মনে হয় সবকিছু আবছা আবছা লাগছে, তাহলেও বুঝতে হবে রাতকানা রোগ হয়েছে।
আবার, অল্প আলো কিংবা বেশি আলো থেকে অন্ধকারে গেলে চোখ তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে দীর্ঘ সময় নেয়। অর্থাৎ, সহজেই অন্ধকারের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট হতে পারে না। সবকিছু সুচারুরূপে দেখতে মোটামুটি বড় একটা সময় নিয়ে নেয়। এ রকম ক্ষেত্রে রাতকানা রোগের লক্ষণ ধরতে হবে।
রাতকানা রোগের চিকিৎসা
রাতকানা রোগের মূল কারণের উপর নির্ভর করেই চিকিৎসা দেয়া হয়। যারফলে, একেক জনের ক্ষেত্রে চিকিৎসা ব্যবস্থা একেক রকম হয়ে থাকে, যেহেতু সবার রাতকানা রোগ হওয়ার কারণ এক হয় না।
রাতকানা রোগের চিকিৎসায় কখনো কোন নির্দিষ্ট টাইপের চশমা পরার পরামর্শ দেয়া হয়, কখনো কন্টাক্ট লেন্সও সাজেস্ট করা হয় যা সঠিক দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে থাকে। কখনো আবার সাধারণ কোন সানগ্লাস ব্যবহার করার জন্যে প্রেসক্রাইবড্ করা হয়। এতে করে একদিকে আল্ট্রাভায়োলেন্ট লাইট থেকে চোখ বর্তমানে রক্ষা পায়, অন্যদিকে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ক্ষতির আশংকা থেকেও মুক্ত থাকে।
কখনো আবার গ্লুকোমা মেডিকেশন বা গ্লুকোমার ঔষধ দেয়া হয়। আবার কখনো রাতকানা রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ছোট-খাট সার্জারির প্রয়োজন হয়, বিশেষ করে যদি চোখের ছানি থেকে রাতকানা রোগ হয়ে থাকে।
রাতকানা রোগের কারণ যদি হয়ে থাকে ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব, তবে ভিটামিন ‘এ’ যুক্ত প্রাকৃতিক খাবার খেতে বলা হয়। তবে, সেটা বড়দের ক্ষেত্রে। ছোটদের ক্ষেত্রে, বিশেষত রাতকানা রোগে আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে চিকিৎসা হিসেবে ভিটামিন ‘এ’ সাপ্লিমেন্ট দেয়া হয়।
শেষ কথা
রাতকানা রোগের লক্ষণগুলো আমাদের জানা হলো, সেই সাথে এ রোগের চিকিৎসা সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া গেল। এখন যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে রাতকানা রোগ সম্পর্কে সচেতনতা।
Leave a Reply