নতুন রক্ত দাতা অথবা ইতোমধ্যে রক্ত দিয়েছেন প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই রক্ত দানের আগে কিছু গুরুত্বপূণ বিষয় জেনে রাখা উচিত। যেহেতু রক্ত তৈরি বা উৎপাদন করা যায় না, তাই রোগীরা তাদের জীবনের জন্য রক্ত দাতাদের উপর নির্ভর করেন। প্রতি রক্তদানে তিনজন রোগী সাহায্য পান। যদিও রক্ত দানের গুরুত্বের ক্ষেত্রে প্রায়শই রক্ত গ্রহীতাদের কথা বলা হয়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে রক্ত দাতাদের সুবিধাও কম নয়।
সাধারণত কোনও অ্যাক্সিডেন্ট কিংবা অন্য কারণে রক্ত স্বল্পতা দেখা দিলে কিংবা বড় ধরণের কোনও অপারেশন করা হলে রক্তের প্রয়োজন হয়ে থাকে। কারো কারো ক্ষেত্রে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলে, রক্ত গ্রহণের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে, একজন রক্তদাতা মহান ও মানবিক ভূমিকা পালন করে থাকেন। কিন্তু, রক্তদানের আগে এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো জেনে রাখা জরুরী।
তাই রক্ত দিতে যাবার আগে চলুন, জেনে নিই রক্ত দানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো।
রক্ত দানের আগে যে ১০টি দরকারি বিষয় জানতে হবে
রক্ত দেয়ার ক্ষেত্রে সবার মধ্যেই এক রকম উৎকণ্ঠা কাজ করে। যেহেতু শরীরের অভ্যন্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান শরীর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, তাই এতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব আছে কিনা তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান থাকেন। তাছাড়া নতুনদের ক্ষেত্রে রক্ত দানের পদক্ষেপগুলো নিয়েও বেশ কৌতূহল থাকে। এই ১০টি বিষয়ের মধ্যে রক্ত দেয়ার আগে করণীয় সম্বন্ধে আপনার প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবেন।
১/ শারীরিক সুস্থতা
রক্ত দানের জন্য আপনাকে অবশ্যই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে। যে কোনো ধরনের মৌসুমি জ্বর, ফ্লু, সর্দি-কাশি, শ্বাস-প্রশ্বাসের তীব্রতা আপনার রক্তদানের সক্ষমতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তবে, সমস্যা কেটে গেলে আপনি রক্ত দিতে পারেন।
যে কোনো সংক্রমণের জন্য আপনি যদি নিয়মিত অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করে থাকেন, সেক্ষেত্রে আপনার রক্ত দেয়া ঠিক হবে না। বড় ধরনের সংক্রমণ যেমন এইচআইভি, যক্ষা, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি থাকলে আপনি রক্ত দিতে পারবেন না।
কোভিড সংক্রমণের ক্ষেত্রে ১৪ দিন অপেক্ষা করে সম্পূর্ণ সুস্থ হবার পর রক্ত দিতে পারেন। তবে, আপনার দেহে করোনা ভাইরাসের অনুপস্থিতির ব্যাপারটা অবশ্যই চিকিৎসকের কাছ থেকে নিশ্চিত হয়ে নেবেন। চর্মরোগের ব্যাপারে সংক্রমণ কেটে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। ব্রণ নিয়ন্ত্রণে ঔষধ খেলে আপনার রক্ত দানে কোনো সমস্যা হবে না।
আপনার রক্ত স্বাভাবিকভাবে জমাট না বাঁধলে রক্ত নেয়ার সময় আপনার যেখানে সুই রাখা হবে সেখানে অতিরিক্ত রক্তপাত হতে পারে। তাই, এ অবস্থায় আপনি রক্ত দেয়ার জন্য উপযুক্ত নন। গর্ভবতী মহিলা ও শিশুর জন্মের পরবর্তী দুই বছর পর্যন্ত কোনো মায়েরই রক্ত দেয়া যাবে না।
সার্জারির ক্ষেত্রে অবশ্য রক্তদানের ব্যাপারটা নির্ভর করছে আপনি কি ধরনের সার্জারি করেছেন তার উপর। আপনার যদি ডেন্টাল সার্জারি হয় এবং কোনও সংক্রমণ না হয়, তবে আপনি অবিলম্বে রক্ত দিতে পারেন। কিন্তু ওরাল সার্জারির জন্য প্রায় তিন দিন এবং বাইপাস সার্জারি বা হার্টের অন্যান্য অপারেশনের ক্ষেত্রে আপনাকে ছয় মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
২/ মানসিক সুস্থতা
রক্ত দানের আগে যথেষ্ট বিশ্রাম এবং শিথিলতা আপনার মনের দিক থেকে শক্ত থাকার জন্য দরকার। বিশেষ করে, প্রথমবার রক্ত দানের ক্ষেত্রে নার্ভাস বোধ করাটা স্বাভাবিক। তাই, আগের রাতে ৭ থেকে ৯ ঘন্টা ভালো করে ঘুম দেন। পরিমিত পরিমাণে খাবার দিয়ে দেহকে সতেজ রাখুন।
মস্তিষ্কে অতিরিক্ত চাপ পড়তে দেবেন না। রক্ত দানের সময় সর্বোচ্চ এক ব্যাগ বা ৪৫০ মিলিলিটার রক্ত নেয়া হয়। এই রক্ত শরীরের মোট রক্তের শতকরা মাত্র ২ থেকে ৩ ভাগ। এই পরিমাণ রক্ত শরীর থেকে বের হলে কোনো ক্ষতি নেই। রক্ত দানের ফলে সুস্থ মানুষ কখনো অসুস্থ হয়ে পড়েন না বরং উল্টো হৃদরোগ ও ক্যান্সারের মত বড় বড় রোগের সম্ভাবনা কমে যায়।
৩/ রক্ত দানের আগে পানি পান ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ
রক্ত দানের পূর্বে আপনার শরীরকে যথেষ্ট পরিমাণে পানি এবং স্বাস্থ্যকর খাবার দিতে হবে। রক্ত দানের ২ ঘন্টা আগে কমপক্ষে ৫০০ মিলিলিটার পানি এবং কিছু শর্করা জাতীয় খাবার খেয়ে নিন।
আগের দিন লাল মাংস, সামুদ্রিক মাছ, হাঁসের মাংস, মটরশুটি, শিম, পালং শাক, কিসমিস, রুটি এবং পাস্তা ইত্যাদি আয়রন ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবারগুলো খেতে পারেন। কারণ, প্রতিবার রক্ত দেয়ার সময় আপনার শরীরে আয়রনের অভাব হয়। চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন, কেননা চর্বিযুক্ত খাবার বেশি খাওয়ার ফলে রক্তের নমুনাগুলি পরীক্ষা করতে অসুবিধা হয়।
৪/ আপনার বয়স, ওজন, উচ্চতা ও রক্তচাপ
রক্ত দেওয়ার জন্য আপনার বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে; বয়সের কোন সীমা নেই। কমপক্ষে ৫০ ফিট ৪ ইঞ্চি উচ্চতায় ওজন হতে হবে কমপক্ষে ৫০ কেজি। এই উচ্চতার নিচে হলে ওজন ৫০ কেজির বেশি হতে হবে।
রক্তচাপ অবশ্যই ৯০/৫০ এর উপরে এবং ১৮০/১০০ এর নীচে থাকতে হবে।
৫/ খালি পেটে রক্তদান থেকে বিরত থাকা
খালি পেটে আপনার শরীর থেকে রক্ত টানলে অল্প সময়ের জন্য আপনার রক্তচাপে প্রভাব ফেলবে। নিম্ন রক্তচাপের কারণে অজ্ঞান, মাথা ঘোরা, খিচুনি ইত্যাদিসহ আরো খারাপ অবস্থা হতে পারে। তাই, রক্ত দানের আগে অবশ্যই ভালোভাবে খেয়ে নিন।
৬/ ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান
হাফ-হাতা শার্ট উত্তম। ফুল-হাতা শার্ট পড়লে আপনি যেন খুব সহজেই হাতা আপনার কনুইয়ের উপরে উঠাতে পারেন। এটি দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ।
এক, আপনি অবশ্যই পরীক্ষার সময় অস্বস্তি বোধ করবেন না। কারণ, টাইট পোশাপ রক্ত দানের সময় আপনার রক্তচাপ বা হৃদস্পন্দন হঠাৎ বাড়িয়ে দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, হালকা পোশাকের হাতা উপরে টানা সহজ এবং রক্ত নেয়ার সুইটি আপনার কনুইতে প্রবেশ করানোর সময় আপনার উপরের বাহুতে চাপ পড়বে না।
৭/ রক্ত নেয়ার পদ্ধতি
রক্ত দিতে প্রায় এক ঘন্টা সময় লাগে। প্রথম ১৫ থেকে ২০ মিনিট হলো নিবন্ধকরণের জন্য। এ সময় আপনার পরিচয় দিয়ে সাইন ইন করা, রক্ত দান প্রক্রিয়া সম্পর্কিত তথ্য পড়া ও আপনার স্বাস্থ্যের অবস্থা যাচাই করা হয়।
এক্ষেত্রে মূলত, আপনি কেমন অনুভব করছেন, আপনি কোথায় ছিলেন বা কোথায় ভ্রমণ করেছেন, কোনো ওষুধ গ্রহণ করছেন কিনা, পূর্বে রক্ত দিয়েছেন কিনা ইত্যাদি সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ন করা হয়। তারপরে কর্মীরা আপনার তাপমাত্রা, নাড়ি, রক্তচাপ এবং হিমোগ্লোবিন স্তর পরীক্ষা করবে। মুল রক্ত সঞ্চালনে কেবল আট থেকে দশ মিনিট সময় নেয়।
৮/ রক্তের গ্রুপ নিয়ে ভুল ধারণা
অনেকেই মনে করেন, রক্ত দেওয়ার জন্য তাদের রক্তের গ্রুপ জানা উচিত। এটা ঠিক নয়। রক্ত দানের পূর্বে আপনার রক্তের গ্রুপ না জানলেও চলবে। আসলে হাসপাতালগুলোর রক্ত দাতাদের প্রয়োজন হয় রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য।
রক্ত দানের সময়ই আপনি আপনার রক্তের গ্রুপ জেনে নিতে পারেন।
৯/ কতবার রক্ত দেয়া যায়
আপনি যদি শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে থাকেন, তবে প্রতি ৯০ দিন পর পর, অর্থাৎ তিন মাস পর পর রক্ত দিতে পারবেন। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের শরীরে সাধারণত ৪ থেকে ৬ লিটার পরিমাণ রক্ত থাকে। রক্তের ভেতরে লোহিত রক্তকণিকাগুলো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ৮০ থেকে ১২০ দিন পরপর ধ্বংস হয়ে নতুন নতুন রক্তকণিকা তৈরি হয়।
প্রতিবারে রক্ত দানে আপনার রক্ত বিশোধন হয়। তাছাড়া, প্রতিবার রক্ত দানে বিনামূল্যেই আপনি জেনে নিতে পারেন আপনার রক্তে কোনো সমস্যা আছে কিনা।
১০/ রক্ত নেয়ার জায়গায় ব্যান্ডেজ
রক্ত দান সম্পূর্ণ হলে আপনার রক্ত নেয়ার স্থানে একটি ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়ে কনুইয়ের কাছে হাত ভাঁজ করে চেপে রাখতে বলা হবে। এই ব্যান্ডেজ এবং চাপের ফলে আপনার শিরা থেকে রক্ত প্রবাহ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে।
রক্তপাত বন্ধ হওয়া নিশ্চিত করতে আপনাকে কমপক্ষে চার ঘন্টা আপনার ব্যান্ডেজ এবং চাপ রাখতে হবে। কখনও কখনও ব্যান্ডেজ বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে রাখার পরেও রক্তপাত ঘটে। এই ক্ষেত্রে রক্ত নেয়ার জায়গায় চেপে ধরে আপনার হাতটি আপনার বুকের উপরে তিন থেকে পাঁচ মিনিটের জন্য ধরে রাখুন।
শেষাংশ
সর্বোপরি, রক্ত দানের আগে এই ১০টি বিষয় মনে রাখলেই আপনার রক্ত দানে কোনো ঝামেলাই হবে না। তদুপরি, রক্ত দানের পর পরই কমপক্ষে ২ থেকে ৩ গ্লাস পানি অথবা পানি জাতীয় খাবার খেয়ে নিন। পরের ২৪ ঘন্টায় অবশ্যই কোনো অ্যালকোহল জাতীয় খাবার খাবেন না। রক্ত নেয়ার পর রিলিজ করে দিলে সাথে সাথেই ভারী বা কঠিন কোনো কাজ করতে যাবেন না। মাথা ঝিম ঝিম করলে কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নিন।
রক্ত দান সম্পর্কিত আরো কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কমেন্ট বক্সে লিখে আমাদেরকে জানাতে পারেন। অতঃপর, লেখাটি সোশ্যাল মিডিয়াতে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে তাদেরকে রক্ত দানে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।
Leave a Reply