হিমোগ্লোবিন আমাদের শরীরের এক ধরণের রক্তরঞ্জক পদার্থ, খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রোটিন। মানব দেহের এই পাওয়ারফুল প্রোটিন বাতাস বা অক্সিজেন বহনকারী হিসেবেই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখে থাকে। আমাদের ফুসফুস যখন নি:শ্বাসের সঙ্গে বাতাস থেকে অক্সিজেন নিয়ে জমা করে, তখন হিমোগ্লোবিন সেই অক্সিজেনকে বহন করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে নিয়ে যায়। অর্থাৎ, শরীরের যেখানে যতটকু অক্সিজেন প্রয়োজন ততটুকু পৌঁছে দেয়। নিয়মিত অক্সিজেন স্বপ্লতা দূর করে। রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে তাই নানা ধরণের সমস্যা দেখা দেয়।
হিমোগ্লোবিন আমাদের রক্তকে রক্তিম করে, গাঢ় করে, রক্তের উপাদান ঠিক রাখে। মাতৃগর্ভে প্রতিটি সন্তানের শরীরেই প্রাকৃতিকভাবে অ্যাডাল্ট টাইপ হিমোগ্লোবিন উৎপন্ন হয় যেটাকে হিমোগ্লোবিন এ-টু বলে। ল্যাবরেটরিতে বিভিন্ন ধরণের রক্ত পরীক্ষায় হিমোগ্লোবিন এ-টু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এমনকি, রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কত, নরমাল না হাই না লো সেটা জানতেও হিমোগ্লোবিন এ-টু এর প্রয়োজন হয়। আর এই গুরুত্বপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জন্মগতভাবেই বাবা মা’র কাছ থেকে সব সন্তানই পেয়ে থাকে।
কিন্তু নানা কারণে শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমতে থাকে এবং আমরা লো লেবেল হিমোগ্লোবিনের মুখোমুখি হই। মহিলারা সাধারণত সন্তান প্রসবের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে হিমোগ্লোবিন সংকটে পড়ে অর্থাৎ এ সময় তাদের শরীরে হিমোগ্লোবিনের মারাত্মক অভাব দেখা দেয়।
মায়ের শরীরে হিমোগ্লোবিন কম থাকলে সন্তানের শরীরেও কম থাকে। অর্থাৎ, জন্মগতভাবে সন্তান মায়ের কাছ থেকে যতটুকু হিমোগ্লোবিন এ-টু পাওয়ার কথা ততটুকু পায় না। ফলে, সন্তানের শরীরেও হিমোগ্লোবিনের অভাব দেখা দেয়।
আর প্রাপ্ত বয়স্কদের শরীরে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার নানা কারণ থাকে। অ্যাক্সিডেন্টের ফলে প্রচুর রক্তক্ষরণ হলে, শরীরে আয়রনের ঘাটতি থাকলে, পাইলস্ এর মতো রোগ থাকলে হিমোগ্লোবিনের অভাব দেখা দেবে। আজ আমরা জানবো এই অভাব দেখা দিলে, হিমোগ্লোবিন কমে গেলে আমাদের শরীরে কী কী সমস্যা হয়-
রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে কি হয়
হিমোগ্লোবিন কি এবং আমাদের শরীরে এই হিমোগ্লোবিনের কাজ কি এ সম্পর্কে আমরা মোটামুটি একটা ধারণা পেয়েছি। রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যায় কেন বা কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কেও আমরা জানি। এবার হিমোগ্লোবিনের অভাবে কি হয় সে সম্পর্কে আমরা আমাদের ধারণাকে পরিস্কার করে নেবো।
হিমোগ্লোবিনের অভাবে নি:শ্বাসে সমস্যা হয়
আমরা আগেই জেনেছি যে আমাদের শরীরে অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের গুরু দায়িত্বটি পালন করে হিমোগ্লোবিন। এটি ফুসফুস থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে শরীরের সব স্থানে পরিমাণ মতো পৌঁছে দেয়। সুতরাং, বুঝতেই পারছেন যদি রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যায়, তবে শরীরে সর্বত্র অক্সিজেন সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। অর্থাৎ, প্রয়োজনীয় সংখ্যক হিমোগ্লোবিন না থাকার কারণে শরীরের কিছু কিছু অংশে অক্সিজেন পৌঁছে না। ফলে, নি:শ্বাসে দূর্বলতা দেখা দেয়। অর্থাৎ, স্বাভাবিক নি:শ্বাস বাধাগ্রস্ত হয়। আর কখনো কখনো দেখা যায় নি:শ্বাস নিতে অস্বাভাবিক কষ্ট হয়।
হিমোগ্লোবিনের অভাবে শারীরিক দূর্বলতা দেখা দেয়
হিমোগ্লোবিন কম থাকা মানে শরীরে রক্ত কম থাকা এবং রক্তের ঘনত্বও স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকা। এ রকম অবস্থায় শরীর তার প্রয়োজনীয় ফাংশনালিটি পায় না। ফলে, শারীরিক দূর্বলতা দেখা দেয়। দৈনন্দিন কাজ-কর্ম করার জন্যে স্বাভাবিক যে শক্তির প্রয়োজন, তাতে বেশ ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে শরীরের হাঁড়গুলোতে শক্তির অভাব দেখা দেয়।
হিমোগ্লোবিনের অভাবে মাথা ব্যথা হয় ও মাথা ঘোরে
শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো মাথায়ও স্বাভাবিক রক্ত চলাচল প্রয়োজন। সেই সাথে, মাথায় প্রবাহিত রক্তে যথেষ্ট্য পরিমাণে হিমোগ্লোবিনের প্রয়োজন। যদি তা না থাকে, অর্থাৎ পরিমাণ মতো হিমোগ্লোবিনের অভাবে মাথা ব্যথা দেখা দেয়। সেই সাথে মাথা ঘোরে, ঝিম ঝিম করতে থাকে, সারাক্ষণ একটা অস্বস্তি লেগে থাকে।
হিমোগ্লোবিনের অভাবে হার্ট বিট বেড়ে যায়
আমরা সকলেই জানি যে হার্ট বা হৃৎপিন্ড আমাদের দেহে রক্ত পরিশোধনের কাজটি করে থাকে। প্রতিদিন একজন মানুষের হার্ট প্রায় ৭০০ গ্যালন রক্ত পরিশোধন করে থাকে। আপনি হয়তো এই ভেবে অবাক হতে পারেন যে, একজন মানুষের শরীরে ৭০০ গ্যালন রক্ত আসবে কোথা থেকে!
আপনার ভাবনা এক অর্থে ঠিক। কিন্তু আপনার জানা প্রয়োজন যে, আমাদের দেহে যে রক্ত প্রবাহ চলতে থাকে, সেগুলো ঘুরে-ফিরে হার্টে আসে আর হার্ট সেগুলো পরিশোধন করে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পাঠিয়ে দেয়। হার্টের মাধ্যমে ব্লাডের এই সার্কুলেশন চলতেই থাকে। বুঝতেই পারছেন, আমাদের দেহে যথেষ্ট্য পরিমাণ রক্ত না থাকলে এবং রক্তে হিমোগ্লিবেনর ঘাটতি দেখা দিলে, হার্টের এই ব্লাড সার্কুলেশন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে, আমাদের হার্ট বিট বেড়ে যায় যা মোটেই সুখকর নয়।
হিমোগ্লোবিনের অভাবে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়
হিমোগ্লোবিনের অভাবে অনেক সময়ই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। আমরা সকলেই জানি যে রক্ত সাধারণত গরম হয়ে থাকে। যেমন, কোন কারণে আমাদের শরীরে কোথাও কাটা গেলে যে রক্ত বের হয় তা ধরলে হাল্কা গরম অনুভূত হয়। আসলে রক্তের মধ্যে থাকা হিমোগ্লোবিনই আমাদের হাত-পা হাল্কা গরম করে রাখে। আর যখনই হাত পা’য়ে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি তৈরি হয়, তখনই হাত, পা ঠান্ডা হয়ে যায়।
হিমোগ্লোবিনের অভাবে ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যায় ও হলুদ বর্ণ ধারণ করে
হিমোগ্লোবিনের অভাবে হলুদ বর্ণ ধারণ করে আমাদের ত্বক। এ রকম অবস্থায় অর্থাৎ যখন ত্বক হলুদ হয়ে ওঠে, অনেকেই তখন এটাকে জন্ডিস হয়েছে ভেবে ভুল করে থাকে। আসলে, ত্বকের স্বাভাবিক রঙের পেছনে রক্তের হিমোগ্লোবিন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আর যখন ত্বকের নিচে যথেষ্ট্য পরিমাণ হিমোগ্লোবিন প্রবাহিত না হয়, তখন আমাদের শরীরের ত্বক আস্তে আস্তে ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
হিমোগ্লোবিনের অভাবে মনোযোগ বিঘ্নিত হয়
রক্তে যদি যথেষ্ট্য পরিমাণে শরীরের জন্যে পাওয়ারফুল হিমোগ্লোবিন না থাকে, তবে সেটা আমাদের মনোযোগেও প্রভাব ফেলে। কারণ, শরীর ও মনের মাঝে রয়েছে গভীর সংযোগ, সুবিশাল সেতুবন্ধন। শরীরে যখন কোন কিছুর অভাব দেখা দেয়, তখন সেটি মনকেও প্রভাবিত করে।
হিমোগ্লোবিনের বেলায়ও একই রকম হয়ে থাকে। এটির অভাবে শরীরে যেমন নানা রকম সমস্যা তৈরি হয়, তেমনি মনেও দেখা মারত্মক সংকট। তার মাঝে সবচেয়ে বড় সংকটই হচ্ছে মনোযোগে সমস্যা। অর্থাৎ, কোন কিছুতে ঠিক মতো মনোযোগ দিতে না পারা।
আমরা জানলাম রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে কি হয়। যেগুলো জানলাম সেগুলোর বাইরেও আরো কিছু ছোট-খাট শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। তবে, উল্লেখিত সমস্যাগুলোই প্রধান। তাই, এগুলো নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হল। আশা করি, আমাদের শরীরে যাতে হিমোগ্লোবিনের অভাব দেখা না দেয় সে ব্যাপারে আমরা সবাই সচেষ্ট্য থাকবো।
Leave a Reply