বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়তে থাকে। বয়স ২০ এর বেশি হলেই প্রতি ৫ বছরে অন্তত একবার কোলেস্টেরলের মাত্রা পরীক্ষা করা জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৩৫ বা তার বেশি বয়সী পুরুষ এবং ৪৫ বা তার বেশি বয়সী মহিলাদের অধিকাংশের শরীরে ক্ষতিকর মাত্রায় কোলেস্টেরল পাওয়া যায়।
কোলেস্টেরলের মাত্রা যত বৃদ্ধি পায়, হৃদরোগের ঝুঁকিও তত বৃদ্ধি পায়। তাই, এ নিয়ে কোনভাবেই হেলাফেলা করা উচিৎ নয়। বরং, নিয়মিত শিডিউলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা পরীক্ষা করে নিতে হবে।
কোলেস্টেরল পরীক্ষা – লিপিড প্রোফাইল
কোলেস্টেরলের মাত্রা জানার জন্যে একটি রক্ত পরীক্ষা করা হয়। এ পরীক্ষায় রক্তে বিদ্যমান বিভিন্ন প্রকার চর্বির পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। একে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ‘লিপিড প্রোফাইল’ বা ‘লিপোপ্রোটিন প্রোফাইল’ বলা হয়।
রোগীর লিপিড প্রোফাইল থেকে চর্বির আনুপাতিক পরিমাণ যাচাই বাছাই করে কোলেস্টেরল মাত্রার একটি সামগ্রিক ধারণা পাওয়া যায়। নির্ভুল ফলাফলের জন্যে পরীক্ষাটি করার আগে আনুমানিক ১০ ঘন্টা খালি পেট থাকতে হয়।
কোলেস্টেরল এর স্বাভাবিক মাত্রা
আত্মীয় স্বজন বা প্রতিবেশী কেউ হৃদরোগে আক্রান্ত হলে, নিজের মধ্যেও তখন একটি ভয় কাজ করতে শুরু করে। আমিও হৃদরোগের ঝুঁকিতে নেই তো? ঝুঁকিতে থাকা না থাকা মূলত নির্ভর করছে কোলেস্টেরলের অতিরিক্ত মাত্রার উপর। আপনার রক্তে কোলেস্টেরলের অতিরিক্ত লক্ষণ রয়েছে কিনা তা যদি যাচাই করতে পারেন, তবে নিজেই বুঝতে পারবেন আপনি কোনও রকম হৃৎরোগের ঝুঁকিতে আছেন কিনা।
খাদ্যাভ্যাসের দিক থেকে খুব কম মানুষই সচেতন। অনিয়ন্ত্রিত খাবারের ফলে শরীরে চর্বি জমতে পারে। চর্বি জমাটা তখনই ক্ষতিকর, যখন তা স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। অবচেতন মনে তখন প্রশ্ন জাগে, কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক মাত্রা কত? আমার শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিক তো?
এ দুটি প্রশ্নের উত্তর রয়েছে আমাদের “লিপিড প্রোফাইলে”। শরীরে বিভিন্ন ধরণের লিপিড বা চর্বি রয়েছে। এর মধ্যে ৪টি লিপিডের মাত্রা জানা থাকলেই শরীরে কোলেস্টেরল এর পরিমাণ নির্ণয় করা যায়।
লিপিডগুলো হলো-
- কম ঘনত্ব যুক্ত লিপো-প্রোটিন (LDL – Low Density Lipoprotein)
- অধিক ঘনত্ব যুক্ত লিপো-প্রোটিন (HDL – High Density Lipoprotein)
- ট্রাইগ্লিসারাইড (Triglycerides)
- শরীরের সমস্ত কোলেস্টেরল (Total Cholesterol in body)
লিপিড প্রোফাইলে মূলত এ ৪টি লিপিডের পরিমাণই গণনা করা হয়। চলুন জেনে আসি, এ ৪টি লিপিডের স্বাভাবিক ও ক্ষতিকর মাত্রা কত।
কম ঘনত্ব যুক্ত লিপো-প্রোটিন (LDL – Low Density Lipoprotein)
এটিকে খারাপ বা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল বলা হয়। কেননা, উচ্চ রক্তচাপসহ হৃদযন্ত্রের অন্যান্য রোগের অন্যতম কারণ এই লিপোপ্রোটিন।
রক্তনালীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় এটি রক্তনালীর গায়ে জমা হতে থাকে। ফলাফল হিসেবে রক্তনালী ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে যায়। দীর্ঘদিন জমার কারণে একসময় রক্তপ্রবাহে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই জটিল অবস্থাটিকে বলা হয় এথেরোস্ক্লেরোসিস।
স্বাভাবিক মাত্রা
প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ও মহিলায় LDL কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক মাত্রা প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ১০০ মিলিগ্রাম বা তার কম। ১৩০মিগ্রা/ডেলি পর্যন্ত এটি গ্রহণযোগ্য। এর বেশি হলেই সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
সর্বোচ্চ মাত্রা
রক্তে এই LDL কোলেস্টেরলের সর্বোচ্চ মাত্রা ১৯০মিগ্রা/ডেলি। এ মাত্রায় পৌছালে যে কোন সময় হার্ট অ্যাটাকসহ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অধিক ঘনত্ব যুক্ত লিপো-প্রোটিন (HDL – High Density Lipoprotein)
এটিকে ভালো বা উপকারী কোলেস্টেরল বলা হয়। রক্তে এর পরিমাণ যত বেশি থাকবে, ততই তা শরীরের জন্য মঙ্গল। কেননা, HDL কোলেস্টেরল হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। রক্তনালীতে জমে থাকা LDL কোলেস্টেরলকে রক্তপ্রাবাহের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দিতে সাহায্য করে এই HDL কোলেস্টেরল।
স্বাভাবিক মাত্রা
প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ও মহিলায় HDL কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক মাত্রা প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ৬০মিলিগ্রাম বা তার বেশি।
সর্বনিম্ন মাত্রা
শরীরে HDL কোলেস্টেরলের সর্বনিম্ন মাত্রা ৪০মিগ্রা/ডেলি। শিশুদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন মাত্রা ধরা হয় ৪৫মিগ্রা/ডেলি। এ পরিমাণ আরো কমে গেলে হৃদরোগ সহ অন্যান্য জটিলতা দেখা দিতে পারে।
তাহলে, বুঝাই যাচ্ছে, শরীরে HDL ও LDL কোলেস্টেরলের ভূমিকা পরস্পরের বিপরীত। এক কথায়, HDL থাকা ভালো, কিন্তু LDL থাকা ক্ষতিকর।
ট্রাইগ্লিসারাইড (Triglycerides)
লিপিড প্রোফাইলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ট্রাইগ্লিসারাইড। আমরা খাবার থেকে যে শক্তি পাই, তা পুরোপুরি ব্যবহার না হলে ট্রাইগ্লিসারাইড আকারে শরীর তা জমাতে থাকে। ট্রাইগ্লিসারাইড মেদকোষে পরিণত হয়।
শরীরে কোন কারণে শক্তির ঘাটতি হলে এই মেদকোষ থেকে শক্তি উৎপন্ন হয়। চিনি, ভাত, তেল ও মিষ্টি জাতীয় খাবার বেশি খেলে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বাড়তে পারে। এটিও হৃদরোগের অন্যতম কারণ।
স্বাভাবিক মাত্রা
শরীরে ট্রাইগ্লিসাইরাইডের স্বাভাবিক মাত্রা প্রতি ডেসি লিটার রক্তে ১৫০মিলিগ্রাম বা তার কম।
সর্বোচ্চ মাত্রা
ট্রাইগ্লিসাইরাইডের সর্বোচ্চ মাত্রা ২০০মিগ্রা/ডেলি।
শরীরের সমস্ত কোলেস্টেরল (Total Cholesterol in body)
LDL, HDL, Triglycerides সহ অন্যান্য আরো যত ধরনের কোলেস্টেরল আছে, তার মোট পরিমাণই টোটাল কোলেস্টেরল। টোটাল কোলেস্টেরল এর মান থেকে শরীরে কোলেস্টেরলের আসল অবস্থা অনুমান করা যায় না।
কেননা, HDL এর পরিমাণ বেশি থাকলে তা শরীরের জন্যে উপকারী। অন্যদিকে, LDL এর পরিমাণ বেশি হলে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এই LDL বা HDL যে কোন একটির পরিমাণ বেশি থাকলেই টোটাল কোলেস্টেরলের মান বেশি আসবে।
স্বাভাবিক মাত্রা
প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে টোটাল কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক মাত্রা ২০০মিগ্রা/ডেলি। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মাত্রা ১৭০মিগ্রা/ডেলি।
সর্বোচ্চ মাত্রা
প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে টোটাল কোলেস্টেরলের সর্বোচ্চ মাত্রা ২৪০মিগ্রা/ডেলি। ২৪০মিগ্রা/ডেলি এর বেশি হলে তা শরীরের জন্য মারাত্মক হুমকি। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ভিন্ন। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে টোটাল কোলেস্টেরলের সর্বোোচ্চ মাত্রা ২০০মিগ্রা/ডেলি।
কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক ও সর্বোচ্চ মাত্রা জানা হলো। রক্ত পরীক্ষা করে সহজেই এ মানগুলো জানা যাবে। তবে, শরীরে কোলেস্টেরল কতটা ক্ষতি করবে তা জানার জন্যে লিপিড প্রোফাইলের সাথে আরো কিছু তথ্য প্রয়োজন। যেমন-
- রোগীর বয়স
- দৈহিক উচ্চতা
- ওজন
- খাদ্যাভ্যাস
- কায়িক শ্রমের মাত্রা
- ধূমপানের অভ্যাস
- পারিবারিক ইতিহাস
- গৃহীত ঔষধ ইত্যাদি।
কোলেস্টেরল এর মাত্রা কমে গেলে বা বেড়ে গেলে কি হয়?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, সারাবিশ্বে শুধুমাত্র স্ট্রোক এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কোটি কোটি মানুষ মারা যায়। এ দুটি রোগেরই অন্যতম কারণ কোলেস্টেরল।
প্রতিবছর বিশ্ব হার্ট দিবসে হৃদরোগ সংক্রান্ত বিভিন্ন গনমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা হয়। তারপরও আমরা সচেতন হতে পারিনি।
HDL আমাদের জন্যে উপকারী। তাই HDL এর মাত্রা বেড়ে গেলে কোন সমস্যা তো হয়ই না, বরং সমস্যা সমাধান হয়। অর্থাৎ, হৃদরোগসহ অন্যান্য রোগের ঝুঁকি কমে।
বাকি তিনটি ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেলে যে সমস্যাগুলো হতে পারে-
- রক্তনালী সরু হয়ে যাওয়া
- রক্তের স্বাভাবিক প্রবাহে ব্যাঘাত
- রক্তচাপের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি
- এথেরোস্ক্লেরোসিস
- মস্তিষ্কের স্ট্রোক
- পক্ষাঘাত
- হার্ট অ্যাটাক
- এনজাইনা বা বুক ব্যথা
- পাকস্থলিতে ব্যথা অনুভব
- দেহের প্রান্তীয় অঞ্চলে( যেমন, হাত, পা) অসাড়তা
- স্মৃতিশক্তি হ্রাস
- পিত্ত থলিতে পাথর
ব্যক্তি বিশেষে এ সমস্যাগুলোর তীব্রতা কম বা বেশি হতে পারে। এ সমস্যাগুলো ছাড়াও মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র ও যকৃতের সাথে সম্পর্কিত আরো অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
উপসংহার
সুস্থ ও নিরোগ শরীরের জন্যে কোলেস্টেরল মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার বিকল্প নেই। নিয়মিত শরীরচর্চা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও সঠিক জীবনাচরণ মেনে চললে সহজেই কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
নাজমুল হোসেন says
আমার লিপিড প্রফাইল এর রেজাল্ট কোলেস্টেরল ১৪৫, এইচডিএল ২৮, এলডিএল ৮৫, ট্রাইগ্লিসারাইড ১৬৯। আমার বয়স ৩২।
এই অবস্থায় আমি hdl কিভাবে বাড়াবো আর ওমেগা ৩ ক্যাপ্সুল কি খেতে পারব? মাঝে মাঝে আমার মাথা ঘুরায় খাওয়ার ১ মিনিট পর বমি বমি ভাব করে, পরে ঠিক হয়ে যায়। এখন আমার করনীয় কি?
রিংকু রায় says
আমার বয়স ৪৩ বছর। আমার লিপড প্রোফাইল রেজাল্ট মোট কোলেষ্টরেল ১৭১ ট্রাইগ্লিসারিড ১৬০ এইচ ডি এল ৪৫ এল ডি এল ৯৪ এই অবস্থায় আমার করণীয় কি?
মো: শাহজালাল says
একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখান? আর খাবারের দিকে মনোযোগ দেন?
মোহাম্মদ রাফি উদ্দিন says
ভাই, আসসালামুয়ালাইকুম। আপনার লেখা পড়ে রক্তে থাকা কোলেস্টেরল সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারলাম। স্বাস্থ্য বিষয়ে আরো লিখবেন আশা করছি।