আপনার সন্তান পড়াশুনা করতে চায় না। এ জন্যে আপনি হয়তো তার উপর খুব বিরক্ত হয়ে আছেন। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন কেন সে পড়াশুনায় মনোযোগী নয়! কেন পড়াশুনা করতে তার ভাল লাগে না! কেন সে আপনার কথা শুনছে না! পড়াশুনা করতে চাইছে না!
যদি না ভেবে থাকেন, তবে ভাবার সময় এসেছে।
কারণ, তার বর্তমান পড়াশুনার উপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার। আর আপনিও নিশ্চয়ই চাইছেন, আপনার সন্তান হোক পড়াশুনার প্রতি আগ্রহী, মনোযোগী এবং স্কুলের নামকরা ছাত্র।
আপনার মতো সব বাবা-মা’ই তাই চায়, তাদের সন্তান যেন পড়াশুনায় ভালো ও মনোযোগী হয়। কিন্তু অধিকাংশ বাবা-মা’ই জানে না বা জানার চেষ্টা করে না যে, তাদের সন্তানরা কেন পড়াশুনা করতে চায় না।
সে-সব বাবা-মা’র জন্যেই আমার আজকের এই লেখা। আগের লেখায় আমাদের নতুন লেখক মোহাম্মদ শরীফ উদ্দিন সন্তানকে পড়াশুনায় মনোযোগী করার ১০টি কার্য্যকরী কৌশল জানিয়েছিলেন। আশা করি, আপনারা অনেকেই সেগুলো জেনেছেন। আজ জানুন বাচ্চাদের পড়াশুনায় অমনোযোগীতার কারণগুলো।
১. পড়া-লেখা বোরিং লাগে
সাধারণত ছাত্র-ছাত্রীরা পড়া-লেখা করাটাকে বোরিং মনে করে। একই পড়া বারবার পড়তে ভাল লাগে না তাদের, যদিও পরীক্ষায় পাসের জন্যে তাদেরকে সেটা পড়তে হয়। তাই, পড়া-লেখার পাশাপাশি তাদেরকে মজা করার অপশন দেয়া উচিৎ।
আপনার সন্তানের কাছে পড়া-শুনা বোরিং লাগার আরেকটা কারণ একই রকম শিডিউল। প্রতিদিন একই সময়ে ঘুম থেকে উঠা, নাস্তা খাওয়া, স্কুলে যাওয়া, হোমওয়ার্ক করা, ইত্যাদি। মাঝে মাঝে শিডিউল বা টাইমিং পাল্টে দিন। স্কুলের শিডিউল তো আর আপনি বদলাতে পারবেন না, কিন্তু বাসায় পড়ার শিডিউল তো পাল্টাতে পারবেন।
২. স্মার্টফোনের ব্যবহার ও আসক্তি
বর্তমানে বাচ্চাদের পড়াশুনায় অমনোযোগীতার প্রধান কারণ স্মার্টফোনের ব্যবহার। বাচ্চারা অতি মাত্রায় স্মার্টফোনে আসক্ত হয়ে পড়ছে যা তাদেরকে পড়া-লেখা থেকে দিন দিন দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। শুধু পড়াশুনাই নয়, এটি তাদেরকে আরো অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত করছে। জেনে নিন স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার বাচ্চাদেরকে যে ৫টি কাজ থেকে বঞ্চিত করছে আর ভাবুন এখানে আপনার ভূমিকা কী।
আমি মনে করি, বাবা-মা হিসেবে সন্তানের স্মার্টফোন আসক্তির পেছনে আপনার ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে, এখানে মায়ের কথাই বেশি বলতে হয়। কারণ, মায়েরা সন্তানের বিরক্ত করা থেকে বাঁচতে সাধারণত তাদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিয়ে থাকেন। আর এখান থেকেই সন্তানরা মোবাইলে ভিডিও দেখা কিংবা গেম খেলায় আসক্ত হয়ে পড়ে।
৩. মোবাইল গেমের মারাত্মক প্রভাব
মোবাইল গেম আরেকটা বড় আসক্তি। গেমগুলো তৈরিই করা হয় এমনভাবে যাতে বাচ্চারা সেগুলোতে ঘন্টার পর ঘন্টা মগ্ন হয়ে থাকে। এটি স্মার্টফোনে আসক্তিরই আরেকটি পথ যা আপনার সন্তানের পড়াশুনার প্রতিবন্ধক।
Save The Children এর করা এক জরিপ থেকে জানা গিয়েছে যে, প্লে-স্টোর কিংবা অ্যাপল স্টোরে যত গেম আছে তার প্রায় ৭০ ভাগই বাচ্চাদের জন্যে। আসলে অফিস কিংবা ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে বড়রা সাধারণত গেম খেলার অতোটা সময় পায় না। তাই, গেম কোম্পানীগুলো মূলত ছাত্র-ছাত্রীদের টার্গেট করে গেম তৈরি করে থাকে।
আপনি যদি একটু ভাল করে খেয়াল করে দেখেন, তবে বুঝতে পারবেন যে আপনার সন্তান দিনের অধিকাংশ সময়ই গেম খেলে কাটিয়ে দিচ্ছে। তবে, এই গেম খেলা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। আপনার সন্তানকে গেম খেলা থেকে বিরত রাখার ৪টি চমৎকার উপায় আছে, আজ থেকেই উপায়গুলো ব্যবহার করা শুরু করুন।
৪. শিক্ষাপদ্ধতির দূর্বলতা
শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে রয়েছে ভিন্ন ধরণের পছন্দ, প্রয়োজনীয়তা এবং প্ল্যানিং। আর আমাদের দেশের শিক্ষাপদ্ধতির মাঝে এগুলোর অনেক অভাব রয়েছে। আমাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বছরের পর বছর ধরে একটা গতানুগতিক শিক্ষাপদ্ধতির ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে যা তাদেরকে অনেক সময়ই পড়াশুনায় অমনোযোগী করে তোলে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা শিক্ষা বোর্ডের তৈরি করা এই বোরিং পদ্ধতির বাইরে আরেকটা সমস্যা হচ্ছে শিক্ষকদের পড়ানোর পদ্ধতি। বেশিরভাগ শিক্ষকই মজা করে পড়াতে পারেন না। এমনভাবে রোবটের মতো পড়িয়ে যান যে আমাদের সন্তানরা খুবই বোরিং ফিল করেন। স্কুল কর্তপক্ষগুলোর এদিকে বেশ নজর দেয়া উচিৎ।
৫. উপযুক্ত পরিবেশের অভাব
আমাদের অধিকাংশ বাড়িতেই পড়া-লেখার উপযুক্ত পরিবেশ নেই। সন্তানের জন্যে সুন্দর একটি রিডিং রুম থাকা আবশ্যক। কিন্তু নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে শুধু পড়ার জন্যে আলাদা রুম থাকাটা বাহুল্য বটে।
আপনি যদি সন্তানের পড়া-শুনার জন্যে আলাদা রুমের ব্যবস্থা করতে পারেন, তো অত্যন্ত ভাল হয়। কারণ, পড়া-লেখার জন্যে নিরিবিলি পরিবেশ প্রয়োজন, এটা আপনি জানেন। আর যদি আলাদা রুমের ব্যবস্থা করা সম্ভব না হয়, তবে এমন রুমে তার পড়ার টেবিল দিন যে রুমে আপনাদের যাতায়াত কম।
৬. পড়া-শুনার প্রয়োজনীতা না বোঝা
আমাদের দেশের অধিকাংশ বাচ্চারাই পড়াশুনার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানে না। বাবা-মা পড়তে বলে বলে, কিংবা অভ্যাশগত কারণে তারা পড়া-শুনা করে থাকে। যার ফলে, তাদের কাছে পড়া-শুনার গুরুত্ব কম।
আমাদের উচিৎ সন্তানকে সর্ব প্রথম পড়া-শুনার প্রয়োজনীতা ভাল করে বোঝানো। কেন তার ভালভাবে পড়া-লেখা করা উচিৎ, করলে কী কী লাভ হবে, ইত্যাদি সম্পর্কে মাঝে-মধ্যেই আলোচনা করা দরকার।
৭. মানসিক চাপ
অধিকাংশ মায়েরাই সন্তানকে মানসিক চাপ দিয়ে থাকেন। বিশেস করে, হোম ওয়ার্কের ব্যাপারে এত বেশি চাপ প্রয়োগ করেন যে, সন্তানের পড়ার স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হয়। কারণ, তার ব্রেন এত চাপ নিতে অভ্যস্ত নয়।
অতিরিক্ত মানসিক চাপ মানুষের ব্রেনের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই, মায়েদের সচেতন হওয়া উচিৎ, খেয়াল রাখা উচিৎ সন্তানের ব্রেনে যেন বেশি চাপ না পড়ে। স্বাভাবিক গতিতে সে যতটুকু পড়া শেষ করতে পারে, ততটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা দরকার। তবে, সে যাতে পড়ার সময় অমনোযোগী না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা যেতে পারে।
৮. প্রতিযোগীতায় পড়ে যাওয়া
অনেক ছাত্র-ছাত্রীই বাবা-মা’র কারণে ছোট বেলাতেই প্রতিযোগীতায় পড়ে যায় যা এক সময় পড়াশুনার প্রতি তাদের বিরক্তি তৈরি করে। সব বাবা-মা’ই চান তাদের সন্তান ক্লাসে প্রথম হোক, পরীক্ষায় প্রথম হোক, অন্যদের পিছিয়ে এগিয়ে যাক।
এই চাওয়াটা মোটেই মন্দ নয়, বাবা-মা হিসেবে সন্তানের ভাল রেজাল্ট আপনি আশা করতেই পারেন। কিন্তু তাকে প্রতিযোগীতায় ফেলে দেবেন না। কারণ, প্রতিযোগীতায় ফেল করলে, অর্থাৎ আপনার চাওয়া অনুযায়ী ক্লাসে প্লেস নিতে না পারলে কিংবা পরীক্ষায় অন্যদের পেছাতে না পারলে তার মধ্যে এক ধরণের ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স তৈরি হয় যা তাকে পড়াশুনা থেকে এক সময় বিমূখ করে তোলে।
শেষ কথা
অল্প বয়স্ক বাচ্চারা খুব সহজেই নতুন নতুন জিনিসের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে এবং দ্রুত শিখে ফেলে। তারা যা শেখে তা যদি মজার হয়, তবে তাদের মাঝে আরো বেশি কিছু শেখার শখ তৈরি হয়, মনে আগ্রহ জমে।
তবে, এই আগ্রহটিও আবেশ বা অবসাদে পরিণত হতে পারে। বিশেষ করে, যদি একাডেমিক পড়া-লেখায় আগ্রহ তৈরি করার মতো কিছু না থাকে। তাই, উপরোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি নজর দিয়ে আপনার সন্তানকে পড়া-লেখায় মনোযোগী করে তুলুন।
Leave a Reply